যে প্রশ্নের জবাব সরকারের নিজেরও জানা নেই by নূরে আলম সিদ্দিকী
৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হওয়ার পর হয় নিদারুণ দাম্ভিকতা অথবা মর্মান্তিক অদূরদর্শিতা,
মননশীলতার দৈন্যের কারণে সরকার একেকটি নতুন বিতর্কের উপস্থাপন করছে। যে
প্রশ্নের জবাব ও যৌক্তিকতা সরকার নিজে অবগত অথবা এর সঠিক জবাব দিতে তারা
প্রস্তুত কিনা সেটি রাজনীতির আজ বড় প্রশ্ন। সম্প্রতিকালে এ কে খন্দকারের
‘জয় পাকিস্তান’ নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় উঠলো সেখানেও মূল প্রশ্নটি হলো ১৫ই
আগস্টের পর এ কে খন্দকার সাহেব খুনি মোশ্তাকের প্রতি প্রকাশ্য আনুগত্য
প্রকাশ করলেন। বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য জেনারেল শফিউল্লাহ, এ কে
খন্দকার, মোশাররফ হোসেন খানদের যে নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল সেটি
তো করেনইনি বরং বাংলাদেশ বেতারে স্ব-ইচ্ছায় খুনি মোশ্তাক সরকারের সমর্থন
প্রদান করেছেন। জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভায়ও তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন।
তাকে ২০০৮-২০১৪ সাল পর্যন্ত কোন যুক্তিতে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য রাখা হলো?
স্বৈরাচারী মানসিকতার এহেন স্বেচ্ছাচারিতা বিরল ও দৃষ্টান্তবিহীন।
দলের পরিচালনা পরিষদ, নীতিনির্ধারণী প্রেসিডিয়াম, সংসদ, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা শুধু অকার্যকরই নয়, কেবল দলীয়করণের আবর্তে অন্তরীণই নয়, প্রধানমন্ত্রীর এতটাই আজ্ঞাবহ যে, শেখ হাসিনার অর্চনা-তোষামোদীর প্রতিযোগিতায় বিবেক বিবর্জিত; অন্ধের মতো যখন ছুটছে, শাসনতন্ত্র তার আঁচলে বাঁধা- এ নির্মম সত্যটি যখন বিশ্ববাসীর কাছে প্রতীয়মান তখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দু’টি প্রধান স্তম্ভ গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অভিশংসন আইন প্রণয়নে এ নির্লজ্জ উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিশ্ব জনমতকে তিনি যে বার্তা দিলেন, এক কথায় নিজেকে প্রতিভাত করলেন- তা হলো, তিনি মনে করেন রাষ্ট্রশাসনে জনগণ, বিশেষজ্ঞের মত, সংসদ, প্রশাসন, আইন বিভাগ কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। তার ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও অভিলাষই সর্বশেষ এবং একমাত্র বিধান। বাংলাদেশে তিনি কারও কাছে জবাবদিহির আওতায় নেই। বিশ্ববাসীর বিশ্লেষণে তিনি রোমান সম্রাটের চেয়েও শক্তিশালী। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি জানি রোমান সম্রাট জাতীয় সমস্যা অথবা কোন নতুন অভিযান পরিচালনা করলে তার মন্ত্রিপরিষদ, সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে চুলচেরা আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নিতেন। গ্রিক সভ্যতার প্রাক্কালেও স্বাধীন ও সার্বভৌম পার্লামেন্ট ছিল এবং সংসদ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, সংসদের অভিমতকে এড়িয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
প্লেটোসহ তৎকালীন দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কালজয়ী ও প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গের শিক্ষক সক্রেটিসের বিচারও সংসদের অভ্যন্তরেই হয়েছিল। যারা এই অভিশংসন আইন, সম্প্রচার আইন নিয়ে নানা আবোল-তাবোল কথা বলছেন, ভাগ্যিস তারা এসব দৃষ্টান্ত দেননি বা দিতে পারেননি। অভিশংসন বিলটি সংসদে পেশ হওয়ার পর এর বিচার-বিশ্লেষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ, শাসনতন্ত্রের প্রণেতাগণসহ বহু বিশ্লেষক, আইনজীবী বিবেকের নিভু নিভু আলোয় এখনও যারা নিজেদের তুলে ধরতে চাইছেন তারা সকলেই প্রস্তাবটি আইনে পরিণত করার আগে গণভোটে পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন। আমি এদের মতো প্রজ্ঞার অধিকারী না হলেও এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলাম। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে তার বিশেষ বাচন ভঙ্গিমায় সংসদকে জানালেন, ’৭২-এর সংবিধানের সংযোজিত ধারাটি কেবল পুনরুজ্জীবিতই করা হলো না বরং তাদের চাকরির নিশ্চয়তা অধিক নিরাপদ করা হলো যে, ইমপিচমেন্ট কমিটির সদস্যদের সুপারিশ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন, তারপরই রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। নিন্দুক এবং তার সমালোচকরা তার ইন্টেগ্রিটি নিয়ে যত কটাক্ষ, যত সমালোচনাই করেন না কেন আমি এ প্রসঙ্গে কোন বিতর্কে যেতে চাই না। তার বাকচাতুর্যে আমার কোন সন্দেহ নেই। তার একটি অদ্ভুত উপস্থাপন-ভঙ্গি এবং বিরল হাস্যোজ্জ্বল মুখ তার তীব্র বিরোধীকেও সাময়িকভাবে হলেও আকৃষ্ট করে। কিন্তু চমক ভাঙতে সময় লাগে না। শুধু সুরঞ্জিত বাবুই নন, বড়-ছোট, মাঝারি পাতি নেতারাও কৃতার্থ চিত্তে এবং বিগলিত হৃদয়ে প্রায়ই বলেন- নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্রের সকল অঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। কথাটি সঙ্গত এবং যুক্তিগ্রাহ্য হতো যদি সংসদের নির্বাচনের প্রশ্নে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটি দেশে এবং বিদেশে অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে আখ্যায়িত না হতো। শুধু ১৫৩ জন সংসদ সদস্যই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত নন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটি গণতন্ত্রের নামে একটি প্রহসন। এবং স্বয়ং শেখ হাসিনার উক্তি, এটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন।
’৭২-এর সংবিধানের স্বীকৃতি ও ম্যান্ডেট নেয়ার জন্য ’৭৩-এর নির্বাচনটি বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী নেতৃত্বে বিকশিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকেই সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে সিরাজ শিকদার ও গণবাহিনীর অস্ত্র যখন গণতন্ত্র ও মানবতাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে তুলেছিল সেই অরাজকতা, থানা লুট, খাদ্যগুদামে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি বীভৎস নারকীয় পরিবেশে নির্বাচন না দেয়ার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা না থাকা সত্ত্বেও ’৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৯১টি (৩০০টির মধ্যে) আসনপ্রাপ্তি সংবিধানকে ম্যান্ডেটস্বীকৃত করে; বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও গণতান্ত্রিক চেতনার মননশীলতাকে হিমাচলের গিরিশৃঙ্গমালার উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে। তখনকার রাজনৈতিক আঙ্গিকে সকলেরই বিশ্বাস ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব আসবে এবং নতুন নতুন মুখ নির্বাচিত হয়ে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো শুধু সংসদে নয়, দেশে গণতন্ত্রের আলো ছড়াবে। শুধু শাসনতন্ত্রে ও লৌকিকতায় নয়, প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগ কংগ্রেসের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হবে এবং সংসদও ভারতীয় সংসদের মতো যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, কার্যকর অর্থে অনুশীলনে, চর্চায়, মননশীলতায় কোন ব্যক্তি বা দলের নয়, দেশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে সংসদকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক পাদপীঠে রূপান্তরিত করবে। বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন হবে দলীয় সংকীর্ণতার প্রভাব বিবর্জিত একেকটি গণতান্ত্রিক পাদপীঠ এবং স্বমহিমায় উদ্ভাসিত নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। ’৯১-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে যতই দিন পেরিয়েছে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা পাওয়া তো দূরে থাক, ব্যক্তিতান্ত্রিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে। দেশ শাসনের প্রশ্নে জনগণ, তাদের মতামত ও স্বার্থ আজ কেবল অপাঙ্ক্তেয়ই নয়, নির্মমভাবে উপেক্ষিত। সেখানে বিচারপতির অভিশংসন ও সম্প্রচার আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ’৭২-এর শাসনতন্ত্র থেকে ভারতসহ যে কোন সংসদের উদাহরণ টানা আজকে একটি বিরাট কৌতুক।
১৯৭৫ সালে মস্কোপন্থি বামদের সুপরিকল্পিত ও কৌশলী চক্রান্তে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। বর্তমানে মস্কো-পিকিং ও গণবাহিনী প্রবর্তকদের বিরামহীন ইন্ধনে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে অকস্মাৎ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বিলুপ্তির মাধ্যমে একদলীয় নয়, বরং এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই এ কে খন্দকার, জেনারেল শফিউল্লাহ, এম এইচ খান, জেনারেল খলিল ও এইচ টি ইমামের মতো সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিরা খুনি মোশ্তাকের সুস্পষ্ট মদতদাতা হওয়ার পরও কোন শাস্তি তো পানইনি, বরং পুরস্কৃত হয়েছেন। অজ্ঞাত পরিচয়, অনভিজ্ঞ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক মস্কো-পিকিংপন্থি ভ্রান্ত বাম ও গণবাহিনীর শক্তিশালী নেতারা ক্ষমতায় সদম্ভে অধিষ্ঠিত থাকার কারণে আক্ষেপে আমি লিখেছিলাম- কর্নেল তাহের ও সিরাজ শিকদার জীবিত থাকলে তারাও বোধহয় শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার শোভা বর্ধন করতেন। কথাটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকার হিসেবে আমার ব্যক্তিগত হলেও নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে প্রেসিডিয়াম এমনকি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পর্যায়ের সদস্যদের এত অসংখ্য সমর্থনসূচক টেলিফোন আমি পেয়েছি যা আমাকে শুধু আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূতই করেনি, মনে হয়েছে আমি আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতা ও কর্মীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, পৃথিবীর যেখানেই গণতন্ত্রের লেশমাত্র রয়েছে সেখানেই কোন না কোনভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তিতান্ত্রিকতার ভিত্তি যখন ক্রমেই জগদ্দল পাথরে রূপান্তরিত হচ্ছে তখন প্রায়ই নতুন নতুন আইন, অনুশাসন, দম্ভোক্তি মানুষকে ব্যথিত ও স্তম্ভিত করছে এবং দেশকে এক অজানা আশঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে সংসদে জাতীয় পার্টির ক্যারিকেচার এবং সংসদের বাইরে কেবলই ক্ষমতালিপ্সু, ভগ্ন মেরুদণ্ড, জনসমর্থনহীন বিএনপির প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সামান্য প্রতিরোধ করারও শক্তি নিঃশেষিত হচ্ছে। এটাও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম বাস্তব দৃষ্টান্ত। সামগ্রিকভাবে জাতি আজ ঘনঘোর অন্ধকার অমানিশার মধ্যে নিপতিত।
এই চরম হতাশার মুহূর্তেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখি বলেই নতুন প্রজন্মের প্রতি আমি উদাত্ত আহ্বান জানাবো, তোমরা আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়ে এই ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে অকুতোভয়ে এগিয়ে আসো। তোমরাই পারবে আরেকটি ৬৯, ৭০ বা ৭১-এর জন্ম দিতে। আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাস শিক্ষা দেয়- গণতান্ত্রিক অধিকার ভিক্ষা চেয়ে পাওয়া যায় না, আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্জ্বলিত হয়েই তাকে অর্জন করতে হয় এবং সেটি স্বার্থবিবর্জিত নতুন প্রজন্মের পক্ষেই সম্ভব।
No comments