দুর্নীতিবাজদের পলায়ন পরিকল্পনা by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
দুর্নীতিপ্রবণ
দেশগুলোতে দুর্নীতিবাজরা সাধারণত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে
দুর্নীতিকর্মে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ সরকারের মন্ত্রী, নেতা ও
প্রশাসনকে হাত না করে এককভাবে দুর্নীতি করতে গেলে পদে পদে বিপদে পড়ার ঝুঁকি
থাকে। আর দুর্নীতিবাজরা যদি সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে রাখতে পারে, তাহলে
তাদের সুবিধা হয়। একদিকে তারা সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স-পারমিট থেকে শুরু
করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে পারে; অন্যদিকে দুর্নীতি করতে গিয়ে
ধরা পড়লে সরকার-ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদবির করে সহজে
ছাড়া পায়। এ জন্য দুর্নীতিবাজরা সরকারের নেতা-মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠজনকে নিজ
দুর্নীতিকর্মের সঙ্গে রাখার জন্য তাদের দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা লভ্যাংশের
একটি বড় অংশ দিতে কার্পণ্য করে না। এর ফলে দুর্নীতিবাজরা অনেকটা
ঝুঁকিমুক্তভাবে ফ্রি-স্টাইলে দুর্নীতি করে রাতারাতি ব্যাপক অর্থবিত্তের
মালিক হয়ে যায়। আর এদের সহায়তাকারী রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসকরাও নামে-বেনামে
দেশে-বিদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্নীতি চর্চার গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব দেশের দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক অঙ্কে বিশেষ পারদর্শী। কোন দল কখন ক্ষমতায় থাকবে সে হিসাব কষতে তারা খুব একটা ভুল করে না। একটি দল নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিবাজরা তাদের সঙ্গে ভিড়তে শুরু করে। তারা ওই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্যবহার করে দুর্নীতির সাম্রাজ্য বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু সরকারের মেয়াদান্তে এসে তারা আবার নতুন করে অঙ্ক কষে দেখে কোন দলের জনপ্রিয়তা কতটা এবং কোন দল পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে। ওই হিসাবে তারা যদি দেখে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা ভালো নয়, তাহলে তারা অন্য জনপ্রিয় দলের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই আঁতাত গড়ে নিতে চেষ্টা করে। আর এ কাজে সফল না হলে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে হয় তারা বিদেশে পাড়ি জমায়, না হলে গা-ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে থেকে পরে ধীরে ধীরে নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিতে প্রয়াস চালায়। ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সরকার গঠিত হলে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দানকারী রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী এবং প্রশাসকরাও একই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে। দুর্নীতিবাজদের মতো তারা রাতারাতি পরিচয় গোপন করতে পারে না। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে এরা ভাব বুঝে আগে থেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়; আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ জীবনযাপনের চেষ্টা করে। আর এমন কাজে সফল হতে না পারলে নতুন সরকারের সঙ্গে যে কোনো উপায়ে আপস করে নিজ কাজে টিকে থাকতে চায়।
বাংলাদেশ যেহেতু একটি উচ্চ মাত্রার দুর্নীতিপ্রবণ দেশ, সে কারণে এ দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি এ থেকে ভিন্ন নয়। বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পাঁচবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। এ দেশের দুনর্িিতবাজরাও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে এবং দুর্নীতি চর্চার স্বার্থে এরা রাজনৈতিক বর্ণ পরিবর্তনে দ্বিধা করে না। এ দেশে দুর্নীতিবাজদের কোনো স্থায়ী দল নেই। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে এরা সে দলের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে তাদের দুর্নীতি কর্ম নির্বিঘœ করতে সচেষ্ট হয়। এ চরিত্র কেবল সাধারণ দুর্নীতিবাজদের নয়, প্রশাসনের মধ্যে দুর্নীতি চর্চাকারীরাও এ রকম চরিত্র লালন করে। সরকারের পরিবর্তনে এরাও ভাব বুঝে বর্ণ পরিবর্তনে চেষ্টা করে। দুর্নীতিতে জড়িত বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কখনও কখনও মামলা হলেও তারা নিজ দল ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা আখ্যা দিয়ে ওই মামলা থেকে রেহাই পেতে সক্ষম হন। তবে সে চেষ্টায় সফল না হলে তাদের ভাগ্যে জোটে গুরুত্বহীন স্থানে বদলি বা ওএসডি হয়ে বসে থাকা।
বাংলাদেশে সরকারের মেয়াদান্তে এসে দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক অঙ্ক কষে কারা আগামীতে সরকার গঠন করবে সে হিসাব মিলিয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টা করে। এ কঠিন কাজে সক্ষম না হলে অনেক দুর্নীতিবাজ বিদেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশে মহাজোট সরকার আমলে দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ এ নয় যে, এর আগের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি কম ছিল। তবে সামাজিক ভাইরাস হিসেবে সাধারণত দুর্নীতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধিই লক্ষ্য করা গেছে। এক সরকারের আমলে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়, পরের সরকারের আমলে সাধারণত দুর্নীতি হয় তার চেয়ে বেশি। তবে চারদলীয় জোট সরকার আমলের দুর্নীতির চেয়ে মহাজোট আমলে যে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এর মধ্যে বড় আকারে যেসব দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে শেয়ারবাজারের শত শত কোটি টাকার পরিকল্পিত লুটপাট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্র“পসহ আরও অনেক এমএলএম কোম্পানির ব্যাপক আর্থিক লুটপাট, রেলওয়ের নিয়োগ দুর্নীতি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রভৃতি অন্যতম। লক্ষ্যণীয়, এ সরকারের আগে এ দেশে যেসব দুর্নীতি হয়েছে তা দেশীয় পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু মহাজোট আমলে প্রথম বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ওই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের দুর্নীতি দেশীয় পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
মহাজোট সরকারের শেষ বছর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, অসৎ আমলা এবং অনিয়মকারী ও ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে অভিজ্ঞ ও সতর্করা নিজেদের বিপদকালে নিজেকে নিরাপদে রাখার জন্য অনেক আগেই বিদেশে অর্থ পাচার ও থাকার জায়গা তৈরি করে রেখেছেন। এ কারণে এ আমলের শেষ দিকে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কেনার পরিসংখ্যান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নিতে হলে ওই দেশের ব্যাংকে মোটা অঙ্কের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয়। দুর্নীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কাছাকাছি আসায় অনেক দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ নিরাপদে বিদেশে গা ঢাকা দেয়ার জন্য মালয়েশিয়াকে নিরাপদ দেশ হিসেবে বেছে নেয়ায় ওই দেশে সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ গত বছর (২০১২) ষষ্ঠ থেকে এক লাফে নিজ অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে আসে। ২০১১ সালে যেখানে ২৭৬ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নেন, সেখানে ২০১২ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩২৫-এ দাঁড়ায়। এ পরিসংখ্যান থেকে অনুধাবন করা যায়, নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে দুর্নীতিবাজদের মধ্যে দেশের বাইরে নিরাপদ আবাস গড়ার প্রবণতা ততই জোরালো হচ্ছে। এমন প্রবণতা সাম্প্রতিক নয়, এর আগের সরকার আমলের শেষ দিকেও তাদের আচরণে একই প্রবণতা লক্ষিত হয়েছিল।
প্রশাসনে সুবিধাভোগীরা যেসব যোগ্য কর্মকর্তাকে কোণঠাসা করে রেখে নিজেরা সরকারি আনুকূল্যে আখের গুছিয়েছেন, নির্বাচন এগিয়ে আসায় তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কট্টরভাবে সরকারি দল না করায় এবং মধ্যপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত যেসব কর্মকর্তা ওএসডি বা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন, তারা এখন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। প্রকাশিত সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কাছাকাছি আসায় বিরোধী শিবিরের বঞ্চিত-বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সরকারকে প্রশাসনে বন্ধুহীন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। প্রশাসনের øায়ুকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত সচিবালয়ে সরকারের মেয়াদান্তে জাতীয়তাবাদী ঘরানার কোণঠাসা কমিটিগুলো আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সাতটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত মোর্চাÑ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ নতুন উদ্যমে পুনর্গঠিত হয়েছে। মধ্য-২০১৩ সালে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের নেতিবাচক ফলাফলে প্রভাবিত হয়ে এ মোর্চা নতুন উৎসাহে কাজ শুরু করলে সরকারপন্থী সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এরা বিরোধী শিবিরের সব কর্মকর্তাকে ঐক্যবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাভোগী আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি শুরু করেছে। এছাড়া কট্টর সরকারপন্থী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা করে গোপনে তাদের দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, যা সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রকাশ করে প্রশাসনে সরকারবিরোধীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তবে এসব কার্যক্রম যত গোপনেই করা হোক না কেন, তা সরকারপন্থী প্রশাসকদের অগোচরে নেই। ফলে সরকারি দলের হ্রাসকৃত জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে ধারণা থাকায় সতর্ক সরকারপন্থী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সরকার পরিবর্তনের পর বিপদ এড়াতে আগেভাগেই বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখছে। তবে এ প্রক্রিয়ার ওপর বিরোধীদলীয় নজরদারিতে রয়েছে। ১৮-দলীয় জোটনেত্রী তার ৫ অক্টোবর, সিলেটের জনসভার বক্তৃতায় এসব দুর্নীতিবাজকে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তারিখ না বসানো ওপেন টিকিট করে রাখার তথ্য ফাঁস করেছেন।
একই রকম পলায়নপর মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। যারা এতদিন সরকারি নির্দেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচার নিপীড়ন করত, নির্বাচন নিকটবর্তী হওয়ায় এবং সরকারি দলের হ্রাসকৃত জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে তারা এখন হতাশায় ভুগছে। এসব পুলিশ কর্মকর্তার অনেকে এখন বড় মেয়াদের ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমনে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে সমালোচিত হয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ছুটি নিতে ব্যস্ত। এদের অনেকের ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়নি; পরিবর্তে কতিপয় এমন আবেদনকারীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে তিরস্কার করা হলে এরা মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। বড় মেয়াদের ছুটি নিতে না পেরে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা রাজধানী ছেড়ে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ জেলা সদরে পোস্টিংয়ের জন্য তদবির করছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আসার জন্য যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আগে ব্যাকুল ছিলেন, তারাই এখন ডিএমপি ছেড়ে নিরাপদ এসবি, সিআইডি বা অন্য কোনো অগুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ পোস্টিং পছন্দ করছেন। সরকারের প্রাথমিক বছরগুলোতে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তারা পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল দেখে আগামী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অনুমান করে ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ভেবে চুপসে গিয়ে নিরাপদ এক্সিট অনুসন্ধান করছেন।
সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চলমান সংকটের সমাধান না করে সরকার একতরফা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়ায় যে রাজনৈতিক সহিংসতার আশংকা দেখা দিয়েছে সে বিষয়টি ভেবেই পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর বাইরে পোস্টিং পেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কারণ এরা ভালো করেই জানেন, একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে যে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদলীয় আন্দোলন শুরু হবে তার তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হবে রাজধানী ঢাকায়। আর এ আন্দোলন মোকাবেলা করতে গিয়ে তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। লন্ডনে তথ্যমন্ত্রীর ওপর হামলা, হালুয়াঘাটে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর লাঞ্ছিত হওয়া প্রভৃতি ঘটনায় এসব কর্মকর্তা এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমনে সরকারি কর্মকর্তা ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা চাকরির ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ভেবে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর সরকারি নির্দেশে অমানবিক ভূমিকা পালনে আগের মতো উৎসাহী হতে পারছেন না।
নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের পলায়নপর মনোবৃত্তি সরকারি দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যেও সংক্রমিত হয় কিনা সে সম্পর্কে সরকারি নীতিনির্ধারকরা শংকিত হয়ে পড়েছেন। জনমত উপেক্ষা করে সরকারের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান উদ্যোগ প্রতিহত করার লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোটনেত্রীর ৫ অক্টোবর সিলেটের জনসভায় কেন্দ্রভিত্তিক সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বানের পর সহিংসতা ও রক্তপাত সম্ভাব্য হয়ে ওঠায় সরকারি প্রশ্রয়ে ফ্রি-স্টাইল দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতিকর্ম বাদ দিয়ে সরকার পরিবর্তন হলে কিভাবে নিরাপদ থাকবে সে পরিকল্পনা করছে। কারণ নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোন দল জয়ী হবে এবং নতুন সরকারের অধীনে দুর্নীতিবাজদের অবস্থা কেমন যাতনাময় হবে সে সম্পর্কে মহাজোট আমলের দুর্নীতিবাজদের ধারণা রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্নীতি চর্চার গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব দেশের দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক অঙ্কে বিশেষ পারদর্শী। কোন দল কখন ক্ষমতায় থাকবে সে হিসাব কষতে তারা খুব একটা ভুল করে না। একটি দল নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিবাজরা তাদের সঙ্গে ভিড়তে শুরু করে। তারা ওই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্যবহার করে দুর্নীতির সাম্রাজ্য বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু সরকারের মেয়াদান্তে এসে তারা আবার নতুন করে অঙ্ক কষে দেখে কোন দলের জনপ্রিয়তা কতটা এবং কোন দল পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে। ওই হিসাবে তারা যদি দেখে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা ভালো নয়, তাহলে তারা অন্য জনপ্রিয় দলের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই আঁতাত গড়ে নিতে চেষ্টা করে। আর এ কাজে সফল না হলে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে হয় তারা বিদেশে পাড়ি জমায়, না হলে গা-ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে থেকে পরে ধীরে ধীরে নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিতে প্রয়াস চালায়। ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সরকার গঠিত হলে দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয়দানকারী রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী এবং প্রশাসকরাও একই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে। দুর্নীতিবাজদের মতো তারা রাতারাতি পরিচয় গোপন করতে পারে না। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে এরা ভাব বুঝে আগে থেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়; আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ জীবনযাপনের চেষ্টা করে। আর এমন কাজে সফল হতে না পারলে নতুন সরকারের সঙ্গে যে কোনো উপায়ে আপস করে নিজ কাজে টিকে থাকতে চায়।
বাংলাদেশ যেহেতু একটি উচ্চ মাত্রার দুর্নীতিপ্রবণ দেশ, সে কারণে এ দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি এ থেকে ভিন্ন নয়। বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পাঁচবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। এ দেশের দুনর্িিতবাজরাও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে এবং দুর্নীতি চর্চার স্বার্থে এরা রাজনৈতিক বর্ণ পরিবর্তনে দ্বিধা করে না। এ দেশে দুর্নীতিবাজদের কোনো স্থায়ী দল নেই। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে এরা সে দলের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে তাদের দুর্নীতি কর্ম নির্বিঘœ করতে সচেষ্ট হয়। এ চরিত্র কেবল সাধারণ দুর্নীতিবাজদের নয়, প্রশাসনের মধ্যে দুর্নীতি চর্চাকারীরাও এ রকম চরিত্র লালন করে। সরকারের পরিবর্তনে এরাও ভাব বুঝে বর্ণ পরিবর্তনে চেষ্টা করে। দুর্নীতিতে জড়িত বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কখনও কখনও মামলা হলেও তারা নিজ দল ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা আখ্যা দিয়ে ওই মামলা থেকে রেহাই পেতে সক্ষম হন। তবে সে চেষ্টায় সফল না হলে তাদের ভাগ্যে জোটে গুরুত্বহীন স্থানে বদলি বা ওএসডি হয়ে বসে থাকা।
বাংলাদেশে সরকারের মেয়াদান্তে এসে দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক অঙ্ক কষে কারা আগামীতে সরকার গঠন করবে সে হিসাব মিলিয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টা করে। এ কঠিন কাজে সক্ষম না হলে অনেক দুর্নীতিবাজ বিদেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশে মহাজোট সরকার আমলে দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ এ নয় যে, এর আগের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি কম ছিল। তবে সামাজিক ভাইরাস হিসেবে সাধারণত দুর্নীতির ক্রমান্বয় বৃদ্ধিই লক্ষ্য করা গেছে। এক সরকারের আমলে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়, পরের সরকারের আমলে সাধারণত দুর্নীতি হয় তার চেয়ে বেশি। তবে চারদলীয় জোট সরকার আমলের দুর্নীতির চেয়ে মহাজোট আমলে যে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এর মধ্যে বড় আকারে যেসব দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে শেয়ারবাজারের শত শত কোটি টাকার পরিকল্পিত লুটপাট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্র“পসহ আরও অনেক এমএলএম কোম্পানির ব্যাপক আর্থিক লুটপাট, রেলওয়ের নিয়োগ দুর্নীতি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি প্রভৃতি অন্যতম। লক্ষ্যণীয়, এ সরকারের আগে এ দেশে যেসব দুর্নীতি হয়েছে তা দেশীয় পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু মহাজোট আমলে প্রথম বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ওই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের দুর্নীতি দেশীয় পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
মহাজোট সরকারের শেষ বছর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, অসৎ আমলা এবং অনিয়মকারী ও ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে অভিজ্ঞ ও সতর্করা নিজেদের বিপদকালে নিজেকে নিরাপদে রাখার জন্য অনেক আগেই বিদেশে অর্থ পাচার ও থাকার জায়গা তৈরি করে রেখেছেন। এ কারণে এ আমলের শেষ দিকে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কেনার পরিসংখ্যান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নিতে হলে ওই দেশের ব্যাংকে মোটা অঙ্কের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয়। দুর্নীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কাছাকাছি আসায় অনেক দুর্নীতিবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ নিরাপদে বিদেশে গা ঢাকা দেয়ার জন্য মালয়েশিয়াকে নিরাপদ দেশ হিসেবে বেছে নেয়ায় ওই দেশে সেকেন্ড হোম সুবিধা গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ গত বছর (২০১২) ষষ্ঠ থেকে এক লাফে নিজ অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে আসে। ২০১১ সালে যেখানে ২৭৬ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধা নেন, সেখানে ২০১২ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩২৫-এ দাঁড়ায়। এ পরিসংখ্যান থেকে অনুধাবন করা যায়, নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে দুর্নীতিবাজদের মধ্যে দেশের বাইরে নিরাপদ আবাস গড়ার প্রবণতা ততই জোরালো হচ্ছে। এমন প্রবণতা সাম্প্রতিক নয়, এর আগের সরকার আমলের শেষ দিকেও তাদের আচরণে একই প্রবণতা লক্ষিত হয়েছিল।
প্রশাসনে সুবিধাভোগীরা যেসব যোগ্য কর্মকর্তাকে কোণঠাসা করে রেখে নিজেরা সরকারি আনুকূল্যে আখের গুছিয়েছেন, নির্বাচন এগিয়ে আসায় তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কট্টরভাবে সরকারি দল না করায় এবং মধ্যপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত যেসব কর্মকর্তা ওএসডি বা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন, তারা এখন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। প্রকাশিত সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কাছাকাছি আসায় বিরোধী শিবিরের বঞ্চিত-বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সরকারকে প্রশাসনে বন্ধুহীন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। প্রশাসনের øায়ুকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত সচিবালয়ে সরকারের মেয়াদান্তে জাতীয়তাবাদী ঘরানার কোণঠাসা কমিটিগুলো আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সাতটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত মোর্চাÑ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ নতুন উদ্যমে পুনর্গঠিত হয়েছে। মধ্য-২০১৩ সালে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের নেতিবাচক ফলাফলে প্রভাবিত হয়ে এ মোর্চা নতুন উৎসাহে কাজ শুরু করলে সরকারপন্থী সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এরা বিরোধী শিবিরের সব কর্মকর্তাকে ঐক্যবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাভোগী আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি শুরু করেছে। এছাড়া কট্টর সরকারপন্থী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা করে গোপনে তাদের দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, যা সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রকাশ করে প্রশাসনে সরকারবিরোধীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তবে এসব কার্যক্রম যত গোপনেই করা হোক না কেন, তা সরকারপন্থী প্রশাসকদের অগোচরে নেই। ফলে সরকারি দলের হ্রাসকৃত জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে ধারণা থাকায় সতর্ক সরকারপন্থী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সরকার পরিবর্তনের পর বিপদ এড়াতে আগেভাগেই বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখছে। তবে এ প্রক্রিয়ার ওপর বিরোধীদলীয় নজরদারিতে রয়েছে। ১৮-দলীয় জোটনেত্রী তার ৫ অক্টোবর, সিলেটের জনসভার বক্তৃতায় এসব দুর্নীতিবাজকে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তারিখ না বসানো ওপেন টিকিট করে রাখার তথ্য ফাঁস করেছেন।
একই রকম পলায়নপর মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। যারা এতদিন সরকারি নির্দেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচার নিপীড়ন করত, নির্বাচন নিকটবর্তী হওয়ায় এবং সরকারি দলের হ্রাসকৃত জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে তারা এখন হতাশায় ভুগছে। এসব পুলিশ কর্মকর্তার অনেকে এখন বড় মেয়াদের ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমনে নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে সমালোচিত হয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন ছুটি নিতে ব্যস্ত। এদের অনেকের ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়নি; পরিবর্তে কতিপয় এমন আবেদনকারীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে তিরস্কার করা হলে এরা মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। বড় মেয়াদের ছুটি নিতে না পেরে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা রাজধানী ছেড়ে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ জেলা সদরে পোস্টিংয়ের জন্য তদবির করছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আসার জন্য যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আগে ব্যাকুল ছিলেন, তারাই এখন ডিএমপি ছেড়ে নিরাপদ এসবি, সিআইডি বা অন্য কোনো অগুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ পোস্টিং পছন্দ করছেন। সরকারের প্রাথমিক বছরগুলোতে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তারা পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল দেখে আগামী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অনুমান করে ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ভেবে চুপসে গিয়ে নিরাপদ এক্সিট অনুসন্ধান করছেন।
সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চলমান সংকটের সমাধান না করে সরকার একতরফা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়ায় যে রাজনৈতিক সহিংসতার আশংকা দেখা দিয়েছে সে বিষয়টি ভেবেই পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর বাইরে পোস্টিং পেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কারণ এরা ভালো করেই জানেন, একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে যে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদলীয় আন্দোলন শুরু হবে তার তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হবে রাজধানী ঢাকায়। আর এ আন্দোলন মোকাবেলা করতে গিয়ে তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। লন্ডনে তথ্যমন্ত্রীর ওপর হামলা, হালুয়াঘাটে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর লাঞ্ছিত হওয়া প্রভৃতি ঘটনায় এসব কর্মকর্তা এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। আগামীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমনে সরকারি কর্মকর্তা ও পোশাকধারী বাহিনীর সদস্যরা চাকরির ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ভেবে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর সরকারি নির্দেশে অমানবিক ভূমিকা পালনে আগের মতো উৎসাহী হতে পারছেন না।
নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের পলায়নপর মনোবৃত্তি সরকারি দল ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যেও সংক্রমিত হয় কিনা সে সম্পর্কে সরকারি নীতিনির্ধারকরা শংকিত হয়ে পড়েছেন। জনমত উপেক্ষা করে সরকারের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান উদ্যোগ প্রতিহত করার লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোটনেত্রীর ৫ অক্টোবর সিলেটের জনসভায় কেন্দ্রভিত্তিক সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বানের পর সহিংসতা ও রক্তপাত সম্ভাব্য হয়ে ওঠায় সরকারি প্রশ্রয়ে ফ্রি-স্টাইল দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতিকর্ম বাদ দিয়ে সরকার পরিবর্তন হলে কিভাবে নিরাপদ থাকবে সে পরিকল্পনা করছে। কারণ নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোন দল জয়ী হবে এবং নতুন সরকারের অধীনে দুর্নীতিবাজদের অবস্থা কেমন যাতনাময় হবে সে সম্পর্কে মহাজোট আমলের দুর্নীতিবাজদের ধারণা রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments