ঢামেকের ক্যান্সার বিভাগে ‘কমিশন’ বাণিজ্য
হাসপাতাল
থেকে ক্যান্সারের ওষুধ দেয়া হয় না। কেমো থেরাপির দামি ওষুধ তাই কিনে আনতে
হয় রোগীদেরকেই। কিন্তু রোগীদেরকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে দেন না
চিকিৎসকরা। বিশেষ করে বহির্বিভাগের রোগীদের সেই ওষুধ কিনতে হয় ৩টি
নির্দিষ্ট কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে। আগের দিন স্লিপ দেয়া হয় রোগীদের।
সেখানে চিকিৎসক নিজে নির্দিষ্ট ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং প্রমোশন
অফিসার-এমপিও’র নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর লিখে দেয়া হয়। রোগীরা তার সঙ্গে
যোগাযোগ করলে পরদিন সকালে সেই ওষুধ সরবরাহ করা হয়। তখন নেয়া হয় তার মূল্য।
এই দৃশ্যটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল-ঢামেকের ক্যান্সার বিভাগের।
বিষয়টি আপতত দৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও এর পেছনে জড়িয়ে আছে চিকিৎসকদের
স্বার্থ। শুধু বড় দাগে কমিশনের জন্য রোগীদের বাইরের কোন ফার্মেসি থেকে ওষুধ
কিনতে দেন না। কেউ কিনে আনলেও তা ফিরিয়ে দেয়া হয় নানা অজুহাতে। তাদের
বাধ্য করা হয় নির্দিষ্ট কোম্পানির লোকদের কাছ থেকে ওষুধ কিনতে। ঢামেক
হাসপাতালে থাকা রোগী ও তাদের অভিভাবকরাই জানিয়েছেন এ তথ্য। তারা জানান, যখন
কেউ কোম্পানির লোকদের কাছ থেকে না কিনে একই ওষুধ বাইরে থেকে আনেন তখন
তাদের রীতিমতো ভয় দেখানো হয়। বলা হয়, এগুলো ভাল না। ব্যবহারের পর রোগীর
ক্ষতি হলে তার দায়-দায়িত্ব চিকিৎসক নেবে না। এসব কথা বলে রোগীকে তা ফেরত
পাঠিয়ে কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি ওষুধ সংগ্রহ করতে বাধ্য করা হয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানিগুলো প্রতি মাসে এই হাসপাতাল
থেকে একটি নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থের ওষুধ বিক্রির টার্গেট করে। বিকন ও টেকনো
নামের দু’টি কোম্পানি ৪০ লাখ করে টার্গেট নির্ধারণ করে ওষুধ বিক্রি করে।
বোডস নামক অপর কোম্পানিও একটি বড় অর্থের টার্গেট নিয়ে কাজ করে। এর জন্য
তারা শতকরা ২০ ভাগ কমিশন দেয় চিকিৎকদের। এর বিনিময়ে কোম্পানিগুলোকে ঢামেকে
সুযোগ দেয়া হয়। কোম্পানির এমপিও’রা নিজেদের ওষুধ সরবরাহ করা, টার্গেট ও
কমিশনের কথা স্বীকার করলেও তার পরিমাণ বলতে অস্বীকৃতি জানান। ঢামেকে ওষুধ
কোম্পানি টেকনোর এমপিও জাহিদ বলেন, ওষুধ দামি এবং সব দোকান রাখেও না। আবার
দোকানদাররা বেশি দামে বিক্রি করেন। আমরা কম দামে সরবরাহ করতে পারে।
পাশাপাশি রোগীকে দোকানদারের কাছে যেতে হয় না। নির্দিষ্ট সময়ে ওষুধ ওয়ার্ডে
পৌঁছে দিই। তিনি জানান, এই সুবিধা দেয়ার জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের একটি
ডোনেশন দেয়া হয়। তবে ঢাকা মেডিক্যালের পাশের কয়েকটি ফার্মেসির লোকজন জানান,
কোম্পানির প্রতিনিধিরা কখনই আসল দাম দেখান না রোগীকে। ফলে রোগী জানেনই না
যে কোন দামে কিনেছেন। তারা দোকানের দামেই ওষুধ সরবরাহ করেন। তাছাড়া যেভাবে
ওষুধ সরবরাহ করা হয়, এটা নিয়মের বাইরে। সূত্র জানায়, কেমো থেরাপির জন্য
রোগীরা প্রতি ২১ দিন পরপর হসপাতালে আসেন। এজন্য তাদের ভর্তি হয়ে দু’দিন
থেকে ইনজেকশন ও অন্য ওষুধ নিতে হয়। তাদের খরচের পরিমাণ এক নয়। ৫০০০ থেকে
২০০০০ টাকার ওষুধ লাগে কারও কারও। রোগের অবস্থা অনুসারে খরচের তারতম্য হয়।
হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসক পরদিন সকালের চিকিৎসার জন্য ওষুধের চাহিদা
দেন। একটি নির্দিষ্ট স্লিপ দেয়া হয় রোগীর হাতে। কিন্তু এ সময় একাধিক
চিকিৎসক সেখানে কোম্পানির প্রতিনিধির মোবাইল ফোন নম্বর লিখে দেন। বেশির ভাগ
সময় এ কাজটি করেন সেলস সহকারী। এটা কোম্পানির প্রতিনিধিকে ধরিয়ে দিলে
তিনিই ব্যবস্থা করেন ওষুধের। পরদিন ক্যানসার বিভাগের নির্দিষ্ট একটি কক্ষ
থেকে টাকা দিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করতে হয়। টাকার স্লিপে লিখা থাকে যে চিকিৎসকের
মাধ্যমে চাহিদাপত্র এসেছে এবং যে প্রতিনিধির মাধ্যমে ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে
তার নাম। পাশাপাশি থাকে সেলস সহকারীর কোড নম্বর ও নাম। এখানে ৩ জনেরই
আলাদা কোড ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক কোম্পানির কাছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও
সেলস সহকারীর পৃথক কোড থাকে। চিকিৎসকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য নামের
পেছনে তার মোবাইল নম্বরের প্রথম কয়েকটি সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। মাস শেষে
তাদের সেই কোড দেখে কমিশন বুঝিয়ে দেয়া হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
দুই চিকিৎসকের নাম এই প্রতিযোগিতায় আগের সারিতে আলোচিত হচ্ছে। সূত্রের
দাবি, বিভাগের সব চিকিৎসক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নন। তবে কয়েকজন
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোগীদের জিম্মি করে এ অনিয়ম করে যাচ্ছেন। বিনিময়ে
কমিশন দেয়ার পাশাপাশি ওইসব চিকিৎসক ও এমপিও’কে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া
হচ্ছে। ভ্রমণে পাঠানো হচ্ছে দেশের বাইরে।
No comments