এমপি-মন্ত্রীদের সাথে দূরত্ব কমেনি তৃণমূলের
বেশির ভাগ এমপি-মন্ত্রীর সাথে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের দূরত্ব এখনো কমেনি; বরং আগের মতোই সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়েই নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন তারা। এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই তৃণমূল নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে এলাকায় নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে রেখেছেনÑ যা নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তৃণমূলকে গুরুত্ব দেয়ার পরই এমপি-মন্ত্রীরা এলাকায় যাওয়া-আসা বাড়িয়ে দিলেও গণমুখী হতে পারেননি। নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আর্থিক অনুদান-সহযোগিতা করলেও তা লোক দেখানো এবং নামকাওয়াস্তে। একাধিক উপজেলা নেতার সাথে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে। তৃণমূল নেতাদের অভিযোগÑ অনেকের এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তৃণমূলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর থেকেই এমপি-মন্ত্রীরা রাজধানীকেন্দ্রিক ব্যবসাবাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। অনেকে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের দিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। তখন থেকেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে এমপি-মন্ত্রীদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এখন এমপিদের ওঠাবসা এলাকার হাইব্রিড নেতাদের সাথে। তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের তারা গুরুত্ব দেন না। অনেকেই এলাকার জনগণ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। এর আগেরবার মুক্তি স্বতন্ত্র এমপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এর পর থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে নিজস্ব বলয় গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের এই এমপি। এলাকার সাথে যোগাযোগও তেমন নেই।
মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানের পর তড়িঘড়ি করে রাজধানীতে ফেরেন। ওই আসন থেকে এবার লড়তে চান নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, নেতাকর্মীদের সাথে এমপির কোনো সুসম্পর্ক নেই। বিএনপি-জামায়াতের সাথে হলো তার সম্পর্ক। এমপি তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে, মামলা দিয়ে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। নিজাম উদ্দিন খান নিলু বলেন, আওয়ামী লীগের প্রকৃত, ত্যাগী নেতাকর্মীরা অবহেলিত। অথচ তিনি কাউকে পরোয়া করেন না। একটা ড্যাম কেয়ার ভাব আছে। একই চিত্র দেখা যায় যশোর-৫ আসনের এমপি স্বপন ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী টিপু সুলতানের সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু স্বপন ভট্টাচার্য এক সময় জেলা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এ প্রসঙ্গে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ কাজী মাহমুদুল হাসান বলেন, এমপি সাহেব স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। এর পর থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে এমপি সাহেবের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি এলাকার কিছু সুবিধাভোগী লোকজন নিয়ে চলাফেরা করেন। এখন কোনো পর্যায়ের কোনো কমিটিতে তিনি নেই। তৃণমূল নেতাকর্মীরা তার কাছে বরাবরই উপেক্ষিত। এখান থেকে আগামী নির্বাচনে অধ্যক্ষ কাজী মাহমুদুল হাসান নৌকা মার্কার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ জন্য তিনি এলাকায় নির্বাচনী কার্যক্রমও শুরু করেছেন। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ-উখিয়ার এমপি আব্দুর রহমান বদিও তৃণমূল নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে রেখেছেন। এলাকার নেতাকর্মীদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। স্থানীয় নেতাকর্মীদের কোনো গুরুত্ব নেই তার কাছে। এমপির ইচ্ছেতেই সব কিছু হয় এলাকায়। জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, তৃণমূলের সাথে এমপির দূরত্ব রয়ে গেছে। এখানে এমপি সাহেবের সাথে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সম্পর্ক ভালো না। তিনি নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন। যাকে বলে বদি বলয়। তাদের নিয়েই এমপি সাহেবের ওঠাবসা। তিনি বলেন, দূরত্ব কমানোর চেষ্টাও এমপি সাহেবের নেই। প্রকৃতপক্ষে তৃণমূলের ত্যাগী কর্মীরা অবহেলিত। বাগেরহাট-৪ আসনের এমপি ডা: মোজাম্মেল। এমপি হওয়ার পর থেকেই এলাকার নেতাকর্মীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এলাকায় কখন যান কখন আসেন নেতাকর্মীরা বলতে পারেন না। এলাকার হাইব্রিড ও নব্য আওয়ামী লীগ নিয়ে ওঠাবসা এমপি সাহেবের। এসব কথা জানান, বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামালউদ্দিন আকন। তিনি আরো বলেন, এমপির সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি এলাকায় কখন আসেন আর কখন যান তা আমরা জানতেও পারি না। এলাকার ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোনো প্রয়োজন তার আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজন থাকলে তো আমাদের ডাকত, খোঁজখবর নিত। শেরপুর-২ আসনের এমপি হলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। তিনি এমপি হওয়ার পর থেকে এলাকায় বিভক্তির দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। একটি মতিয়া গ্রুপ আরেকটি বাদশা গ্রুপ নামে পরিচিত। মতিয়া চৌধুরী এলাকার জনগণ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাদশা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা। শেরপুর-৩ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হক। তিনিও এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সাধারণ মানুষের সাথে তেমন ওঠাবসা নেই,
যা আছে তা নিজের কিছু আত্মীয়স্বজন ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। এসব কথা জানালেন ওই এলাকার বাসিন্দা ও যুব শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো: রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে এমপি সাহেবের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। শুধু আওয়ামী লীগের তৃণমূল নয়, এলাকার জনগণ থেকেও তিনি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। রফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি, ঘুষবাণিজ্যসহ এমন কোনো কাজ নেই, যা এমপি করেননি। তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীসহ তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। আগামী নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পাবেন না তা নিশ্চিত। দলীয়ভাবে নতুন কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে বলে তৃণমূলেরও প্রত্যাশা। তৃণমূলের সাথে এমপি-মন্ত্রীদের দূরত্ব না কমা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ড. হাছান মাহমুদ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, অনেক জায়গায় এমপি বা মন্ত্রীদের সাথে নেতাকর্মীদের দূরত্ব আছে তা ঠিক। যারা আগামীতে নির্বাচন করতে চায় অথবা নির্বাচন করুক বা না করুক তাদের অবশ্যই তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। তাদের অভাব, অভিযোগ শোনা প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাদের কারণেই তারা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের কারণেই দল আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। সুতরাং যেখানে যেখানে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাদের উচিত দূরত্ব কমিয়ে আনা। তিনি বলেন, যেসব কেন্দ্রীয় নেতা, যারা বর্তমানে এমপি-মন্ত্রী আছেন তাদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে দল এসব বিষয় অবশ্যই গুরুত্ব দেবে। যেসব নেতা-মন্ত্রী তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন তারা এবার অবশ্যই মনোনয়ন পাবেন না।
No comments