সিসি’র নিঃশর্ত নিয়ন্ত্রণে মিশর by রিফাত আহমাদ
আব্দেল
ফাত্তাহ সিসি’র জয় আগে থেকেই নিশ্চিত ছিল। তাই স্থানীয় সময় সোমবার
প্রকাশিত নির্বাচনী ফলাফল কারো জন্যই খুব একটা বিস্ময়কর ছিল না। মিশরের এই
বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয়
দফায় মিশরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচনে মোট ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৫ শতাংশ।
২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়ে ভোটার উপস্থিতি কমেছে ৬.৫ শতাংশ। সিসি’র জয়
অবধারিত থাকলেও এই নির্বাচন পরিচিতি পেয়েছে ‘ওয়ান ম্যান শো’ হিসেবে। সেদিক
দিয়ে বিবেচনা করলে মিশরের সামপ্রতিক এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিকে
প্রতিযোগিতামূলক বলাটা অতিমাত্রায় অতিরঞ্জন হয়ে যাবে। নির্বাচনে প্রার্থী
ছিলেন মোটে দু’জন: ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি ও অপরজন
হচ্ছেন তারই এক সমর্থক মুসা মোস্তফা মুসা। মুসা প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন
একেবারে শেষ মুহূর্তে। আবেদন করার সময়সীমা শেষ হওয়ার মাত্র ঘণ্টা কয়েক
আগে। শুধু প্রার্থী বিবেচনা ছাড়াও, নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশে
সমপন্ন হয়েছে এমনটা বলাও সঠিক হবে না। নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই বদ্ধ
পরিবেশের অভিযোগ এনে প্রতিযোগিতা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন বেশ কয়েকজন
প্রার্থী। এদের মধ্যে দু’জন কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দিও হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে
অভিযোগ ওঠেছে, সরকার ভোটারদের সক্রিয় করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
বিরোধীদলীয় কেউ কেউ এই রাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টাকে অন্যায্য বলে দাবি করেছেন।
বস্তুত, অকেজো ব্যালটের সংখ্যা, সিসি’র প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষে পড়া
ব্যালটের চেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল। অনেক ভোটারই ব্যালট পেপারে সিসি ও মুসা’র
নাম কেটে জনপ্রিয় ফুটবল তারকা মোহাম্মদ সালাহ’র নাম লিখে দিয়েছে। দ্য
ইকোনমিস্ট অনুসারে এমন ব্যালট পেপারের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। মুসা এর
চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন। এই বিষয়টিকে মিশরের গণতান্ত্রিক ধারায় পরিবর্তন
হিসেবে না দেখে বরং ভবিষ্যতে কি ঘটতে চলেছে সেদিকে নজর রাখা দরকার। সিসি’র
এই জয়কে তার আগের জয়ের বিদায় হিসেবে দেখাটাই সবচেয়ে কার্যকরী। কেননা,
ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি বেশিরভাগ রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠানেরই জোরালো
সমর্থন রয়েছে। এজন্য মিশরের ভেতর ও বাইরে, কোন জায়গায়ই সিসি’র জয় নিয়ে কোনো
সন্দেহ ছিল না। আর আগের বারের মতন এইবারও প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিসি’র
গুরুত্ব বাছাই করা: মিশরের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার উন্নতি। এছাড়া, নাগরিক
সমাজে আরো স্বাধীনতা এনে দেয়া ও বৃহৎ পরিসরে সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি নজর
দেয়ার মতন বিষয়ও খেয়াল রাখতে হবে। সিসি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার আরো
একটি দিক হচ্ছে, তিনি এখন থেকে গুরুত্বের সঙ্গে কে তাকে অনুসরণ করবে
সেদিকে নজর দেয়া শুরু করবেন। তিনি চাইলে কোনো উত্তরসূরি ঠিক করে রাখতে
পারেন- তবে সে ব্যক্তি কে হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অথবা,
তিনি এটাও মেনে নিতে পারেন যে, তিনি সমর্থন করেন না এমন একজন তার রেখে
যাওয়া আসন দখল করবে। তবে তেমনটা কল্পনা করা কঠিন। কেননা, মিশরের বর্তমান
প্রশাসন দেশটিতে সত্যিকারের রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার পথ সংকুচিত করে রেখেছে।
পরিস্থিতি এমন মোড়ও নিতে পারে যে, দেখা গেল, সিসি নিজেই তৃতীয় দফায়
প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নেমে গেলেন। তবে সেক্ষেত্রে, সংবিধানে পরিবর্তন
আনতে হবে। দূর করতে হবে প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদি সময়সীমা বিষয়ক আইন। আর এর
জন্য প্রয়োজন হবে গণভোটের। বর্তমান পরিস্থিতি হিসেবে, মিশরের অভিজাত
ব্যবসায়ী শ্রেণি সিসি’কে সমর্থন করে। এছাড়া, সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি
মোবারকের সমর্থকদের একটি অংশও সিসি’র পক্ষে রয়েছে। অন্যদিকে, বিরোধী দলের
অবস্থা একেবারে নাজুক। বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সক্ষমতা তাদের নেই।
মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থি, বিদ্রোহীপন্থি কর্মী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে
সিসি’র বেশ কয়েকজন বিরোধিতাকারী রয়েছেন। তবে তারা সংবিধান পরিবর্তনের কোনো
পদক্ষেপ নস্যাৎ করার মতো সক্ষমতা রাখেন না। কিন্তু তবুও, সিসি এ বিষয়ে খুব
স্বস্তিতে নেই। ভোটারদের সক্রিয় করার চেষ্টা সত্ত্বেও কম ভোটার উপস্থিতি
প্রমাণ করে যে জনগণের অনাগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিষয়টি কায়রোতে প্রভাব
ফেলবে। এমনকি আকারে বৃদ্ধি পেলে তা রাজনৈতিক সিস্টেমেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
রাজনৈতিক পরিবেশে মতদ্বৈধতা বিরাজমান। কিন্তু এটা ছড়িয়ে পড়ার জন্য রাজনৈতিক
বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমের প্রয়োজন। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে পরিণতি আরো
অদম্য হয়ে ওঠতে পারে। মিশর ছেড়ে বাইরের দিকে নজর দিলে, সিসি প্রশাসনকে
বেশকিছু পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে লেবানন,
ইথিওপিয়ায় রেনেসাঁ বাঁধ নির্মাণ ও নীল নদের পানি নিয়ে ভয়ানক সমস্যার সৃষ্টি
হতে পারে। তবে সিসি’র জন্য সৌভাগ্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ
তাকে সমর্থন করেন। আর এই সমর্থন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এখানে
বিশদভাবে বর্ণনা করার মতো না হলেও, কিছু বিষয় সিসি’র প্রতিকূলেও রয়েছে।
বিশেষ করে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সিসি’র বন্ধুত্বপূর্ণ সমপর্ক নিয়ে খুব একটা
উল্লসিত নয় ওয়াশিংটন। এছাড়া, ট্রামপ প্রশাসন এটাও চায় যে, মিশরে সিসি
সরকার বিভিন্ন এনজিও’র ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিক। কেননা, সেখানে এসব
নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশকিছু আমেরিকান এনজিও কর্মী দেশটির আদালতে দোষী
সাব্যস্ত হয়েছে। তবে এসব বাদ দিলে ট্রামপ প্রশাসন বেশ ভালোভাবেই সিসি’কে
সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর ট্রামেপর নতুন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টনও
সিসি’র সমর্থক। অন্যদিকে, ইউরোপের সঙ্গে সিসি’র সমপর্ক পাঁচমিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিশরের সমপর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে আইএস ও অভিবাসন
দমন। তবে ইউরোপীয় দেশগুলো মনে করে, মিশর এসব ইস্যুতে সঠিক অবস্থানেই আছে।
যদিও, ওইসব দেশগুলো থেকে প্রতিনিয়ত মিশরের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের
অভিযোগ এনে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আমেরিকা আর ইউরোপ
ছাড়া আমিরাত ও সৌদির সঙ্গে মিশরের সমপর্ক সব মিলিয়ে বেশ ভালোই। অন্যভাবে
বললে, সিসি’র জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন সমস্যা তেমন একটা নেই।
(দ্য আটলান্টিক ও আল জাজিরা অবলম্বনে)
(দ্য আটলান্টিক ও আল জাজিরা অবলম্বনে)
No comments