ইইউর রুলিং, হিজাব ও মুসলিম নারী by নিহাদ আল আবেদী
ইউরোপিয়ান
ইউনিয়নের (ইইউ) ঊর্ধ্বতন আদালত ১৪ মার্চ এই মর্মে রুলিং দিয়েছেন যে,
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তাদের স্টাফের ‘দৃশ্যমান ধর্মীয় প্রতীক
ধারণ’ করাকে নিষিদ্ধ করার অধিকার রাখেন। কেউ কেউ বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত
কর্মস্থলে হিজাব পরিহিত নারীর ওপর একটি প্রত্যক্ষ হামলা। অপর দিকে
‘ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস’ বলেছেন, যদি কোনো কোম্পানির নিজস্ব নিয়ম
মোতাবেক, কোনো রাজনৈতিক, আদর্শিক বা ধর্মীয় চিহ্ন ধারণ করা নিষিদ্ধ থাকে,
তাকে ‘প্রত্যক্ষ বৈষম্য’ বলা যায় না।
আদালত ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে দু’জন নারীর মামলায় রায় দিয়েছেন। হিজাব বা মাথার স্কার্ফ সরাতে অস্বীকার করায় তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেক মুসলিম মহিলাই এটা পরিধান করে থাকেন এবং তারা এটাকে তাদের ধর্মের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করেন। আলজাজিরা টিভি চ্যানেল এই রায় বা রুলিং সম্পর্কে চারজন মহিলার বক্তব্য নিয়েছে।
নাদিয়া খেদাশি বলেছেন, এই রায়ের অর্থ, কিভাবে পোশাক পরব, সে অধিকার এবং আমার কাজ পাওয়ার অধিকার, এই দুটোর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। ২৫ বছরের খেদাশি ফ্রান্স এবং ইইউর মধ্যে বৈষম্য নিরসনের প্রকল্পগুলোতে সম্পৃক্ত। তিনি ফোরাম অব ইউরোপিয়ান মুসলিম ইয়ুথ অ্যান্ড স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের স্বেচ্ছাসেবী এবং ফ্রান্সের মুসলিম শিক্ষার্থী সংগঠনের সদস্যা।
তিনি বলেন, ফ্রান্সের মানুষের মন দখল করে আছে হিজাব ইস্যু। আদালতের রায় থেকে দেখা যায়Ñ অন্তর্ভুক্তিমূলক নারীবাদ ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো কাজ করা বাকি, যাতে সব নারীর স্বার্থ রক্ষা করা যায়। দেশটি স্বাধীনতা আর নারীবাদকে ভালোবাসার জন্য সুপরিচিত। মুসলমান হিসেবে অনুভব করছি, আদালতের এই রুলিং আমার অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করার বদলে প্রাত্যহিক জীবনকে আরো কঠিন করে তুলবে। নিজ দেশে আমার নিজের কল্যাণের প্রতি এই রুলিং সরাসরি হুমকি। বর্তমানে ফ্রান্সে কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রকাশ্য স্থানে মাথায় স্কার্ফ দেয়া নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। এই পরিস্থিতিতে আদালতের এমন সিদ্ধান্তের অর্থ, এটা অগ্রযাত্রার পথে কোনো পদক্ষেপ নয়। বরং ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানো বক্তব্য বাড়বে যার টার্গেট নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। বাড়বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধ।
তিনি আরো বলেছেন, আমি একজন ফরাসি নাগরিক। সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছি। আমার দুই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি রয়েছে। তবে আরো অনেকের মতো আমিও অন্য কোনো দেশে স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবছি। কারণ, ফ্রান্সে তো থাকার অনুকূল পরিবেশ নেই। আসলেই যদি কখনো কোনো ফরাসি কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউতে আমাকে ডাকা হয়, আমি জানিÑ মাথার স্কার্ফ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে। তখন আমাকে তা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে, নতুবা চাকরিটা পাওয়ার সুযোগ হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। আমাদের জীবন আরো সমস্যাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, ‘নিজ দেশে পরবাসী’ হয়ে গেছি।
নাদিয়া খেদাশির ভাষায়, আমরা মুসলমানরা খুবই সুসংহত। এ কারণে আমাদের মনে করা হয় ‘একটা সমস্যা’। অতীতে এটা আশা করা হতো না যে, মুসলমানরা ইউনিভার্সিটিতে যাবে; এমনকি, তাদের প্রকাশ্যে দেখা যাওয়াটা পর্যন্ত প্রত্যাশিত ছিল না। আদালত (হিজাব নিয়ে) যে রায় দিলেন, তা বিদ্যমান বৈষম্য বাড়িয়ে দেবে এবং এই বৈষম্যকে আইনগত মদদ জোগাবে। এ ক্ষেত্রে বড় যে ব্যাপার, তা হলোÑ মুসলিম নারীদের এখানে সেখানে চোখে পড়া। প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে কি আমাদের দৃশ্যমান হওয়ার অনুমোদন নেই? এই দৃশ্যমানতা কি অপরাধ?
কোনো কাজের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার দাবি হলো, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী সব গ্রাহককে একই সেবা দেবেন। গ্রাহক কে কিংবা তার পোশাক কেমন, তা মোটেই বিবেচনা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ‘নিরপেক্ষতা’ মানে, সেই অভিন্ন সুযোগ যেখানে নাস্তিক, সংশয়বাদী কিংবা বিশ্বাসী পরস্পরের ভিন্নতা সত্ত্বেও সহাবস্থান করেন। এই নিরপেক্ষতা বজায় রাখা প্রয়োজন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নিরপেক্ষতা বলতে কী বোঝায়? এর আওতা কত দূর পর্যন্ত? যদি নিরপেক্ষতার নামে আমার আমিত্বকে বাধা দেয়া হয়, তা হলে একসাথে থাকা এবং পারস্পরিক মর্যাদাবোধের সাথে এটা কি সঙ্গতিপূর্ণ? পোশাকের কারণে নারীর কাজ করার অধিকার অস্বীকার করা গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা ইউরোপে সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক যে সমাজ চাই, তার সাথেও এটা বেমানান। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ও স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, যে বাগাড়ম্বর বিধিনিষেধ আরোপ করে, তা দিয়ে নারী দেহের মুক্তি আনা কিংবা এর দাবি করা সম্ভব নয়। বর্ণবাদী কুযুক্তি মুক্তি আনতে পারে না। বরং এটা শেখায় নতি স্বীকার করতে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস নাগরিকদের বদলে কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করাকে পছন্দ করছেন।
ওয়ার্দা আল কাদ্দুরি বেলজিয়ামে জাতিসঙ্ঘের যুব প্রতিনিধি ছিলেন ২০১৫ ও ২০১৬তে। তিনি বলেছেন, আমার ছোট বোন ১৮ বছর বয়সে হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন আমার মা-বাবা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের ভয় ছিল, হিজাব পরিধান করলে তাদের সন্তান সমাজে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং হিজাব পছন্দ করার বিষয়টি তার জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে। তাদের আশঙ্কার কারণ, হিজাবের কারণে শিক্ষা ও পেশার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা হারাতে হবে। এমনকি প্রকাশ্যে মৌখিকভাবে অপদস্থ কিংবা দৈহিকভাবে আক্রান্ত হতে হবে। বাস্তবেও সেটা ঘটেছে।
ওয়ার্দা বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বলতে বুঝি, নিজের শরীর সম্পর্কে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা। আজকাল মনে হয়, নারীর শুধু কম পোশাক পরিধানের স্বাধীনতা আছে। অপরদিকে, যে নারী বেশি পোশাক পরিধানকে পছন্দ করে, তার স্বাধীনতা নেই। যদি হিজাব পরার প্রশ্ন আসে, আমি তা করতে চাই চাকরি হারানোর ভীতি ছাড়াই। মাথায় শিফন কাপড়ের একটি টুকরা পরিধান করলে আমার সামর্থ্য ও মেধার রদবদল হবে না।
তিনি বলেছেন, আমি দেখেছিÑ নারী হিজাব পরলে ইন্টার্নশিপ কিংবা চাকরির বেলায় তাকে প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যানের শিকার হতে হয়। দেখেছি, এমন অবস্থায় কিভাবে তারা ধীরে ধীরে উৎসাহ হারিয়ে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন; এমনকি বিষণœতায় ভোগেন। সমাজে অংশ নিতে হলে নারীকে তার কিছু একটা খুলে ফেলতে হবেÑ এমন দাবি কিভাবে করা চলে?
তিনি বলেন, সামাজিক অংশগ্রহণ এবং একাত্মতার জন্য কাজ করার সুযোগ পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের দু’টি দুর্বল অংশ হলো নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর নারী। শ্রমবাজারে তাদের প্রবেশের পথ সুগম করে দেয়া উচিত। তা না করে পর্দানশিন মুসলিম মহিলাদের পথে আরো বাধা তৈরি করা হচ্ছে। সমান সুযোগ পেতে কেন একজন নারীকে তার হিজাব খুলতে হবে?
কাজের ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ওয়ার্দা আল কাদ্দুরি প্রচার চালিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে।
তাঁর ভাষায়, নিরপেক্ষতার মূলনীতি বলতে কী বুঝায়, তা একেক দেশে একক রকম। একজন শিখ ব্রিটেনে পুলিশের চাকরিতে তার ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে পাগড়ি পরতে পারেন। ফ্রান্সের সেক্যুলার সমাজে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে মুসলিম নারীর হিজাব পরিধানের অধিকার নেই। বেলজিয়াম এই দুই মডেলের মাঝামাঝি অবস্থানে। কোনো ব্যক্তি ধর্মীয় প্রতীকরূপী পোশাক পরলেই তার মানে এটা নয় যে, রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হলো। সরকারি কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের বিধিবিধান মোতাবেক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমি এমনকি এ কথাও বলব, দৃশ্যমান ধর্মীয় বৈচিত্র্য আসলে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার সুফল। জোর করে হিজাবের মতো ধর্মীয় প্রতীককে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া নিরপেক্ষতা নয়। তবুও দক্ষিণপন্থী দলগুলো এমন দাবি জানাচ্ছে। বেলজিয়ামও চরম ডানপন্থী, লোকরঞ্জনবাদী ও জাতীয়তাবাদী দল থেকে মুক্ত নয়। রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীসহ যারা জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন, তারা বর্ণবিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য দিচ্ছেন, যা তাদের অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। এটাই যেন ইউরোপে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার আদালতের আলোচ্য রায় আগে থেকেই বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর করল। যেমন, বেলজিয়ামে স্কুল ও সিটি হলের মতো প্রকাশ্য স্থানে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ। এই রায় পেয়ে চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলো তাদের প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাওয়াকে সঠিক বলে বিশ্বাস করছে।
ওয়ার্দা আল কাদ্দুরি আরো বলেন, যেসব মুসলিম মহিলা হিজাব পরিধান করে আসছেন, তারা আগে থেকেই জানেনÑ তাদের চাকরির সুযোগ সীমিত। অভিবাসী মহিলা, যারা হিজাব পরিধান করেন, সামাজিকভাবে তাদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আর কেউ আছেন বলে মনে হয় না। কারণ তারা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, জেন্ডার এবং দৃশ্যমান ধর্মের কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আদালতের সর্বশেষ রুলিং কোম্পানিগুলোকে আইনি সুযোগ দিয়েছে হিজাব থেকে ‘মুক্ত’ হওয়ার জন্য। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস নাগরিকদের নয়, কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করছে।
তিনি আরো বলেছেন, ইউরোপের মুসলমানদের ওপর বর্তমান পরিস্থিতি যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে, তার অবমূল্যায়ন করা চলে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন বেশি থেকে আরো বেশি প্রতিকূল হয়ে উঠছে আমাদের জন্য। এই অবস্থায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্তম্ভতুল্য বিচার বিভাগের ওপর আমার মনের শান্তি নির্ভর করেছিল। অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে ধারণা ছিল, অভিবাসীদের প্রতি চরম বিদ্বেষের মাঝেও আমার মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে পারব। এখন আর সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। একই শঙ্কা দেখতে পাচ্ছি আমার পরিবার, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবসহ অন্যান্য মুসলমানের মাঝেও।
নেদারল্যান্ডসের নাগরিক আইয়া সাবি (২১) একজন লেখক, কলামিস্ট। তিনি বলেছেন, ‘নিরপেক্ষতা’ একটা ভ্রান্তির নাম। যদিও উল্লিখিত রুলিং সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এর সূচনা মুসলিম নারীদের মাথার স্কার্ফের সাথে সংশ্লিষ্ট, এমন এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। বাস্তবেও আমরা দেখছি, স্কার্ফ পরিহিতা মুসলিম নারী এবং শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন এই আইন দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেকের মাথায় মুসলিম ও ইসলাম সম্পর্কে এমন ইমেজ রয়েছে যা এক কথায় ভয়ঙ্কর। তাই মাথার স্কার্ফ তাদের কাছে একটা সমস্যা। এ দিকে কোম্পানিমালিকেরা আশঙ্কা করছেন, তারা গ্রাহক হারাবেন। অনেকের মধ্যে স্কার্ফভীতি সঞ্চারিত হয়েছে। ‘নিরপেক্ষতা’র প্রয়োগ চলছে এভাবেই। আসলে ‘নিরপেক্ষ’ মানে ‘স্বাভাবিক’। এ জন্যই নিরপেক্ষতা গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। অন্য অর্থ বোঝালে ‘নিরপেক্ষতা’ গ্রহণীয় নয়। আদালত রুলিং দিয়ে বলতে চাইছেন, মুসলমানরা স্বাভাবিক নয়, তারা এখানকার নয়; তাই তাদের গ্রহণ করা যায় না।
আইয়া সাবি বলেছেন, যদি স্কার্ফ পরিহিত কোনো নারী কাউন্টারে থাকে, আপনার সাথে কাজ করে, অথবা শিক্ষা দেয় আপনাকে, সে যে কাজই করুক না কেন, সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হলোÑ সে তার নিজের শরীরের বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ কারণে স্কার্ফ দিয়ে চুল ঢেকে রেখেছে। এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। তাই তাকে স্কার্ফ পরতে নিষেধ করার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করার অধিকারও কারো নেই। মুসলমান মহিলাদের জন্য মাথার হিজাব নিছক অনুষঙ্গ নয়, এটা তাদের বিশ্বাসের অংশ।
ইলক নূর কুজুম (৩৮) তুর্কি বংশোদ্ভূত লেখিকা। তিনি বলেছেন, আমার ১১ বছরের মেয়ে আমাকে একদিন বলল, আম্মু, স্কার্ফ মাথায় দিয়ে লেখাপড়া করার জন্য আমাকে কি জার্মানি ছেড়ে যেতে হবে, যেভাবে একদিন পড়াশোনার উদ্দেশ্যে তোমাকে স্বদেশ ছাড়তে হয়েছিল? বললাম, ‘মা তোমাকে তা করতে হবে না। মাথায় স্কার্ফ পরেই তুমি জার্মানিতে পড়াশোনা ও কাজ করতে পারবে। চিন্তা করো না।’ কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত নই, সে এ দেশে এটা করতে পারবে কি না। ২০ বছর আগে তুরস্কে মাথার স্কার্ফকে সমস্যা মনে করা হতো। তাই স্কার্ফ পরিধান করে পড়াশোনার জন্য আমাকে তুরস্ক ছেড়ে আসতে হয়েছিল। ধর্মবিশ্বাসের কারণে যাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে, আমি তাদের একজন। এবার ইউরোপের কোর্ট অব জাস্টিস যে রায় দিলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যখন নেদারল্যান্ডর ফ্রান্স আর জার্মানিতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মওসুম, তখন এই রায় এসেছে।
জার্মান প্রবাসী এই মহিলা বলেন, সাম্প্রতিককালে চরম দক্ষিণপন্থী ‘পাশ্চাত্যের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক ইউরোপিয়ান’ বা ‘পেজিডা’ সংগঠনের সাথে জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টিও ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চরমপন্থী দল বা আন্দোলনের উত্থান থামানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কোর্টের ওই রুলিং যতটা আইনগত, এর চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।
তিনি বলেছেন, মুসলিম নারীর কাছে হিজাব হলো বিশ্বাসের অঙ্গ। তাই মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের মতো এটাও বদলানো যায় না। এর ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের চাকরি ও ব্যবসা থেকে বঞ্চিত করবে। জার্মানিতে যারা হিজাব নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী, তাদের বেশির ভাগের ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে তেমন জ্ঞান নেই। একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। আমার কয়েকজন জার্মান প্রতিবেশী ছিলেন যারা কোনো দিন কোনো মুসলমানের বাসায় যাননি। যখন তাদের ঘনিষ্ঠ হলাম, তারা আমাকে ইসলাম ও মুসলিম নারী সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘স্বীকার করছি, আমরা এত দিন মুসলমানদের সম্পর্কে জানতাম না।’
দুর্ভাগ্য হলো, হিজাবের নিষেধাজ্ঞা জার্মানির চার মিলিয়নেরও বেশি মুসলমানের বিরুদ্ধে বৈষম্য বাড়াবে।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
আদালত ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে দু’জন নারীর মামলায় রায় দিয়েছেন। হিজাব বা মাথার স্কার্ফ সরাতে অস্বীকার করায় তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেক মুসলিম মহিলাই এটা পরিধান করে থাকেন এবং তারা এটাকে তাদের ধর্মের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করেন। আলজাজিরা টিভি চ্যানেল এই রায় বা রুলিং সম্পর্কে চারজন মহিলার বক্তব্য নিয়েছে।
নাদিয়া খেদাশি বলেছেন, এই রায়ের অর্থ, কিভাবে পোশাক পরব, সে অধিকার এবং আমার কাজ পাওয়ার অধিকার, এই দুটোর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। ২৫ বছরের খেদাশি ফ্রান্স এবং ইইউর মধ্যে বৈষম্য নিরসনের প্রকল্পগুলোতে সম্পৃক্ত। তিনি ফোরাম অব ইউরোপিয়ান মুসলিম ইয়ুথ অ্যান্ড স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের স্বেচ্ছাসেবী এবং ফ্রান্সের মুসলিম শিক্ষার্থী সংগঠনের সদস্যা।
তিনি বলেন, ফ্রান্সের মানুষের মন দখল করে আছে হিজাব ইস্যু। আদালতের রায় থেকে দেখা যায়Ñ অন্তর্ভুক্তিমূলক নারীবাদ ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো কাজ করা বাকি, যাতে সব নারীর স্বার্থ রক্ষা করা যায়। দেশটি স্বাধীনতা আর নারীবাদকে ভালোবাসার জন্য সুপরিচিত। মুসলমান হিসেবে অনুভব করছি, আদালতের এই রুলিং আমার অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করার বদলে প্রাত্যহিক জীবনকে আরো কঠিন করে তুলবে। নিজ দেশে আমার নিজের কল্যাণের প্রতি এই রুলিং সরাসরি হুমকি। বর্তমানে ফ্রান্সে কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রকাশ্য স্থানে মাথায় স্কার্ফ দেয়া নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। এই পরিস্থিতিতে আদালতের এমন সিদ্ধান্তের অর্থ, এটা অগ্রযাত্রার পথে কোনো পদক্ষেপ নয়। বরং ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানো বক্তব্য বাড়বে যার টার্গেট নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। বাড়বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংস অপরাধ।
তিনি আরো বলেছেন, আমি একজন ফরাসি নাগরিক। সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছি। আমার দুই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি রয়েছে। তবে আরো অনেকের মতো আমিও অন্য কোনো দেশে স্থায়ীভাবে থাকার কথা ভাবছি। কারণ, ফ্রান্সে তো থাকার অনুকূল পরিবেশ নেই। আসলেই যদি কখনো কোনো ফরাসি কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউতে আমাকে ডাকা হয়, আমি জানিÑ মাথার স্কার্ফ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে। তখন আমাকে তা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে, নতুবা চাকরিটা পাওয়ার সুযোগ হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। আমাদের জীবন আরো সমস্যাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, ‘নিজ দেশে পরবাসী’ হয়ে গেছি।
নাদিয়া খেদাশির ভাষায়, আমরা মুসলমানরা খুবই সুসংহত। এ কারণে আমাদের মনে করা হয় ‘একটা সমস্যা’। অতীতে এটা আশা করা হতো না যে, মুসলমানরা ইউনিভার্সিটিতে যাবে; এমনকি, তাদের প্রকাশ্যে দেখা যাওয়াটা পর্যন্ত প্রত্যাশিত ছিল না। আদালত (হিজাব নিয়ে) যে রায় দিলেন, তা বিদ্যমান বৈষম্য বাড়িয়ে দেবে এবং এই বৈষম্যকে আইনগত মদদ জোগাবে। এ ক্ষেত্রে বড় যে ব্যাপার, তা হলোÑ মুসলিম নারীদের এখানে সেখানে চোখে পড়া। প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে কি আমাদের দৃশ্যমান হওয়ার অনুমোদন নেই? এই দৃশ্যমানতা কি অপরাধ?
কোনো কাজের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার দাবি হলো, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী সব গ্রাহককে একই সেবা দেবেন। গ্রাহক কে কিংবা তার পোশাক কেমন, তা মোটেই বিবেচনা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ‘নিরপেক্ষতা’ মানে, সেই অভিন্ন সুযোগ যেখানে নাস্তিক, সংশয়বাদী কিংবা বিশ্বাসী পরস্পরের ভিন্নতা সত্ত্বেও সহাবস্থান করেন। এই নিরপেক্ষতা বজায় রাখা প্রয়োজন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নিরপেক্ষতা বলতে কী বোঝায়? এর আওতা কত দূর পর্যন্ত? যদি নিরপেক্ষতার নামে আমার আমিত্বকে বাধা দেয়া হয়, তা হলে একসাথে থাকা এবং পারস্পরিক মর্যাদাবোধের সাথে এটা কি সঙ্গতিপূর্ণ? পোশাকের কারণে নারীর কাজ করার অধিকার অস্বীকার করা গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা ইউরোপে সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক যে সমাজ চাই, তার সাথেও এটা বেমানান। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ও স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, যে বাগাড়ম্বর বিধিনিষেধ আরোপ করে, তা দিয়ে নারী দেহের মুক্তি আনা কিংবা এর দাবি করা সম্ভব নয়। বর্ণবাদী কুযুক্তি মুক্তি আনতে পারে না। বরং এটা শেখায় নতি স্বীকার করতে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস নাগরিকদের বদলে কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করাকে পছন্দ করছেন।
ওয়ার্দা আল কাদ্দুরি বেলজিয়ামে জাতিসঙ্ঘের যুব প্রতিনিধি ছিলেন ২০১৫ ও ২০১৬তে। তিনি বলেছেন, আমার ছোট বোন ১৮ বছর বয়সে হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন আমার মা-বাবা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের ভয় ছিল, হিজাব পরিধান করলে তাদের সন্তান সমাজে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং হিজাব পছন্দ করার বিষয়টি তার জন্য বোঝা হয়ে দেখা দেবে। তাদের আশঙ্কার কারণ, হিজাবের কারণে শিক্ষা ও পেশার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা হারাতে হবে। এমনকি প্রকাশ্যে মৌখিকভাবে অপদস্থ কিংবা দৈহিকভাবে আক্রান্ত হতে হবে। বাস্তবেও সেটা ঘটেছে।
ওয়ার্দা বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বলতে বুঝি, নিজের শরীর সম্পর্কে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা। আজকাল মনে হয়, নারীর শুধু কম পোশাক পরিধানের স্বাধীনতা আছে। অপরদিকে, যে নারী বেশি পোশাক পরিধানকে পছন্দ করে, তার স্বাধীনতা নেই। যদি হিজাব পরার প্রশ্ন আসে, আমি তা করতে চাই চাকরি হারানোর ভীতি ছাড়াই। মাথায় শিফন কাপড়ের একটি টুকরা পরিধান করলে আমার সামর্থ্য ও মেধার রদবদল হবে না।
তিনি বলেছেন, আমি দেখেছিÑ নারী হিজাব পরলে ইন্টার্নশিপ কিংবা চাকরির বেলায় তাকে প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যানের শিকার হতে হয়। দেখেছি, এমন অবস্থায় কিভাবে তারা ধীরে ধীরে উৎসাহ হারিয়ে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন; এমনকি বিষণœতায় ভোগেন। সমাজে অংশ নিতে হলে নারীকে তার কিছু একটা খুলে ফেলতে হবেÑ এমন দাবি কিভাবে করা চলে?
তিনি বলেন, সামাজিক অংশগ্রহণ এবং একাত্মতার জন্য কাজ করার সুযোগ পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের দু’টি দুর্বল অংশ হলো নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর নারী। শ্রমবাজারে তাদের প্রবেশের পথ সুগম করে দেয়া উচিত। তা না করে পর্দানশিন মুসলিম মহিলাদের পথে আরো বাধা তৈরি করা হচ্ছে। সমান সুযোগ পেতে কেন একজন নারীকে তার হিজাব খুলতে হবে?
কাজের ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ওয়ার্দা আল কাদ্দুরি প্রচার চালিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে।
তাঁর ভাষায়, নিরপেক্ষতার মূলনীতি বলতে কী বুঝায়, তা একেক দেশে একক রকম। একজন শিখ ব্রিটেনে পুলিশের চাকরিতে তার ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে পাগড়ি পরতে পারেন। ফ্রান্সের সেক্যুলার সমাজে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে মুসলিম নারীর হিজাব পরিধানের অধিকার নেই। বেলজিয়াম এই দুই মডেলের মাঝামাঝি অবস্থানে। কোনো ব্যক্তি ধর্মীয় প্রতীকরূপী পোশাক পরলেই তার মানে এটা নয় যে, রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হলো। সরকারি কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের বিধিবিধান মোতাবেক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমি এমনকি এ কথাও বলব, দৃশ্যমান ধর্মীয় বৈচিত্র্য আসলে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার সুফল। জোর করে হিজাবের মতো ধর্মীয় প্রতীককে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া নিরপেক্ষতা নয়। তবুও দক্ষিণপন্থী দলগুলো এমন দাবি জানাচ্ছে। বেলজিয়ামও চরম ডানপন্থী, লোকরঞ্জনবাদী ও জাতীয়তাবাদী দল থেকে মুক্ত নয়। রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীসহ যারা জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন, তারা বর্ণবিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য দিচ্ছেন, যা তাদের অজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। এটাই যেন ইউরোপে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার আদালতের আলোচ্য রায় আগে থেকেই বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর করল। যেমন, বেলজিয়ামে স্কুল ও সিটি হলের মতো প্রকাশ্য স্থানে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ। এই রায় পেয়ে চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলো তাদের প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাওয়াকে সঠিক বলে বিশ্বাস করছে।
ওয়ার্দা আল কাদ্দুরি আরো বলেন, যেসব মুসলিম মহিলা হিজাব পরিধান করে আসছেন, তারা আগে থেকেই জানেনÑ তাদের চাকরির সুযোগ সীমিত। অভিবাসী মহিলা, যারা হিজাব পরিধান করেন, সামাজিকভাবে তাদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আর কেউ আছেন বলে মনে হয় না। কারণ তারা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, জেন্ডার এবং দৃশ্যমান ধর্মের কারণে বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আদালতের সর্বশেষ রুলিং কোম্পানিগুলোকে আইনি সুযোগ দিয়েছে হিজাব থেকে ‘মুক্ত’ হওয়ার জন্য। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস নাগরিকদের নয়, কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করছে।
তিনি আরো বলেছেন, ইউরোপের মুসলমানদের ওপর বর্তমান পরিস্থিতি যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে, তার অবমূল্যায়ন করা চলে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন বেশি থেকে আরো বেশি প্রতিকূল হয়ে উঠছে আমাদের জন্য। এই অবস্থায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্তম্ভতুল্য বিচার বিভাগের ওপর আমার মনের শান্তি নির্ভর করেছিল। অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে ধারণা ছিল, অভিবাসীদের প্রতি চরম বিদ্বেষের মাঝেও আমার মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্য আইনি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে পারব। এখন আর সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। একই শঙ্কা দেখতে পাচ্ছি আমার পরিবার, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবসহ অন্যান্য মুসলমানের মাঝেও।
নেদারল্যান্ডসের নাগরিক আইয়া সাবি (২১) একজন লেখক, কলামিস্ট। তিনি বলেছেন, ‘নিরপেক্ষতা’ একটা ভ্রান্তির নাম। যদিও উল্লিখিত রুলিং সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এর সূচনা মুসলিম নারীদের মাথার স্কার্ফের সাথে সংশ্লিষ্ট, এমন এক ঘটনার মধ্য দিয়ে। বাস্তবেও আমরা দেখছি, স্কার্ফ পরিহিতা মুসলিম নারী এবং শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন এই আইন দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেকের মাথায় মুসলিম ও ইসলাম সম্পর্কে এমন ইমেজ রয়েছে যা এক কথায় ভয়ঙ্কর। তাই মাথার স্কার্ফ তাদের কাছে একটা সমস্যা। এ দিকে কোম্পানিমালিকেরা আশঙ্কা করছেন, তারা গ্রাহক হারাবেন। অনেকের মধ্যে স্কার্ফভীতি সঞ্চারিত হয়েছে। ‘নিরপেক্ষতা’র প্রয়োগ চলছে এভাবেই। আসলে ‘নিরপেক্ষ’ মানে ‘স্বাভাবিক’। এ জন্যই নিরপেক্ষতা গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। অন্য অর্থ বোঝালে ‘নিরপেক্ষতা’ গ্রহণীয় নয়। আদালত রুলিং দিয়ে বলতে চাইছেন, মুসলমানরা স্বাভাবিক নয়, তারা এখানকার নয়; তাই তাদের গ্রহণ করা যায় না।
আইয়া সাবি বলেছেন, যদি স্কার্ফ পরিহিত কোনো নারী কাউন্টারে থাকে, আপনার সাথে কাজ করে, অথবা শিক্ষা দেয় আপনাকে, সে যে কাজই করুক না কেন, সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হলোÑ সে তার নিজের শরীরের বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ কারণে স্কার্ফ দিয়ে চুল ঢেকে রেখেছে। এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। তাই তাকে স্কার্ফ পরতে নিষেধ করার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করার অধিকারও কারো নেই। মুসলমান মহিলাদের জন্য মাথার হিজাব নিছক অনুষঙ্গ নয়, এটা তাদের বিশ্বাসের অংশ।
ইলক নূর কুজুম (৩৮) তুর্কি বংশোদ্ভূত লেখিকা। তিনি বলেছেন, আমার ১১ বছরের মেয়ে আমাকে একদিন বলল, আম্মু, স্কার্ফ মাথায় দিয়ে লেখাপড়া করার জন্য আমাকে কি জার্মানি ছেড়ে যেতে হবে, যেভাবে একদিন পড়াশোনার উদ্দেশ্যে তোমাকে স্বদেশ ছাড়তে হয়েছিল? বললাম, ‘মা তোমাকে তা করতে হবে না। মাথায় স্কার্ফ পরেই তুমি জার্মানিতে পড়াশোনা ও কাজ করতে পারবে। চিন্তা করো না।’ কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত নই, সে এ দেশে এটা করতে পারবে কি না। ২০ বছর আগে তুরস্কে মাথার স্কার্ফকে সমস্যা মনে করা হতো। তাই স্কার্ফ পরিধান করে পড়াশোনার জন্য আমাকে তুরস্ক ছেড়ে আসতে হয়েছিল। ধর্মবিশ্বাসের কারণে যাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে, আমি তাদের একজন। এবার ইউরোপের কোর্ট অব জাস্টিস যে রায় দিলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যখন নেদারল্যান্ডর ফ্রান্স আর জার্মানিতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মওসুম, তখন এই রায় এসেছে।
জার্মান প্রবাসী এই মহিলা বলেন, সাম্প্রতিককালে চরম দক্ষিণপন্থী ‘পাশ্চাত্যের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক ইউরোপিয়ান’ বা ‘পেজিডা’ সংগঠনের সাথে জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টিও ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চরমপন্থী দল বা আন্দোলনের উত্থান থামানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কোর্টের ওই রুলিং যতটা আইনগত, এর চেয়ে বেশি রাজনৈতিক।
তিনি বলেছেন, মুসলিম নারীর কাছে হিজাব হলো বিশ্বাসের অঙ্গ। তাই মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের মতো এটাও বদলানো যায় না। এর ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের চাকরি ও ব্যবসা থেকে বঞ্চিত করবে। জার্মানিতে যারা হিজাব নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী, তাদের বেশির ভাগের ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে তেমন জ্ঞান নেই। একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। আমার কয়েকজন জার্মান প্রতিবেশী ছিলেন যারা কোনো দিন কোনো মুসলমানের বাসায় যাননি। যখন তাদের ঘনিষ্ঠ হলাম, তারা আমাকে ইসলাম ও মুসলিম নারী সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘স্বীকার করছি, আমরা এত দিন মুসলমানদের সম্পর্কে জানতাম না।’
দুর্ভাগ্য হলো, হিজাবের নিষেধাজ্ঞা জার্মানির চার মিলিয়নেরও বেশি মুসলমানের বিরুদ্ধে বৈষম্য বাড়াবে।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
No comments