‘যে পোড়ে সেই বোঝে কি যন্ত্রণা’ by সালমান ফরিদ
হাতের
আঙুল সামান্য পুড়ে গেলে সেই যন্ত্রণাই অসহ্য হয়ে ওঠে। আর যার সারা শরীর
পুড়ে গেছে তার কতটুকু যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে তা কেবল সেই বোঝে। অবরোধের আগুনে
পুড়ে আমাদের সেই অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এভাবে রাজনীতির বলি
বানিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছেন কেউ, আবার কেউ যেতে চাইছেন মসনদে। আমরা
রাজনীতি বুঝি না। গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ। পরিবার চলে আমাদের আয়-রোজগারে।
সেই উৎস বন্ধ হয়ে গেলে উপোস থাকতে হয় পরিবারের সদস্যদের। এ থেকে আমরা
মুক্তি চাই। আমরা আর রাজনীতির বলি হতে চাই না।’ দুই হাতের আঙুল থেকে কোনই
পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা। মুখের সামনের দিকটা পুড়ে ফুলে গেছে। ডান পাশের
কানের অবস্থা আরও বীভৎস। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিলেন সামনের দিকে। আর যেন
খুঁজছিলেন কাউকে মনের গহিনে থাকা দুঃখগুলো ভাগ করে নেবেন বলে। এ
প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে এভাবেই একটানা প্রকাশ করলেন মনের
ভেতরে থাকা যন্ত্রণাগুলোকে। তার নাম বিল্লাল হোসেন। বয়স ২৮। গুলিস্তানে
কাপড়ের দোকানে চাকরি করেন। বাড়ি ঢাকার রূপগঞ্জের ভুলতায়। ঢাকা মেডিক্যাল
কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন তিনি। গত ২৪শে জানুয়ারি
যাত্রাবাড়ীতে অবরোধের আগুনে যে ২৯ জন দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তিনি তাদের
একজন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তবুও বললেন। প্রত্যাশা একটাই, তার কথাগুলো
যেন দুই নেত্রী আর রাজনীতিবিদদের কান পর্যন্ত যায়। বিল্লাল যখন কথা বলে
থামলেন, তখন মুখে ছিল শেষ আকুতি- ‘রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের জীবনের হয়তো
মূল্য নেই, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কাছে আমরা একমাত্র অবলম্বন।
পরিবারগুলোকে আর পথে বসাবেন না। আগুনে পুড়িয়ে পঙ্গু-অকর্মণ্য বানিয়ে আর
নিঃস্ব করবেন না। আমরা করুণা চাই না। দয়া করে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা
দিন।’ শুধু বিল্লাল হোসেন নন। অবরোধ-হরতাল নামক মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের বলি
হয়ে বার্ন ইউনিটে যারাই ভর্তি হয়েছেন তারা একই অনুরোধ জানাচ্ছেন। বলছেন,
দেশটায় আর কত আগুন জ্বলবে। এবার শান্তি চাই। শান্তি না এলে প্রতিদিন এ রকম
আগুনে পোড়া মানুষের সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। অবরোধ ও হরতাল অব্যাহত থাকায়
প্রতিদিই পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে এসে
ভর্তি হচ্ছেন অসংখ্য ব্যক্তি। ওয়ার্ডে, বারান্দায় অতিরিক্ত সিটে, ফ্লোরে
বিছানায় শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। হরতাল-অবরোধে আক্রান্ত হলে তাদের
‘অবরোধ ভিকটিম’ ও ‘হরতাল ভিকটিম’ হিসেবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের চিত্র এখন ভয়াবহ। চারদিকে কষ্ট ও গোঙানির করুণ সুর। যন্ত্রণায়
কাতর নারী-পুরুষ ও শিশুদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি। রোগী, অভিভাবকের আর্তনাদ
এখন সবগুলো ওয়ার্ডে। চিকিৎসকরা অবিরাম দিয়ে চলছেন সেবা। প্রাকৃতিক
দুর্যোগে দগ্ধদের মনে এতটুকু দুঃখ নেই, যতটুকু ক্ষোভ নিয়ে বিছানায়
কাতরাচ্ছেন অবরোধ ভিকটিম হয়ে। কোন দগ্ধ রোগীর বিছানার পাশে বসে কাঁদছেন মা।
কারও বা স্ত্রী-ভাই। স্বজনের যন্ত্রণায় তাদের কাছে সান্ত্ব্তনার কোন ভাষা
নেই। শরীর বুলিয়ে দিচ্ছেন, কেউ বা হাত, মুখ কিংবা মাথা। অসহ্য যন্ত্রণার
মাঝে কাছের মানুষের এতটুকু সহানুভূতির মধ্যেই তারা শান্তি খুঁজছেন।
খাগড়াছড়ির রামগতিতে ২৪শে জানুয়ারি পেট্রলবোমায় দগ্ধ ট্রাকের হেলপার গিয়াস
উদ্দিন রাশেদের (২৬) মা সেলিমা বেগমের চোখেমুখে এখনও ভয়। রাশেদের মুখে
হাতে, পিঠে ব্যান্ডেজ। সন্তানের সঙ্গে নিজেই যেন দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের
বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তার চোখে পানি। কতক্ষণ পরপর বুকের মানিকের
মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তাকিয়ে থাকছেন চোখ বন্ধ করে থাকা রাশেদের দিকে।
‘তাদের স্বার্থের জন্য আমার সন্তানকে এমন পরিণতি কেন ভোগ করতে হবে? সহ্য হয়
না ছেলের পোড়া মুখ দেখে। কেন এমন হবে? আমরা হরতাল-অবরোধ কি- বুঝি না।
দু’বেলা দু’মুঠো ভাত পেটে দিতে পারলেই খুশি। আমাদের নিয়ে এই নিষ্ঠুর খেলা
আর খেলবেন না।’ রাশেদ বলেন, ট্রাক আন-লোড করে নোয়াখালীর দিকে ফিরছিলাম। এ
সময় রাস্তার পাশে ১২-১৩ বছরের একটি শিশুকে দেয়াশলাই জ্বালাতে দেখলাম।
কিন্তু পরেই দেখি সে আমাদের দিকে ককটেল ছুড়ে মারলো। আমি বাম পাশে থাকায়
সেটি এসে আমার গায়ে লাগে। অগ্নিদগ্ধ বিল্লাল হোসেনের ছোট ভাই সোহাগ বলেন,
আমাদের পুরো পরিবার তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এখন সেই ভাই বেকার হয়ে গেলে
আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। রাজনীতির জন্য আমাদের এ অবস্থা।
রাজনীতিবিদরা আমার ভাইয়ের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিন। না হলে আমরা না খেয়ে
মরবো। এ দেশে জন্ম নিয়ে কি এ অনিশ্চয়তা উপহার পাবো? যাত্রাবাড়ীতে
অগ্নিদগ্ধ শহিদুল ইসলাম (৪০) বলেন, আগুন লাগার পর আমি তখনই নেমে যেতে
পারতাম। তাহলে হয়তো এখন আমার শরীরের ১০ শতাংশ বার্ন থাকতো না। আমি আরও ৪-৫
জনকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে যাই। তবে সান্ত্বনা একটাই যে যদিও আমি তাদের উদ্ধার
না করতাম তাহলে চোখের সামনে হয়তো তাদের কেউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতেন।
আমার কাছে মানুষগুলোর জীবন তখন মূল্যবান ছিল। তার শ্যালক সায়মন বলেন, মানুষ
যেখানে পেট্রল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারতে চাইছে সেখানে নিজের বিপদ ডেকে এনে
অনেকের জীবন বাঁচিয়েছেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা এগুলো দেখেন না। বার্ন
ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি
দগ্ধ মানুষগুলোকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। অনেকের ক্ষেত্রে এটি
হয়তো আর হয় না। কিন্তু সুস্থ করে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দিই।
তিনি জানান, এ পর্যন্ত গত ৫ই জানুয়ারি থেকে অবরোধ ও হরতালে আক্রান্ত হয়ে
ভর্তি হয়েছেন ৮৫ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৫ জন এবং চিকিৎসা নিয়ে চলে
গেছেন ৩০ জন। ভর্তি আছেন ৫০ জন। এদের ৯ জনের অবস্থা এখনও গুরুতর। ৬ জন আছেন
সিসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে।
No comments