পরকীয়ার জেরে খুন কেন এই নৃশংসতা by মারুফ কিবরিয়া

প্রেম-পরকীয়ায় জড়িয়ে খুনের ঘটনা বাড়ছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের শিকার হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়ার বলি হচ্ছে তৃতীয় কেউ। সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন সামাজিক বন্ধনে চিড় ধরা, অস্থিরতা ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-টানাপড়েনে আপনজনকে খুনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তবে এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে হতাশা, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।
সম্প্রতি রংপুরে আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিকের পরকীয়ার জেরে। স্নিগ্ধা তার সহকর্মী কামরুলের প্রেমে পড়েন। আর সেটা যখন গাঢ় রূপ নেয় তাতেই বাধে বিপত্তি। স্ত্রীর ‘অবৈধ’ সম্পর্কটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না রথীশ। স্বামীর বাধা পেয়ে প্রেমিককে নিয়ে দুই মাস ধরে খুনের পরিকল্পনা করেন স্নিগ্ধা। একপর্যায়ে চলতি মাসেই এই আইনজীবী স্বামীকে দুধের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে হত্যা করেন। রথীশচন্দ্র ও স্নিগ্ধার দীর্ঘ সংসার জীবনে অনার্স পড়ুয়া এক ছেলে ও নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি মেয়ে রয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কুদরত আলী নামে এক ঘটককে গলা কেটে হত্যা করেছে তার স্ত্রী মাছুরা খাতুন। দীর্ঘ দিনের সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না তাদের। জানা গেছে, দুজনের মাঝে বোঝাপড়ার অনেক অভাব ছিল। কিন্তু কখনো সমাধানের পথে হাঁটতে চাননি মাছুমা। বরং পাশের এলাকার আরিফ নামের এক যুবকের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। দিনকে দিন সে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়টি লোক মারফত জানতে পারেন কুদরত। এ নিয়ে একাধিকবার সতর্ক করেছেন তিনি। এমনকি প্রেমিক আরিফকেও নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাতেও কাজ হয়নি। বরং হিংস্র হয়ে উঠে মাছুমা। স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করে পালিয়ে যায় সে।
চলতি বছরের ১৮ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় সাভারের জামসিং সোলায়মান মার্কেট এলাকায় সিদ্দিক মিয়ার বাড়িতে দিনমজুর স্বামী মোহাম্মদ হোসেন আলী ঘুমন্ত স্ত্রী মারুফাকে গলা কেটে হত্যা করে। এ ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জানা যায়, মোহাম্মদ হোসেন আলী এক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। বিষয়টি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া বিবাধ লেগে থাকতো। কিন্তু মারুফার প্রতিদিনের ঝগড়া যেন বিষের মতো হয়ে উঠেছিল হোসেন আলীর কাছে। একপর্যায়ে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে গিয়ে স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যা করে হোসেন আলী।
গত ৭ই ফেব্রুয়ারি প্রবাসী স্বামীকে হত্যা করে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে স্ত্রী। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের পুটিমারা গ্রামে ঘটে এই ঘটনা। সকালে থানায় ঢুকেই পুলিশকে বলে, আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি। আপনারা আমাকে গ্রেপ্তার করুন। মধ্য বয়সী এই নারীর কথা শুনে চমকে উঠেন থানার পুলিশ সদস্যরা। আটক করা হয় ওই নারীকে। তার কথানুসারেই বসত ঘরের বারান্দা থেকে উদ্ধার করা হয় স্বামী অলিউল্লাহ’র লাশ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে চাকরি করছেন অলিউল্লাহ। প্রবাসের আয় দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী মাজেদা বেগমের নামে অর্ধকোটি টাকা মূল্যের জমি কিনেছেন তিনি। গত তিন মাস আগে দেশে ফেরার পর মাজেদার সন্দেহ হয় তার স্বামী সৌদিতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এই সন্দেহ থেকেই কলহের সৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত ঘুমন্ত স্বামীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে স্ত্রী মাজেদা। এ হত্যার পেছনেও ছিল তার পরকীয়া।
পরকীয়ার কারণে এমন হত্যাকাণ্ড দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা এবং প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। সমাজে বিজ্ঞজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা এবং গণমাধ্যমও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, পরকীয়ার কারণে খুন বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বহুগামিতা, ভালোবাসার বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়া, ধর্মীয় মূল্যবোধ না থাকা। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর ওপর বেশি জোর দিতে হবে। আর সে সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে হবে। স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে প্রচুর সময় দিতে হবে। একই সঙ্গে সন্তানদের প্রতিও তাদের যত্নবান হতে হবে। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার, স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে ভালোবাসার মাধ্যমেই তাদের ফেরাতে হবে। তাছাড়া কিছুতে এ ধরনের সম্পর্কের কারণে মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা বাড়তেই থাকবে। মানুষ আরো হিংস্র হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন. পরকীয়া এক ধরনের সম্পর্ক। কিন্তু এটা আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গা থেকে গ্রহণ করতে পারি না। আইনের দিক থেকে জোরালো কোনো বাধা না থাকলেও সামাজিকভাবে এর বড় একটা বাধা রয়েছে। একই সমাজে চলতে গেলে কারো প্রতি ভালো লাগা বা মন্দলাগা তৈরি হতেই পারে। তবে যদি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে অন্য কোনো সম্পর্ক চলে আসে তাহলে সেটা নিয়ে ঝামেলায় না গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত। একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর মধ্যে বিশেষ করে স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কে শেয়ারিংয়ের জায়গাটি একেবারেই নেই। যে কারণে এত দ্বন্দ্ব। এত নৃশংসতা। যতদিন পর্যন্ত এ সমস্যা দূর করতে না পারবে ততদিন এটা চলতে থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহরিয়ার আফরিন বলেন, আমরা আধুনিক হয়ে যাচ্ছি। সবাই স্বাধীন। কোনো বাধা ছাড়াই আমরা ঘোরাফেরা করতে পারি। যখন যা খুশি করতে পারি। এসব তো রয়েছেই, তার সঙ্গে নতুন সংযোজন হিসেবে আছে সোশ্যাল মিডিয়া। খুব সহজেই আমরা একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছি। একটি সম্পর্ক তৈরি করে ফেলছি। ভাবছি না সেটা সঠিক না ভুল। আর নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তো ঘটছেই। বড় কথা আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকেই সরে যাচ্ছি দিন দিন। আর এসব কারণেই পরকীয়া বাড়ছে। বাড়ছে নৃশংসতা। এই নৃশংসতা থেকে নিজেদের রেহাই পেতে হলে সবার আগে মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সংসারে বন্ধনের জায়গাটি অটুট রাখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.