আইন বাস্তবায়ন ও নথি ব্যবস্থাপনা by মুহাম্মদ লুৎফুল হক

২০০৯-এর মার্চে জাতীয় সংসদে তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে এবং একই বছরের ১ জুলাই থেকে আইনের কার্যকারিতা শুরু হয়েছে। আইন পাস ও কার্যকর হওয়ার পর থেকে জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এর সুফল এখনো জনগণ ভোগ করতে পারছে না।
কেন বা কী কারণে জনগণ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তার অনেক দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কারণ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে তথ্যের অপ্রাপ্যতা বা সুষ্ঠু তথ্য ও নথি ব্যবস্থাপনার অভাব। তথ্য অধিকার আইনের সফল বাস্তবায়নের জন্য অতিঅবশ্যই উন্নত নথি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন আছে। ক্রটিপূর্ণ নথি ব্যবস্থাপনা তথ্য অধিকার আইনকে অকার্যকর করে ফেলে, কারণ ক্রটিপূর্ণ নথি ব্যবস্থাপনায় চাহিদাকৃত তথ্য সম্পূর্ণভাবে ও সময়মতো পাওয়া যায় না। তাই তথ্য অধিকার আইন যতই জনবান্ধব ও গণমুখী হোক না কেন অথবা সরকার তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে যতই সচেষ্ট থাকুক না কেন, আধুনিক নথি ব্যবস্থাপনার অভাব থাকলে এই আইন অকার্যকর হয়ে পড়বে। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, নথি ব্যবস্থাপনা যত উন্নত হবে, তথ্য অধিকার আইনও তত সফল হবে। উন্নত তথ্য বা নথি ব্যবস্থাপনায় চাহিদাকারী চাহিদাকৃত তথ্য সঠিক বা নির্ভুলভাবে পেয়ে থাকে, একই সঙ্গে তথ্য সরবরাহকারীও সহজে এবং সময়মতো তথ্য প্রদানে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে সুষ্ঠু পদ্ধতিতে তথ্যসংবলিত নথি সৃষ্টি করা, গুছিয়ে রাখা, তালিকাভুক্ত করা, সংরক্ষণ করা ইত্যাদি অনুসরণ না করলে নথি খুঁজে পাওয়া এবং নিয়মানুযায়ী যথাসময়ে এবং যথা পদ্ধতিতে চাহিদাকারীকে তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
প্রায় ৮০টি দেশে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হলেও এটি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে অনেক দেশেই নথি ব্যবস্থাপনা বা তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতিসংশ্লিষ্ট আইনগুলো হালনাগাদ করা হয়নি। এ কারণে অনেক দেশেই জনগণের তথ্য অধিকার ব্যাহত হচ্ছে, এদের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর করার পাশাপাশি নথি ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট আইন ও বিভিন্ন নির্দেশিকা প্রণয়ন বা সংশোধন ও কার্যকর করার প্রয়োজন আছে। কারণ আমাদের নথি ব্যবস্থাপনা এখনো ঔপনিবেশিক সময়ের গোপনীয়তার সংস্কৃতির আলোকে সৃষ্ট নির্দেশাবলি অনুসরণ করছে। প্রায় ১৮ মাস আগে তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হলেও নথি ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট কোনো আইন ও নির্দেশিকা সংশোধন বা প্রণয়ন হয়নি। আগে থেকেই বাংলাদেশে নথি ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট কোনো আইন প্রচলিত নেই অর্থাৎ পাবলিক রেকর্ডস অ্যাক্ট-জাতীয় কোনো আইন বাংলাদেশে নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নথি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কীয় কোনো আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনাও বাংলাদেশে প্রচলিত নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, আদালত, দপ্তর, বাহিনী ইত্যাদি সংস্থা বা কার্যালয় নিজ নিজ প্রয়োজনে এক ধরনের নথি ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে থাকে, যা অনেক প্রাচীন বা যুগোপযোগী নয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাতিলপ্রায়। যেমন, ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত ‘রেকর্ডস ম্যানুয়াল ১৯৪৩’ এখন আর বিশেষ উপযোগী নয়, তবু আধুনিক কোনো নির্দেশিকা না থাকায় এখনো বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে তাই অনুসরণ করা হচ্ছে। সর্বোপরি এসব নির্দেশিকার অনেকগুলোই তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য অনুকূলও নয়। যেহেতু এসব নির্দেশিকা কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশিকাকে অনুসরণ করে প্রণীত হয়নি, তাই বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত নির্দেশাবলি নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্যহীন আবার ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে ১৯৭৩ সালে সৃষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসের একটি ভূমিকা আছে, কিন্তু তাদের নিজস্ব বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আজও তারা কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশাবলি তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।
বাংলাদেশে নথি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়ে নথির খোঁজ করলে প্রায়ই শুনতে হয় যে তা পাওয়া যাচ্ছে না। ঔপনিবেশিক আমলে নথি ব্যবস্থাপনার যে মান ছিল, তা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে নিম্নগামী হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কার্যালয়ে নথি ব্যবস্থাপনাকে বিশেষ কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না। প্রশাসনে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থা, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির জন্য উন্নত নথি ব্যবস্থাপনা হুমকিস্বরূপ; তাই প্রশাসনের অশুভ শক্তি নথি ব্যবস্থাপনাকে তাদের অভিন্ন স্বার্থে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত বছর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের নথি ব্যবস্থাপনা ও তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে একটি জরিপ করে। এতে উল্লেখ আছে যে বাংলাদেশে নথি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বের দিক থেকে খুব নিম্নে। এতে সরকারের কর্মসম্পাদন ও সেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে এবং টেকসই আইসিটি পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা থাকছে। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে তথ্য অধিকার আইন এই দুরবস্থা থেকে উত্তরণে উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করতে পারে। নথি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বিষয়ে তথ্য কমিশনও অবহিত আছে। এ বছরের ১৪ জুলাই প্রধান তথ্য কমিশনার উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশে নথি ব্যবস্থাপনা অনেক নিম্নমানের এবং জরুরি ভিত্তিতে নথিগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
তথ্য বা নথি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা এবং তা কাটিয়ে ওঠার পথ নিয়ে বিশেষ কোনো গবেষণা বা জরিপ বাংলাদেশে এ যাবৎ হয়নি, তবে লব্ধ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বব্যাংকের জরিপ থেকে নথি ব্যবস্থাপনায় নিচের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা যায়:
সর্বস্তরে নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উদাসীনতা।
নথি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় স্থানের অভাব।
নথি ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যালয়সমূহে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা পদের প্রাধিকার না থাকা।
নথি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপ্রতুল বা শূন্য বাজেট বরাদ্দ।
নথি ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণের অভাব।
নথি ব্যবস্থাপনায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতার অভাব।
নথি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক আইনকানুন বা নির্দেশাবলির অভাব।
জাতীয় আর্কাইভসের আইনগত সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা।
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এ তথ্য সংরক্ষণ ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে এবং তথ্য কমিশনকে নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় তথ্যবিন্যাস, সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে সরাসরি উল্লেখ আছে এবং কোনো কোনো ধারায় পরোক্ষভাবেও তথ্য ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উল্লেখ আছে। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর যেসব ধারা ও উপধারায় তথ্য সংরক্ষণ ও নথি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উল্লেখ আছে তা হচ্ছে ধারা ৫, ধারা ১৩ (৫)(ক), ধারা ২৫ (১১)(ক)(ঈ), ধারা ২৫ (১১)(চ) এবং ধারা ২৫ (১১)(ঙ)।
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে তথ্য কমিশন এখনো নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারেনি বা কার্যকর হতে সক্ষম হয়নি। এ কারণে তারা তথ্য বা নথি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কোনো নির্দেশিকা বা প্রবিধান তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। তবে ধারণা করা যায় যে তথ্য কমিশন শিগগিরই নথি সংরক্ষণ বিষয়ে প্রবিধান ও নির্দেশিকা তৈরি করবে এবং সব কর্তৃপক্ষকে তা অনুসরণের জন্য নির্দেশ দেবে। তথ্য কমিশন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় আর্কাইভসের সহযোগিতা নিতে পারে।
এটা বাস্তবতা যে বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত হলেও তথ্য অধিকার আইন এখনো গতিশীল হয়নি। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই যেমন তথ্য অধিকারসংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, সুশীল সমাজ, অধিকারকর্মী, মিডিয়া বা খোদ তথ্য কমিশনও লক্ষ্য থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। কিছুদিন ধরে তথ্য অধিকার নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকাও সমালোচিত হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারক এবং সরকারি কর্মকর্তারাও তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে প্রকাশ্যে বিরূপ সমালোচনা করছেন এবং বাস্তবায়নে ধীরগতির আশ্রয় নিচ্ছেন। বেসরকারি সংস্থাগুলোর যাঁরা তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একসময় প্রাণপাত করছিলেন এবং তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য অধিকার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে সক্ষম, তাঁদেরও অনেকে তথ্য অধিকার বিষয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কারণ আইনে তাঁদেরও তথ্য প্রদানের আওতায় আনা হয়েছে। এ সবই হচ্ছে আইন প্রয়োগের বিষয়ে সরকার ও তথ্য কমিশনের কার্যকর ভূমিকার অভাবে। তথ্য সংরক্ষণ ও নথি ব্যবস্থাপনার উন্নতিকল্পে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সরকার, তথ্য কমিশন ও সৎ এনজিওদের তথ্য অধিকারবিষয়ক দায়িত্ব পালনের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে তথ্য অধিকার আইনকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার পথ করে দিতে এখনই সচেষ্ট হতে হবে। নতুবা অনেক সুন্দর আইনের মতো এই আইনও মুখ থুবড়ে পড়বে। নিশ্চয়ই এটি আমাদের কাম্য নয়।
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।
lutful55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.