তাহলে ৭০ ও ৯৯ অনুচ্ছেদেও সংশোধনী আনুন by মিজানুর রহমান খান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আক্ষেপের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, সংসদে কারও অপসারণের প্রস্তাব তিনি চাইলে কী পরিণতি হতে পারে। শেখ হাসিনাকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ গণতন্ত্রের মাননির্দেশক। কোনো নির্বাচনের মান ভালো-খারাপ যেমনই হোক, এটাই চূড়ান্ত মনোভাব। তাঁর এই উক্তি নির্দেশ করছে যে, শুধু সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ শুধরে অভিশংসন-প্রথা আমদানি নয়, এ উপলক্ষে ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদ এবং অবসরের পরে বিচারকদের চাকরি গ্রহণসংক্রান্ত ৯৯ অনুচ্ছেদের দিকেও নজর দিতে হবে।

বিচারক অপসারণ-প্রক্রিয়ায় ৭০ অনুচ্ছেদের দলীয়করণের প্রভাবের দিকে চার আইনবিদ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটাই যথেষ্ট নয়। তাঁদের আরও কতগুলো কথা পরিষ্কার করে বলতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দুই সংবিধানপ্রণেতার উদ্দেশে অনভিপ্রেত তির্যক মন্তব্য করেছেন। মাহবুবে আলম নিজেই বাহাত্তরে না ফিরতে মত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন বিদ্যমান কাউন্সিল সংস্কার করতে। কিন্তু এখন তিনি ড. কামাল ও আমীর-উল ইসলামের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, এখন কেন ডিগবাজি খাচ্ছেন? এটা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক এবং অপ্রাসঙ্গিক। মনে হচ্ছে, তিনি আওয়ামী লীগ নেত্রীকে খুশি করতেই এই মন্তব্য করেছেন। সরকারপ্রধানকে খুশি করার গরজটা কত তীব্র, সেটা প্রধানমন্ত্রীর ‘কেনা যায়’ মন্তব্যে স্পষ্ট। শেখ হাসিনাকে কেনা যায় না। আর অ্যাটর্নি জেনারেলকেও কেনা যায় না! তবে অ্যাটর্নির উচিত, তিনি কেন ডিগবাজি খেলেন সেটা ব্যাখ্যা করা।
বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার কথা বলা যে একটি চাতুরী, সেটা বাহাত্তরের সংবিধানপ্রণেতারা যেভাবে বলছেন, তাতে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, সরকারি দল প্রচারণার কাজে গোয়েবলসীয় তত্ত্ব অন্ধের মতো অনুসরণ করার পণ করেছে। বাহাত্তরের সংবিধানপ্রণেতাদের তরফে কিছু সত্য দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ না করার কারণে সরকার একটা সুযোগও পাচ্ছে। যেমন সংবিধানপ্রণেতারা এখন হঠাৎ করে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা তুলছেন। তাঁরা বলছেন না যে, ৭০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে অভিশংসনের কী সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, সেটা বাহাত্তরে ভাবা হয়নি। এমনকি তাঁরা বাহাত্তরের সংবিধান আজকের প্রেক্ষাপটে কতটা, কোথায় অপ্রাসঙ্গিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ, সে-বিষয়ক সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরছেন না। বিচারক অপসারণ-প্রক্রিয়ার ব্যাপারে চার আইনবিদের একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি তাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা সরকারকে আলোচনা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আজ যদি দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র থাকত, আর সরকার তাঁদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানাত, তাহলে তাঁদের পক্ষে দ্রুত একটি বিকল্প সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া দুরূহ হতো। কারণ, তাঁদের প্রস্তুতিমূলক কাজ নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল মনে করেন, কাউন্সিলকে আরও উন্নত করার সুযোগ আছে। তাকে গ্রেপ্তার করানোর ক্ষমতা দিতে হবে। তার অবমাননার বিধান আনতে হবে। কিন্তু নাগরিক সমাজের দিক থেকে সেই প্রস্তুতি কোথায়?
এটা ভয়ংকর, আজ কাউকে কথা বলতে না দিয়ে ১৬তম সংশোধনী আনা হচ্ছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেই মতামত নেওয়ার কথা বলেছিলেন। আজ বলা হচ্ছে, আইন নিয়ে বলতে দেওয়া হবে। তার মানে দাঁড়াল ক্ষমতাসীন সরকার অভিশংসন-প্রথা ফেরানোর সঙ্গে সংবিধানের অন্য কোনো অনুচ্ছেদ সংশোধনের যোগসূত্র আছে, সেটাই স্বীকার করে না। কিন্তু সেখানেই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। নাগরিক সমাজকে বলতে হবে কাউন্সিল রাখার বিকল্প হচ্ছে তার সংস্কার। আর এই হচ্ছে তার রূপরেখা। বলতে হবে, কাউন্সিলের বিকল্প সংসদীয় অপসারণব্যবস্থাও চলতে পারে। কিন্তু সর্বাগ্রে সংসদকে প্রকৃত সংসদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সার্বভৌম সংসদের নামে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এখনই জোরেশোরে সংসদকে স্বাধীন করার কথা তুলতে হবে।
চার আইনবিদ ৭০ অনুচ্ছেদবিরোধী যে অবস্থান নিয়েছেন, সেটাই হতে পারে মূলমন্ত্র। তবে সেটা আমরা কেবল তাঁদের মতো করে বিচারক অপসারণ বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার আলোকেই বুঝব না; বুঝব পুরো রাষ্ট্র গঠনের ত্রুটি দূর করার দিক থেকে। আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও লাগবে; সংসদের স্বাধীনতাও লাগবে। বাহাত্তরে যে কারণ ও যুক্তিতে ৭০ অনুচ্ছেদ আনা হয়েছিল, তাতে সংকীর্ণ মানসিকতার ছাপ পড়েছিল। ১৯৭২ সালেই এর কোনো দরকার ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব যথেষ্ট উঁচুতে ছিল। বিশ্বের সব লিখিত সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং কেবল ব্যক্তিকে মহীয়ান করতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত করার এই ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারলে জাতির বড় উপকার করা হবে। কারণ, সবকিছু ছাপিয়ে বড় সত্য এই যে, ৭০ অনুচ্ছেদ থাকার কারণে বিদ্যমান কাউন্সিল-ব্যবস্থাও অকার্যকর রয়ে গেছে। আর সে কারণে বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার স্বাধীনতা এবং তার গণমুখী হওয়ার সম্ভাবনা অব্যাহতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।
আগামী কয়েক দিবসের মধ্যে যে বিধান আমরা পাচ্ছি, ভারত সেটা ১৯৫০ সালে লিখেছিল। সেই লেখাটা গৌণ বিষয় ছিল। মুখ্য ছিল আইন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যেটা আমাদের তিন মাসের মধ্যে পরিবেশন করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন, সেটা করতে ভারতের মতো দেশেরও দীর্ঘ সময় লেগেছিল। ১৯৬৪ সালে তারা বিল আনল। কী ধরনের কমিটি করে, কী প্রক্রিয়ায় বিচারক অপসারণ করা হবে, সে জন্য যৌথ কমিটি হলো। দুই বছর পরে তারা প্রতিবেদন দিল। এরও দুই বছর পরে ১৯৬৮ সালে বিল পাস হলো। এখন সেই আইনের একটি সংস্কার-প্রক্রিয়া প্রায় ১০ বছর ধরে চলমান আছে।
আমাদের নাগরিক সমাজ ও আইনবিদদের ভাবতে হবে, গণতন্ত্রের দাবিদার একটি সরকার তাদের কেন এতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারে। একটি সর্বদলীয় শক্তিশালী বার সম্মেলনের আহ্বানের কোনো প্রভাব সরকারের ওপর কেন নেই? সেটা কেবলই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছেন, সেই কারণে? আমি মনে করি, এটা একমাত্র কারণ নয়। জনসম্পৃক্ততা ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে একটা বিরাট শূন্যতা তাঁদের তরফেও রয়েছে। যেমন আইনবিদেরা প্রবলভাবে যুক্তি দিচ্ছেন যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। কাউন্সিল বিলোপ হলে এই মৌলিক কাঠামোয় আঘাত পড়বে। তাঁরা বলছেন না যে, নির্বাচন কমিশনসহ অন্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর স্বাধীনতাকে আমরা কী বলব? এসব সংস্থা সংবিধানের কী কাঠামো? এসব সংস্থার হয়ে বারের মতো কথা বলার কেউ নেই। তাহলে তাদের কথা কে বলবে?
সরকারের শক্তি হলো, নাগরিক সমাজ কখনো উঁচু স্বর তৈরি করতে পারেনি যে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় নির্বাহী ক্ষমতা থাকতে পারবে না। বাহাত্তরে এটা করা নিশ্চিত ভুল ছিল। তখন শুদ্ধ হলেও সেই কার্যকারণ আমূল বদলে গেছে। তাদের উচিত প্রতিটি সুযোগে এ কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলা। বিচ্ছিন্নভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো না বলা। কারণ, এটাই বলতে হবে, স্বাধীন সংসদ না থাকলে সংবিধানই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সংসদ সদস্যদের ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা নিয়ে রাজনীতিকেরা আন্দোলনে নামতে অপারগ। কেনা যায়—উক্তির মধ্যে সেটা আবারও পরিষ্কার হলো। আর এই ঘাটতি পূরণের দায় অন্যরাও নিতে চান না। সুপ্রিম কোর্ট বারকে কখনো আমরা ৭০ অনুচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনে নামতে দেখিনি। তাদের কখনো বলতেও শুনিনি, কেবল সংসদেরই নয়, প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা সত্যিকার অর্থে বিচার বিভাগ ও বিচারকের স্বাধীনতার মারাত্মক অন্তরায়। আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম ইত্তেফাককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যখন বলেন, সুপ্রিম কাউন্সিল একটি মীমাংসিত বিষয়, তখন তা আমাদের হতবিহ্বল করে। কারণ, বিষয়টি ১৯৭২ সাল থেকেই অমীমাসিংত এবং তা দালিলিকভাবে প্রমাণিত। বাহাত্তরে যদি ওই আইন নিয়ে আলোচনা হতো, তখন তাঁদের মনে পড়ত যে, ৭০ অনুচ্ছেদের প্রভাব সব সাংবিধানিক সংস্থার ওপর কী হতে পারে। মাননীয় সংবিধানপ্রণেতারা স্বীকার করুন, আপনারা ৭২ সালে প্রধানমন্ত্রীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং ৭০ অনুচ্ছেদ ঢুকিয়ে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত, মীমাংসিত ও অনুসৃত ‘ক্ষমতার পৃথক্করণ’ নীতিকে ধূলিসাৎ করেছিলেন।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে। ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কার্য করবেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেনও, ক্ষমতা তো রাষ্ট্রপতির হাতেই থাকছে। এর মানে কী? সংবিধানে যেখানেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার কথা আছে, সেখানেই আসলে ক্ষমতাটা ভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে প্রস্তাব পাস হলে কি আপনাআপনি কেউ অপসারিত হবেন? নাকি সংসদ তখনো প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে?
আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইন না করা পর্যন্ত নতুন আনা অনুচ্ছেদটি মৃতই থাকবে। তাহলে মৃতকে আনতে এত ব্যাকুল কেন। আইনমন্ত্রী সাবেক বিচারপতিদের দিয়ে তদন্ত কমিটির যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা আরও ক্ষতিকর ফল বয়ে আনতে পারে। এর অর্থ হলো, সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদকে আমরা আর বাহাত্তরের মতো ফেরত পাব না। এটা ফেরত চাই। এই অনুচ্ছেদ অবসরের পরে বিচারকদের চাকরি নিষিদ্ধ করেছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই বিষয়ে আইনজীবীরা নীরব। এই নীরবতা ভাঙুন। বিল পাস থেকে সরকার বিরত থাকুন। সেটা কাউন্সিল বহাল রাখতে নয়, সেটা অনেক বেশি জরুরি অভিশংসনবিষয়ক একটি ত্রুটিমুক্ত কার্যকর আইন তৈরি করতেও।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.