আলোচনা- সুনীতি ও সুশাসন by আফতাব চৌধুরী

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ৩৯ বছর পূর্ণ হলো। প্রতি বছরই স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে আমরা হিসাব মিলাই। কীসের হিসাব, না প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির জমা খরচ। এ হিসাব কোনদিনই কড়ায় ক্রান্তিতে মিলে না। জানি তবুও ক্ষেপার পরশ পাথর খোঁজার মতোই সেস্নটে ঢ্যাড়া কাটি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সে ঐতিহাসিক 'ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি'র মুখস্ত হয়ে যাওয়া লাইনগুলো আবার পড়ি।
বার বার আউড়ে যাই এবং প্রতিবারই প্রত্যাশার পারদ চড়া হয়। তাতে বাড়তে থাকে হতাশা। কী হওয়ার ছিল, আর কী হল! এ বিষণ্নতা শুষে নেয় বিজয় দিবসের যাবতীয় আমোদ-আহ্লাদ। উৎকট থেকে উলস্নাসের উৎরোল। জন্ম নেয় এক নেতিঘোর তমিস া। অথচ বিজয় তো এক ইতির ঠিকানা। বিদেশী শাসনমুক্ত দেশবাসী নিজের মতো করে বাঁচবে বলেই না এত সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর শোনিত পিচ্ছিল সরণিতে মৃতু্যর দীর্ঘ কাতার। এ বিশাল দেশ বিভেদ আর বৈচিত্র্যের মাঝেই অঙ্গীকার করেছিল, সবাই অন্তত খেয়ে-পরে থাকার মতো এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। প্রয়োজন ছিল সুশাসন আর সুনীতির। কিন্তু এ টুকুই যে পাওয়া গেল না। দুনর্ীতি আর দুঃশাসনে ছেয়ে গেল সারা দেশ। মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ থেকে বিচার ব্যবস্থা-গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তম্ভেই বাসা বাঁধল নীতিহীনতা আর অরাজকতা। কিন্তু এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করে এ দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল একটা সুন্দর, পরিচ্ছন্ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না দারিদ্য্র, থাকবে না হীনমন্যতা, থাকবে না দুনর্ীতি, থাকবে না সন্ত্রাস, থাকবে না ছিনতাই, থাকবে না দলীয়করণ ও ধর্ষণের মত পরিস্থিতি ও পরিবেশ। থাকবে প্রাচুর্য, ভ্রাতৃত্ব, থাকবে সম্পদ, আর এ সম্পদের মালিক হবে গোটা দেশের মানুষ। কিন্তু আমাদের মনে হয় সে আশা বা আকঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি আজও। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আরো কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম করতে হবে।
মাত্র ক'মাস আগে প্রকাশিত অমর্ত্য সেনের সাম্প্রতিকতম পুস্তক 'দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস'-এ আলোচিত হয়েছে ন্যায় এর-সরূপ। রলস-এর ১৯৫৮-এর বিখ্যাত ধারণা 'জাস্টিস এজ ফেয়ারনেস'সহ পশ্চিমা তাত্তি্বকদের যাবতীয় বক্তব্যকে খণ্ডন করে অমর্ত্য বোঝাতে চেয়েছেন বাস্তবে কোনো আদর্শ সামাজিক ন্যায় ব্যবস্থা সম্ভবই নয়। ন্যায় বরাবরই এক আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। তাই তিনি জোর দিয়েছেন 'প্রতিকারযোগ্য অন্যায়' (রেমিডিয়েবল ইনজাস্টিস) এর অপসারণে। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন ন্যায় নয়, নীতিই প্রধান হিসাবে গণ্য হোক। প্রখর নীতিবোধই পারে একটি সমাজকে ন্যায়ের-এর রাস্তায় নিয়ে যেতে। অমর্ত্যর সারস্বত আমরা বরাবরই লক্ষ্য করেছি সুমহান ঐতিহ্যের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য। ঐতিহ্যের পুনর্নিমাণের সে অভীপ্সাই প্রতিফলিত হয়েছে ন্যায় সম্পর্কিত তার নবতম ধারণায়। কিন্তু এ ইশারাতো আমাদের সংবিধানেও রয়েছে। সামাজিক ন্যায়ের সুবিস্তৃত অঙ্গনে প্রবেশাধিকার থাকে শুধুই সুনীতির। স্বাধীকার, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব তো আসলে তিনটি মৌলিক নীতিবোধ, আমাদেরকে পৌঁছে দেবে চতুর্থ তথা অন্তিম লক্ষ্যে। যা কি না ন্যায়।
এর মধ্যে সংঘাত থাকবে, থাকবে পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের সংঘর্ষ। কিন্তু আমরা তো জানতাম, মিলাবেন, তিনি মিলাবেন। ফলে সমন্বয় ভাবনাও কাজ করবে অগোচরে। বিভিন্ন লেখক তাদের ইদানীংয়ের রচনাগুলোতে বার বার আমাদের এ কথাই বলেছেন। দৃঢ় প্রত্যয়ে অমস্নান জানাচ্ছেন, শুধুমাত্র শ্রেণী পরিচয় থেকেই সংঘাতের সরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর জন্যে আমাদের যেতে হবে পরিচিত তাত্তি্বক কাঠামোর বাইরে। কিন্তু বাংলাদেশীয় গণতন্ত্রে মুশকিলের জায়গা যে অন্যত্র। শিল্প না কৃষি, নদী বাঁধ হবে কি না ইত্যাদি এবং সমজাতীয় ন্যায় সংকল্পজনিত প্রশ্নের বাইরেও রয়েছে আমাদের না-শাসন এবং দুঃশাসনের অজস উপস্থিতি। অমর্ত্যর 'প্রতিকারযোগ্য অন্যায়' তত্ত্ব সম্ভবত এসব ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীর চাপে পুলিশ যখন দুষ্টের দমনে এগিয়ে না এসে শিষ্টকেই ফাটকে পুরে দেয়, দেশের অগ্রগণ্য আইনজীবী যখন খুনের ঘটনার একমাত্র সাক্ষীকে উৎকোচ প্রদান এবং ভীতি প্রদর্শন করেন, দেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশন কোনো কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে কিংবা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত নাগরিক সমাজের অনেককেই যখন নিজের হক পাওনা আদায়ের জন্য উৎকোচ প্রদান করতে হয় তখন গণতন্ত্র এবং বিজয় সত্যিই বিপন্ন হয় এবং ন্যায় শাস্ত্রের কোনো অভিধানেই এর প্রতিকার লেখা থাকে না।
এভাবে অসংখ্য প্রতিকারযোগ্য অন্যায়ই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিজয়কে অর্থহীন করে দিচ্ছে। আমাদের গণতন্ত্রের এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শক্তির আন্দোলনের জন্য সুখবর নয়। আমাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয় বিবেচনা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
================================
আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি  পরিবেশ সুরক্ষায় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা  রাত যায় দিন আসে  শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব  ভালবাসা নিভিয়ে দেয় হিংসার আগুন  মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি  রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আফতাব চৌধুরী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.