চট্টগ্রামে বিপর্যস্ত আমদানি-রপ্তানি শিল্পখাত, ১৭,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি by মহিউদ্দীন জুয়েল
১৫ দিনের হরতালে ব্যবসায়ে ক্ষতি ১৭,০০০ কোটি টাকা। দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও একের পর এক হরতাল অবরোধের কারণে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য। এতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমই এর শীর্ষ নেতারা। অন্যদিকে সারা দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলেছেন এভাবে সংঘাতময় পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্য। বর্তমানে সারা দেশের সব ধরনের পোশাকশিল্প, ভোগ্যপণ্য ও আমদানি-রপ্তানির দুই তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। চিটাগাং চেম্বার এর নেতারা জানান, উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি, পণ্য ও যাত্রী পরিবহন খাতে ৬৮ কোটি, রপ্তানি খাতে ৬৯৫ কোটি টাকাসহ ১৫ দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। কেবল তাই নয়, এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের পণ্য পরিবহনে স্থবিরতা নেমে আসায় ব্যাহত হচ্ছে সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। বন্দরে বেড়েছে কন্টেইনার জট। পরিস্থিতির খানিক সমাধান হলেও সমস্যা থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে পরিবহন ভাড়ার ক্ষেত্রে। হরতালের কারণে চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে বাড়তে পারে ১০ হাজার টাকা বৃদ্ধি। স্বাভাবিক নিয়মে যা সর্বোচ্চ ১৬,০০০ টাকা। চেম্বার নেতারা আরও জানান, বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাস স্বাভাবিক থাকলেও এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে পণ্য ডেলিভারি। পুলিশ ও বিজিবি পাহারায় ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে যান চালাতে রাজি হলেও সেখানে আপত্তি রয়েছে আবার চালক-বাস মালিকদের। সরজমিনে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙর মাদারভেসেল থেকে পণ্য বোঝাই অন্তত ৩০০ লাইটার জাহাজ সদরঘাট থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত ঘাটে অলস বসে আছে। পরিবহন সঙ্কটের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে জটিলতা তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের বাইর থেকে পণ্য নিয়ে ঢুকতে না পারা বড় বড় কনটেইনার লরি নিয়েও। বেশির ভাগ কনটেইনার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে না আসায় তার প্রভাব পড়ছে পোশাকশিল্পে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বন্দর নগরী হচ্ছে দেশের অর্থনীতির অক্সিজেন। চট্টগ্রামে কোন প্রভাব পড়লে তার জের ধরে স্তিমিত হয়ে যায় দেশের অর্থনীতি। এইবারের হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা পরিস্থিতির সমাধান চাই। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। হরতাল অবরোধে শত শত কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। অচলাবস্থার মধ্যে পণ্য খালাস হয় না। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের অর্ডার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির উত্তোরণই একমাত্র সমাধান। চট্টগ্রাম চেম্বার সূত্র জানায়, পরিস্থিতি সমাধানের আহ্বান জানিয়ে গত ১৮ই জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশ করেন সংগঠনটির নেতারা। এতে তারা ৯ দফা দাবিও সরকারের কাছে পেশ করেন। চেম্বার ভবনে আয়োজিত ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার ছাড়াও ছিলেন বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। দাবিগুলোর মধ্যে অবিলম্বে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস, গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, বন্দর কাস্টমসসহ সংশিষ্ট বিভাগে মনিটরিং টাস্কফোর্স গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত কর্মদিবসে ব্যাংকঋণ মওকুফসহ একাধিক প্রস্তাবনা দেয়া হয়। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বার এর সহসভাপতি সৈয়দ জামাল আহমেদ বলেন, এই মুহূর্তে হরতালে বড় সমস্যা হচ্ছে পণ্য পরিবহনে জটিলতা। যা খুবই ঝুঁকির মধ্য দিয়ে চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে পুলিশ দেয়া হলেও মালিক, ব্যবসায়ী ও চালকদের মাঝে শঙ্কা কাজ করছে সবসময়। তাই আমি পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাইওয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছি। চট্টগ্রামের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, কেবল বন্দর নয়, হরতালের কারণে প্রতিদিন ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে তাদের। হরতালের কারণে পরিবহন ব্যবস্থা সঙ্কটে পড়ায় তাদের পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না সারা দেশে। অর্ডার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিদেশীদের কাছেও। সর্বশেষ গত ৬ মাসের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫২০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে তাদের। কিন্তু হরতালের কারণে এখন সব রপ্তানি পণ্য বেসরকারি আইসিডিতে রাখা হচ্ছে। গত ২০ দিন ধরে চলছে এমন অবস্থা। ফলে ভাড়া বাড়ছে কয়েকগুণ। এসব সমস্যা প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে অনেকখানি পিছিয়ে দিচ্ছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র পোর্ট অ্যান্ড শিপিং বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হরতালে আমাদের ক্ষতি কয়েক শ’ কোটি টাকা। এসব টাকা কিভাবে পোষাবেন ব্যবসায়ীরা তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। আমাদের অর্ডার নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না। ক্ষতি হচ্ছে সবদিকে।
No comments