তারেক রহমানের উক্তি ও সত্য উদঘাটনের সুযোগ by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা জবরদখলকারী খোন্দকার মোশতাককে ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে গালমন্দ করায় কুপিত হয়ে লন্ডনের প্রবাস থেকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার মনোনীত উত্তরসূরি তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান আওয়ামী লীগকে ‘দল অব কুলাঙ্গারস’ বলে গালাগালি করেছেন। কুলাঙ্গারের অর্থ জানা থাকলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে খোন্দকার মোশতাককে ওই অভিধায় অভিহিত করে শেখ হাসিনা ভুল করেননি। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থেকে বঙ্গবন্ধুর একেবারে ‘কাছের মানুষ’ সেজে তাঁকে ঝাড়ে-বংশে হত্যা করার প্রধান কুশীলবের ভূমিকা যে পালন করে, তাকে কুলাঙ্গার আখ্যা দিলে অন্যায় কীভাবে হলো, তা বোঝা যাচ্ছে না। আরও বোঝা মুশকিল, গালটা তারেক রহমান নিজের ভাগে নিলেন কেন? মোশতাকের পক্ষ নিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে প্রকারান্তরে তারেক রহমান বিএনপির জন্ম এবং রাজনীতির সঙ্গে মোশতাক ও পঁচাত্তরের খুনি চক্রের পরমাত্মীয়তা স্বীকার করে নিলেন কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
খোন্দকার মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতা ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধকালীন মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার মতোই ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই খোন্দকার মোশতাক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত শক্তভাবে ওই গাদ্দারদের মোকাবিলা করে মোশতাক চক্রকে পুরোপুরি অকার্যকর করে রেখেছিলেন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এটুকু ইতিহাস তারেক রহমানেরও নিশ্চয়ই জানা আছে। খোন্দকার মোশতাক ধুয়া তুলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুজিবকে জীবিত ফেরত পেতে চাইলে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারকে ছাড় দিতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাবে রাজি হতে হবে।’ এর বিপরীতে তাজউদ্দীনের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল, ‘স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা পেলেই শুধু মুজিবকেও পাওয়া যাবে, অন্য কোনোভাবে নয়।’ এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য খোন্দকার মোশতাক ও মাহবুবুল আলম চাষীকে ওই দুই মাস দায়িত্ব থেকে সরিয়ে পূর্ণ নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য হলো: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার পরপর হয়তো এই ইস্যুতেই শেখ মণির সহায়তায় খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিরূপ অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য কোনো সদস্যেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা থাকা অস্বাভাবিক নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ বাঁচানোকে তাজউদ্দীন গুরুত্ব দেননি, মোশতাক ও শেখ মণির মতো তাজউদ্দীন-বিরোধীদের হাতে এটাই হয়তো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক সাম্প্রতিক স্মারক বক্তৃতায় জাতিকে জানিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার এক দিনের মধ্যেই তাজউদ্দীন বুঝে গিয়েছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তারপরও তাজউদ্দীন দৃঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিষেধ করেছিলেন খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রিসভায় না নিতে। কিন্তু তাজউদ্দীনের কথা পাত্তা পায়নি। মোশতাক তখন বনে গেছেন বঙ্গবন্ধুর আপনজন, বনে গেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগনের সার্টিফিকেটে। মন্ত্রিসভার দাপুটে সদস্য হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর সরকারে জায়গা করে নিয়েছিলেন খোন্দকার মোশতাক। তাজউদ্দীন ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি হারানো বঙ্গবন্ধুর সে আস্থা জীবদ্দশায় আর ফিরে পাননি। বঙ্গবন্ধু কখনোই তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাননি কীভাবে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল, কেনই বা তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন, ২৬৬ দিনের মুক্তিযুদ্ধের সময় কার কী ভূমিকা ছিল, যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার কলকাতা থেকে কীভাবে মুজিবনগর সরকারের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। হয়তো অন্য কারও কাছ থেকে তিনি এসব ব্যাপারে মিথ্যা বয়ান পেয়ে তাজউদ্দীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নেতিবাচক উপলব্ধিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাঁর সবচেয়ে আস্থাভাজন আপনজন হিসেবে পরিচিত তাজউদ্দীন কোনো অপরাধ না করে এহেন শাস্তি পাওয়াটা হয়তো মেনে নিতে না পেরে তাঁর নেতার ওপর অভিমান করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রকৃত সত্য এবং তাঁর নিজস্ব ভাষ্য তুলে ধরেননি, নেতার ভুলও ভাঙাননি। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একবারও তাঁর নামাঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ঐতিহাসিক শপথ অনুষ্ঠানস্থল বর্তমান মেহেরপুরের মুজিবনগরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। এতৎসত্ত্বেও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাজউদ্দীন সব অপমান হজম করে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ক্রমেই তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। সরকারের নীতিনির্ধারণে তাজউদ্দীনকে অগ্রাহ্য করাটাই যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর মন্ত্রিত্বের দুই বছর নয় মাস সময়কালের শেষের দিকে। তবু বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের সদস্যদের মধ্যে সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা, নিয়মনিষ্ঠতা ও কর্তব্যপরায়ণতার বিচারে তাজউদ্দীনই যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তা ইতিহাসেরই রায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অপমানজনকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব এই মোশতাক-তাহেরউদ্দিন ঠাকুর চক্রই সুপরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে থাকতে চেষ্টা করেছে। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ থেকে মোশতাকের পৃষ্ঠপোষকতাকারী শেখ মণিরও নিষ্কৃতি মেলেনি, এটাই ঘাতকদের রক্তলোলুপ ও কৃতঘ্ন চরিত্রের পরিচায়ক!
১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে ফারুক-রশীদ গং অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় জিয়াউর রহমানকে নেতৃত্ব প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছিল, এটা তো আশির দশকেই কর্নেল রশীদের নিজের বয়ানে বিবৃত হয়েছে। ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার্থে অবস্থানকালে (১৯৮৭-৮৮ সালে) সেখানকার টেলিভিশনের ওই প্রোগ্রামটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি। রশীদের বয়ান মোতাবেক জিয়াউর রহমান ওই প্রস্তাবে সায় দেননি এই বলে, ‘আমাদের সিনিয়রদের পক্ষে এ ব্যাপারে অসুবিধা আছে, তোমরা জুনিয়ররা পারলে কিছু করো।’ এই বক্তব্যটি তখন থেকেই বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু রশীদের এই বক্তব্য আদৌ দেওয়া হয়নি বলা যাবে না এত দিন পর। এটা তো ‘রেকর্ডেড’ বক্তব্য, যা একাধিকবার ‘ব্রডকাস্ট’ হয়েছে। এই বক্তব্যের ভিত্তিতে যেটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে তা হলো: জিয়াউর রহমান ফারুক-রশীদ-মোশতাক চক্রের অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে রক্ষা করার শপথে আবদ্ধ ছিলেন, অথচ অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের খবর জেনেও তা তিনি যথাযথ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে যথাসময়ে জানাননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি কেউ অভিযোগ করে যে জিয়াউর রহমানও ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের দায়ভার এড়াতে পারেন না, তাহলে ওই ব্যক্তির উচিত হবে অভিযোগটির আইনি সমাধানের জন্য যথাযোগ্য আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভা-সমিতি বা মিডিয়ায় এই বিষয়টা নিয়ে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়াই এ ব্যাপারটার সুরাহা করার যৌক্তিক পন্থা। জিয়াউর রহমানকে তাঁর অনুসারী ও সমর্থকেরা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও সামরিক অভ্যুত্থানের শুধুই ‘সুবিধাভোগী’ বলে প্রচার করে চলেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ের যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার দায়ভার তাঁরা সুচারুভাবে মোশতাক, ফারুক-রশীদ নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা এবং খালেদ মোশাররফের ওপর পার করে দিয়ে জিয়াউর রহমানের ‘মাসুম’ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু সত্য ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২-১৯৭৫ পর্বের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল, কারা কী ঘটিয়েছিল, কার বা কাদের কী ভূমিকা ছিল, এই প্রতিটি পর্বে কার কী সম্মান প্রাপ্য, প্রকৃত খলনায়ক কে বা কারা ছিল—এগুলো ক্রমেই জাতির সামনে উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবিশ্রান্ত গালাগালির প্রতিযোগিতা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্রমেই অভব্য ও অসহনীয় পর্যায়ে অবনমিত করা সত্ত্বেও সত্য উদ্ঘাটনের যে স্বর্ণসুযোগ জাতির সামনে হাজির হয়েছে, তা হেলায় হারানো যাবে না।
আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্বগুলোর বর্ণনায় সত্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ঘটানো হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে দলগুলোর রাজনীতির স্বার্থে। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসকে বিএনপির মূল নেত্রী থেকে শুরু করে কোনো নেতা-নেত্রীই প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না বলে পণ করেছেন। বিএনপির ইতিহাস-পাঠ শুরুই হয় মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ থেকে। এ ব্যাপারেও বিকৃতি আছে: ঘোষণাটি ২৬ মার্চে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে ২৭ মার্চ প্রচারিত হলেও বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-নেত্রীই এখনো গলাবাজি করছেন যে ২৬ মার্চ নাকি ওটা প্রচারিত হয়েছে। এর উল্টোপিঠে আওয়ামী লীগের ইতিহাস পাঠে ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর এক লাফে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে চলে যাওয়ার প্রবণতা জোরদার হচ্ছে ক্রমেই। স্বাধীনতা অর্জনের সব কৃতিত্ব যেন শুধুই বঙ্গবন্ধুর, আর কে কী করেছেন, তাঁর যেন স্বীকৃতি দিতেও কার্পণ্য! এতেও যে একধরনের ইতিহাস বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে?
এ জন্যই বলছি, জাতির মহামূল্যবান ও পরম গর্বের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এহেন গালাগালির প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হলে সত্য ইতিহাসের নায়ক এবং সাক্ষী যাঁরা এখনো জীবিত আছেন, তাঁদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নিজের পাতে ঝোল টানার প্রবণতা পরিহার করে শুধুই বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অবিকৃত সত্যটা জাতিকে জানানোর দায়িত্বটুকু পালন করুন। আপনাদের চাওয়া-পাওয়ার পালা প্রায় শেষ। কোনো দল বা দলনেত্রীর মনোরঞ্জনের আর প্রয়োজন নেই। পরের প্রজন্মের কাছে সত্য উদ্ঘাটনের দায়বদ্ধতা দ্বারা তাড়িত হয়ে এই মহাসুযোগ গ্রহণ করুন।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
খোন্দকার মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতা ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধকালীন মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার মতোই ভয়ংকর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই খোন্দকার মোশতাক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত শক্তভাবে ওই গাদ্দারদের মোকাবিলা করে মোশতাক চক্রকে পুরোপুরি অকার্যকর করে রেখেছিলেন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এটুকু ইতিহাস তারেক রহমানেরও নিশ্চয়ই জানা আছে। খোন্দকার মোশতাক ধুয়া তুলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুজিবকে জীবিত ফেরত পেতে চাইলে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারকে ছাড় দিতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাবে রাজি হতে হবে।’ এর বিপরীতে তাজউদ্দীনের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল, ‘স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা পেলেই শুধু মুজিবকেও পাওয়া যাবে, অন্য কোনোভাবে নয়।’ এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য খোন্দকার মোশতাক ও মাহবুবুল আলম চাষীকে ওই দুই মাস দায়িত্ব থেকে সরিয়ে পূর্ণ নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য হলো: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার পরপর হয়তো এই ইস্যুতেই শেখ মণির সহায়তায় খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিরূপ অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য কোনো সদস্যেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা থাকা অস্বাভাবিক নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ বাঁচানোকে তাজউদ্দীন গুরুত্ব দেননি, মোশতাক ও শেখ মণির মতো তাজউদ্দীন-বিরোধীদের হাতে এটাই হয়তো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক সাম্প্রতিক স্মারক বক্তৃতায় জাতিকে জানিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার এক দিনের মধ্যেই তাজউদ্দীন বুঝে গিয়েছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তারপরও তাজউদ্দীন দৃঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিষেধ করেছিলেন খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রিসভায় না নিতে। কিন্তু তাজউদ্দীনের কথা পাত্তা পায়নি। মোশতাক তখন বনে গেছেন বঙ্গবন্ধুর আপনজন, বনে গেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগনের সার্টিফিকেটে। মন্ত্রিসভার দাপুটে সদস্য হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর সরকারে জায়গা করে নিয়েছিলেন খোন্দকার মোশতাক। তাজউদ্দীন ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি হারানো বঙ্গবন্ধুর সে আস্থা জীবদ্দশায় আর ফিরে পাননি। বঙ্গবন্ধু কখনোই তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাননি কীভাবে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল, কেনই বা তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন, ২৬৬ দিনের মুক্তিযুদ্ধের সময় কার কী ভূমিকা ছিল, যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার কলকাতা থেকে কীভাবে মুজিবনগর সরকারের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। হয়তো অন্য কারও কাছ থেকে তিনি এসব ব্যাপারে মিথ্যা বয়ান পেয়ে তাজউদ্দীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নেতিবাচক উপলব্ধিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাঁর সবচেয়ে আস্থাভাজন আপনজন হিসেবে পরিচিত তাজউদ্দীন কোনো অপরাধ না করে এহেন শাস্তি পাওয়াটা হয়তো মেনে নিতে না পেরে তাঁর নেতার ওপর অভিমান করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রকৃত সত্য এবং তাঁর নিজস্ব ভাষ্য তুলে ধরেননি, নেতার ভুলও ভাঙাননি। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একবারও তাঁর নামাঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ঐতিহাসিক শপথ অনুষ্ঠানস্থল বর্তমান মেহেরপুরের মুজিবনগরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। এতৎসত্ত্বেও জাতির প্রতি কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাজউদ্দীন সব অপমান হজম করে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ক্রমেই তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। সরকারের নীতিনির্ধারণে তাজউদ্দীনকে অগ্রাহ্য করাটাই যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর মন্ত্রিত্বের দুই বছর নয় মাস সময়কালের শেষের দিকে। তবু বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের সদস্যদের মধ্যে সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা, নিয়মনিষ্ঠতা ও কর্তব্যপরায়ণতার বিচারে তাজউদ্দীনই যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তা ইতিহাসেরই রায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অপমানজনকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব এই মোশতাক-তাহেরউদ্দিন ঠাকুর চক্রই সুপরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে থাকতে চেষ্টা করেছে। এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ থেকে মোশতাকের পৃষ্ঠপোষকতাকারী শেখ মণিরও নিষ্কৃতি মেলেনি, এটাই ঘাতকদের রক্তলোলুপ ও কৃতঘ্ন চরিত্রের পরিচায়ক!
১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে ফারুক-রশীদ গং অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় জিয়াউর রহমানকে নেতৃত্ব প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছিল, এটা তো আশির দশকেই কর্নেল রশীদের নিজের বয়ানে বিবৃত হয়েছে। ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার্থে অবস্থানকালে (১৯৮৭-৮৮ সালে) সেখানকার টেলিভিশনের ওই প্রোগ্রামটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি। রশীদের বয়ান মোতাবেক জিয়াউর রহমান ওই প্রস্তাবে সায় দেননি এই বলে, ‘আমাদের সিনিয়রদের পক্ষে এ ব্যাপারে অসুবিধা আছে, তোমরা জুনিয়ররা পারলে কিছু করো।’ এই বক্তব্যটি তখন থেকেই বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু রশীদের এই বক্তব্য আদৌ দেওয়া হয়নি বলা যাবে না এত দিন পর। এটা তো ‘রেকর্ডেড’ বক্তব্য, যা একাধিকবার ‘ব্রডকাস্ট’ হয়েছে। এই বক্তব্যের ভিত্তিতে যেটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে তা হলো: জিয়াউর রহমান ফারুক-রশীদ-মোশতাক চক্রের অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে রক্ষা করার শপথে আবদ্ধ ছিলেন, অথচ অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের খবর জেনেও তা তিনি যথাযথ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে যথাসময়ে জানাননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি কেউ অভিযোগ করে যে জিয়াউর রহমানও ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের দায়ভার এড়াতে পারেন না, তাহলে ওই ব্যক্তির উচিত হবে অভিযোগটির আইনি সমাধানের জন্য যথাযোগ্য আদালতে বিচারপ্রার্থী হওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভা-সমিতি বা মিডিয়ায় এই বিষয়টা নিয়ে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়াই এ ব্যাপারটার সুরাহা করার যৌক্তিক পন্থা। জিয়াউর রহমানকে তাঁর অনুসারী ও সমর্থকেরা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও সামরিক অভ্যুত্থানের শুধুই ‘সুবিধাভোগী’ বলে প্রচার করে চলেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ের যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার দায়ভার তাঁরা সুচারুভাবে মোশতাক, ফারুক-রশীদ নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা এবং খালেদ মোশাররফের ওপর পার করে দিয়ে জিয়াউর রহমানের ‘মাসুম’ ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু সত্য ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। স্বাধীনতাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২-১৯৭৫ পর্বের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল, কারা কী ঘটিয়েছিল, কার বা কাদের কী ভূমিকা ছিল, এই প্রতিটি পর্বে কার কী সম্মান প্রাপ্য, প্রকৃত খলনায়ক কে বা কারা ছিল—এগুলো ক্রমেই জাতির সামনে উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবিশ্রান্ত গালাগালির প্রতিযোগিতা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ক্রমেই অভব্য ও অসহনীয় পর্যায়ে অবনমিত করা সত্ত্বেও সত্য উদ্ঘাটনের যে স্বর্ণসুযোগ জাতির সামনে হাজির হয়েছে, তা হেলায় হারানো যাবে না।
আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্বগুলোর বর্ণনায় সত্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ঘটানো হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে দলগুলোর রাজনীতির স্বার্থে। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসকে বিএনপির মূল নেত্রী থেকে শুরু করে কোনো নেতা-নেত্রীই প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না বলে পণ করেছেন। বিএনপির ইতিহাস-পাঠ শুরুই হয় মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ থেকে। এ ব্যাপারেও বিকৃতি আছে: ঘোষণাটি ২৬ মার্চে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে ২৭ মার্চ প্রচারিত হলেও বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-নেত্রীই এখনো গলাবাজি করছেন যে ২৬ মার্চ নাকি ওটা প্রচারিত হয়েছে। এর উল্টোপিঠে আওয়ামী লীগের ইতিহাস পাঠে ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর এক লাফে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে চলে যাওয়ার প্রবণতা জোরদার হচ্ছে ক্রমেই। স্বাধীনতা অর্জনের সব কৃতিত্ব যেন শুধুই বঙ্গবন্ধুর, আর কে কী করেছেন, তাঁর যেন স্বীকৃতি দিতেও কার্পণ্য! এতেও যে একধরনের ইতিহাস বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে?
এ জন্যই বলছি, জাতির মহামূল্যবান ও পরম গর্বের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এহেন গালাগালির প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হলে সত্য ইতিহাসের নায়ক এবং সাক্ষী যাঁরা এখনো জীবিত আছেন, তাঁদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নিজের পাতে ঝোল টানার প্রবণতা পরিহার করে শুধুই বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অবিকৃত সত্যটা জাতিকে জানানোর দায়িত্বটুকু পালন করুন। আপনাদের চাওয়া-পাওয়ার পালা প্রায় শেষ। কোনো দল বা দলনেত্রীর মনোরঞ্জনের আর প্রয়োজন নেই। পরের প্রজন্মের কাছে সত্য উদ্ঘাটনের দায়বদ্ধতা দ্বারা তাড়িত হয়ে এই মহাসুযোগ গ্রহণ করুন।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments