ভারতে মুসলিম অনুপ্রবেশের তত্ত্ব ধাপ্পাবাজি -আনন্দবাজারে দুই অর্থনীতিবিদের নিবন্ধ
অনুপ্রবেশ রোধে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব |
অবশেষে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপির শীর্ষ নেতারা
ভারতে তথাকথিত মুসলিম অনুপ্রবেশ নিয়ে যে রূপকল্প তৈরি করেছিলেন তাকে
চ্যালেঞ্জ করেছেন শুভনীল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ। তারা দুজনেই কলকাতা
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অর্থনীতির শিক্ষক। গতকাল আনন্দবাজার
পত্রিকায় তারা এক নিবন্ধ লিখেছেন। এর শিরোনাম হলো ‘অনুপ্রবেশের তত্ত্ব হলো
ধাপ্পাবাজি’। তারা স্পষ্ট লিখেছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলো অনুপ্রবেশকারীতে
ভরে গেছে, এই বক্তব্যের কোন সারবত্তা নেই। এই নিবন্ধ প্রকাশ করা হলো এমন
একটি সময়ে যখন বিধানসভা ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে সামনে রেখে
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘বাংলাদেশী’ মুসলিম বিরাধী একটি কার্ড খেলার তোড়জোড়
শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ওদিকে ইঙ্গিত করেই দুই গবেষক উল্লেখ করেন যে, ‘‘কিন্তু একদিকে যেমন সামপ্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে মুসলমান সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের লাগাতার প্রচার চলছে, অন্য দিকে এই সমপ্রদায়ের উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো কোন নতুন দিশা দেখাতে পারছে না। যে রাজনীতি চলছে, তাতে মুসলমানদের উন্নতি অসম্ভব। বরং, রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ মেনে মুসলমান সমপ্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অংশকে অনগ্রসর শ্রেণীর আওতায় এতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সরকারি চাকরিতে বা সমাজের অন্যান্য অংশে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা উচিত।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, ‘কিন্তু সমস্ত সমস্যার সমাধান এতেই হয়ে যাবে না। উপরোক্ত সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে যেখানে মুসলমান সমপ্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগুরু সেখানে স্কুল সংখ্যা অন্যান্য এলাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। হাসপাতালের ক্ষেত্রেও একই বিষয় দেখা যাচ্ছে। তাই মুসলমান প্রধান এলাকায় যথার্থ পরিকাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ব পালন না করে একদিকে সামপ্রদায়িকতার তাস খেলে আর অন্যদিকে মৌলভীদের ভাতা দিয়ে মুসলমানদের উন্নতি হবে না।’’
ওই দুই গবেষক ১০ই সেপ্টেম্বর সরকারি তথ্য দিয়েই দাবি করেছেন যে, পরিসংখ্যান বলছে, অনুপ্রবশের ফলে এই রাজ্যে মুসলমানের সংখ্যা বাড়েনি। বরং, অশিক্ষা বা দারিদ্র্যের মতো উন্নয়নের (অভাবের) সূচকের সঙ্গেই মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের সম্পর্ক।
তারা বলেছেন, ‘ধর্মভিত্তিক জনগণনার পরিসংখ্যান সামনে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা নিয়ে স্বভাবতই আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রশ্নটা তো রাজনৈতিক ছিলই। এবার তাতে পরিসংখ্যানের ধুনোর গন্ধ লাগলে হিন্দুত্ববাদীরা মনে বিশেষ জোর পাবেন, তা আর বিচিত্র কী? কিন্তু, রাজনীতি সরিয়ে রাখলে, পশ্চিমবঙ্গের ছবিট কেমন?
এই রাজ্যের জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ২০০১ সালের ৭২.৫% থেকে ২০১১ সালে কমে হয়েছে ৭০.৫%, যেখানে মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত একই সময়ে ২৫.২% থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭%। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.২% যা ২০০১ থেকে ২০১১ সালে কমে হয় ১০.৮%। একই সময়ে মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২৫.৯% থেকে কমে হয় ২১.৮%। অর্থাৎ, সমপ্রদায়-নির্বিশেষে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৩.৪ শতাংশ-বিন্দু, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৪.১ শতাংশ-বিন্দু।’
উল্লেখ্য যে, শুভনীল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, যারা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন, তাদের মধ্যে যারা দুর্গাপূজা করেন তারা শরণার্থী, আর যারা করেন না তারা অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ, অনুপ্রবেশকারী মানে মুসলমান সমপ্রদায়ের মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যায় কোন মৌলিক তারতম্য দেখা যায়নি, বিপুল পরিমাণে অনুপ্রবেশকারী রাজ্যে প্রবেশ করলে যা ঘটত।’
কেউ বলতেই পারেন, রাজ্যের জেলাওয়াড়ি হিসেবের মধ্যেই, বিশেষত সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্রে, লুকিয়ে আছে অনুপ্রবেশের তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য। পরিসংখ্যান যখন আছে, তখন দেখে নেওয়াই তো ভাল।
ওই নিবন্ধে একটি সারণি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তারা বলেন, প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর দিকে তাকানো যাক। দেখা যাচ্ছে যে সেই জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোন নির্দিষ্ট একটি প্রবণতা নেই। একদিকে যেমন উত্তর দিনাজপুরে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রাজ্যের মুসলমান সমপ্রদায়ের গড়ের তুলনায় ৮ শতাংশ-বিন্দু বেশি, সেখানে আবার নদিয়ায় তা প্রায় ৪ শতাংশ-বিন্দু কম, দক্ষিণ দিনাজপুরে ৭.৫ শতাংশ-বিন্দু কম। দ্বিতীয়ত, যে জেলায় মুসলমানদের বৃদ্ধির হার রাজ্য গড়ের তুলনায় বেশি, সেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেমন, উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ইত্যাদি। আবার, যেখানে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার এই সমপ্রদায়ের রাজ্য গড়ের তুলনায় কম, সেই জেলাগুলিতে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, পুরুলিয়ার মতো জেলাও রয়েছে যা সীমান্তবর্তী জেলা না হওয়া সত্ত্বেও এই জেলাতে মুসলমান ও হিন্দু উভয়েরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিজ নিজ রাজ্য গড়ের তুলনায় বেশি।
ওই দুই গবেষকের নিবন্ধ এরপর তুলে ধরা হলো। তারা লিখেছেন, এখন এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্তে খুব সহজেই পৌঁছনো সম্ভব। প্রথমত, সীমান্তবর্তী জেলাগুলি অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে, এই বক্তব্যের কোন সারবত্তা নেই, কারণ এই জলাগুলিতে কোন একটি বিশেষ সমপ্রদায়ের জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধিকে কোন নির্দিষ্ট ছকে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ধার্মিক পরিচয়ের তুলনায় অন্য কয়েকটি সূচক অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, যে জেলাগুলিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই বৃদ্ধির হার রাজ্যে গড়ের তুলনায় অনেকটা বেশি, সেই জেলাগুলির স্বাক্ষরতার হার অন্য জেলাগুলোর তুলনায় অনেক কম। স্বাক্ষরতার নিরিখে উত্তর দিনাজপুরের স্থান সবার নিচে, তার ঠিক উপরেই রয়েছে মালদা, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ। আবার তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা জেলা যেমন কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, হুগলি বা উত্তর ২৪ পরগনা উভয় সমপ্রদায়ের ক্ষেত্রেই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিজ নিজ রাজ্যে গড়ের থেকে কম। স্বাক্ষরতার নিরিখেও এই জেলাগুলোর স্থান অনেক উপরে।
বিশেষত উল্লেখযোগ্য যে কলকাতায় মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার শূন্য (২০০১-২০১১র মধ্যে)। এবং কলকাতার জন্মহার ভারতের ৬৪০টি জেলার মধ্যে বর্তমানে সর্বনিম্ন (১.২ সন্তান প্রতি দম্পতি)। জনসংখ্যাবিদদের মতে, সাধারণত অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন, সামাজিক পশ্চাৎপদতা এবং জন্মহারের মধ্যে সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে হলে অনুপৃবেশের মত বিভেদপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরে বাজার গরম না করে বরং মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা বেশি জরুরি।
তা যদি হয়, তবে আমাদের রাজ্যের মুসলমান সমপ্রদায়ের সম্পর্ক আরও কিছু কথা বলা আবশ্যিক। ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা (ঝঘঅচ ও এঁরফধহপব এঁরষফ কর্তৃক) অনুযায়ী, মুসলমানদের মধ্যে ১৭.৩% পরিবার নিরক্ষর, এবং আরও ১১.৮% পরিবারের সদস্যরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি। ৮০% মুসলমান সমপ্রদায়ের মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় কায়িক শ্রম ও দিনমজরির মধ্য দিয়ে। এই সমপ্রদায়ের মাত্র ১৭% মানুষ শহরে বসবাস করেন, এবং ডাক্তারি, ওকালতি বা অধ্যাপকের মত পেশা আছে মাত্র ০.৪% মানুষের। অর্থাৎ, রাজ্যের মুসলমান সমপ্রদায়ের আর্থ সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই পরিস্থিতিতে এই সমপ্রদায়ের জন্মহার অন্য সমপ্রদায়ের থেকে বেশি হওয়াতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তা সত্ত্বেও, রাজ্যে মুসলমান সমপ্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। এর অনেক কারণ রয়েছে। আমরা শুধু দুটি কারণের উল্লেখ করবো। এক, গর্ভ নিরোধক পদ্ধতির ব্যবহারের হার গোটা দেশের মুসলমানদের মধ্যে এ রাজ্যে সর্বোচ্চ।
দ্বিতীয় কারণটি কলকাতা শহরের নিরিখে বর্তমান নিবন্ধের এক লেখকের গবেষণায় উঠে এসেছে। সেই গবেষণার ফল বলছে, পরিবারের সন্তানদের আরও ভাল করে বড় করে তোলা এবং উন্নত জীবন দেয়ার আকাঙ্ক্ষা মুসলমান পরিবারেও দেখা যাচ্ছে। এর ফলে সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। মুসলমান সমাজের এই আকাঙ্ক্ষাকে স্বচ্ছ ও ন্যায্য ভাবে বাস্তবায়িত করা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অতি জরুরি।
ওদিকে ইঙ্গিত করেই দুই গবেষক উল্লেখ করেন যে, ‘‘কিন্তু একদিকে যেমন সামপ্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে মুসলমান সমপ্রদায়ের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের লাগাতার প্রচার চলছে, অন্য দিকে এই সমপ্রদায়ের উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো কোন নতুন দিশা দেখাতে পারছে না। যে রাজনীতি চলছে, তাতে মুসলমানদের উন্নতি অসম্ভব। বরং, রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ মেনে মুসলমান সমপ্রদায়ের উল্লেখযোগ্য অংশকে অনগ্রসর শ্রেণীর আওতায় এতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সরকারি চাকরিতে বা সমাজের অন্যান্য অংশে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা উচিত।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, ‘কিন্তু সমস্ত সমস্যার সমাধান এতেই হয়ে যাবে না। উপরোক্ত সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে যেখানে মুসলমান সমপ্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগুরু সেখানে স্কুল সংখ্যা অন্যান্য এলাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। হাসপাতালের ক্ষেত্রেও একই বিষয় দেখা যাচ্ছে। তাই মুসলমান প্রধান এলাকায় যথার্থ পরিকাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ব পালন না করে একদিকে সামপ্রদায়িকতার তাস খেলে আর অন্যদিকে মৌলভীদের ভাতা দিয়ে মুসলমানদের উন্নতি হবে না।’’
ওই দুই গবেষক ১০ই সেপ্টেম্বর সরকারি তথ্য দিয়েই দাবি করেছেন যে, পরিসংখ্যান বলছে, অনুপ্রবশের ফলে এই রাজ্যে মুসলমানের সংখ্যা বাড়েনি। বরং, অশিক্ষা বা দারিদ্র্যের মতো উন্নয়নের (অভাবের) সূচকের সঙ্গেই মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের সম্পর্ক।
তারা বলেছেন, ‘ধর্মভিত্তিক জনগণনার পরিসংখ্যান সামনে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা নিয়ে স্বভাবতই আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রশ্নটা তো রাজনৈতিক ছিলই। এবার তাতে পরিসংখ্যানের ধুনোর গন্ধ লাগলে হিন্দুত্ববাদীরা মনে বিশেষ জোর পাবেন, তা আর বিচিত্র কী? কিন্তু, রাজনীতি সরিয়ে রাখলে, পশ্চিমবঙ্গের ছবিট কেমন?
এই রাজ্যের জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ২০০১ সালের ৭২.৫% থেকে ২০১১ সালে কমে হয়েছে ৭০.৫%, যেখানে মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত একই সময়ে ২৫.২% থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭%। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.২% যা ২০০১ থেকে ২০১১ সালে কমে হয় ১০.৮%। একই সময়ে মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২৫.৯% থেকে কমে হয় ২১.৮%। অর্থাৎ, সমপ্রদায়-নির্বিশেষে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৩.৪ শতাংশ-বিন্দু, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৪.১ শতাংশ-বিন্দু।’
উল্লেখ্য যে, শুভনীল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, যারা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন, তাদের মধ্যে যারা দুর্গাপূজা করেন তারা শরণার্থী, আর যারা করেন না তারা অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ, অনুপ্রবেশকারী মানে মুসলমান সমপ্রদায়ের মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যায় কোন মৌলিক তারতম্য দেখা যায়নি, বিপুল পরিমাণে অনুপ্রবেশকারী রাজ্যে প্রবেশ করলে যা ঘটত।’
কেউ বলতেই পারেন, রাজ্যের জেলাওয়াড়ি হিসেবের মধ্যেই, বিশেষত সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্রে, লুকিয়ে আছে অনুপ্রবেশের তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য। পরিসংখ্যান যখন আছে, তখন দেখে নেওয়াই তো ভাল।
ওই নিবন্ধে একটি সারণি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তারা বলেন, প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর দিকে তাকানো যাক। দেখা যাচ্ছে যে সেই জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোন নির্দিষ্ট একটি প্রবণতা নেই। একদিকে যেমন উত্তর দিনাজপুরে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রাজ্যের মুসলমান সমপ্রদায়ের গড়ের তুলনায় ৮ শতাংশ-বিন্দু বেশি, সেখানে আবার নদিয়ায় তা প্রায় ৪ শতাংশ-বিন্দু কম, দক্ষিণ দিনাজপুরে ৭.৫ শতাংশ-বিন্দু কম। দ্বিতীয়ত, যে জেলায় মুসলমানদের বৃদ্ধির হার রাজ্য গড়ের তুলনায় বেশি, সেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেমন, উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ইত্যাদি। আবার, যেখানে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার এই সমপ্রদায়ের রাজ্য গড়ের তুলনায় কম, সেই জেলাগুলিতে হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, পুরুলিয়ার মতো জেলাও রয়েছে যা সীমান্তবর্তী জেলা না হওয়া সত্ত্বেও এই জেলাতে মুসলমান ও হিন্দু উভয়েরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিজ নিজ রাজ্য গড়ের তুলনায় বেশি।
ওই দুই গবেষকের নিবন্ধ এরপর তুলে ধরা হলো। তারা লিখেছেন, এখন এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্তে খুব সহজেই পৌঁছনো সম্ভব। প্রথমত, সীমান্তবর্তী জেলাগুলি অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে, এই বক্তব্যের কোন সারবত্তা নেই, কারণ এই জলাগুলিতে কোন একটি বিশেষ সমপ্রদায়ের জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধিকে কোন নির্দিষ্ট ছকে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ধার্মিক পরিচয়ের তুলনায় অন্য কয়েকটি সূচক অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, যে জেলাগুলিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই বৃদ্ধির হার রাজ্যে গড়ের তুলনায় অনেকটা বেশি, সেই জেলাগুলির স্বাক্ষরতার হার অন্য জেলাগুলোর তুলনায় অনেক কম। স্বাক্ষরতার নিরিখে উত্তর দিনাজপুরের স্থান সবার নিচে, তার ঠিক উপরেই রয়েছে মালদা, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ। আবার তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা জেলা যেমন কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, হুগলি বা উত্তর ২৪ পরগনা উভয় সমপ্রদায়ের ক্ষেত্রেই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিজ নিজ রাজ্যে গড়ের থেকে কম। স্বাক্ষরতার নিরিখেও এই জেলাগুলোর স্থান অনেক উপরে।
বিশেষত উল্লেখযোগ্য যে কলকাতায় মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার শূন্য (২০০১-২০১১র মধ্যে)। এবং কলকাতার জন্মহার ভারতের ৬৪০টি জেলার মধ্যে বর্তমানে সর্বনিম্ন (১.২ সন্তান প্রতি দম্পতি)। জনসংখ্যাবিদদের মতে, সাধারণত অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন, সামাজিক পশ্চাৎপদতা এবং জন্মহারের মধ্যে সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে হলে অনুপৃবেশের মত বিভেদপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরে বাজার গরম না করে বরং মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা বেশি জরুরি।
তা যদি হয়, তবে আমাদের রাজ্যের মুসলমান সমপ্রদায়ের সম্পর্ক আরও কিছু কথা বলা আবশ্যিক। ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা (ঝঘঅচ ও এঁরফধহপব এঁরষফ কর্তৃক) অনুযায়ী, মুসলমানদের মধ্যে ১৭.৩% পরিবার নিরক্ষর, এবং আরও ১১.৮% পরিবারের সদস্যরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি। ৮০% মুসলমান সমপ্রদায়ের মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় কায়িক শ্রম ও দিনমজরির মধ্য দিয়ে। এই সমপ্রদায়ের মাত্র ১৭% মানুষ শহরে বসবাস করেন, এবং ডাক্তারি, ওকালতি বা অধ্যাপকের মত পেশা আছে মাত্র ০.৪% মানুষের। অর্থাৎ, রাজ্যের মুসলমান সমপ্রদায়ের আর্থ সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই পরিস্থিতিতে এই সমপ্রদায়ের জন্মহার অন্য সমপ্রদায়ের থেকে বেশি হওয়াতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তা সত্ত্বেও, রাজ্যে মুসলমান সমপ্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। এর অনেক কারণ রয়েছে। আমরা শুধু দুটি কারণের উল্লেখ করবো। এক, গর্ভ নিরোধক পদ্ধতির ব্যবহারের হার গোটা দেশের মুসলমানদের মধ্যে এ রাজ্যে সর্বোচ্চ।
দ্বিতীয় কারণটি কলকাতা শহরের নিরিখে বর্তমান নিবন্ধের এক লেখকের গবেষণায় উঠে এসেছে। সেই গবেষণার ফল বলছে, পরিবারের সন্তানদের আরও ভাল করে বড় করে তোলা এবং উন্নত জীবন দেয়ার আকাঙ্ক্ষা মুসলমান পরিবারেও দেখা যাচ্ছে। এর ফলে সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। মুসলমান সমাজের এই আকাঙ্ক্ষাকে স্বচ্ছ ও ন্যায্য ভাবে বাস্তবায়িত করা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অতি জরুরি।
No comments