গণিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ by মাহবুব মজুমদার
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী বাংলাদেশি দল |
‘শিক্ষা
ক্ষেত্রে, গণিতে বাংলাদেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে শীর্ষে
চলে আসবে—এটি অবিশ্বাস্য,’ বললেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য
অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ।
বস্তুত, কয়েক দিন আগে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াডে’ (আইএমও) বাংলাদেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশকে পরাজিত করেছে। ক্রিকেট খেলায় ভারতকে পরাজিত করা নিঃসন্দেহে একটি বড় আনন্দ ও গর্বের বিষয় ছিল। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গণিতে ভারতকে পরাজিত করা সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো যে শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের সত্যিকারের প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীরা ভারতের মতো প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ছেলেমেয়েদের শুধু সমতুল্য নয়, তাদের থেকে সেরাও হতে পারে।
আইএমও একটি অত্যন্ত কঠিন প্রতিযোগিতা। এটি গণিতের অত্যন্ত জটিল সমস্যা সমাধানের প্রতিযোগিতা, যা ‘এ’ বা ‘ও’ লেভেল অথবা এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার মতো নয়। গণিতশাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের অনেকেও এর কঠিন সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন না। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ যখন প্রথম এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তখন দেশের অনেক বরেণ্য গণিতবিদই এ উদ্যোগ সম্পর্কে আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। তাঁদের ধারণা ছিল যে বাংলাদেশের কোনো ছাত্রছাত্রীর পক্ষেই আইএমওর প্রতিযোগিতায় দেওয়া ছয়টি সমস্যার একটিরও সমাধান করা সম্ভব নয়। সেই বছরের প্রতিযোগিতায় ২৫২ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ৩।
কিন্তু এই বছর আমাদের একজন ছাত্র প্রায় চারটি এবং আরেকজন তিনটি সমস্যার সমাধান করে। ফলে আমাদের সানজিদ আনোয়ার রৌপ্যপদক এবং অন্য চারজন আদিব হাসান, আসিফ-ই-এলাহী, সাব্বির রহমান ও সাজিদ আকতার ব্রোঞ্জ মেডেল পায়। এ ছাড়া নাঈমুল ইসলাম পায় সম্মানজনক স্বীকৃতি। এবারের বাংলাদেশের মোট নম্বর ছিল ৯৭ এবং ভারতের ৮৬। প্রতিযোগী ১০৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩ এবং ভারতের ৩৭।
এই প্রতিযোগিতা দুই দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। এর জন্য প্রতিদিন সাড়ে চার ঘণ্টার পরীক্ষা দিতে হয়। প্রত্যেককে ছয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং প্রতিটি প্রশ্নের মান ৭। একজন প্রতিযোগীর সর্বোচ্চ নম্বর হতে পারে ৪২। পরীক্ষার পরের তিন দিন একটি অতি কঠিন চাপ সৃষ্টিকারী পরিবেশে পরীক্ষার খাতা দেখা হয়। এ সময় পরীক্ষার্থীদের টিম লিডার এবং স্বাগতিক দেশের পরীক্ষকদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়।
এই প্রতিযোগিতায় শ খানেক দেশ অংশ নেয়। প্রতিটি টিমে ছয়জন প্রতিযোগী থাকে। মোট ১২ দিনের এই অনুষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি অংশ নেয়। এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে দুই মিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় হয়। এর জন্য গুগল প্রতিবছর এক মিলিয়ন ডলার দান করে থাকে।
বাংলাদেশের এবারের অভূতপূর্ব সাফল্য থেকে কি বলা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা ভারতের সমতুল্য? কোনোভাবেই না। এমনকি কাছাকাছিও না। ভারতের অনেক বেশি মেধাবী ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তারা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। তারা অনেক বেশি উঁচুমানের বিজ্ঞানী সৃষ্টি করে। তবে এবারের সফলতা থেকে সুস্পষ্ট হলো যে যদি চায় বাংলাদেশও বিশ্বমানের প্রতিভা ও বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। সফলতাও দেখাতে পারে।
বাংলাদেশের অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও বাংলাদেশ ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড কেন এত সফল? এর প্রথম কারণ হলো এটি একটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাব্রতী প্রচেষ্টা। কেউ এর থেকে কোনো অর্থকড়ি পায় না। এর ফলে এতে স্বার্থান্বেষীদের কোনো রকম সম্পৃক্ততা নেই।
দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে একদল সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও অত্যন্ত নিবেদিত ব্যক্তি জড়িত। অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অন্য সদস্যরা বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করার ব্যাপারে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুনির হাসানের নিষ্ঠা অতুলনীয় এবং তিনি একজন অসাধারণ সংগঠক। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এতে বটবৃক্ষের ভূমিকা পালন করেছেন। এর সঙ্গে জড়িত নূর মোহাম্মদ শফিউল্লা, মাসুম বিলাল, জাহিদুল হাসান, মির্জা তানজিম মুগ্ধ, কাজী হাসান জোবায়ের, সিদ্দিকুর রহমানের মতো আরও অনেক নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাব্রতী ও সাবেক ছাত্র, যাঁরা প্রতিযোগীদের প্রশিক্ষণ দেন ও প্রস্তুত করেন। এ ছাড়া দ্য ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারের সঙ্গে জড়িত একদল স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ ‘গণিত উৎসব’কে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই অনন্য উদ্যোগ অবশ্য শুরুই হতো না প্রথম আলোর প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়া। অন্যদিকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে জাতীয় গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াডের ব্যাপক প্রসার কঠিন হতো।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ১০ বছর ধরে আইএমওর ন্যাশনাল কোচ ও দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমি যে দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়েছি তা হলো আমাদের তরুণেরা পারে এবং তাদের জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি তাদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি। এক কথায়, ১৬ বছর বয়সে আমি নিজে যেমন ছিলাম, আমি তাদের সেভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমি নিজে বহু গণিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি এবং অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তাই আমি মেধাবী তরুণদের মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত এবং আমি জানি, তাদের পক্ষে সব অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। আমি জানি, যথাযথভাবে পরিচর্যা এবং উৎসাহিত করলে কোনো বাধাই তাদের জন্য অনতিক্রম্য নয়। দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের বিশ্বাস ও আস্থার অভাবই আমি লক্ষ করেছি বাংলাদেশের অনেক শিক্ষকের মধ্যে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত ছেলেমেয়েরা অনেক দিক থেকেই এইচএসসি এবং ও লেভেল পাস করা ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর। তারা কঠিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অনেক বেশি দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। এর ফলে তাদের অনেকেই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা এমআইটিসহ আরও অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। এদের একজন এমনকি কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে হার্ভার্ডে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। আমি নিশ্চিত, এরাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যথাযথ গণিত ও বিজ্ঞানের সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। এদের অনেকেই এখন গণিত সম্পর্কিত বিষয়ে পিএইচডি শুরু করছে এবং গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ছাত্রদের উৎসাহ দিচ্ছে।
আমি বিশ্বাস করি যে একটি সমাজ তখনই দ্রুত এগিয়ে যায়, যখন তাদের সবচেয়ে মেধাবী তরুণদের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে এবং তাদের মধ্যে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতার সৃষ্টি হয়। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণেরা উপেক্ষিত থেকে যায় এবং তাদের যথাযথভাবে পরিচর্যা করা হয় না। গণিত অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের সেই অভাব পূরণ করারই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত, যাতে আমাদের তরুণেরা অন্য যেকোনো দেশের প্রতিযোগীদের পরাজিত করতে পারে। তাই বাংলাদেশের তরুণেরা আজ শুধু ক্রিকেটের মতো প্রতিযোগিতায় নয়, বরং শিক্ষা ক্ষেত্রের অতি মর্যাদাবান প্রতিযোগিতায় হারাতে পারে।
ড. মাহবুব মজুমদার: অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড টিমের জাতীয় কোচ ও দলনেতা।
বস্তুত, কয়েক দিন আগে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াডে’ (আইএমও) বাংলাদেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশকে পরাজিত করেছে। ক্রিকেট খেলায় ভারতকে পরাজিত করা নিঃসন্দেহে একটি বড় আনন্দ ও গর্বের বিষয় ছিল। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গণিতে ভারতকে পরাজিত করা সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো যে শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের সত্যিকারের প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীরা ভারতের মতো প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ছেলেমেয়েদের শুধু সমতুল্য নয়, তাদের থেকে সেরাও হতে পারে।
আইএমও একটি অত্যন্ত কঠিন প্রতিযোগিতা। এটি গণিতের অত্যন্ত জটিল সমস্যা সমাধানের প্রতিযোগিতা, যা ‘এ’ বা ‘ও’ লেভেল অথবা এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার মতো নয়। গণিতশাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের অনেকেও এর কঠিন সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন না। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ যখন প্রথম এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তখন দেশের অনেক বরেণ্য গণিতবিদই এ উদ্যোগ সম্পর্কে আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। তাঁদের ধারণা ছিল যে বাংলাদেশের কোনো ছাত্রছাত্রীর পক্ষেই আইএমওর প্রতিযোগিতায় দেওয়া ছয়টি সমস্যার একটিরও সমাধান করা সম্ভব নয়। সেই বছরের প্রতিযোগিতায় ২৫২ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ৩।
কিন্তু এই বছর আমাদের একজন ছাত্র প্রায় চারটি এবং আরেকজন তিনটি সমস্যার সমাধান করে। ফলে আমাদের সানজিদ আনোয়ার রৌপ্যপদক এবং অন্য চারজন আদিব হাসান, আসিফ-ই-এলাহী, সাব্বির রহমান ও সাজিদ আকতার ব্রোঞ্জ মেডেল পায়। এ ছাড়া নাঈমুল ইসলাম পায় সম্মানজনক স্বীকৃতি। এবারের বাংলাদেশের মোট নম্বর ছিল ৯৭ এবং ভারতের ৮৬। প্রতিযোগী ১০৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩ এবং ভারতের ৩৭।
এই প্রতিযোগিতা দুই দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। এর জন্য প্রতিদিন সাড়ে চার ঘণ্টার পরীক্ষা দিতে হয়। প্রত্যেককে ছয়টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং প্রতিটি প্রশ্নের মান ৭। একজন প্রতিযোগীর সর্বোচ্চ নম্বর হতে পারে ৪২। পরীক্ষার পরের তিন দিন একটি অতি কঠিন চাপ সৃষ্টিকারী পরিবেশে পরীক্ষার খাতা দেখা হয়। এ সময় পরীক্ষার্থীদের টিম লিডার এবং স্বাগতিক দেশের পরীক্ষকদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়।
এই প্রতিযোগিতায় শ খানেক দেশ অংশ নেয়। প্রতিটি টিমে ছয়জন প্রতিযোগী থাকে। মোট ১২ দিনের এই অনুষ্ঠানে প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি অংশ নেয়। এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে দুই মিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় হয়। এর জন্য গুগল প্রতিবছর এক মিলিয়ন ডলার দান করে থাকে।
বাংলাদেশের এবারের অভূতপূর্ব সাফল্য থেকে কি বলা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা ভারতের সমতুল্য? কোনোভাবেই না। এমনকি কাছাকাছিও না। ভারতের অনেক বেশি মেধাবী ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তারা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে। তারা অনেক বেশি উঁচুমানের বিজ্ঞানী সৃষ্টি করে। তবে এবারের সফলতা থেকে সুস্পষ্ট হলো যে যদি চায় বাংলাদেশও বিশ্বমানের প্রতিভা ও বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। সফলতাও দেখাতে পারে।
বাংলাদেশের অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও বাংলাদেশ ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড কেন এত সফল? এর প্রথম কারণ হলো এটি একটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাব্রতী প্রচেষ্টা। কেউ এর থেকে কোনো অর্থকড়ি পায় না। এর ফলে এতে স্বার্থান্বেষীদের কোনো রকম সম্পৃক্ততা নেই।
দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে একদল সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও অত্যন্ত নিবেদিত ব্যক্তি জড়িত। অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অন্য সদস্যরা বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করার ব্যাপারে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুনির হাসানের নিষ্ঠা অতুলনীয় এবং তিনি একজন অসাধারণ সংগঠক। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এতে বটবৃক্ষের ভূমিকা পালন করেছেন। এর সঙ্গে জড়িত নূর মোহাম্মদ শফিউল্লা, মাসুম বিলাল, জাহিদুল হাসান, মির্জা তানজিম মুগ্ধ, কাজী হাসান জোবায়ের, সিদ্দিকুর রহমানের মতো আরও অনেক নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাব্রতী ও সাবেক ছাত্র, যাঁরা প্রতিযোগীদের প্রশিক্ষণ দেন ও প্রস্তুত করেন। এ ছাড়া দ্য ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গারের সঙ্গে জড়িত একদল স্বেচ্ছাব্রতী তরুণ ‘গণিত উৎসব’কে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই অনন্য উদ্যোগ অবশ্য শুরুই হতো না প্রথম আলোর প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছাড়া। অন্যদিকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে জাতীয় গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াডের ব্যাপক প্রসার কঠিন হতো।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ১০ বছর ধরে আইএমওর ন্যাশনাল কোচ ও দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমি যে দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়েছি তা হলো আমাদের তরুণেরা পারে এবং তাদের জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি তাদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি। এক কথায়, ১৬ বছর বয়সে আমি নিজে যেমন ছিলাম, আমি তাদের সেভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমি নিজে বহু গণিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি এবং অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তাই আমি মেধাবী তরুণদের মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত এবং আমি জানি, তাদের পক্ষে সব অসম্ভবকে সম্ভব করা সম্ভব। আমি জানি, যথাযথভাবে পরিচর্যা এবং উৎসাহিত করলে কোনো বাধাই তাদের জন্য অনতিক্রম্য নয়। দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের বিশ্বাস ও আস্থার অভাবই আমি লক্ষ করেছি বাংলাদেশের অনেক শিক্ষকের মধ্যে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত ছেলেমেয়েরা অনেক দিক থেকেই এইচএসসি এবং ও লেভেল পাস করা ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর। তারা কঠিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অনেক বেশি দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। এর ফলে তাদের অনেকেই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা এমআইটিসহ আরও অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। এদের একজন এমনকি কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে হার্ভার্ডে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। আমি নিশ্চিত, এরাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যথাযথ গণিত ও বিজ্ঞানের সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। এদের অনেকেই এখন গণিত সম্পর্কিত বিষয়ে পিএইচডি শুরু করছে এবং গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ছাত্রদের উৎসাহ দিচ্ছে।
আমি বিশ্বাস করি যে একটি সমাজ তখনই দ্রুত এগিয়ে যায়, যখন তাদের সবচেয়ে মেধাবী তরুণদের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে এবং তাদের মধ্যে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতার সৃষ্টি হয়। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের প্রতিভাবান তরুণেরা উপেক্ষিত থেকে যায় এবং তাদের যথাযথভাবে পরিচর্যা করা হয় না। গণিত অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের সেই অভাব পূরণ করারই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত, যাতে আমাদের তরুণেরা অন্য যেকোনো দেশের প্রতিযোগীদের পরাজিত করতে পারে। তাই বাংলাদেশের তরুণেরা আজ শুধু ক্রিকেটের মতো প্রতিযোগিতায় নয়, বরং শিক্ষা ক্ষেত্রের অতি মর্যাদাবান প্রতিযোগিতায় হারাতে পারে।
ড. মাহবুব মজুমদার: অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড টিমের জাতীয় কোচ ও দলনেতা।
No comments