অবরোধে বড় ক্ষতি কৃষকের by ইফতেখার মাহমুদ
(ছবি:-১ স্বাভাবিক দিনে এমন সময় ক্রেতা-বিক্রেতা ও পাইকারদের পদভারে মুখর থাকে বগুড়ার মহাস্থান সবজির মোকাম। অবরোধের কারণে এখন ক্রেতা ও পাইকার কম। বেচাকেনাও মন্থর l ছবি: সোয়েল রানা ছবি:-২ ভাড়া স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হওয়ায় ট্রাক ভাড়া করতে পারছেন না প্রান্তিক কৃষকেরা। তাই চলতি ট্রাকে অল্প ভাড়ায় উৎপাদিত পণ্য গন্তব্যে পাঠানোর আশায় রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে অপেক্ষায় দুই কৃষক। ছবিটি গতকাল বিকেলে মহাসড়কের মিঠাপুকুর উপজেলার বৈরীগঞ্জ থেকে তোলা l ছবি: মঈনুল ইসলাম) দেশে
সারা বছর যে সবজি হয়, তার ৪০ শতাংশ এখন মাঠেই পড়ে আছে। এখন নতুন আলু
তোলার সময়। কৃষক মাঠ থেকে তুলতেও শুরু করেছিলেন। এরই মধ্যে ২০ থেকে ৩০
শতাংশ আলু মাঠ থেকে উঠেছে। কিন্তু পেট্রলবোমা হামলার ভয়ে প্রায় ২০ লাখ টন
আলু ভোক্তার কাছে যেতে পারছে না। ফলে তা এখন হাটে-মাঠে নষ্ট হচ্ছে।
পরিবহনের অভাবে চালকলগুলো থেকেও সারা দেশে চাল সরবরাহ কমেছে প্রায় ৬০
শতাংশ। এতে বন্ধ হয়ে গেছে ৮০ শতাংশ চালকল। আমন ধান কেটে কৃষক মাঠে রবি
মৌসুমের সবজি ও আলু চাষ করেছিলেন। এরপর শুরু হয় বোরো চাষের প্রস্তুতি।
কৃষকেরা এ জন্য মাঠ প্রস্তুতি আর চারা বোনাও শুরু করেছিলেন। মাঠের ফসল
বেচে যে টাকা আসে, তা বোরোতে বিনিয়োগ করে থাকেন কৃষক। আমনে কৃষকের জন্য
অভিশাপ হয়ে এসেছিল বন্যা। সবজি বেচে সেই ক্ষতি পোষানোর চিন্তা ছিল
তাঁদের। টানা ২২ দিনের অবরোধে সেই আশাও ভেস্তে যাচ্ছে। দেশে সারা বছর
উৎপাদিত ৪০ লাখ টন সবজির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই হয় শীতকালে। আর এর ৪০ শতাংশ
কৃষক মাঠ থেকে তোলেন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে। রাজনৈতিক সংঘাতের কবলে
পড়ে মাঠ থেকে সবজি তোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন কৃষক। হাটে পানির দরে
বিক্রি হচ্ছে টমেটো, বেগুন, শিম, কপি। কোথাও কোথাও তো বিক্রিও হচ্ছে
না, মাঠে পচে নষ্ট হচ্ছে। গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার আলুর ফলন ভালো
হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের নতুন আলু সবে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু তা ভোক্তাদের
কাছে কমই পৌঁছাতে পারছে। জমির পাশে আর হাটে আলুর স্তূপ বাড়ছে। গত মাসেও
একেক মণ নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আর এখন তা ২০০ টাকায়ও
কেউ কিনছেন না। হাটে-মোকামে ওঠা নতুন আমনের বিক্রিও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ থেকে ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত
প্রতিবেদনে ‘গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট’-এ বলা হয়েছে, বছরের মাঝামাঝি সময়ে
আঘাত হানা বন্যার কারণে বাংলাদেশে আমনের উৎপাদন কমবে। আর ওই বন্যার ক্ষতি
কাটিয়ে উঠতে না উঠতে অবরোধের কবলে পড়েছেন কৃষক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা
প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেনের
মতে, চলমান রাজনৈতিক সংঘাত কৃষকের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে আনবে। আমন ধান,
সবজি আর আলু বিক্রির সবচেয়ে উপযুক্ত সময় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। মাঠের ফসল
বিক্রি করতে না পারলে কৃষক বোরোতে বিনিয়োগ করতে পারবেন না। এতে আমনের
মতো বোরোতেও উৎপাদন কমতে পারে। ফলে দেশ খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
করেছিল, তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। চাল পরিবহন ও বিক্রি দুই-ই কমে যাওয়ায়
হাটে-মোকামে ধান বিক্রিও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে দেশের
চালকলগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো-হাসকিং-মেজর মিল মালিক সমিতি।
সংগঠনটির হিসাবে দেশে প্রায় ১৭ হাজার চালকল রয়েছে। অবরোধের কারণে ৭০ শতাংশ
চালকল বন্ধ রাখা হয়েছে। সাধারণত জানুয়ারির দিকে হাটে ধানের দাম বাড়তে
থাকে। মার্চ-এপ্রিলে বোরো কাটা শুরু হলে দাম কমে আসে। এবার জানুয়ারিতেই
ধান-চালের দাম কমতে শুরু করেছে। প্রতি মণ ধান ৬৫০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি
হচ্ছে। তবে ভোক্তাপর্যায়ে চালের দাম কমেনি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক
খাদ্যশস্য পরিস্থিতি শীর্ষক প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের
(টিসিবি) হিসাবে গত এক মাসে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম এক টাকা বেড়েছে।
দেশের বিভিন্ন বাজারে চালকলগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন চাল
সরবরাহ হতো—এ কথা জানিয়ে বাংলাদেশ অটো-হাসকিং-মেজর মিল মালিক সমিতির
সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জানিয়েছেন, এখন প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার টন
চাল সরবরাহ করতে পারছেন তাঁরা। চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অবরোধের আগে
উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে একেকটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৫ থেকে ২০
হাজার টাকা। এখন প্রায় সব এলাকার ট্রাকের ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাও সব
ট্রাক পণ্য পরিবহনে রাজি হচ্ছে না। মাহবুব হোসেনের মতে, অবরোধের কারণে
ব্যবসায়ীরা তাঁদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের
দাবি তুলছেন। কিন্তু কৃষকের পক্ষে দেশে শক্তিশালী সংগঠন না থাকায় তাঁরা
ক্ষতির কথা রাষ্ট্রের কানে তুলতে পারছেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত
কৃষকের জন্য সরকার যদি ক্ষতিপূরণ দিতে পারে, তাহলে রাজনৈতিক দুর্যোগের
ক্ষতি পোষানোর জন্য কৃষককে সহায়তা দেওয়া উচিত। কেননা, ক্ষতির কারণে কৃষক
উৎপাদন কমিয়ে দিলে তার ফলাফল হিসেবে সামগ্রিকভাবে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে।
এতে দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যের দাম বেড়ে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বৈদেশিক
মুদ্রা খরচ করে বেশি দামে খাদ্য আমদানি করতে হবে।
No comments