মৌলিকত্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিল by শফিক রহমান
ক্রমশ
মৌলিকত্ব এবং ধর্মীয় আবেদন হারাচ্ছে বাংলাদেশের ‘ইসলামিক জলসাগুলো’।
স্থানীয়ভাবে ‘ওয়াজ মাহফিল’ নামে পরিচিত এসব সমাবেশে ইসলামিক ধর্মোপদেশ দেয়া
হলেও ফিঁকে হয়ে আসছে আগের ‘ধর্মীয় চেতনা ও ভাবগাম্ভীর্য’।
জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গও আসছে না আগের মতো। সেখানে জায়গা করে
নিচ্ছে হাস্য-রস। কোন কোন ক্ষেত্রে খিস্তি-খেউড়ও। ফলে ইসলামি দাওয়াত ও
আমল-আখলাকের শিক্ষা পৌঁছানোর ঐতিহাসিক স্বীকৃত এ মাধ্যমটি ক্রমশ যেন রূপ
নিচ্ছে ‘তামাশার আসরে’। নানা অঞ্চলের নানা বয়সের বিভিন্ন ধারা ও মতাদর্শের
আলেম-ওলামার সস্তা-সরল উদাহরণ-উপমা, অঙ্গ-ভঙ্গী ও বয়ানেই ঘটছে এ অবনতি।
এর জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিজ্ঞ আলেমদের অনুপস্থিতিকে দায়ী করছেন দেশের প্রবীণদের কেউ কেউ। কেউ আবার এক্ষেত্রেও প্রযুক্তির প্রভাব বিশেষ করে সামাজিক গণমাধ্যমকে দায়ী করছেন। তাদের বক্তব্য, আগেও হয়তো আঞ্চলিক পর্যায়ে ছোট ছোট আয়োজনে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে এ ধারা চলে আসছিল কিন্তু তার প্রভাব ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফেসবুক-ইউটিউবের প্রভাবে এখন সবকিছুই আঞ্চলিক সীমানা পেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে জাতীয় পর্যায়ে, ভাইরাল হচ্ছে এবং স্থায়ী একটি প্রভাব সৃষ্টি করছে।
ইউটিউবে শুধু ‘ওয়াজ’ লিখে সার্চ দিয়েই দেখা যাবে নামের আগে-পরে বাহারী বিশেষণযুক্ত অসংখ্য আলেম-ওলামার অসংখ্য ওয়াজ। পরিচিত-অপরিচিত, বিখ্যাত-অখ্যাত নানা ইউটিউব চ্যানেলের ব্যানারে ঝুলছে তাদের ওইসব ওয়াজ ও ওয়াজের খণ্ড অংশ। সঙ্গে চটকদার ভাষার বিজ্ঞাপন দেখে ওয়াজের বয়ান না ভেবে কৌতুকের বিনোদন ভাবলেও ভুল হবে না। যেমন, ইসলামিক ওয়াজ বগুড়া নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলের বিজ্ঞাপন, ‘গোলাম রাব্বানীর হাসির ওয়াজ- একটা লাইক দিবেন ভাইয়া’। ওয়াজ বাংলা টিভি লিখেছে, ‘বউয়ের হাতে মার খেলেন-অস্থির হাসির ওয়াজ’। নিচে হুজুরের নাম হিসেবে লেখা-আমির হামজা্।
তাকওয়া মিডিয়া সেন্টার নামের ইউটিউব চ্যানেলটি বলছে, ‘হাসি কান্নায় মজার ওয়াজ’। পাশে একটু ছোট করে লেখা- ভাইরাল ওয়াজ। তাতে ক্লিক করতেই দেখা গেল- উত্তেজনায় হুজুর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, অমনি দুই হাতের উপর ভর দিয়ে লাফ দিয়ে পা তুলে বসে পরলেন সিটে। মোড় দিয়ে ঘুরে বসে চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক নিয়ে বললেন-আইজগা বেডা খেলা দেহামু। এবার মাইক্রোফোন মুখ বরাবর তুলে দেয়ার জন্য মাইক অপারেটরকে উদ্দেশ্য করে হাক দিয়ে বললেন- এই মাইকওয়ালা উডা বেডা। আবার মোড় দিয়ে ঘুরে বসে বললেন- পাগলারে চিনা রাখবি। এইডা আলাদা জিনিস…। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আপ হওয়া ওয়াজের ওই ভিডিওটি গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভিউয়ারের সংখ্যা ছিল ১২,৪৩,০৭৬ জন।
এমন ওয়াজের তালিকায় আরও আছে, ‘ফানা ফানা ওয়াজ’; ‘এমন ওয়াজ আর শুনিনি- হাসতে হাসতে প্যান্ট খুলে যায়’; ‘১০০% মজার ওয়াজ- কলিজা ঠাণ্ডা’; ‘ডিজিটাল বক্তার ডিজিটাল ওয়াজ’; ‘ডিজিটাল ওয়াজ-মাল যায়তেছে’; ‘পান ও জর্দা-চরম হাসির ওয়াজ’; ‘এই ওয়াজ শুধু অবিবাহিতদের জন্য’; ‘ইন্ডিয়ান সিরিয়াল কিরন মালা নাটকের জন্য দোয়া- একটু হাসলে দোষ কিসের?’ ইত্যাদি।
অথচ, আশি এবং নব্বইয়ের দশক জুড়ে দেশের স্বনামখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বের করা ওয়াজের ক্যাসেটগুলোর কাভারে বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে লেখা থাকত বিষয় বিবেচনায় ক্যাসেটের শিরোনাম এবং সঙ্গে যার বয়ান তার নাম ও ছবি। আর শিরোনামের শীর্ষে থাকত ‘রাসুল্লাহ (সা:) এর জীবনী’; ‘বেহেস্ত দোযখ’; ‘নবীজির ইন্তেকাল’; ‘নবীজির মেরাজ’; ‘কারবালার করুণ কাহিনী’ ইত্যাদি।
মোহাম্মদিয়া ইসলামিক মিডিয়া নামের ইউটিউব চ্যানেলের হাসির ওয়াজের বিজ্ঞাপন দেয়া হযরত মাওলানা মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদীর একটি ওয়াজের খণ্ডিত অংশে ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল হুজুরের ছবি। তিনি ‘মা’ ডাকের সৌন্দর্য এবং আল্লাহর নামের মহিমা বুঝাতে বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের আধুনিক নাম নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন। নিজের মুখকে বিকৃত করে ছন্দ মিলিয়ে বলছেন, পিংকি, রিংকি, হেলেনা, দোলেনা, এদিক-সেদিক যায়না, কখনও ঘরে থাকেনা।…জুতা দিয়া বাইড়াই। বদমাইশের স্টাইলের গুষ্ঠি কিলাই।’
অন্য হুজুরদের বয়ানের মধ্যেই আবার এসব ওয়াজের কড়া সমালোচনা পাওয়া যায়। যেমনটি পাওয়া গেল ইসলামিক ওয়াজ ইউটিউব চ্যানেলের ব্যানারে মুফতি উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদের একটি ওয়াজের খণ্ডিত অংশে। সেখানে তিনি বলছেন, ওয়াজের মঞ্চ গুরুগম্ভীর একটা বিষয়। ওয়াজ শুনে মানুষের দিলে কম্পন আসবে, মানুষের দিল নরম হবে। কোরআনের আয়াত থেকে তিনি আরও বলছেন, মুমিনের সামনে যখন আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তখন মুমিনের ঈমান বাড়তে থাকে। আর বর্তমানে আমাদের ওয়াজ শুনলে পরে মানুষের হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা শুরু হয়। একেওকি আপনারা ওয়াজ বলবেন?
তিনি বলেন, ‘যত ফান ভিডিও আছে তা ওয়াজে শুরু হয়েছে। এর নাম ওয়াজ নয়। খোদার কসম, আল্লাহর নবীর সারা জীবনে ওয়াজে বসে একটি বারও অযথা কোথাও হাসাননি। কেউ পারলে প্রমাণ করুক বিশ্বনবী ওয়াজ করছেন আর এভাবে মানুষকে হাসাইয়া হাসাইয়া পেট ব্যাথা করাইছেন। একটা প্রমাণ কেউ দেখাইতে পারবেন? তাহলে তুমি কার আদর্শ মেনে ওয়াজ করছো। বোঝা গেল এগুলা ওয়াজ নয় ধান্ধা, তামাশা। আর তামাশা বাড়ার কারণেই মানুষ ওয়াজের মধ্যে যায় মজা পেয়ে চলে আসে কিন্তু কেউ আমল করেনা।’
ওয়াজ মাহফিলের বয়ানে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ
ওয়াজ মাহফিলের বয়ানে রাজনৈতিক প্রসঙ্গের উপস্থিতি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং সত্য একটি ঘটনা। তা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যে কোন প্রসঙ্গের। বলা হতো- ওয়াজ মাহফিলকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। যিনি বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত এবং কারাবন্দি। তবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছাড়াও তার সমকালীন অন্যান্য আলেম ওলামার বয়ানেও রাজনৈতিক প্রসঙ্গের উপস্থিতি ছিল সরবে। বিশেষ করে আশির দশক জুড়ে প্রায় সবার বয়ানে থাকত আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসন ও নির্যাতনের নানা বর্ণনা। পরের দশকগুলোতেও এর ধারবাহিকতায় যুক্ত হয় ইরাকে মার্কিন হামলা, আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার ইস্যুসহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশীদের সমর্থন ও সহমর্মিতার প্রকাশ।
তবে এমন আন্তর্জাতিক একটি ইস্যুকে ওয়াজ মাহফিলের ময়দানে মজা করে তুলে ধরতেন মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সীমান্ত বুলবুল। সাতক্ষীরা বা যশোরের সীমান্ত এলাকায় বাড়ি বলেই নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল ‘সীমান্ত বুলবুল’। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিরাজুল ইসলাম সীমান্ত বুলবুলের বয়স আশির কোঠায়। তখনও মাঝ রাতে দুই থেকে তিন ঘন্টা ধরে বয়ান করতেন পুরো সময়টি হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে। কোরআনের তাফসির এবং হাদীসের ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব ও বীরত্বের কাহিনী তুলে ধরতেন। এক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি টেনে আনতেন ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, যুদ্ধবিরতি, ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারির তাসখন্দ চুক্তি এবং চুক্তি পরবর্তী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর প্রসঙ্গটি। তিনি বলতেন, চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর মূলে ছিল ‘পরাজয়ের গ্লানি’।
প্রসঙ্গত, চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাসখন্দে রহস্যজনকভাবে মারা যান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো আজও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর রহস্য জানা যায়নি। ২০১৫ সালে শাস্ত্রীর পরিবার নতুন করে দাবি তোলে, তার মৃত্যু সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল প্রকাশ্যে আনার।
কিন্তু বর্তমানের ওয়াজ মাহফিলে রাজনৈতিক প্রসঙ্গের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায়না। তবে গত ৩ মার্চ জাতীয় সংসদে কওমি মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীকে কটাক্ষ করে দেয়া বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য এ পালে কিছুটা হাওয়া এনে দেয়। এই সময়ের মধ্যে মাহফিলের বয়ানে অধিকাংশ আলেম ওলামার শুধু আলোচনা সমালোচনাই নয় বিষোদগারের মুখে পরেন রাশেদ খান মেনন।
এছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামি রাজনৈতিক দলসহ নানা পক্ষের সমালোচনার জের ধরে গত ৯ মার্চ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্যরা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেন- দলের সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য বিকৃত করে একটি মহল দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি কথা হচ্ছিল প্রযোজনা সংস্থা বাঁশরির কর্ণধার মো. রিপনের সঙ্গে। তিনি বাঁশরির ব্যানারে দীর্ঘ দিন বাংলা লোকজ গান বিশেষ করে বাউল, জারি-সারি ও পালাগানের ক্যাসেট, সিডি ও ভিডি প্রকাশ করতেন। সঙ্গে প্রকাশ করতেন ওয়াজের ক্যাসেট ও সিডি। তিনি জানান, ওয়াজের ক্যাসেট, সিডি-ভিসিডির চাহিদার শীর্ষে ছিল জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ। তার পরেই ছিল যুক্তিবাদী মীর হাবিবুর রহমান ও চরমোনাইর মরহুম পীর সৈয়দ মাওলানা মো. ফজলুল করিমের ওয়াজ। পরে এদের সঙ্গে আরও যুক্ত হন মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন, মাওলানা সাইফুল ইসলাম যুক্তিবাদী এবং তারিক মনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন। মো. রিপন বলেন, ‘বর্তমানে এ লাইনে নতুন নতুন অনেক মাওলানা এসেছেন। আমরা এখন আর কারো ওয়াজের সিডি-ভিসিডি করছিনা। পুরনো প্রযোজনাগুলো বাঁশরী ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে দিয়েছি।’
এর আগে ২০১০ সালে প্রযোজনা সংস্থা সাউন্ডটেক’র ব্যবস্থাপক আতিউর রহমান এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, ওই সময়ে হঠাৎ করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের সিডি-ভিসিডির চাহিদা কমে যায়। কারণ হিসেবে যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার গ্রেফতারের ঘটনাকেই উল্লেখ করেছিলেন আতিউর রহমান। যদিও বর্তমানে ইউটিউবে তার অসংখ্য ওয়াজ দেখা যাচ্ছে। যার ভিউয়ারের সংখ্যাও অনেক।
বর্তমানে যাদের ওয়াজ ইউটিউবে বেশি দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা হাফীজুর রহমান, মুফতি আমির হামজা, আল্লামা মামুন হক, মুফতি রিজওয়ান রফিকী, মাওলানা আবদুল্লাহ আল আমীন (যাকে দ্বিতীয় সাঈদী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে), মো. রেজাউল করিম সীমান্ত বুলবুল, মাওলানা মোশতাক ফয়েজী, মাওলানা আবদুল খালেক শরীয়তপুরী, মাওলানা নাসির উদ্দিন গোপালগঞ্জ, রফিক উল্লাহ আফসারি প্রমূখ। এদের মধ্যে দুই একজন ছাড়া বাকি সবাই ইউটিউব জগতে ‘হাসির হুজুর’ হিসেবে পরিচিত।
নতুন অনুসঙ্গ শিশু বক্তা
ওয়াজ মাহফিলের বিরাজমান এ বিশৃঙ্খলার মধ্যে নতুন অনুসঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ‘শিশু বক্তা’ ও ‘কিশোর বক্তা’। এদের তালিকায় রয়েছেন আবু মুসা বিপ্লবী। তার পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আবদুর রহিম বিপ্লবী হুজুরের ছাত্র। আরেকজন হলেন হাফেজ ক্বারী রফিকুল ইসলাম নেত্রকোনা (বাংলাদেশে হুজুরদের নামের শেষে নিজ জেলার নাম যুক্ত করার প্রবণতা দীর্ঘ দীনের। এক্ষেত্রেও শিশু বক্তা রফিকুল ইসলামের নামের শেষে ‘নেত্রকোনা’ জেলার নামটিকে ব্যবহার করা হয়েছে)। একই ধারায় রয়েছেন ক্বারী মাওলানা মো. নূরুল ইসলাম বিক্রমপুরী (বিক্রমপুর জেলা থেকে বিক্রমপুরী)। আরও রয়েছেন মুহাম্মদ নাঈম উদ্দিন আজিজি। যাকে জুনিয়র তাহেরী নামেও পরিচিত করা হয়। এছাড়া রয়েছেন কিশোর বক্তা ক্বারী মুহাম্মদ শামীম রেজা কাদেরী।
ইউটিউব চ্যানেলে এসব শিশু ও কিশোর বক্তাদের ওয়াজে লাইক-শেয়ার অনেক হলেও সমালোচনা আছে আলেম ওলামাসহ দর্শক শ্রোতাদের মাঝে। যেমন, ক্বারী মাওলানা মো. নূরুল ইসলাম বিক্রমপুরীর একটি ওয়াজের মন্তব্যের ঘরে শুরুতেই একজন লিখেছেন, ‘এই শিশুর কন্ঠটা পুঁজি করে যারা ব্যবসা করছে তাদেরকে আল্লাহ হেদায়েত দান করুক আমিন…।’
রেজাউল করিম নামে একজন লিখেছেন, ‘ইসলাম ধর্ম প্রচার কি এত সহজ? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাহলে নবীদেরকে কেন ৪০ বছর বা পূর্ণাঙ্গ বয়সে নবুয়ত দান করলেন? আবেগি বাঙালী…শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।’
মাসুদ আজাদ নামের একজন লিখেছেন, ‘এই বাচ্চাকে আল্লাহ মাফ করুক। ৯ বছর বয়সে একজন কিভাবে মাওলানা হয়। ১৪ বছর লাগে শুধু পড়া লেখাতেই..।’
আর মিজান হাওলাদার নামে একজন লিখেছেন, ‘হায়রে বাঙালী মুসলিম বুঝলিনা, এই চেয়ারটার দাম দিতে পারলি না।’
একই বক্তব্য মুফতি উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদের। তিনি বলেন, বিশ্ব নবী বলেছেন অযোগ্য লোকের হাতে যখন দায়িত্ব অর্পণ হয় তখন কেয়ামতের অপেক্ষা কর। আমি বলব, বাংলাদেশের শিশু বক্তা, ২৬ ইঞ্চি বক্তা, অন্ধ বক্তা, আম্মা হুজুর, মহিলা বক্তা এই সবগুলো হলো অযোগ্য ওয়াজ করার জন্য। আর আমরা অযোগ্য লোককে দাওয়াত করে ওয়াইজি বানিয়ে দিচ্ছি। এর মানে কেয়ামতের আলামত নিজেরাই সংঘটিত করছি।
একই ভাবে এটাকে ‘কেয়ামতের আলামত’ উল্লেখ করে এগুলো থামানোর আর্জি মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর। তিনি বলেন, তাফসির মাহফিলের মধ্যেও শো-অফ। খালি লোক দেখানোর মানসিকতা। এগুলো বন্ধ করেন। এগুলোর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নাই।
তিনি আরও বলেন, ওয়াজ মাহফিল দীনের দাওয়াতের একটা প্লাটফর্ম। এখানে লৌকিকতা যেন না হয়। আমাদের দরকার এখলাস। এখলাসের বড়ই অভাব। মাহফিলে গেলে আমাদের বলা হয়- হুজুর আপনাকে কিন্তু কাপাইতে হবে। আবার বলে- হুজুর আপনাকে কিন্তু জমাইয়া দিয়া যাইতে হবে। এগুলোর সঙ্গে হেদায়েতের কোন সম্পর্ক আছে? এই জন্যইতো সমাজে হেদায়েত নাই। মাহফিলের পর মাহফিল হয় কিন্তু ফজরের নামাজটা ঠিকমতো হয়না। আসুন আমরা এখন একটু থামি। অনেক হয়েছে।
ওয়াজ মাহফিল যত ধারা ও উপধারা
উপমহাদেশে প্রথম ওয়াজ মাহফিলের সূচনা ঘটে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (রঃ) হাত ধরে। চরমোনাইর পীর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব এবং বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী জানান, মুঘল শাসনামলের অবসান এবং ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা পর্বে সমাজে সৃষ্ট নৈরাজ্য, অপসংস্কৃতি ও ইসলামের বিকৃতি দূর করতে কুরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ানের এ ধারা শুরু করেন শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী। পরবর্তীতে যা ভারত-পাকিস্তানসহ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এখানে ওয়াজ মাহফিল বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় বিশেষভাবে পাঁচ ধারায় বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন, কওমি বা দেওবন্দি ধারা, আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধারা, ওরস ও মাজারকেন্দ্রিক ধারা, জামায়াত বা মওদুদীবাদের ধারা এবং আহলে হাদিস বা সালাফী মতবাদের অনুসারীদের ধারা। শেষের এই ধারাটি কোনো মাজহাব মানে না বলে তাদেরকে ‘লা মাজহাবী’ও বলা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামের আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত সাময়িকী আত-তাওহীদের সম্পাদক মাওলানা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ওয়াজের ময়দানে বাতিলের ফিতনাসহ নানা মতবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। নামেও পরিবর্তন এসেছে। কেউ বলছেন, ইসলামি সম্মেলন, কেউ বলছেন ‘শানে রেসালত সম্মেলন’; ‘শানে মোস্তফা’ ইত্যাদি। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে ‘এশায়াত সম্মেলনের’।
আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী বলেন, মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ব্রিটিশরা নানা বাতিল মতবাদ সৃষ্টি করেছিল। সমাজে আজও তারা আছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
ওয়াজ মাহফিলে হাসি-তামাশার প্রসঙ্গে নূরুল হুদা ফয়েজী বলেন, ‘এরা কন্ট্রোলের বাইরে।’
এর জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিজ্ঞ আলেমদের অনুপস্থিতিকে দায়ী করছেন দেশের প্রবীণদের কেউ কেউ। কেউ আবার এক্ষেত্রেও প্রযুক্তির প্রভাব বিশেষ করে সামাজিক গণমাধ্যমকে দায়ী করছেন। তাদের বক্তব্য, আগেও হয়তো আঞ্চলিক পর্যায়ে ছোট ছোট আয়োজনে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে এ ধারা চলে আসছিল কিন্তু তার প্রভাব ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু ফেসবুক-ইউটিউবের প্রভাবে এখন সবকিছুই আঞ্চলিক সীমানা পেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে জাতীয় পর্যায়ে, ভাইরাল হচ্ছে এবং স্থায়ী একটি প্রভাব সৃষ্টি করছে।
ইউটিউবে শুধু ‘ওয়াজ’ লিখে সার্চ দিয়েই দেখা যাবে নামের আগে-পরে বাহারী বিশেষণযুক্ত অসংখ্য আলেম-ওলামার অসংখ্য ওয়াজ। পরিচিত-অপরিচিত, বিখ্যাত-অখ্যাত নানা ইউটিউব চ্যানেলের ব্যানারে ঝুলছে তাদের ওইসব ওয়াজ ও ওয়াজের খণ্ড অংশ। সঙ্গে চটকদার ভাষার বিজ্ঞাপন দেখে ওয়াজের বয়ান না ভেবে কৌতুকের বিনোদন ভাবলেও ভুল হবে না। যেমন, ইসলামিক ওয়াজ বগুড়া নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলের বিজ্ঞাপন, ‘গোলাম রাব্বানীর হাসির ওয়াজ- একটা লাইক দিবেন ভাইয়া’। ওয়াজ বাংলা টিভি লিখেছে, ‘বউয়ের হাতে মার খেলেন-অস্থির হাসির ওয়াজ’। নিচে হুজুরের নাম হিসেবে লেখা-আমির হামজা্।
তাকওয়া মিডিয়া সেন্টার নামের ইউটিউব চ্যানেলটি বলছে, ‘হাসি কান্নায় মজার ওয়াজ’। পাশে একটু ছোট করে লেখা- ভাইরাল ওয়াজ। তাতে ক্লিক করতেই দেখা গেল- উত্তেজনায় হুজুর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, অমনি দুই হাতের উপর ভর দিয়ে লাফ দিয়ে পা তুলে বসে পরলেন সিটে। মোড় দিয়ে ঘুরে বসে চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক নিয়ে বললেন-আইজগা বেডা খেলা দেহামু। এবার মাইক্রোফোন মুখ বরাবর তুলে দেয়ার জন্য মাইক অপারেটরকে উদ্দেশ্য করে হাক দিয়ে বললেন- এই মাইকওয়ালা উডা বেডা। আবার মোড় দিয়ে ঘুরে বসে বললেন- পাগলারে চিনা রাখবি। এইডা আলাদা জিনিস…। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আপ হওয়া ওয়াজের ওই ভিডিওটি গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভিউয়ারের সংখ্যা ছিল ১২,৪৩,০৭৬ জন।
এমন ওয়াজের তালিকায় আরও আছে, ‘ফানা ফানা ওয়াজ’; ‘এমন ওয়াজ আর শুনিনি- হাসতে হাসতে প্যান্ট খুলে যায়’; ‘১০০% মজার ওয়াজ- কলিজা ঠাণ্ডা’; ‘ডিজিটাল বক্তার ডিজিটাল ওয়াজ’; ‘ডিজিটাল ওয়াজ-মাল যায়তেছে’; ‘পান ও জর্দা-চরম হাসির ওয়াজ’; ‘এই ওয়াজ শুধু অবিবাহিতদের জন্য’; ‘ইন্ডিয়ান সিরিয়াল কিরন মালা নাটকের জন্য দোয়া- একটু হাসলে দোষ কিসের?’ ইত্যাদি।
অথচ, আশি এবং নব্বইয়ের দশক জুড়ে দেশের স্বনামখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বের করা ওয়াজের ক্যাসেটগুলোর কাভারে বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে লেখা থাকত বিষয় বিবেচনায় ক্যাসেটের শিরোনাম এবং সঙ্গে যার বয়ান তার নাম ও ছবি। আর শিরোনামের শীর্ষে থাকত ‘রাসুল্লাহ (সা:) এর জীবনী’; ‘বেহেস্ত দোযখ’; ‘নবীজির ইন্তেকাল’; ‘নবীজির মেরাজ’; ‘কারবালার করুণ কাহিনী’ ইত্যাদি।
মোহাম্মদিয়া ইসলামিক মিডিয়া নামের ইউটিউব চ্যানেলের হাসির ওয়াজের বিজ্ঞাপন দেয়া হযরত মাওলানা মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদীর একটি ওয়াজের খণ্ডিত অংশে ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল হুজুরের ছবি। তিনি ‘মা’ ডাকের সৌন্দর্য এবং আল্লাহর নামের মহিমা বুঝাতে বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েদের আধুনিক নাম নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন। নিজের মুখকে বিকৃত করে ছন্দ মিলিয়ে বলছেন, পিংকি, রিংকি, হেলেনা, দোলেনা, এদিক-সেদিক যায়না, কখনও ঘরে থাকেনা।…জুতা দিয়া বাইড়াই। বদমাইশের স্টাইলের গুষ্ঠি কিলাই।’
অন্য হুজুরদের বয়ানের মধ্যেই আবার এসব ওয়াজের কড়া সমালোচনা পাওয়া যায়। যেমনটি পাওয়া গেল ইসলামিক ওয়াজ ইউটিউব চ্যানেলের ব্যানারে মুফতি উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদের একটি ওয়াজের খণ্ডিত অংশে। সেখানে তিনি বলছেন, ওয়াজের মঞ্চ গুরুগম্ভীর একটা বিষয়। ওয়াজ শুনে মানুষের দিলে কম্পন আসবে, মানুষের দিল নরম হবে। কোরআনের আয়াত থেকে তিনি আরও বলছেন, মুমিনের সামনে যখন আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তখন মুমিনের ঈমান বাড়তে থাকে। আর বর্তমানে আমাদের ওয়াজ শুনলে পরে মানুষের হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা শুরু হয়। একেওকি আপনারা ওয়াজ বলবেন?
তিনি বলেন, ‘যত ফান ভিডিও আছে তা ওয়াজে শুরু হয়েছে। এর নাম ওয়াজ নয়। খোদার কসম, আল্লাহর নবীর সারা জীবনে ওয়াজে বসে একটি বারও অযথা কোথাও হাসাননি। কেউ পারলে প্রমাণ করুক বিশ্বনবী ওয়াজ করছেন আর এভাবে মানুষকে হাসাইয়া হাসাইয়া পেট ব্যাথা করাইছেন। একটা প্রমাণ কেউ দেখাইতে পারবেন? তাহলে তুমি কার আদর্শ মেনে ওয়াজ করছো। বোঝা গেল এগুলা ওয়াজ নয় ধান্ধা, তামাশা। আর তামাশা বাড়ার কারণেই মানুষ ওয়াজের মধ্যে যায় মজা পেয়ে চলে আসে কিন্তু কেউ আমল করেনা।’
ওয়াজ মাহফিলের বয়ানে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ
ওয়াজ মাহফিলের বয়ানে রাজনৈতিক প্রসঙ্গের উপস্থিতি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত এবং সত্য একটি ঘটনা। তা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যে কোন প্রসঙ্গের। বলা হতো- ওয়াজ মাহফিলকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। যিনি বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত এবং কারাবন্দি। তবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছাড়াও তার সমকালীন অন্যান্য আলেম ওলামার বয়ানেও রাজনৈতিক প্রসঙ্গের উপস্থিতি ছিল সরবে। বিশেষ করে আশির দশক জুড়ে প্রায় সবার বয়ানে থাকত আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসন ও নির্যাতনের নানা বর্ণনা। পরের দশকগুলোতেও এর ধারবাহিকতায় যুক্ত হয় ইরাকে মার্কিন হামলা, আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার ইস্যুসহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশীদের সমর্থন ও সহমর্মিতার প্রকাশ।
তবে এমন আন্তর্জাতিক একটি ইস্যুকে ওয়াজ মাহফিলের ময়দানে মজা করে তুলে ধরতেন মাওলানা সিরাজুল ইসলাম সীমান্ত বুলবুল। সাতক্ষীরা বা যশোরের সীমান্ত এলাকায় বাড়ি বলেই নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল ‘সীমান্ত বুলবুল’। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিরাজুল ইসলাম সীমান্ত বুলবুলের বয়স আশির কোঠায়। তখনও মাঝ রাতে দুই থেকে তিন ঘন্টা ধরে বয়ান করতেন পুরো সময়টি হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে। কোরআনের তাফসির এবং হাদীসের ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব ও বীরত্বের কাহিনী তুলে ধরতেন। এক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি টেনে আনতেন ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, যুদ্ধবিরতি, ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারির তাসখন্দ চুক্তি এবং চুক্তি পরবর্তী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর প্রসঙ্গটি। তিনি বলতেন, চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর মূলে ছিল ‘পরাজয়ের গ্লানি’।
প্রসঙ্গত, চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাসখন্দে রহস্যজনকভাবে মারা যান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো আজও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর রহস্য জানা যায়নি। ২০১৫ সালে শাস্ত্রীর পরিবার নতুন করে দাবি তোলে, তার মৃত্যু সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল প্রকাশ্যে আনার।
কিন্তু বর্তমানের ওয়াজ মাহফিলে রাজনৈতিক প্রসঙ্গের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায়না। তবে গত ৩ মার্চ জাতীয় সংসদে কওমি মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীকে কটাক্ষ করে দেয়া বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য এ পালে কিছুটা হাওয়া এনে দেয়। এই সময়ের মধ্যে মাহফিলের বয়ানে অধিকাংশ আলেম ওলামার শুধু আলোচনা সমালোচনাই নয় বিষোদগারের মুখে পরেন রাশেদ খান মেনন।
এছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামি রাজনৈতিক দলসহ নানা পক্ষের সমালোচনার জের ধরে গত ৯ মার্চ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্যরা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেন- দলের সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য বিকৃত করে একটি মহল দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি কথা হচ্ছিল প্রযোজনা সংস্থা বাঁশরির কর্ণধার মো. রিপনের সঙ্গে। তিনি বাঁশরির ব্যানারে দীর্ঘ দিন বাংলা লোকজ গান বিশেষ করে বাউল, জারি-সারি ও পালাগানের ক্যাসেট, সিডি ও ভিডি প্রকাশ করতেন। সঙ্গে প্রকাশ করতেন ওয়াজের ক্যাসেট ও সিডি। তিনি জানান, ওয়াজের ক্যাসেট, সিডি-ভিসিডির চাহিদার শীর্ষে ছিল জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজ। তার পরেই ছিল যুক্তিবাদী মীর হাবিবুর রহমান ও চরমোনাইর মরহুম পীর সৈয়দ মাওলানা মো. ফজলুল করিমের ওয়াজ। পরে এদের সঙ্গে আরও যুক্ত হন মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন, মাওলানা সাইফুল ইসলাম যুক্তিবাদী এবং তারিক মনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন। মো. রিপন বলেন, ‘বর্তমানে এ লাইনে নতুন নতুন অনেক মাওলানা এসেছেন। আমরা এখন আর কারো ওয়াজের সিডি-ভিসিডি করছিনা। পুরনো প্রযোজনাগুলো বাঁশরী ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে দিয়েছি।’
এর আগে ২০১০ সালে প্রযোজনা সংস্থা সাউন্ডটেক’র ব্যবস্থাপক আতিউর রহমান এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, ওই সময়ে হঠাৎ করে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের সিডি-ভিসিডির চাহিদা কমে যায়। কারণ হিসেবে যুদ্ধাপরাধ মামলায় তার গ্রেফতারের ঘটনাকেই উল্লেখ করেছিলেন আতিউর রহমান। যদিও বর্তমানে ইউটিউবে তার অসংখ্য ওয়াজ দেখা যাচ্ছে। যার ভিউয়ারের সংখ্যাও অনেক।
বর্তমানে যাদের ওয়াজ ইউটিউবে বেশি দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা হাফীজুর রহমান, মুফতি আমির হামজা, আল্লামা মামুন হক, মুফতি রিজওয়ান রফিকী, মাওলানা আবদুল্লাহ আল আমীন (যাকে দ্বিতীয় সাঈদী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে), মো. রেজাউল করিম সীমান্ত বুলবুল, মাওলানা মোশতাক ফয়েজী, মাওলানা আবদুল খালেক শরীয়তপুরী, মাওলানা নাসির উদ্দিন গোপালগঞ্জ, রফিক উল্লাহ আফসারি প্রমূখ। এদের মধ্যে দুই একজন ছাড়া বাকি সবাই ইউটিউব জগতে ‘হাসির হুজুর’ হিসেবে পরিচিত।
নতুন অনুসঙ্গ শিশু বক্তা
ওয়াজ মাহফিলের বিরাজমান এ বিশৃঙ্খলার মধ্যে নতুন অনুসঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ‘শিশু বক্তা’ ও ‘কিশোর বক্তা’। এদের তালিকায় রয়েছেন আবু মুসা বিপ্লবী। তার পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আবদুর রহিম বিপ্লবী হুজুরের ছাত্র। আরেকজন হলেন হাফেজ ক্বারী রফিকুল ইসলাম নেত্রকোনা (বাংলাদেশে হুজুরদের নামের শেষে নিজ জেলার নাম যুক্ত করার প্রবণতা দীর্ঘ দীনের। এক্ষেত্রেও শিশু বক্তা রফিকুল ইসলামের নামের শেষে ‘নেত্রকোনা’ জেলার নামটিকে ব্যবহার করা হয়েছে)। একই ধারায় রয়েছেন ক্বারী মাওলানা মো. নূরুল ইসলাম বিক্রমপুরী (বিক্রমপুর জেলা থেকে বিক্রমপুরী)। আরও রয়েছেন মুহাম্মদ নাঈম উদ্দিন আজিজি। যাকে জুনিয়র তাহেরী নামেও পরিচিত করা হয়। এছাড়া রয়েছেন কিশোর বক্তা ক্বারী মুহাম্মদ শামীম রেজা কাদেরী।
ইউটিউব চ্যানেলে এসব শিশু ও কিশোর বক্তাদের ওয়াজে লাইক-শেয়ার অনেক হলেও সমালোচনা আছে আলেম ওলামাসহ দর্শক শ্রোতাদের মাঝে। যেমন, ক্বারী মাওলানা মো. নূরুল ইসলাম বিক্রমপুরীর একটি ওয়াজের মন্তব্যের ঘরে শুরুতেই একজন লিখেছেন, ‘এই শিশুর কন্ঠটা পুঁজি করে যারা ব্যবসা করছে তাদেরকে আল্লাহ হেদায়েত দান করুক আমিন…।’
রেজাউল করিম নামে একজন লিখেছেন, ‘ইসলাম ধর্ম প্রচার কি এত সহজ? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাহলে নবীদেরকে কেন ৪০ বছর বা পূর্ণাঙ্গ বয়সে নবুয়ত দান করলেন? আবেগি বাঙালী…শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।’
মাসুদ আজাদ নামের একজন লিখেছেন, ‘এই বাচ্চাকে আল্লাহ মাফ করুক। ৯ বছর বয়সে একজন কিভাবে মাওলানা হয়। ১৪ বছর লাগে শুধু পড়া লেখাতেই..।’
আর মিজান হাওলাদার নামে একজন লিখেছেন, ‘হায়রে বাঙালী মুসলিম বুঝলিনা, এই চেয়ারটার দাম দিতে পারলি না।’
একই বক্তব্য মুফতি উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদের। তিনি বলেন, বিশ্ব নবী বলেছেন অযোগ্য লোকের হাতে যখন দায়িত্ব অর্পণ হয় তখন কেয়ামতের অপেক্ষা কর। আমি বলব, বাংলাদেশের শিশু বক্তা, ২৬ ইঞ্চি বক্তা, অন্ধ বক্তা, আম্মা হুজুর, মহিলা বক্তা এই সবগুলো হলো অযোগ্য ওয়াজ করার জন্য। আর আমরা অযোগ্য লোককে দাওয়াত করে ওয়াইজি বানিয়ে দিচ্ছি। এর মানে কেয়ামতের আলামত নিজেরাই সংঘটিত করছি।
একই ভাবে এটাকে ‘কেয়ামতের আলামত’ উল্লেখ করে এগুলো থামানোর আর্জি মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর। তিনি বলেন, তাফসির মাহফিলের মধ্যেও শো-অফ। খালি লোক দেখানোর মানসিকতা। এগুলো বন্ধ করেন। এগুলোর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নাই।
তিনি আরও বলেন, ওয়াজ মাহফিল দীনের দাওয়াতের একটা প্লাটফর্ম। এখানে লৌকিকতা যেন না হয়। আমাদের দরকার এখলাস। এখলাসের বড়ই অভাব। মাহফিলে গেলে আমাদের বলা হয়- হুজুর আপনাকে কিন্তু কাপাইতে হবে। আবার বলে- হুজুর আপনাকে কিন্তু জমাইয়া দিয়া যাইতে হবে। এগুলোর সঙ্গে হেদায়েতের কোন সম্পর্ক আছে? এই জন্যইতো সমাজে হেদায়েত নাই। মাহফিলের পর মাহফিল হয় কিন্তু ফজরের নামাজটা ঠিকমতো হয়না। আসুন আমরা এখন একটু থামি। অনেক হয়েছে।
ওয়াজ মাহফিল যত ধারা ও উপধারা
উপমহাদেশে প্রথম ওয়াজ মাহফিলের সূচনা ঘটে শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (রঃ) হাত ধরে। চরমোনাইর পীর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব এবং বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী জানান, মুঘল শাসনামলের অবসান এবং ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা পর্বে সমাজে সৃষ্ট নৈরাজ্য, অপসংস্কৃতি ও ইসলামের বিকৃতি দূর করতে কুরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ানের এ ধারা শুরু করেন শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী। পরবর্তীতে যা ভারত-পাকিস্তানসহ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এখানে ওয়াজ মাহফিল বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় বিশেষভাবে পাঁচ ধারায় বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন, কওমি বা দেওবন্দি ধারা, আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধারা, ওরস ও মাজারকেন্দ্রিক ধারা, জামায়াত বা মওদুদীবাদের ধারা এবং আহলে হাদিস বা সালাফী মতবাদের অনুসারীদের ধারা। শেষের এই ধারাটি কোনো মাজহাব মানে না বলে তাদেরকে ‘লা মাজহাবী’ও বলা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামের আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত সাময়িকী আত-তাওহীদের সম্পাদক মাওলানা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ওয়াজের ময়দানে বাতিলের ফিতনাসহ নানা মতবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। নামেও পরিবর্তন এসেছে। কেউ বলছেন, ইসলামি সম্মেলন, কেউ বলছেন ‘শানে রেসালত সম্মেলন’; ‘শানে মোস্তফা’ ইত্যাদি। ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে ‘এশায়াত সম্মেলনের’।
আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী বলেন, মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ব্রিটিশরা নানা বাতিল মতবাদ সৃষ্টি করেছিল। সমাজে আজও তারা আছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
ওয়াজ মাহফিলে হাসি-তামাশার প্রসঙ্গে নূরুল হুদা ফয়েজী বলেন, ‘এরা কন্ট্রোলের বাইরে।’
No comments