বৌদ্ধ প্রবারণা : ধর্মীয় ও সামাজিক আবেদন by ড. সু কোমল বড়– য়া
শুভ প্রবারণা। এটি বৌদ্ধদের দ্বিতীয়
বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। শুধু বাংলাদেশের বৌদ্ধরা নন, বিশ্বের সব বৌদ্ধ এ শুভ
তিথিটি যথাযথ মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপন করছেন। এই দিনে
আমি দেশের সব ধর্ম সম্প্রদায় এবং বিশ্ববাসীকে জানাই প্রবারণার শারদীয়
শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমান কাল
থেকে এ সংস্কৃতি এখানে বহমান। এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান
বলতে কিছু নেই। এ দেশ আমাদের সবার। এটা আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি। তাই
তো আমরা এখানে নানা জাতি, গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
দেখতে পাই। দেখতে পাই নানা ধর্মীয় উৎসব ও পূজা-পার্বণ। এটাই হল আমাদের
জাতীয় সংস্কৃতি। এটাই আমাদের ঐক্য, সংহতি ও সম্প্র্রীতির মেলবন্ধনের
উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দেখুন, কী অপূর্ব মিলন আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে! ভাবলে অবাক হই। এই তো কদিন আগেই শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হল মহাসাড়ম্বরে। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর রেশ কাটতে না কাটতেই উদযাপিত হল বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। দুটি উৎসবের অপার আনন্দ আমরা সবাই ভাগাভাগি করে উপভোগ করেছি। বেশ উৎসবমুখর ছিল গত কটা দিন। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ আর কে খ্রিস্টানÑ এর মাঝে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবাই আমরা কেনাকাটা করেছি, আনন্দ করেছি। মিলেমিশে সব জায়গায় ঘুরেছি, বেড়িয়েছি। আজ উদযাপিত হচ্ছে বৌদ্ধ প্রবারণা। প্রতিটি বৌদ্ধ পল্লী, জনপদ আর পার্বত্য বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরগুলো যেন আনন্দে মুখরিত। সমতল-পার্বত্য এলাকার মধ্যে কোনো রকম বৈষম্য দেখছি না। সব জায়গায় চলছে যেন রং-বেরংয়ের ফানুস আর কল্পতরু তৈরির মহা ধুমধাম।
প্রবারণা বৌদ্ধ বিনয়ভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অধিষ্ঠান। এর কার্যকারিতা শুধু বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রামনদের জীবনের জন্য নয়, সামগ্রিক বৌদ্ধ জীবন তথা বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাসহ মানবজীবনের সর্বাবস্থায় এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বলা আছে, এসব নীতি-আদর্শের মধ্যে কোনো প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। তাই বৌদ্ধ প্রবারণা শুধু ধ্যানের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এতে আÍশুদ্ধিতা, আÍসংযম ও আÍোপলব্ধির মতো ভাবনাগুলো বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। এছাড়া মানবজীবনের বহুমাত্রিকতার গুণেও বৌদ্ধ প্রবারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়। যেমনÑ সেবা, দান, পরোপকার, বিনয় ও পারস্পরিক সৌজন্য প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য এবং পাশাপাশি আÍজিজ্ঞাসা, কর্তব্য, ধ্যাননিষ্ঠতা ও বিবেকবোধের মতো অন্তর্মুখী গুণগুলোও। এগুলো কোনো একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সমগ্র মানবসত্তার জন্য প্রয়োজন। এ জন্য বলা হয়, বৌদ্ধ প্রবারণার আবেদন সবার জন্য, সর্বজনীন ও সর্বকালীন। সংঘশক্তি বৃদ্ধিতেও এর কর্মপ্রবাহ অসাধারণত্বের পরিচয় দেয়। জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতির মেলবন্ধনে এর অবদান অতুলনীয়। বৌদ্ধ শাস্ত্রে আরও উল্লেখ আছে, সুখ সঙঘস্স সাম¹ি সাম¹নং তপো সুখো। অর্থাৎ একত্রে বাস করা সুখকর, একত্রে মিলনও সুখকর এবং একসঙ্গে তপস্যা করা আরও বেশি সুখকর। সুতরাং তিন মাস প্রবারণার ধ্যানে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা শিক্ষার জন্য সবাইকে একসঙ্গে তপস্যা করতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্য তৈরি করতে হয়।
পাপকে বারণ করা, পাপকর্ম থেকে বিরত থাকার নামই প্রবারণা। একে ধ্যানের অভিলাষ পূরণও বোঝায়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা দীর্ঘ তিন মাস বৌদ্ধরা যে ধ্যানের অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন, তারই সমাপ্তি দিবসকে বলা হয় প্রবারণা। এটি ইসলামের রোজাভঙ্গের শেষ দিন ঈদুল ফিতরের মতো আনন্দঘন একটি দিবস। বৌদ্ধরা বহির্মুখী শিক্ষার চেয়ে অন্তর্মুখী ভাবনাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। চিত্তের উৎকর্ষই হল অন্তর্মুখী শিক্ষা। এতে মানবিক গুণাবলি তথা মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাই তো বলা আছে, মনুষ্যত্বের গুণেই মানুষ বড় হয়। বিত্তে নয়, চিত্তের গুণে।
সামাজিক দৃষ্টিতে বৌদ্ধ প্রবারণা একটি জাতীয় উৎসবও বটে। এদিন বৌদ্ধ পাড়া-মহল্লা ও প্রতিটি বিহারকে নানা আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে বিহার ও বিহারের চারপাশ বর্ণাঢ্যভাবে সাজানো হয়। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। শিশু-কিশোর, বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-প্রৌঢ় সব বয়সের মানুষ যেন এদিন আনন্দে মেতে ওঠে। ছেলেমেয়েরা বাগান থেকে নানা বর্ণের ফুল ও পুষ্পপাতা এনে গৃহ ও বিহারকে সাজিয়ে তোলে। বাড়িতে তৈরি করা হয় নানা রকমের সুস্বাদু খাবার, পায়সান্ন আর পিঠা। প্রবারণার দিন অতি ভোর থেকেই বৃদ্ধ নর-নারী ও নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করে। সারিবদ্ধভাবে শোভাযাত্রা করে। পরস্পর কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। বড়দের প্রণাম করে। পূজার অর্ঘ্য আর দানীয় সামগ্রী নিয়ে বিহারে যায়। পঞ্চশীল, অষ্টশীল গ্রহণ করে। বুদ্ধপূজা দেয়। ধর্ম শ্রবণ করে। বারবার সাধুবাদ দেয়। বিহারে নানা রং-বেরংয়ের সুদৃশ্য কল্পতরু বৃক্ষ তৈরি করা হয়। এতে ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে যার যার সামর্থ্য ও ইচ্ছানুযায়ী দানীয় সামগ্রী বেঁধে দেয়। বেশ আনন্দ করে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই নানা রংয়ের ফানুস ওড়ানো হয়। এটি করা হয় বুদ্ধের কেশধাতু পূজার উদ্দেশেই। নেচেগেয়ে কীর্তন করা হয়। ঢাকঢোল বাজানো হয়। নদী ও সাগরে রঙিন কাগজ এবং কাপড়ের তৈরি জাহাজ ও নৌকা ভাসানো হয়। তারপর সবাই বিহারে বসে দেশ, জাতি ও বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও মঙ্গল কামনা করেন। ভিক্ষুরা সীমাঘরে বসে কিংবা বুদ্ধের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রবারণার বিনয়কর্ম সম্পাদন করেন। ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস ব্রত ভঙ্গ করেন। এর পরদিন থেকেই শুরু হয় শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা-চরথ ভিক্খবে চারিকং, বহুজন হিথায়, বহুজন সুখায়Ñ বুদ্ধের এই মহামন্ত্র বাণী নিয়ে ধর্ম প্রচারের জন্য চারদিকে বের হন। সদ্ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। বিহারগুলোতে চলে মাসব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসব ও ধর্মীয় সভা। এতে অনেক লোকের সমাগম হয়। অতএব, বৌদ্ধ প্রবারণা ধর্মীয় জীবনে যেমন অর্থবহ দিকনির্দেশনা করে, তেমনি সামাজিক ও জাতীয় জীবনেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান বহন করে। চলুন, আমরা সবাই প্রবারণার শিক্ষায় ব্রতী হই। আর এদিনে দেশের এই ক্রান্তিকাল ও সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য সবাই প্রার্থনা করি। সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্তুÑ জগতের সকল জীব সুখী হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। সমগ্র বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। ভবতু সব্ব মঙ্গলংÑ সকলেই মঙ্গল লাভ করুক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়–য়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
দেখুন, কী অপূর্ব মিলন আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে! ভাবলে অবাক হই। এই তো কদিন আগেই শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপিত হল মহাসাড়ম্বরে। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর রেশ কাটতে না কাটতেই উদযাপিত হল বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। দুটি উৎসবের অপার আনন্দ আমরা সবাই ভাগাভাগি করে উপভোগ করেছি। বেশ উৎসবমুখর ছিল গত কটা দিন। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ আর কে খ্রিস্টানÑ এর মাঝে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবাই আমরা কেনাকাটা করেছি, আনন্দ করেছি। মিলেমিশে সব জায়গায় ঘুরেছি, বেড়িয়েছি। আজ উদযাপিত হচ্ছে বৌদ্ধ প্রবারণা। প্রতিটি বৌদ্ধ পল্লী, জনপদ আর পার্বত্য বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরগুলো যেন আনন্দে মুখরিত। সমতল-পার্বত্য এলাকার মধ্যে কোনো রকম বৈষম্য দেখছি না। সব জায়গায় চলছে যেন রং-বেরংয়ের ফানুস আর কল্পতরু তৈরির মহা ধুমধাম।
প্রবারণা বৌদ্ধ বিনয়ভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অধিষ্ঠান। এর কার্যকারিতা শুধু বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রামনদের জীবনের জন্য নয়, সামগ্রিক বৌদ্ধ জীবন তথা বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাসহ মানবজীবনের সর্বাবস্থায় এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বলা আছে, এসব নীতি-আদর্শের মধ্যে কোনো প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। তাই বৌদ্ধ প্রবারণা শুধু ধ্যানের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এতে আÍশুদ্ধিতা, আÍসংযম ও আÍোপলব্ধির মতো ভাবনাগুলো বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। এছাড়া মানবজীবনের বহুমাত্রিকতার গুণেও বৌদ্ধ প্রবারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়। যেমনÑ সেবা, দান, পরোপকার, বিনয় ও পারস্পরিক সৌজন্য প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য এবং পাশাপাশি আÍজিজ্ঞাসা, কর্তব্য, ধ্যাননিষ্ঠতা ও বিবেকবোধের মতো অন্তর্মুখী গুণগুলোও। এগুলো কোনো একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য নয়, সমগ্র মানবসত্তার জন্য প্রয়োজন। এ জন্য বলা হয়, বৌদ্ধ প্রবারণার আবেদন সবার জন্য, সর্বজনীন ও সর্বকালীন। সংঘশক্তি বৃদ্ধিতেও এর কর্মপ্রবাহ অসাধারণত্বের পরিচয় দেয়। জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতির মেলবন্ধনে এর অবদান অতুলনীয়। বৌদ্ধ শাস্ত্রে আরও উল্লেখ আছে, সুখ সঙঘস্স সাম¹ি সাম¹নং তপো সুখো। অর্থাৎ একত্রে বাস করা সুখকর, একত্রে মিলনও সুখকর এবং একসঙ্গে তপস্যা করা আরও বেশি সুখকর। সুতরাং তিন মাস প্রবারণার ধ্যানে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা শিক্ষার জন্য সবাইকে একসঙ্গে তপস্যা করতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্য তৈরি করতে হয়।
পাপকে বারণ করা, পাপকর্ম থেকে বিরত থাকার নামই প্রবারণা। একে ধ্যানের অভিলাষ পূরণও বোঝায়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা দীর্ঘ তিন মাস বৌদ্ধরা যে ধ্যানের অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন, তারই সমাপ্তি দিবসকে বলা হয় প্রবারণা। এটি ইসলামের রোজাভঙ্গের শেষ দিন ঈদুল ফিতরের মতো আনন্দঘন একটি দিবস। বৌদ্ধরা বহির্মুখী শিক্ষার চেয়ে অন্তর্মুখী ভাবনাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। চিত্তের উৎকর্ষই হল অন্তর্মুখী শিক্ষা। এতে মানবিক গুণাবলি তথা মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাই তো বলা আছে, মনুষ্যত্বের গুণেই মানুষ বড় হয়। বিত্তে নয়, চিত্তের গুণে।
সামাজিক দৃষ্টিতে বৌদ্ধ প্রবারণা একটি জাতীয় উৎসবও বটে। এদিন বৌদ্ধ পাড়া-মহল্লা ও প্রতিটি বিহারকে নানা আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে বিহার ও বিহারের চারপাশ বর্ণাঢ্যভাবে সাজানো হয়। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। শিশু-কিশোর, বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-প্রৌঢ় সব বয়সের মানুষ যেন এদিন আনন্দে মেতে ওঠে। ছেলেমেয়েরা বাগান থেকে নানা বর্ণের ফুল ও পুষ্পপাতা এনে গৃহ ও বিহারকে সাজিয়ে তোলে। বাড়িতে তৈরি করা হয় নানা রকমের সুস্বাদু খাবার, পায়সান্ন আর পিঠা। প্রবারণার দিন অতি ভোর থেকেই বৃদ্ধ নর-নারী ও নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করে। সারিবদ্ধভাবে শোভাযাত্রা করে। পরস্পর কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। বড়দের প্রণাম করে। পূজার অর্ঘ্য আর দানীয় সামগ্রী নিয়ে বিহারে যায়। পঞ্চশীল, অষ্টশীল গ্রহণ করে। বুদ্ধপূজা দেয়। ধর্ম শ্রবণ করে। বারবার সাধুবাদ দেয়। বিহারে নানা রং-বেরংয়ের সুদৃশ্য কল্পতরু বৃক্ষ তৈরি করা হয়। এতে ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে যার যার সামর্থ্য ও ইচ্ছানুযায়ী দানীয় সামগ্রী বেঁধে দেয়। বেশ আনন্দ করে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই নানা রংয়ের ফানুস ওড়ানো হয়। এটি করা হয় বুদ্ধের কেশধাতু পূজার উদ্দেশেই। নেচেগেয়ে কীর্তন করা হয়। ঢাকঢোল বাজানো হয়। নদী ও সাগরে রঙিন কাগজ এবং কাপড়ের তৈরি জাহাজ ও নৌকা ভাসানো হয়। তারপর সবাই বিহারে বসে দেশ, জাতি ও বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও মঙ্গল কামনা করেন। ভিক্ষুরা সীমাঘরে বসে কিংবা বুদ্ধের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রবারণার বিনয়কর্ম সম্পাদন করেন। ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস ব্রত ভঙ্গ করেন। এর পরদিন থেকেই শুরু হয় শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা-চরথ ভিক্খবে চারিকং, বহুজন হিথায়, বহুজন সুখায়Ñ বুদ্ধের এই মহামন্ত্র বাণী নিয়ে ধর্ম প্রচারের জন্য চারদিকে বের হন। সদ্ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। বিহারগুলোতে চলে মাসব্যাপী কঠিন চীবর দানোৎসব ও ধর্মীয় সভা। এতে অনেক লোকের সমাগম হয়। অতএব, বৌদ্ধ প্রবারণা ধর্মীয় জীবনে যেমন অর্থবহ দিকনির্দেশনা করে, তেমনি সামাজিক ও জাতীয় জীবনেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান বহন করে। চলুন, আমরা সবাই প্রবারণার শিক্ষায় ব্রতী হই। আর এদিনে দেশের এই ক্রান্তিকাল ও সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য সবাই প্রার্থনা করি। সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্তুÑ জগতের সকল জীব সুখী হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। সমগ্র বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। ভবতু সব্ব মঙ্গলংÑ সকলেই মঙ্গল লাভ করুক।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়–য়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন- বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
No comments