ভারতের পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্নপূরণ কত দূর? by শহীদ জাভেদ বুরখি
গত
বছরের মে মাসে ভারতের লোকসভায় নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির
বিপুল বিজয় ছিল অনেক দিক দিয়েই চমকের। এমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নিকট
অতীতে দেশটির আর কোনো রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করতে পারেনি। মোদির ব্যক্তিত্ব
এবং বক্তব্যের নতুনত্ব দেশটির সাধারণ মানুষ যে গ্রহণ করেছিল তা পরিষ্কার।
মোদির বিজয় নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনাও কম হয়নি। নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতা
গ্রহণ অনুষ্ঠানেও ছিল চমক। দরবার হলের আনুষ্ঠানিকতার বদলে শামিয়ানার নিচে
বিশ্বের বহু দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন
তিনি। চিরশত্রু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ
শরিফও ছিলেন সেখানে। মোদি ইনিংসের শুরুটা নিঃসন্দেহে ছিল দুর্দান্ত।
সরকার গঠনের পর সবার আলোচনার বিষয় ছিল মোদি সরকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশটিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারবেন। নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পররাষ্ট্রনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন তা বাস্তব রূপ নিতে আর কতটা সময় বাকি। সরকার গঠনের পর এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দেশসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি ক্ষমতাধর দেশে সফরের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আসলেই তিনি একটা কিছু করতে যাচ্ছেন। গড়িয়ে চলল সময়। একে একে পার হলো পাঁচ বছর ক্ষমতার মেয়াদের এক-চতুর্থাংশ তথা ১৫টি মাস। এখন কিন্তু কেউ আর স্বপ্নের জগৎ আর কথার ফুলঝুরির মাঝে বিচরণ করতে চাইছেন না। চাইছেন বাস্তব জগতে ফিরে আসতে। কোথাও পৌঁছতে হলে কোথাও থেকে শুরু করতে হবে।
মোদির স্বপ্নগুলোর কয়টি বাস্তবায়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে সেই হিসাব এখন মেলাতে বসেছেন বিশ্লেষকেরা। এসব স্বপ্নে একটি ছিল তৃতীয় বিশ্বের তকমা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্তত ‘উদীয়মান’ শক্তির খেতাবটি ধারণ করতে পারা। এই ‘উদীয়মান’ শব্দের প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আকর্ষণের একটি কারণ ছিল এটা শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে অগ্রসর হবে না, এর সাথে জড়িয়ে আছে এই উপমহাদেশের পাশাপাশি এশিয়ার অনেক ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রশ্ন।
২৯টি রাজ্য এবং সাতটি ইউনিয়ন টেরিটরির মোটামুটি বিশাল দেশ ভারত। এ কথা বলাই বাহুল্য, এর প্রতিটি রাজ্যই বিশ্বের অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়ে বহু গুণ বড়। এ বিচারে যদি দেশটির উন্নয়নের প্রতি নজর দেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে এ পর্যন্ত সেখানে কেবল একটি রাজ্যেই মোটামুটি ভালো উন্নয়ন হয়েছে। আর তা হলো গুজরাট। দেশের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই রাজ্যের রাজনীতির মধ্য দিয়েই বলতে গেলে মোদির উত্থান। বহু বছর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন তিনি। ভালো উদ্যোক্তা হিসেবে এ রাজ্যবাসীর বেশ সুনাম রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অগ্রভাগে রয়েছে এখানকার বেসরকারি খাত। দেশটির যেকোনো রাজ্যের তুলনায় এটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুলাংশে এগিয়ে। নির্বাচনের আগে মোদির অঙ্গীকার ছিল গুজরাটের উন্নয়ন মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। ভোটাররা তা বিশ্বাসও করেছিল।
ক্ষমতার চেয়ারে বসেই প্রথমে নজর দিলেন পররাষ্ট্রনীতির দিকে। তার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল, ভারত একটি বিশাল এবং উদ্যমী জাতি। তিনি বিশ্ববাসীকেও তা বিশ্বাস করাতে চাইলেন এবং চাইলেন বিশ্ববাসী যেন তার দেশকে একটি পরাশক্তি হিসেবেই দেখে। গত ১৫ মাসে তিনি এতসংখ্যক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন যে তার পূর্বসূরি মনমোহন সিং দুই মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতা থাকার পরও সে সুযোগ পাননি। মোদির পরাশক্তি হওয়ার দাবি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্কও তৈরি হয়। মোদি ওয়াশিংটন সফরে গেলে এমন বর্ণাঢ্য আয়োজনে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়, যা খুব কম নেতার ভাগ্যেই জোটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু তাকে স্বাগতই জানাননি হেঁটে মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন।
গুণমুগ্ধ মোদিও এ বছরের জানুয়ারিতে প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন ওবামাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেবল এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেই ধন্য হননি, মোদির পাশে বসে উপভোগ করেছেন ট্যাংক, মিসাইল ও ভারী সরঞ্জাম সজ্জিত শক্তিধর ভারতীয় বাহিনীর শক্তি প্রদর্শনের উৎসব। হিন্দু চরমপন্থীগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মোদি ক্ষমতায় আসার পর অনেকে ধারণা করেছিলেন তিনি যেহেতু পূর্বসূরিদের চেয়ে ব্যক্তিক্রম হয়তো ভারত এবার তার পশ্চিম প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে বরফ গলানোর দিকে নজর দেবেন। কিন্তু আদতে তা হয়নি।
বরং ঘটেছে উল্টো। যার প্রকাশ ঘটে গত ২৪ আগস্ট। সেদিন দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আলোচনার বিষয়বস্তুতে ভারত নাকি কিছু অগ্রহণযোগ্য শর্ত দিয়েছিল। তাই আলোচনা বাতিল করে পাকিস্তান। এর মধ্য দিয়ে ইসলামাবাদ কি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে, পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশকে হেলাফেলা করা উচিত নয়? তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, দুই দেশের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্নপর্যায়ে অবস্থান করছে।
পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চীনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে যে সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিলেন মোদি তাও এখনো দেখা যাচ্ছে না। তিনি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান চালু করে দেশের উৎপাদন খাতের আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন দেশকে শিল্পোন্নত দেশের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু স্লোগান আর বাস্তবতার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান এই ১৫ মাসেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের অর্থনীতিতে উৎপাদন খাতের সবচেয়ে বেশি অবদানের সময়টি ছিল বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের মাঝামাঝি।
ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের ‘স্কামপিটার ব্লগ’-এ লেখা হয়, ভারতের অর্থনৈতিক ‘পুনরুজ্জীবন ঘটলে বিশ্বনেতাদের ভালোই লাগবে।’ ম্যাগাজিনটি আরো লেখে, ‘‘সমস্যা অনুসন্ধানের জন্য সেই ১৯৯১ সালে ফিরে যেতে হবে। যখন দেশটি পণ্যের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার জন্য তার বাজার খুলে দিয়েছিল। কিন্তু বাজারের কিছু চালিকাশক্তি ভূমি, শ্রম ও পুঁজি থেকে যায় সাবেকী অবস্থায়। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য ভারতীয় কারখানাগুলোর সহসাই প্রয়োজন হয়ে পড়ে আয়তনে বড় হওয়ার, আরো সুসজ্জিত হওয়ার। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতিপ্রবণ ভারতে পুঁজির মূল্য ছিল অত্যধিক চড়া। এই মূল্য আরো বেড়ে যায় যখন সমস্যাকবলিত ব্যাংকগুলো আদালতে ছুটছিল খাতকদের কাছ থেকে পাওনা ঋণ আদায়ের জন্য। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় ব্যাংকগুলো ছিল কাহিল। সেই সাথে শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কৃষিভূমি পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে। দেশটির শ্রম আইনের বেশির ভাগ লেখা হয় সেই ১৯৪০-এর দশকে। উৎপাদকেরা উৎপাদন করবেন কী, নীতি আর বিধানের বোঝা সামাল দিতে গিয়েই হিমশিম খেতে থাকেন। তাই তারা লে-অফ কর্মীদের দূরে রাখতে স্বল্প শ্রমিক গ্রহণের দিকে মনোযোগ দেন।” সহজে ব্যবসা করা যায়- এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের যে তালিকা রয়েছে সেখানে শীর্ষ ৫০-এর মধ্যে ভারতকে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন মোদি। সর্বশেষ প্রকাশিত সেই তালিকায় দেশটির অবস্থান ১৪২তম।
১৫ মাসের মাথায় ভারতের জনগণ এখন রাস্তায় নামতে শুরু করেছেন। এই রাস্তাই তো তাদের দাবি জানানো ও আদায়ের আসল জায়গা। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুম্বাইয়ে বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। এই তো ২৬ আগস্ট মোদির চিরচেনা গুজরাটের রাজধানী আহমদাবাদে দাঙ্গায় নিহত হয় ছয়জন নিম্নসম্প্রদায়ের মানুষ। চাকরিতে উচ্চ শ্রেণীর মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে যে আইন করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে নি¤œ শ্রেণীর লোকজন।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেশটির জনসংখ্যার অনুপাতে হিন্দুদের সংখ্যা ৮০ শতাংশের নিচে নেমে আসার খবর শুনে মাঠে নেমেছে জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা। সরকারি হিসেবে মুসলমানেরা এখন ১৪.২৫ শতাংশ। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় আদমশুমারির এই ফল প্রকাশে কয়েক মাস বিলম্ব করেছিল মোদি সরকার।
এ সব কিছুতে ভারতের শিক্ষা যেন একটিই- বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানের প্রতি কঠোর হতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো। আসল ঘটনা যে মোদির নিজের ঘরেই, তা আর কে বলবে। নিজের ঘর সামাল দিতে না পারলে মোদির পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন হয়তো অপূর্ণই থেকে যাবে।
লেখক : বিশ্ব¦ব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, অনুবাদ : মাসুম বিল্লাহ
সরকার গঠনের পর সবার আলোচনার বিষয় ছিল মোদি সরকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশটিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারবেন। নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পররাষ্ট্রনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন তা বাস্তব রূপ নিতে আর কতটা সময় বাকি। সরকার গঠনের পর এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দেশসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি ক্ষমতাধর দেশে সফরের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আসলেই তিনি একটা কিছু করতে যাচ্ছেন। গড়িয়ে চলল সময়। একে একে পার হলো পাঁচ বছর ক্ষমতার মেয়াদের এক-চতুর্থাংশ তথা ১৫টি মাস। এখন কিন্তু কেউ আর স্বপ্নের জগৎ আর কথার ফুলঝুরির মাঝে বিচরণ করতে চাইছেন না। চাইছেন বাস্তব জগতে ফিরে আসতে। কোথাও পৌঁছতে হলে কোথাও থেকে শুরু করতে হবে।
মোদির স্বপ্নগুলোর কয়টি বাস্তবায়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে সেই হিসাব এখন মেলাতে বসেছেন বিশ্লেষকেরা। এসব স্বপ্নে একটি ছিল তৃতীয় বিশ্বের তকমা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অন্তত ‘উদীয়মান’ শক্তির খেতাবটি ধারণ করতে পারা। এই ‘উদীয়মান’ শব্দের প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আকর্ষণের একটি কারণ ছিল এটা শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে অগ্রসর হবে না, এর সাথে জড়িয়ে আছে এই উপমহাদেশের পাশাপাশি এশিয়ার অনেক ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রশ্ন।
২৯টি রাজ্য এবং সাতটি ইউনিয়ন টেরিটরির মোটামুটি বিশাল দেশ ভারত। এ কথা বলাই বাহুল্য, এর প্রতিটি রাজ্যই বিশ্বের অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়ে বহু গুণ বড়। এ বিচারে যদি দেশটির উন্নয়নের প্রতি নজর দেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে এ পর্যন্ত সেখানে কেবল একটি রাজ্যেই মোটামুটি ভালো উন্নয়ন হয়েছে। আর তা হলো গুজরাট। দেশের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই রাজ্যের রাজনীতির মধ্য দিয়েই বলতে গেলে মোদির উত্থান। বহু বছর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন তিনি। ভালো উদ্যোক্তা হিসেবে এ রাজ্যবাসীর বেশ সুনাম রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অগ্রভাগে রয়েছে এখানকার বেসরকারি খাত। দেশটির যেকোনো রাজ্যের তুলনায় এটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুলাংশে এগিয়ে। নির্বাচনের আগে মোদির অঙ্গীকার ছিল গুজরাটের উন্নয়ন মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। ভোটাররা তা বিশ্বাসও করেছিল।
ক্ষমতার চেয়ারে বসেই প্রথমে নজর দিলেন পররাষ্ট্রনীতির দিকে। তার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল, ভারত একটি বিশাল এবং উদ্যমী জাতি। তিনি বিশ্ববাসীকেও তা বিশ্বাস করাতে চাইলেন এবং চাইলেন বিশ্ববাসী যেন তার দেশকে একটি পরাশক্তি হিসেবেই দেখে। গত ১৫ মাসে তিনি এতসংখ্যক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন যে তার পূর্বসূরি মনমোহন সিং দুই মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতা থাকার পরও সে সুযোগ পাননি। মোদির পরাশক্তি হওয়ার দাবি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্কও তৈরি হয়। মোদি ওয়াশিংটন সফরে গেলে এমন বর্ণাঢ্য আয়োজনে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়, যা খুব কম নেতার ভাগ্যেই জোটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু তাকে স্বাগতই জানাননি হেঁটে মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন।
গুণমুগ্ধ মোদিও এ বছরের জানুয়ারিতে প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন ওবামাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেবল এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেই ধন্য হননি, মোদির পাশে বসে উপভোগ করেছেন ট্যাংক, মিসাইল ও ভারী সরঞ্জাম সজ্জিত শক্তিধর ভারতীয় বাহিনীর শক্তি প্রদর্শনের উৎসব। হিন্দু চরমপন্থীগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মোদি ক্ষমতায় আসার পর অনেকে ধারণা করেছিলেন তিনি যেহেতু পূর্বসূরিদের চেয়ে ব্যক্তিক্রম হয়তো ভারত এবার তার পশ্চিম প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে বরফ গলানোর দিকে নজর দেবেন। কিন্তু আদতে তা হয়নি।
বরং ঘটেছে উল্টো। যার প্রকাশ ঘটে গত ২৪ আগস্ট। সেদিন দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আলোচনার বিষয়বস্তুতে ভারত নাকি কিছু অগ্রহণযোগ্য শর্ত দিয়েছিল। তাই আলোচনা বাতিল করে পাকিস্তান। এর মধ্য দিয়ে ইসলামাবাদ কি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে, পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশকে হেলাফেলা করা উচিত নয়? তাই স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, দুই দেশের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্নপর্যায়ে অবস্থান করছে।
পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চীনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে যে সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিলেন মোদি তাও এখনো দেখা যাচ্ছে না। তিনি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান চালু করে দেশের উৎপাদন খাতের আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন দেশকে শিল্পোন্নত দেশের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন বলে। কিন্তু স্লোগান আর বাস্তবতার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান এই ১৫ মাসেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের অর্থনীতিতে উৎপাদন খাতের সবচেয়ে বেশি অবদানের সময়টি ছিল বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের মাঝামাঝি।
ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের ‘স্কামপিটার ব্লগ’-এ লেখা হয়, ভারতের অর্থনৈতিক ‘পুনরুজ্জীবন ঘটলে বিশ্বনেতাদের ভালোই লাগবে।’ ম্যাগাজিনটি আরো লেখে, ‘‘সমস্যা অনুসন্ধানের জন্য সেই ১৯৯১ সালে ফিরে যেতে হবে। যখন দেশটি পণ্যের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার জন্য তার বাজার খুলে দিয়েছিল। কিন্তু বাজারের কিছু চালিকাশক্তি ভূমি, শ্রম ও পুঁজি থেকে যায় সাবেকী অবস্থায়। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার জন্য ভারতীয় কারখানাগুলোর সহসাই প্রয়োজন হয়ে পড়ে আয়তনে বড় হওয়ার, আরো সুসজ্জিত হওয়ার। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতিপ্রবণ ভারতে পুঁজির মূল্য ছিল অত্যধিক চড়া। এই মূল্য আরো বেড়ে যায় যখন সমস্যাকবলিত ব্যাংকগুলো আদালতে ছুটছিল খাতকদের কাছ থেকে পাওনা ঋণ আদায়ের জন্য। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় ব্যাংকগুলো ছিল কাহিল। সেই সাথে শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কৃষিভূমি পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে। দেশটির শ্রম আইনের বেশির ভাগ লেখা হয় সেই ১৯৪০-এর দশকে। উৎপাদকেরা উৎপাদন করবেন কী, নীতি আর বিধানের বোঝা সামাল দিতে গিয়েই হিমশিম খেতে থাকেন। তাই তারা লে-অফ কর্মীদের দূরে রাখতে স্বল্প শ্রমিক গ্রহণের দিকে মনোযোগ দেন।” সহজে ব্যবসা করা যায়- এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের যে তালিকা রয়েছে সেখানে শীর্ষ ৫০-এর মধ্যে ভারতকে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন মোদি। সর্বশেষ প্রকাশিত সেই তালিকায় দেশটির অবস্থান ১৪২তম।
১৫ মাসের মাথায় ভারতের জনগণ এখন রাস্তায় নামতে শুরু করেছেন। এই রাস্তাই তো তাদের দাবি জানানো ও আদায়ের আসল জায়গা। পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুম্বাইয়ে বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। এই তো ২৬ আগস্ট মোদির চিরচেনা গুজরাটের রাজধানী আহমদাবাদে দাঙ্গায় নিহত হয় ছয়জন নিম্নসম্প্রদায়ের মানুষ। চাকরিতে উচ্চ শ্রেণীর মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে যে আইন করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে নি¤œ শ্রেণীর লোকজন।
স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেশটির জনসংখ্যার অনুপাতে হিন্দুদের সংখ্যা ৮০ শতাংশের নিচে নেমে আসার খবর শুনে মাঠে নেমেছে জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা। সরকারি হিসেবে মুসলমানেরা এখন ১৪.২৫ শতাংশ। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় আদমশুমারির এই ফল প্রকাশে কয়েক মাস বিলম্ব করেছিল মোদি সরকার।
এ সব কিছুতে ভারতের শিক্ষা যেন একটিই- বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানের প্রতি কঠোর হতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো। আসল ঘটনা যে মোদির নিজের ঘরেই, তা আর কে বলবে। নিজের ঘর সামাল দিতে না পারলে মোদির পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন হয়তো অপূর্ণই থেকে যাবে।
লেখক : বিশ্ব¦ব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, অনুবাদ : মাসুম বিল্লাহ
No comments