নদী রক্ষায় আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন by হাসান কামরুল
নদী
দখল এদেশে সবচেয়ে সহজ কাজ। যদি রাজনীতির তকমা গায়ে থাকে তাহলে অনায়াসে
নদীর দু’তীরে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায়। ঢাকার
তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার শুধু
তীর দখল হয়নি, নদীর ভেতরে জেটি করে বালু ও পাথর ওঠানামার যে দৃশ্য, তা
বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। প্রতিটি সরকারের আমলেই খুব
ঘটা করে নদীর দখল অবমুক্ত করার কর্মসূচি নেয়া হয়। কিন্তু লোক দেখানো সে
কর্মসূচি মূলত অবৈধ দখলদারিত্বের হাত থেকে নদীকে রক্ষা করতে বরাবরই ব্যর্থ
হয়। ব্যর্থতার মূল নিয়ামক হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী বলয়। যারা ক্ষমতার
কাছাকাছি থেকে নদীকে গলাটিপে হত্যা করছে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য,
তারা সব সময়ই প্রভাবশালী ও নদী দখলে পারদর্শী। পুলিশ, র্যাবের যৌথ অভিযানে
একদিকে কিছু অস্থায়ী কাঠামো ধ্বংস করা হলেও স্থায়ী কাঠামোগুলো বহাল
তবিয়তেই নদীর তীর ঘেঁষে দণ্ডায়মান।
এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নদী দখলমুক্ত করার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢাকা ও তার আশপাশের নদীগুলো পুনরুদ্ধারে একনেক থেকে ৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবং বিআইডব্লিউটিএ বালু, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন জায়গায় ৩২৬টি অবৈধ দখল চিহ্নিত করে। এবং একক অভিযানে প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা দখলমুক্ত করতে সমর্থ হয়।
হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০০৯-এর জুনে নদীর তীর দখলমুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। রুলের উল্লেখযোগ্য দিক ছিলÑ দখলদারিত্বমুক্ত নদীর সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য ড্রেজিং বা খননে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে ঢাকার চারটি নদী এলাকাকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার নির্দেশ প্রদান। হাইকোর্টের রুলের পরে সরকার নড়েচড়ে বসে এবং নদীর দূষণ রোধে ও দখলদারিত্বমুক্ত করতে নৌপরিবহন মন্ত্রীর সমন্বয়ে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করে। অক্টোবরে টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় পরবর্তী সাতদিনের মধ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোকে দখলমুক্ত করা হবে। কিন্তু দু’মাস অতিবাহিত হলেও অবৈধ দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে দখলকারীরা একের পর বাধা সৃষ্টি করলে টাস্কফোর্স ডিসেম্বরের সভায় নদীর দু’তীরে স্থায়ী পিলার বসানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
জানুয়ারি ২০১০-এ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসককে স্ব-স্ব নদীর সীমানা নির্ধারণ ওই বছরের ১৫ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করে। এবং সেই সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের কাজের সুবিধার্থে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সারাহ বেগম কবরী ও সানজিদা বেগম এমপিকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কাজ হল নদীগুলো যাতে নতুন করে দখল ও দূষণের শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং নদী দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
১৪ জানুয়ারি ২০১০-এ টাস্কফোর্সের জরুরি সভায় নদীর দু’পাশে সীমানা নির্ধারণ পিলার বসানোর জন্য টেন্ডার আহ্বান এবং নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১০ সালে একনেক দেশের সব নদীর তীর সংরক্ষণে ১০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে। কিন্তু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স নদীর দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে জটিলতার মুখোমুখি হওয়ায় নদী দখলমুক্ত করা কঠিন পড়ে এবং অনেকাংশে টাস্কফোর্স নদীর দখল অবমুক্ত করতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে। এমনকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে স্থানীয় ও প্রভাবশালী দখলবাজরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে টাস্কফোর্স অবৈধ নদী দখলকারীর অনেক স্থাপনাই সরাতে পারেনি। আর এ না পারার পেছনে প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামোর অভাবকে দায়ী করা হয়। টাস্কফোর্সের ব্যর্থতায় হাইকোর্ট আবার রুল রাজি করেন। বারবার উচ্চ আদালতের তাগিদ সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত ফল না আসায় পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের অব্যাহত সমালোচনায় টাস্কফোর্স দীর্ঘ এক বছর পর ১২ এপ্রিল ২০১১ তারিখে বিআইডব্লিউটিএ’র তত্ত্বাবধানে তুরাগ নদীর দু’পাশে সীমানা পিলার বসানোর কাজ শুরু করে।
মে ২০১১, বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠনের অব্যাহত আপত্তির কারণে টাস্কফোর্স তুরাগের দু’পাশে সীমানা পিলার বসানোর কাজ থেকে সরে আসে। পরিবেশ সংগঠনগুলো সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখে নদীর প্রকৃত তীর থেকে অনেক ভেতরে পিলার বসানো হচ্ছে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক বিবেচনা অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাবশালী দখলদারদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাদের দখলি স্থাপনাকে ঠিক রাখতে সীমানা পিলার প্রকৃত তীর থেকে সরিয়ে ভিন্ন জায়গায় বসানো হচ্ছে। এ নিয়ে হাইকোর্ট আবার সমন জারি করে। হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে ভূমি প্রতিমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে পরিবেশ সংগঠনগুলোর আপত্তি নজরে আনার চেষ্টা করে। এবং ভূমি প্রতিমন্ত্রী পরিবেশ সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নদীর প্রকৃত তীর সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ ও যেসব ভুল জায়গায় এরই মধ্যে সীমানা পিলার বসানো হয়েছে সেগুলো তুলে ফেলার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তও আলোর মুখ দেখতে ব্যর্থ হওয়ায় ২ জুলাই ২০১১ তারিখে পরিকল্পনা, অর্থ, শিপিং, যোগাযোগ, পানিসম্পদ, ভূমিজরিপ অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কাছে এক সপ্তাহের মধ্যে জবাব চেয়ে উচ্চ আদালত থেকে আবারও সমন জারি করা হয়।
১২ জুলাই ২০১১-এ হাইকোর্ট আবার ১১ জন সরকারি কর্মকর্তাকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্ব ও নদী দখলমুক্ত করতে না পারার কারণ সশরীরে কোর্টে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা প্রদানে হুকুম প্রদান করেন।
মার্চ ২০১২-এ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) টাস্কফোর্সের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য বুড়িগঙ্গার তীরসংলগ্ন হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, আমলিগলা ও লালবাগের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করে দেখতে পায়, বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
জুলাই ২০১২-এ বাপা টাস্কফোর্সকে ত্র“টিপূর্ণ নদী অবমুক্ত করার প্রক্রিয়া বন্ধ করার আহ্বান জানায় এবং সেই সঙ্গে দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
সেপ্টেম্বর ২০১৩-এ পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএ এবং ঢাকা ও আশপাশের জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে এক সভায় অভিযোগ করা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যক্তিরা ভুল সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করতে না পারার জন্য দায়ী।
সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৩-এ বাপা ও গ্রিন ভয়েস নদীর দখলমুক্ত ও সঠিক সীমানা পিলার নির্ধারণে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। তারা দাবি করে মৌসুমে নদীর পানি সর্বোচ্চ যে স্থান পর্যন্ত পৌঁছায় সে স্থানকে নদীর তীর ধরে সীমানা নির্ধারণের।
৩০ জুলাই ২০১৩-এ টাস্কফোর্স তাদের ২২তম সভায় নদীর কিছু অংশের সীমানা পিলার উঠিয়ে নতুন করে বসানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সর্বশেষ সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর সীমানা নির্ধারণ পিলার প্রভাবশালী স্থানীয়দের ছকে বসানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দখলকারীরা রাজনৈতিক ব্যানার ব্যবহার করে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি পিলার বসানোর কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নদীর তীরে নিজেদের ইচ্ছামতো পিলার বসাচ্ছে। যার ফলে নদীর তীর কোথাও কোথাও সরু হতে হতে খালে পরিণত হয়েছে। জিপিএস রিডিংয়ের মাধ্যমে পুরোদস্তুর মানচিত্র প্রস্তুত করে নদীর দু’পাশের প্রকৃত তীর সংরক্ষণে সরকারকে আরও বলিষ্ঠ হওয়ার অনুরোধ রইল। কারণ নদীই আমাদের প্রাণ। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচব, আর নদী না বাঁচলে মানুষের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে।
হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নদী দখলমুক্ত করার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢাকা ও তার আশপাশের নদীগুলো পুনরুদ্ধারে একনেক থেকে ৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এবং বিআইডব্লিউটিএ বালু, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন জায়গায় ৩২৬টি অবৈধ দখল চিহ্নিত করে। এবং একক অভিযানে প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা দখলমুক্ত করতে সমর্থ হয়।
হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০০৯-এর জুনে নদীর তীর দখলমুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। রুলের উল্লেখযোগ্য দিক ছিলÑ দখলদারিত্বমুক্ত নদীর সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য ড্রেজিং বা খননে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে ঢাকার চারটি নদী এলাকাকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার নির্দেশ প্রদান। হাইকোর্টের রুলের পরে সরকার নড়েচড়ে বসে এবং নদীর দূষণ রোধে ও দখলদারিত্বমুক্ত করতে নৌপরিবহন মন্ত্রীর সমন্বয়ে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করে। অক্টোবরে টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় পরবর্তী সাতদিনের মধ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোকে দখলমুক্ত করা হবে। কিন্তু দু’মাস অতিবাহিত হলেও অবৈধ দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে দখলকারীরা একের পর বাধা সৃষ্টি করলে টাস্কফোর্স ডিসেম্বরের সভায় নদীর দু’তীরে স্থায়ী পিলার বসানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
জানুয়ারি ২০১০-এ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসককে স্ব-স্ব নদীর সীমানা নির্ধারণ ওই বছরের ১৫ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করে। এবং সেই সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের কাজের সুবিধার্থে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সারাহ বেগম কবরী ও সানজিদা বেগম এমপিকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কাজ হল নদীগুলো যাতে নতুন করে দখল ও দূষণের শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং নদী দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব জনসাধারণের মধ্যে তুলে ধরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
১৪ জানুয়ারি ২০১০-এ টাস্কফোর্সের জরুরি সভায় নদীর দু’পাশে সীমানা নির্ধারণ পিলার বসানোর জন্য টেন্ডার আহ্বান এবং নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১০ সালে একনেক দেশের সব নদীর তীর সংরক্ষণে ১০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে। কিন্তু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স নদীর দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে জটিলতার মুখোমুখি হওয়ায় নদী দখলমুক্ত করা কঠিন পড়ে এবং অনেকাংশে টাস্কফোর্স নদীর দখল অবমুক্ত করতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে। এমনকি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে স্থানীয় ও প্রভাবশালী দখলবাজরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে টাস্কফোর্স অবৈধ নদী দখলকারীর অনেক স্থাপনাই সরাতে পারেনি। আর এ না পারার পেছনে প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামোর অভাবকে দায়ী করা হয়। টাস্কফোর্সের ব্যর্থতায় হাইকোর্ট আবার রুল রাজি করেন। বারবার উচ্চ আদালতের তাগিদ সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত ফল না আসায় পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের অব্যাহত সমালোচনায় টাস্কফোর্স দীর্ঘ এক বছর পর ১২ এপ্রিল ২০১১ তারিখে বিআইডব্লিউটিএ’র তত্ত্বাবধানে তুরাগ নদীর দু’পাশে সীমানা পিলার বসানোর কাজ শুরু করে।
মে ২০১১, বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠনের অব্যাহত আপত্তির কারণে টাস্কফোর্স তুরাগের দু’পাশে সীমানা পিলার বসানোর কাজ থেকে সরে আসে। পরিবেশ সংগঠনগুলো সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখে নদীর প্রকৃত তীর থেকে অনেক ভেতরে পিলার বসানো হচ্ছে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক বিবেচনা অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাবশালী দখলদারদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাদের দখলি স্থাপনাকে ঠিক রাখতে সীমানা পিলার প্রকৃত তীর থেকে সরিয়ে ভিন্ন জায়গায় বসানো হচ্ছে। এ নিয়ে হাইকোর্ট আবার সমন জারি করে। হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে ভূমি প্রতিমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে পরিবেশ সংগঠনগুলোর আপত্তি নজরে আনার চেষ্টা করে। এবং ভূমি প্রতিমন্ত্রী পরিবেশ সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নদীর প্রকৃত তীর সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ ও যেসব ভুল জায়গায় এরই মধ্যে সীমানা পিলার বসানো হয়েছে সেগুলো তুলে ফেলার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তও আলোর মুখ দেখতে ব্যর্থ হওয়ায় ২ জুলাই ২০১১ তারিখে পরিকল্পনা, অর্থ, শিপিং, যোগাযোগ, পানিসম্পদ, ভূমিজরিপ অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কাছে এক সপ্তাহের মধ্যে জবাব চেয়ে উচ্চ আদালত থেকে আবারও সমন জারি করা হয়।
১২ জুলাই ২০১১-এ হাইকোর্ট আবার ১১ জন সরকারি কর্মকর্তাকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্ব ও নদী দখলমুক্ত করতে না পারার কারণ সশরীরে কোর্টে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা প্রদানে হুকুম প্রদান করেন।
মার্চ ২০১২-এ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) টাস্কফোর্সের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য বুড়িগঙ্গার তীরসংলগ্ন হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, আমলিগলা ও লালবাগের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করে দেখতে পায়, বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
জুলাই ২০১২-এ বাপা টাস্কফোর্সকে ত্র“টিপূর্ণ নদী অবমুক্ত করার প্রক্রিয়া বন্ধ করার আহ্বান জানায় এবং সেই সঙ্গে দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
সেপ্টেম্বর ২০১৩-এ পরিবেশবাদী ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বিআইডব্লিউটিএ এবং ঢাকা ও আশপাশের জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে এক সভায় অভিযোগ করা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যক্তিরা ভুল সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করতে না পারার জন্য দায়ী।
সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৩-এ বাপা ও গ্রিন ভয়েস নদীর দখলমুক্ত ও সঠিক সীমানা পিলার নির্ধারণে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। তারা দাবি করে মৌসুমে নদীর পানি সর্বোচ্চ যে স্থান পর্যন্ত পৌঁছায় সে স্থানকে নদীর তীর ধরে সীমানা নির্ধারণের।
৩০ জুলাই ২০১৩-এ টাস্কফোর্স তাদের ২২তম সভায় নদীর কিছু অংশের সীমানা পিলার উঠিয়ে নতুন করে বসানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সর্বশেষ সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর সীমানা নির্ধারণ পিলার প্রভাবশালী স্থানীয়দের ছকে বসানো হচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দখলকারীরা রাজনৈতিক ব্যানার ব্যবহার করে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি পিলার বসানোর কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নদীর তীরে নিজেদের ইচ্ছামতো পিলার বসাচ্ছে। যার ফলে নদীর তীর কোথাও কোথাও সরু হতে হতে খালে পরিণত হয়েছে। জিপিএস রিডিংয়ের মাধ্যমে পুরোদস্তুর মানচিত্র প্রস্তুত করে নদীর দু’পাশের প্রকৃত তীর সংরক্ষণে সরকারকে আরও বলিষ্ঠ হওয়ার অনুরোধ রইল। কারণ নদীই আমাদের প্রাণ। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচব, আর নদী না বাঁচলে মানুষের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে।
হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক
No comments