মুঘল ভারতের অলিন্দে by ড. মাহফুজ পারভেজ

বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে মানুষ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। একদল, যারা তাজমহল দেখেছে। আরেক দল, যারা দেখে নি। তাজমহলের শহর আগ্রাকে বলা হয় মুঘল ঐতিহ্যের হৃৎপিণ্ড। মুঘলদের যতগুলো রাজধানী ছিল, তারমধ্যে দীর্ঘস্থায়ী হলো আগ্রা। মধ্যযুগের বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর আগ্রায় এখনো বিশ্বের নানা প্রান্তের ভ্রমণ বিলাসী মানবস্রোত গভীর আগ্রহ নিয়ে উপসি'ত হয়। ভারতের পর্যটন ক্ষেত্রের মধ্যে যে কারণে শীর্ষে অবস্থান করছে আগ্রা। উত্তর ভারতের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণের সূত্রে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নাভিমূল, মুঘল রাজধানী, তাজমহলের শহর আগ্রা সম্পর্কে সবিস্তারে হচ্ছে এই লেখায়। বর্তমানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অতীতের বিচিত্র উপাদান দিয়ে সাজানো হয়েছে লেখাটি।

বৃষ্টিস্নাত জয়পুর থেকে আগ্রার পথে
আমরা আগ্রায় প্রবেশ করি তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে। সারা উত্তর ভারতই তখন বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। মধ্য সেপ্টেম্বরের বর্ষণে কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব। বৃষ্টিভেজা সড়ক পথে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে আগ্রায় এসেই মুখোমুখি হলাম প্রবল বর্ষণের।
মধ্যযুগে ভারতের রাজধানী আগ্রা নানা কারণে এখনো গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত মুঘল স্থাপনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রাচীন আগ্রা। বাগিচা, প্রাসাদ ও দুর্গের নগরীতে ঢুকতেই গা ছমছমে ইতিহাসের পরশ পেলাম, যার কয়েকটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক ও যোগাযোগের দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলগত স্থান হওয়ায় আগ্রাকে শাসনের কেন্দ্রস'ল রূপে বেছে নিয়েছিলেন মুঘলরা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রায় প্রবেশের অনেকগুলো পথ রয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুঘল বিজেতারা দিল্লি জয় করলেও রাজধানী বানিয়েছিলেন আগ্রায়। আগেকার মুসলিম শাসকদের হাতে গড়া রাজধানী দিল্লিকে ছেড়ে আগ্রায় ক্ষমতার মূলকেন্দ্র ও রাজধানী তৈরির পেছনে অনেকগুলো বিবেচনার মধ্যে আগ্রার কৌশলগত ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ও যোগাযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।

আগ্রা থেকে ভারতের সব দিকে যাওয়ার পথ সুগম। সব জায়গা থেকে আগ্রায় আসাও সহজ। উত্তর প্রদেশের অংশ হলেও আগ্রা দিল্লির কাছেই। পাঞ্জাব থেকে সন্নিকটে। রাজস্থান, গুজরাত হয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দিকেও পথ উন্মুক্ত। মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র থেকেও আসা যায় আগ্রায়। আর লক্ষ্ণৌ, আলিগড় ছুঁয়ে বিহারের পাটনা হয়ে বাংলায় যাতায়াতের সুবিধাও আগ্রার রয়েছে।
এক সময়ে ভারতের রাজধানী বা এক নম্বর শহর আগ্রা এখন উত্তর প্রদেশের চতুর্থ আর সারা ভারতের ২৪তম গুরুত্বপূর্ণ শহর। উত্তর ভারতের হিন্দি-উর্দু বলয়ের এই শহরের প্রধান ভাষা হিন্দুস্থানি তথা হিন্দি ও উর্দু। জনসংখ্যার ৮৫% ভাগ হিন্দু, ১০% মুসলমান আর বাকি জনসংখ্যা জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত হিন্দি পত্রিকা দৈনিক জাগরণ-এর প্রধান দপ্তর আগ্রায়, যদিও উত্তর ভারতের অন্যান্য শহর থেকেও পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় একযোগে।

আগ্রাকে বলা যায় উত্তর ভারত বা হিন্দি বলয়ের অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন কেন্দ্র। মুঘল স্থাপনা ছাড়াও এখানে আছে ক্যান্টনমেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা। আগ্রার প্রধান দ্রষ্টব্য অবশ্য বিশ্বের বিস্ময় তাজমহল, আগ্রার দুর্গ ও সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি, যার প্রতিটিই ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিজেট বা বিশ্বসভ্যতার অংশ। এগুলো ছাড়াও ছোট-বড় আরও বহু দর্শনীয় স্থান, বাগ-বাগিচা-উদ্যান, হর্ম্য, প্রাসাদ, স্থাপনা ছড়িয়ে আছে আগ্রার সর্বত্র।
ভারতের প্রধান পর্যটন ডেসটিনেশন বা ভ্রমণ এলাকাকে বলা হয় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল বা সোনালি ত্রিভুজ, যার একবাহু দিল্লিতে, আরেক বাহু জয়পুরে এবং অন্য বাহু আগ্রায় মিশেছে। ত্রিভুজের মতো এই তিনটি এলাকাতেই ভারতের সিংহভাগ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন।

জয়পুর থেকে আসার কারণে আমরা পথে পেয়েছি উত্তর প্রদেশের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যার মধ্যে রয়েছে মথুরা ও বৃন্দাবন। জয়পুর-আগ্রা সুপার হাইওয়ে ধরে রিজার্ভ কারে চলতে চলতে সুবিধা মতো থেমে থেমে এগিয়েছি আমরা। পথের ধারে রাজস্থানী ধাবায় চা, নাস্তা করে দেখেছি ঊষর মরুময় প্রান্তরে সবুজের সমাবেশ। রঙ-বেরঙের শাড়ি ও ওড়নায় ঢাকা রাজস্থানের গ্রাম্য নারীদের। বিশালাকায় পাগড়ি মাথায় রাজস্থানের রাজপুত বা জাট। কখনো ময়ূরের সমাবেশ বা উটের বহর।
গ্রামের দিকে পুরুষদের সবারই বড় পাগড়ি ব্যবহারের রহস্য বুঝতে গিয়ে দেখলাম, এর সঙ্গে ঐতিহ্য ও বাস্তব প্রয়োজন মিশে আছে। রাজস্থানের মরুময় ও ঊষর ভূমি থেকে প্রচুর ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। বিরাট পাগড়িতে নাক, মুখ, মাথা, শরীর ঢেকে ফেলার সুবিধা নিয়ে থাকেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
জয়পুর থেকে আগ্রা যেতে একটি পাহাড়ের ভেতরের সংক্ষিপ্ত ট্যানেল পেরিয়ে ধরতে হয় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মাঝ দিয়ে প্রসারিত সুপার হাইওয়ে। ২০০ মাইলের এই দূরত্ব নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর। পথের পাশে হাট, বাজার ও ছোট ছোট শহর। আর আছে প্রতিমা ও পূজার মঞ্চ তৈরির কুটির শিল্প। মার্বেল ও গ্রাফাইট পাথর কেটে কেটে বানানো হয় মনোরম প্রতিমূর্তি, যেজন্য যোধপুর, কিষাণগড়, জয়সালমের থেকে আসে বাহারি পাথর।

রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশের সীমানায় হিন্দু তীর্থক্ষেত্র মথুরা ও বৃন্দাবন জয়পুর-আগ্রা সড়কের পাশেই। ফলে পূজার সামগ্রী ও প্রতিমা বানানো আর বিক্রির জমজমাট বাজার চারপাশে। হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে এই নির্দিষ্ট স্থানে।  
সড়কের রাজস্থান অংশ পেরিয়ে উত্তর প্রদেশে ঢুকতেই হিন্দি ভাষা, পোশাক, পরিচ্ছদে পার্থক্য দেখা গেল। রাজস্থানের হিন্দিতে গুজরাতি, মাড়োয়ারি ও পাঞ্জাবি টান বদলে গেল। উত্তর প্রদেশের হিন্দিতে পাওয়া গেল উর্দু আর বিহারি হিন্দির প্রভাব। হিন্দি ভাষার অনেকগুলো উপভাষা ও কথ্যরূপ আছে। যার মধ্যে মৈথিলি, ভোজপুরি, ব্রজবুলি ইত্যাদি অন্যতম। বিশাল উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের নানা প্রান্তে চর্চিত হচ্ছে হিন্দি ভাষার একেকটি ধারা।    
মথুরা ও বৃন্দাবনে এক চক্কর দিতে গিয়ে পেলাম পেয়ারিলালকে। অবসর নিয়ে ফৌজি ধাবা নামে জলপানির দোকান চালাচ্ছেন তিনি। চাকরি করেছেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামেও। ভাঙা ভাঙা বাংলা জানেন। ঢাকা ও বাংলাদেশের অনেক কথা বললেন তিনি।
কৃষ্ণের কারণে মথুরা আর রাধার জন্য বৃন্দাবন প্রসিদ্ধ। স্থান দুটি বৈষ্ণব ভাবধারার হিন্দুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মন্দির আর ভক্তের উপসি'তিতে মুখর স্থান দুটি। একটির থেকে আরেকটি মোটামুটি নিকটবর্তী। তবে বৃন্দা বা তুলসী বন নামে পরিচিতি বৃন্দাবনে নগরায়ণের ফলে বনাঞ্চল কমছে। কিন' ভক্তি-মিশ্রিত ধর্মীয় ভাবাবেগ আর প্রেমের বাতাবরণ সেখানে অটুট। বার্ডস আই ভিউ ধরনের সংক্ষিপ্ততম চোখের দেখা দেখে ফিরে আসার সময় আর্দ্র হৃদয়ে বাজে দুটি লাইন:
সে কি মথুরায় থাকে আমায় ভুলে
বাজে বাঁশি যুগে যুগে যমুনা কূলে।

ধর্মীয় ভক্তির নিদর্শন কিন' ভারতের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে খুবই স্পষ্ট। রাজস্থানের মুসলিম ধর্মীয় কেন্দ্র আজমির থেকে খানিক এগিয়ে গেলে টিলা ও মরুর উপান্তে পৃথিবীর একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির পুষ্পর। সেসব স্থানে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমাদের মূল আকর্ষণ যেহেতু আগ্রা, তাই পথের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোতে যথেষ্ট সময় দেয়া যায় নি। এমনিতেই বৃষ্টি পিছু নেওয়ায় গাড়ির গতি কমিয়ে রেখেছে ড্রাইভার সুরজিৎ। এসিতে বসে গাড়ির এফএম রেডিওতে রাজস্থানী কান্ট্রি মিউজিক শুনতে শুনতে চলে এলাম আগ্রার কাছাকাছি। আগ্রার শহরে প্রবেশের আগে আগে পথে পড়লো বিখ্যাত ফতেহপুর সিক্রি। দিল্লি হয়ে এলে মূল আগ্রা শহর আগে পড়তো। আমরা বিপরীত দিক দিয়ে আসায় এ সুবিধা পেলাম। ভোরে রওয়ানা দিয়ে থেমে থেমে ১১টা নাগাদ ফতেহপুরের সামনে পৌঁছে গেলাম। মূল সড়ক থেকে ডানে মোড় দিয়ে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ফতেহপুর সিক্রি। যদিও হাইওয়ে থেকে ফতেহপুর সিক্রির প্রাচীর ঘেরা দুর্গ-সদৃশ্য বিশালাকায় নগরীর আবছায়া দেখা যায়, তথাপি এতে প্রবেশ করতে হয় মূল সড়ক থেকে উপপথ ধরে খানিকটা ভেতরে এসে।

আমরা ঠিক করেছি দুপুরটা এখানে কাটিয়ে বিকালে যাবো আগ্রা শহরের মূল আকর্ষণ বিশ্বের বিস্ময় তাজমহলে। তারপর রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন আগ্রার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে। যমুনা তীরে স্থাপিত ইতিহাসের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় ঐতিহাসিক আগ্রা-ফতেহপুরের বৃষ্টিভেজা বাতাসের স্পর্শে কেমন একটা শিহরণ দোলা দিল শরীর ও মনে। গাড়ি থেকে নামতে সময় লাগলো কিছুটা। তন্ময় চোখে ফতেহপুর সিক্রিতে প্রবেশের অতিকায় বুলন্দ দরওয়াজা নামের রাজকীয় তোরণের দিকে তাকাতেই মনে হলো ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছি ইতিহাসের অলিন্দে।  

ফতেহপুর সিক্রি
পরিত্যক্ত মুঘল রাজধানীতে ষোড়শ শতকে শুরু হয়ে (৩০ এপ্রিল, ১৫২৬) ঊনিশ শতকে সমাপ্ত (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭) কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে মাত্র ১৪ বছর রাজধানী ছিল ফতেহপুর সিক্রি। সে আমলে রাজা-বাদশাহের খেয়াল-খুশির অন্ত ছিল না। আর সেসব ছিল বড়ই বিচিত্র ও সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের চেয়ে অনেক আলাদা। ফতেহপুর সিক্রিতে মিশে আছে সেইসব রাজসিক খেয়ালের খানিকটা ঝলক।
স্বল্প জীবনপ্রাপ্ত হলেও ফতেহপুর সিক্রির দীর্ঘ ইতিহাস ও তাৎপর্য আছে। ১৫৭১ সালে এখানে রাজধানী বানিয়ে তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালেই তা সরিয়ে নেন। ১৬১০ সালে শহরটি সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হয়। পরিত্যক্ত হয়ে নিঃসঙ্গভাবে পড়ে থাকে বিশাল স্থাপনাসমূহ, যা এখন ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যের অংশ।

রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি ফতেহপুর সিক্রির সঙ্গে মিশে আছে আধিভৌতিক রহস্যময়তা। কালের করাল গ্রাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন রাজধানীর পাদদেশে টুপটুপ বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সেই পরশ এসে শরীরে লাগলো। খানিক অপেক্ষার পর বৃষ্টির আঁচ কমে এলে আমরা ফতেহপুরের ভেতরে প্রবেশ করি আর তখনো এর অতীত ও ইতিহাসের গুঞ্জন সঙ্গী হলো আমাদের।
সম্রাট আকবর এখানে রাজধানী স্থাপন করার আগে সিক্রি নামের একটি গ্রাম ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর এ জায়গাটি চিনতেন এবং পছন্দও করতেন। ফলে জায়গাটি মুঘলদের কাছে অচেনা-অজানা ছিল না। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সিক্রি নামটি সম্রাট বাবরের দেওয়া। বাবর এই এলাকাটিকে বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য অনেকবার ব্যবহার করেছিলেন এবং সিক্রির নিকটবর্তী সীমান্তে রাজস্থান-পাঞ্জাব হয়ে আগত মহারাজা রানা সংগ্রাম সিংহের বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন।
বাবরের জীবনীকার বেভারেজ লিখেছেন, রানা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে বাবর এখানে ফতেহবাগ বা বিজয় উদ্যান নামে একটি বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্য এশিয়ান মুঘলদের উদ্যানপ্রীতি ছিল সর্বজনবিদিত। তারা যেখানেই কর্তৃত্ব করেছে, সেখানেই সুপরিকল্পিত বাগান বা উদ্যান বানিয়েছেন। বাগানকে তারা বলতেন  গুলিস্তাঁ। আগ্রার চারদিকে শত শত বছর পরেও ছড়িয়ে আছে মুঘল রাজন্যদের উদ্যানপ্রেমের চিহ্ন। দিল্লি, ঢাকা, কাশ্মীর, লাহোর, সর্বত্র মুঘল-প্রতিষ্ঠিত বাগানের দেখা পাওয়া যায় এখনো।
ফতেহপুরে বাবরের বাগান সম্পর্কে তার কন্যা ও সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী হুমায়ূননামা-এর রচয়িতা গুলবদন বেগম লিখেছেন, বাবর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন, যা তিনি বিনোদন ও লেখার কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি নিকটবর্তী ঝিলের মাঝখানে একটি বেদিও নির্মাণ করেন।
     
সম্রাট আকবর রাজধানী বানানোর সময় (১৫৭১) জায়গাটির কোনো আনুষ্ঠানিক নামকরণ করেন নি। রাজকীয় ফরমান দিয়ে ফতেহপুর বা বিজয়ের শহর নামটি প্রতিষ্ঠা করেন আরো পরে, ১৫৭৩ সালে গুজরাট জয় উপলক্ষে। তারও আগে, ১৫৬৯ সালে বেশ পরিণত বয়সে এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে আকবরের ঔরসে। আগে থেকেই এখানে শেখ সেলিম চিস্তি নামে একজন বুজুর্গ পিরের খানকাহ বা আশ্রম ছিল এবং পিরের দোয়ায় আকবর পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন বলে পুত্রের নামও রাখা হয় পিরের নামানুসারে, সেলিম, যিনি পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে খ্যাত। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় জন্মদিনেই আকবর এখানে রাজধানী নির্মাণ শুরু করেন।  

জয়পুর-আগ্রা হাইওয়ে থেকে ডানে মোড় দিয়ে যে গলিপথ, তাতে কিছুদূর এগিয়ে আবার ডানে কিঞ্চিত উপরের দিকে উঠতে হয় ফতেহপুর সিক্রিতে যেতে। আকবর বাদশাহের এই রাজধানী নগরীটি কিছুটা উচ্চভূমিতে অবসি'ত। নগরের প্রবেশের মুখেই বুলন্দ দরওয়াজা নামে বিশাল গেট। মধ্যযুগের বিবেচনায় সুবিশাল তোরণে এক সুপরিকল্পিত নগরীর প্রাচীন প্রচ্ছায়া ভেসে আসে প্রথম দর্শনেই। মুঘল পূর্ব-পুরুষ তৈমুর লং মধ্য এশিয়ার রীতির সঙ্গে পারসিক আদলের মিশেলে যে স্থাপত্যশৈলীর প্রচলন করেছিলেন, সম্রাট আকবর সেভাবে ফতেহপুর সিক্রি নির্মাণ করতে চাইলেও এতে স্থানীয় স্থাপত্যরীতির মিশেল হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। পার্শ্ববর্তী রাজস্থানে প্রচুর ও বিচিত্র বেলেপাথর থাকায় ভেতরের অট্টালিকাগুলো পাথুরে এবং অধিকাংশই লালচে রঙের। মুঘলরা সাধারণত লাল আর সাদা, এই দুই রঙের প্রতি তাদের আগ্রহ দেখিয়েছেন। মুঘল স্থাপনাগুলোর যেগুলো ধর্মস্থান বা সমাধিস'ল, সেগুলো সাধারণ সাদা আর রাজকীয় অন্যান্য নির্মাণের ক্ষেত্রে লাল রঙের প্রাধান্য দিয়েছেন তারা।    
 
মুঘলরা ভারতকে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও স্থাপত্য উপহার দিয়েই শেষ করেন নি, এখনো আয়ের পথ খুলে দিয়ে গেছেন। টিকিট কেটে ঢুকতে হচ্ছে এসব স্থাপনায়। এতে ভারতীয়দের জন্য টিকিটের দাম কম হলেও বিদেশিদের জন্য যথেষ্ট উচ্চমূল্য। তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, কুতুব মিনারসহ বিভিন্ন মুঘল ও মুসলিম স্থাপনায় লাখ লাখ পর্যটক কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে ভারত সরকারের তহবিলে। টিকিটের পাশাপাশি দালাল ও গাইডের লম্বা বহর। সব কিছু চিনিয়ে-জানিয়ে দেওয়ার জন্য পিছু নেয় তারা। ভারতের মুঘল ঐতিহ্য এমনই এক নিঃশেষ-না-হওয়া বিষয়, যা এখনো খুলে রেখেছে কর্মসংস্থান ও রোজগারের পথ!

বৃষ্টির কারণে ফতেহপুর সিক্রিতে ভিড় কম। দালাল ও গাইডরাও তেমন নেই। ড্রাইভার সুরজিৎ সঙ্গী হলো আমাদের। রাজপুত যুবক এ পথে পর্যটক আনা-নেওয়া করতে করতে ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্থান-কাল সম্পর্কে বেশ ওয়াকেবহাল। যথারীতি বুলন্দ দরওয়াজা দিয়েই প্রবেশ করি আমরা। তবে বাদশাহী দরওয়াজা নামে আরেকটি প্রবেশদ্বারও রয়েছে। লাল-হলুদ বেলে পাথরে নির্মিত ফটকে সাদা-কালো মার্বেল দিয়ে নকশা করা। মাটি থেকে ৫৪ মিটার লম্বা দরওয়াজা পর্যন্ত পৌঁছাতে ৪২টি সিঁড়ির ধাপ উঠতে হলো। দরজার পাল্লাগুলো কাঠের কারুকাজ করা এবং এর মাথায় এক সারি প্যারাপেট ও পেছনে তিনটি ছত্রী রয়েছে। মূল দ্বারের দেওয়ালে খোদাই করা আছে ধর্মকথা, যাতে এই বিশ্বের নশ্বরতার উল্লেখ করে অবিনশ্বর সৃষ্টিকর্তার গুণ কীর্তন করা হয়েছে। বুলন্দ বা সুমহান নামে খ্যাত প্রবেশ তোরণে সৃষ্টিকর্তার মহিমাব্যঞ্জক বাণী থাকাই স্বাভাবিক।

ফতেহপুরের ভেতরে প্রাসাদ প্রাঙ্গণ, যেখানে জ্যামিতিকভাবে সজ্জিত বেশকিছু চাতাল দেখা গেল। রয়েছে বুজুর্গ-পির সেলিম চিস্তির মাজার শরিফ। দুর্দান্ত শিল্প ভাবনা ও নান্দনিক স্থাপত্যের কেন্দ্রবিন্দু ফতেহপুর সিক্রির চারদিকে তাকিয়েই নিজের বোকামির জন্য লজ্জিত হলাম। বৃষ্টিসিক্ত বিরূপ আবহাওয়ায় আর স্বল্প সময় নিয়ে এখানে আসার কোনও মানেই হয় না। পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করে দেখতে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে এখানে আসাই শ্রেয়। তা না হলে দুই মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া প্রাসাদ আর প্রাঙ্গণ সমৃদ্ধ রাজধানী শহর ভালো করে দেখা মোটেও সম্ভব নয়।
পুরো ফতেহপুর সিক্রি পাঁচ মাইল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মনে করা হয়, রাজপুত, জাঠ, মারাঠা, শিখ আক্রমণের কারণে শহরটিকে দুর্গ-সদৃশ্য করা হয়েছে মুঘল যুদ্ধরীতি ও প্রতিরক্ষা কৌশলের আলোকে। আগ্রা দুর্গও তেমনি। রাজস্থানেও দুর্গ শহর দেখেছি। মধ্যযুগের শহরগুলো সামরিক নিরাপত্তার কারণে সুদৃঢ় প্রাচীর বেষ্টিত দেখতে পাওয়া যায়। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, শত শত বছর পরেও প্রাচীরগুলো বেশ মজবুত ও সুরক্ষিত।

সুললিত ও সুসজ্জিত ফতেহপুর আবাস দেখে মুঘলদের পরিচ্ছন্ন রুচি ও গুছানো প্রশাসনিক কার্যক্রমের নমুনা বোঝা যায়। রাষ্ট্রীয় কাজ, বসবাস, আহার, বিহার, বিনোদন ও অন্যান্য তৎপরতায় জীবনকে চমৎকার অবকাঠামোয় প্রবাহিত করেছিলেন মুঘলরা। তৎকালের ভারতে সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, খাদ্য, উন্নত প্রশাসনের পাশাপাশি যুক্ত করেছিলেন স্থাপত্য সুষমায় ঋদ্ধ নান্দনিক বসবাসের আমেজ।
হাতের সময়কে যথাসম্ভব কাজে লাগানোর পরও ফতেহপুর সিক্রি পুরো ঘুরে না দেখতে পারার অতৃপ্তি নিয়ে ফিরতে হলো। ভেতরে অনেক ছোট বড় স্থাপনা, মহল, প্রাঙ্গণ এবং এসবের ইতিহাস ও শিল্প গুণ পরখ করে দেখার জন্য পুরো একটি দিনও মনে হয় যথেষ্ট নয়। অনুচ্চ ফতেহপুর সিক্রির চারপাশে প্রসারিত বিশাল ভারতের সবগুলো দিক, যেখানে বসে মধ্য এশিয়ার পারস্য-তুর্কি-মোঙ্গল ঐতিহ্যের মুঘলরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজের শৈল্পিক রূপান্তর সাধন ও সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ করেছিলেন, যার ঐতিহাসিক প্রভাব আজও অম্লান।  

কয়েক শত বছর মুঘলরা ভারত শাসন করে চুঘতাই তুর্কি ও পার্শি ভাষা এবং মধ্য এশীয় সংস্কৃতির নানা উপকরণের মিশেলে হিন্দি ও উর্দু ভাষা, হিন্দুস্থানী সঙ্গীত, রুচি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাসে যুক্ত করেছিলেন অভাবনীয় উৎকর্ষতা। ফতেহপুর সিক্রিতে দাঁড়িয়ে মনে হলো, তারা ছিলেন মিলনের দূত। তারা না ছিলেন বিদেশি, না ছিলেন এদেশীয়। তারা ছিলেন এ উপমহাদেশের গঙ্গা-যমুনা-সিন্ধু বাহিত বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক স্রোতধারা আর বর্ণময় শিল্পকলার সুসমন্বয়ের প্রতীক। উন্নত সকল কিছুর মিশ্রণে ও ভালোবাসায় ভারতকে তারা সাজিয়ে ছিলেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে।

মুঘলরা একই সঙ্গে তৈমুর ও চেঙ্গিস খানের বংশধারার ঐতিহ্য বহন করলেও তাদের ধমনীতে মিশেছিল উপমহাদেশীয় রক্ত। এজন্যই তারা ছিলেন দেশজ কাঠামোতে উত্তর-পুরুষের ঐতিহ্যের সংস্থাপক। ইতিহাস বলে, শুধুমাত্র বাবর ও হুমায়ূন ছিলেন প্রকৃত মধ্য এশীয়। আকবর ছিলেন পার্শিয়ান হামিদা বানুর গর্ভজাত অর্ধেক ইরানি। মাতা যোধাবাঈ-এর কারণে জাহাঙ্গীর ছিলেন অর্ধেক রাজপুত। পূর্বের বাংলা থেকে পশ্চিমের কাবুল আর উত্তরের কাশ্মীর থেকে দক্ষিণের কাবেরী নদী পর্যন্ত শাসন করেছিলেন তারা মৈত্রী, সমন্বয় ও মিলনের মাধ্যমে। ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষকে নিয়ে যে সাম্রাজ্য ভারতবর্ষে মুঘলরা শাসন করেছিলেন, তা ছিল তৎকালীন বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এবং সমৃদ্ধতম দেশ, যার অপসৃয়মান ঝলক এখনো মিশে আছে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, হায়দরাবাদ, লখনৌ, ঢাকা এবং সংক্ষিপ্ততম রাজধানী ফতেহপুর সিক্রির সুনিপুণ বিন্যাসে।       

ফতেপুর সিক্রির শান বাঁধানো চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে অতীত ঐতিহ্যের সেইসব কথা বার বার প্রতিধ্বনি তুলেছে মনের অজান্তেই। বার বার মনে জাগে, শ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট ও নগরের গোড়াপত্তনকারী আকবরের কথাও। স্বল্প সময়ের রাজধানী হলেও ফতেহপুর সিক্রিতে আকবর তার অভিনব দ্বীন-ই-ইলাহি বিষয়ে নানা ধর্মের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনায় মত্ত হতেন। আকবরের তারিখ-ই-ইলাহি-এর জন্মস্থানও ফতেহপুর সিক্রি, আকবরের যে বর্ষগণনা রীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের বাংলা সাল বা বঙ্গাব্দ। নিঃসন্তান আকবরের শেষজীবনে একমাত্র পুত্রও পির সেলিম চিস্তির দোয়ায় ভূমিষ্ঠ হয় ফতেহপুরের মাটিতে। আর এখানেই পরবর্তীকালে শেষ দিকের মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের প্রতিনিধি সৈয়দ হাসান আলি খানকে হত্যা করা হয় ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদারদের ইঙ্গিতে। মুঘলরা দুর্বল হলে এই পরিত্যক্ত রাজধানী কখনো মারাঠা, কখনো রাজপুত, জাঠ বা শিখ জাতির দখলে আসে। সর্বশেষে ইংরেজরা ভারত দখল করে তারা এখানে গড়ে সেনা ছাউনি। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই হয়েছে এই সংক্ষিপ্তকালের রাজধানী শহরে। ফলে এখানে রয়েছে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পাশাপাশি আনন্দ ও বেদনার প্রবহমান অশ্রুধারা। বৃষ্টিভেজা ফতেহপুর সিক্রি ঘুরে ইতিহাস ছুঁয়ে আগ্রায় ফিরে আসার সময় সেসব কথাই দোলা দিয়েছে মনে।

প্রেম ও বেদনার মহাকাব্য তাজমহলে
তাজমহলের সামনে এসে আমি বৃষ্টির সঙ্গে ভেঙে পড়লাম বিষাদে। পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য শ্বেতমর্মরকাব্য নামে পরিচিত তাজমহলও কম বেদনার্ত নয়। যার বুকের উপর দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য সুষমাময় তাজ, সেই মমতাজ মহল দেখতে পারেন নি তাজকে। প্রেমে ও আবেগে আপ্লুত নির্মাতা সম্রাট শাহজাহানও বন্দি জীবন কাটিয়েছেন অদূরের আগ্রা দুর্গে, সেখান থেকে তাজের দিকে চেয়ে চেয়ে তার চোখ হয়েছে অশ্রুসিক্ত, হৃদয় বেদনা-দীর্ণ ও রক্তাক্ত। কারণ তাজের চত্বরেই প্রিয়তমা স্ত্রীর শেষশয্যার অদূরে সমাহিত করা হয় তার প্রিয় পুত্র, ভ্রাতৃঘাতী ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত দার্শনিক রাজপুত্র দারাশিকোহ’র মস্তক-বিহীন দেহ। (তার কর্তিত মস্তক সমাহিত রয়েছে দিল্লিতে, হুমায়ূনের কবরগাহ বা মাকবারায়)।

আরজুমান্দ বানু নামে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর ফুফু ছিলেন মুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। ১৬০৭ সালে পারস্য বংশধারার এই কিশোরীর প্রেমে পড়েন শাহজাদা খুররম, যিনি পরে পরিচিতি লাভ করেন সম্রাট শাহজাহান নামে। প্রেম ও পরিচয়ের পাঁচ বছর পর ১৬১২ সালে আরজুমান্দকে বিয়ে করে শাহজাহান নাম স্ত্রীর দেন মমতাজ মহল বা প্রাসাদের রত্ন। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের শেষে ১৪তম সন্তানের (কন্যা গওহর বেগম) জন্ম দিতে গিয়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মমতাজ মারা যান। ব্যথিত শাহজাহান, আরো স্ত্রী থাকার পরেও মমতাজের প্রেম ও স্মৃতি ভুলতে পারেন নি। মমতাজের সমাধিস'লে তাজমহল নির্মাণ শুরু করেন তিনি।   
১৬৩১ সালে মমতাজের মৃত্যুর পরের বছর (১৬৩২) শাহজাহান তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু করেন। মূল সমাধি ছাড়াও উদ্যান আর অন্যান্য স্থাপনা নিয়ে তাজমহল নামে বিরাট কমপ্লেক্সের মূল নির্মাণ ১৬৪৮ সালে এবং সামগ্রিক নির্মাণকাজ ১৬৫৩ সালে শেষ হয়। অনেক শিল্পী ও নকশাকারক ছাড়াও দেশ-বিদেশের ২০ হাজার সুদক্ষ কর্মী জড়িত ছিলেন তাজমহল নির্মাণে। এদের মধ্যে উস্তাদ আহমেদ লাহোরীর নাম রয়েছে সর্বাগ্রে। এছাড়াও পারস্য থেকে আনা হয় স'পতি ঈসাকে। বেনারসের পুরু নামের একজন কিছু কাজ করেন। বড় গম্বুজটির নকশা করেন উসমানিয়া সাম্রাজ্য থেকে আগত তুর্কি শিল্পী ইসমাঈল খান। বড় গম্বুজের শীর্ষে স্বর্ণের দণ্ড নির্মাণ ও স্থাপন করেন লাহোরের কাজিম খান। পাথর খোদাইয়ের কাজের নেতৃত্ব দেন দিল্লির ভাম্বর চিরঞ্জিলাল। পারস্যের সিরাজ থেকে এসেছিলেন চারুলিপিকর আমানত খান, যার নাম তাজমহলের প্রবেশ পথের দরজায় প্রত্যায়ন করা হয়েছে। পুরো কাজের রাজমিস্ত্রিদের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ হানিফ। ইরানের মীর আ. করিম ও মুকার্রিমাত খান সমগ্র কাজের ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক হিসাবের দায়িত্বে ছিলেন। মোটামুটি এমন কয়েকজনের নাম নানা সূত্রে উল্লিখিত হলেও তাজমহলের পেছনে আরও বহু শিল্পী ও শ্রমিক যে নিয়োজিত ছিলেন তা এর বিরাট এবং সূক্ষ্ম কাজের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।  

তাজমহলে প্রবেশের তিনটি গেট আছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া তাজের শুভ্রতা ও সৌন্দর্য ম্লান করছে বলে বেশ দূরে গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। আমরা নগরীর বিশাল রাজপথ ছেড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে তাজে প্রবেশের অপেক্ষাকৃত সরু গলিপথের মুখে আসি। সেখানে বেজায় ভিড়। গাইড, টাঙ্গা, ব্যাটারিচালিক ও মানবচালিত রিকশার হট্টগোল। আরো আছে হুইলচেয়ারের সারি এবং সাহায্যকারীদের দল। এদের এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াও বেশ মুশকিল। বছরে যাকে দেখতে ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন পর্যটক আসেন, সেখানে ভিড় হবে না তো কোথায় হবে!

তাজের আশেপাশে প্রাচীন মুঘল ধরনের নগর বিন্যাস দেখা গেল, যদিও পুরনো কাঠামো বদল করে অস্থায়ী দোকান, খাবারের স্টল গড়ে উঠেছে সেখানে। তাজের চারপাশের জায়গাটির নাম তাজগঞ্জি বা মুমতাজাবাদ। তাজের দক্ষিণ দিকে এলাকাটি নির্মাণ করা হয়েছিল দর্শনার্থীদের জন্য থাকার সরাইখানা ও অন্যান্য প্রয়োজনে। এখন নানা দোকানে গিঞ্জি অবস্থা সেখানে। এসব ভিড় ঠেলে আসতে হলো মূল ফটকের কাছে এবং যথারীতি টিকিট কেটে ঢুকতে হলো ভেতরে। 
 
তাজ আসলে একটি নয়, অনেকগুলো স্থাপনার মিলনে একটি উদ্যানময় কমপ্লেক্স। মমতাজের মূল সমাধিস'লই তাজমহল নামে পরিচিতি। তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার ভিত্তিতে, যাতে মুঘল, পারস্য, তুর্কি, কুর্দি, মধ্য এশীয় তৈমুর প্রভাব রয়েছে। সমরখন্দে তৈমুর নির্মিত গুর-ই-আমির-এর পরোক্ষ প্রভাব এখানে কেউ কেউ লক্ষ্য করেন। যদিও মুঘলদের দুর্গ, লালকেল্লা, জামে মসজিদ, দেওয়ানে খাস, দেওয়ানে আম ইত্যাদিতে মধ্য এশীয় প্রভাব সুবিদিত।
তাজমহলের ক্ষেত্রে ভবন, মিনার, কারুকাজ, লিপি, অলংকরণ ইত্যাদির মধ্যে সুসমন্বয় রক্ষা করা হয়েছে চমৎকারভাবে। বাগানের বিন্যাসেও মুঘল, পারস্য, তুর্কি শিল্প ও স্থাপত্য কলাকে একাকার করা হয়েছে। প্রথম দর্শনের সবুজ গালিচাময় পুষ্পিত বাগানের মধ্যে শ্বেত-শুভ্র তাজমহল ও পুরো কমপ্লেক্সকে দেখে মনে হয়েছে শান্ত-সমাহিত এমন এক উদ্যান, যা পৃথিবীর কোলাহল ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে একখণ্ড নান্দনিক পরিসর ও স্বর্গীয় আরাম।
খুব কাছে থেকে নয়, তাজমহলের সামনের চত্বরের বাগানে দাঁড়িয়ে দেখলে চোখের সামনে তাজের সামগ্রিক সৌন্দর্য প্রস্ফূটিত হয় সবচেয়ে বেশি। বাগানটি চারটি অংশে বিভক্ত এবং একে বলা হয় চারবাগ বা চারটি বাগান। বাগানের মাঝখানে স্বচ্ছ জলের চৌবাচ্চা, যেখানে তাজের প্রতিবিম্ব জলে টলমল করে। ভেতরের পুরোটাই পাকা ও চিলতে সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত, যে হাঁটা-সড়কের চারপাশ পুষ্পিত ও বৃক্ষময়।

তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। এতে মমতাজের বড় ও আরো কয়েকটি ছোট সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। এতে কিছু কিছু লাল বেলে পাথরও ব্যবহার করা হয়েছে। সমাধি ছাড়াও দেয়াল, স্তম্ভ ইত্যাদি অপূর্ব নান্দনিক অলংকরণে সমৃদ্ধ। বরফি-কাটা ঝালর, খিলান, প্রভৃতির জ্যামিতিক বিন্যাস পুরো স্থাপনাকেই শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বলতর করেছে। তাজ কমপ্লেক্সের মধ্যে অনন্য সুন্দর একটি মসজিদও রয়েছে।
শুধু ভবন নয়, প্রসারিত দেয়াল আর তাজের গম্বুজ ও মিনারের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেও কোনো ক্লান্তি আসে না। কেন হাজার হাজার মানুষের এতো বছর লেগেছিল তাজ বানাতে, তা টের পাওয়া যায় শৈল্পিক কাজের দিকে নজর দিলে। গম্বুজ ও মিনারের সৌন্দর্য ছাড়াও কারুকাজ, জালির কাজ, অলংকরণ, হস্তলিপি, খোদাই, সূক্ষ্ম কাট-স্টাইলে দেয়াল বা আচ্ছাদনের ঝালক পুরো আয়োজনকে একটি সামগ্রিক শিল্পকর্ম বা আর্টপিসে রূপ দিয়েছে। দূরের তাজমহল কাছে থেকে দেখলে মনে হয়, রাজকীয় পোশাক পরিহিত তার প্রতিটি অঙ্গ ও অংশ। প্রতিটি স্থানে শিল্পীর নানা রকমের স্পর্শ উদ্ভাসিত। কোথাও পারস্য ইমেজ তো কোথাও তুর্কি চিত্রময়তা কিংবা কোথায় মধ্য এশীয় স্টাইলের সমুন্নত রূপ।

সমাধি সৌধ মূল কেন্দ্রে রেখে সমগ্র তাজ কমপ্লেক্স প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এতো মানুষের অংশগ্রহণ ও দীর্ঘ সময় ছাড়াও তাজের নির্মাণ সামগ্রীতে ছিল তৎকালের বিশ্বসেরা উপাদান। নির্মাণসামগ্রী আনাতে মানুষের পাশাপাশি হাজার হাজার হাতি ব্যবহৃত হয়। রাজস্থানের স্বচ্ছ আলো-প্রবাহী পাথর, পাঞ্জারের মার্বেল ও রঙিন পাথর, চীন দেশের সবুজ রত্ন ও স্ফটিক, তিব্বতের ফিরোজা পাথর, আফগানিস্তানের নীলকান্তমণি, শ্রীলঙ্কার বর্ণময় পাথর ও রত্ন তাজমহলের নির্মাণের সময় সৌন্দর্য বিধানের কাজে ব্যবহার করা হয়। আর নির্মাণে খরচ করা হয় তৎকালীন সময়ের আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন রুপি, যা আজকের হিসাবে অকল্পনীয়ভাবে এক বিশাল অঙ্ক।   

তাজমহল নিয়ে ভাবালুতা ও আবেগ আসা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। নির্মম শাসক ও বহু নারীর স্বামী হয়েও যে প্রেমের প্রকাশ ঘটানো যায়, তাজমহল সে প্রমাণবহ। তাজমহল মুঘল নির্মাণশৈল্পী ও সৌন্দযপ্রিয়তার বিশ্বজনীন নিদর্শনও বটে। প্রেম ও সৌন্দর্যে তাজ এতোই আকর্ষক যে ভারতের সিংহভাগ পর্যটকের প্রায়-সবাই এখানে আসেন, যাদের মধ্যে বিদেশিই বেশি। বৃষ্টির হাল্কা দাপটের মধ্যে আমরা যখন তাজমহল পরিদর্শন করি, তখনো পর্যটকদের কমতি ছিল না। অধিকাংশই ছিলেন বিদেশি এবং নানা বয়সের।
সন্ধ্যার মুখে তাজ কমপ্লেক্স থেকে ফিরে আসার সময় বৃষ্টিভেজা মেঘলা আকাশের কারণে রাতের চন্দ্রালোকে তাজের আরেক মায়াবী রূপ দেখার সুযোগ ঘটেনি। তাজের মূল গম্বুজ আর চারটি মিনার ও কারুময় দেয়াল, খিলান, গম্বুজ, হর্ম্য, ঝালর থেকে পাশের যমুনা নদীতে জোছনা ছুঁয়ে চির শায়িত মমতাজ মহলের বিষাদ মিশে যাওয়ার ছবিটিও দেখা হলো না। বরং নিজের ভেতরে কেন যেন টের পাওয়া গেল অন্য রকম অচেনা এক তরঙ্গ। উত্তর ভারতের ঐতিহাসিক বাতাসে ভেসে আসা সে তরঙ্গে হাহাকার নয়, প্রেম নয়, বেদনা নয়, আনন্দ নয়, মিলন নয়, ছিল অন্যরকম, অন্য কিছুর পরশ, যা এসে মিশে যাচ্ছিল হৃদয়ের মর্মমূলে, পাওয়া-না-পাওয়ার মাঝখানের গভীর শূন্যতায়।  

রাতের আগ্রায়
তাজমহল থেকে বের হয়ে অলিগলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে রাতের আগ্রার মুখোমুখি হলাম। পুরনো আগ্রার গিঞ্জি এলাকার ভিড়, রিকশার টুংটাং, মিনা বাজারের হইচই ফেলে চলে এসেছি নগরীর আলো-শোভিত এভিনিউ-এ। মোবাইল অ্যাপে হোটেল বুক করা আছে, ড্রাইভার সুরজিৎ সেখানে ব্যাগ রেখে বিশ্রাম নিতে চলে গেল। আমরা আগামীকাল সারাদিন ঘুরে রাতের মধ্যে জয়পুর ফিরে যাবো, এমন চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে। কাজটি ভুল হয়েছে। যে টাকায় আগ্রা-জয়পুর আপ-ডাউন করছি, তাতে জয়পুর-আগ্রা হয়ে দিল্লি চলে যাওয়া যেতো। রাস্তায় যেতে কষ্ট হবে ভেবে আমরা জয়পুর থেকে দিল্লির প্লেনের টিকিট কেটে রেখেছি। ফলে আমাদের আগ্রা থেকে আবার জয়পুরই ফিরতে হচ্ছে। এতে সময় ও টাকা খরচ হলো বেশি। একই পথ দুবার ঘুরতে হলো।
সবচেয়ে ভালো হতো, জয়পুর থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লি চলে যাওয়া। জয়পুর-আগ্রা-জয়পুরের খরচে জয়পুর-আগ্রা-দিল্লি যাতায়াত হয়ে যেতো। সময় যেমন বাঁচতো, তেমনি হোটেল আর জয়পুর-দিল্লির বিমান ভাড়াও লাগতো না। অভিজ্ঞতা না থাকায় ভুলের মাশুলস্বরূপ সময় ও টাকার গচ্চা দিতেই হলো।

উত্তর ভারতে হোটেল বেশ সুলভ, কলকাতার চেয়েও কম টাকায় ভালো হোটেল পাওয়া যায় অ্যাপে। গাড়িও অ্যাপে নেওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে, টু ওয়ে, ঘণ্টা ধরে গাড়ি পাওয়া যায়। সুরজিৎ সার্বক্ষণিক থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ। সে গাড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলও। কাল আবার জার্নি করবে আর আমি হেঁটে শহরের জীবনকে স্পর্শ করতে চাই বলে ওকে বিদায় দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরতে শুরু করি। অবশ্য প্রয়োজন হলে ফোনে ডাকলেই সে ছুটে আসবে। আমাদের হোটেলের পাশেই কম দামের একটি হোটেলে সে উঠেছে। অতএব, চিন্তার কিছু নেই।
ঘুরাঘুরির সময় খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটাও আমি ঝামেলাহীন রাখি। যেখানে সুবিধা হয় খেয়ে নিই। প্রধানত পাউরুটি, কলা, আপেল, ডিম সেদ্ধ, দুধ খেয়ে দিব্যি চলছে। ভ্রমণে ভারি খাবার আমার অপছন্দ। রাতের দিকে সুবিধা মতো কোথাও ডিনার করে নেওয়া যাবে। খাওয়া ও দেখার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে তাজমহল সংলগ্ন এলাকা থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম আগ্রা শহরের মূলকেন্দ্রে।
এতো বছরের পুরনো হওয়ার পরেও আগ্রার সর্বত্র মুঘলাই রোশনাই ঝলঝল করছে। চারিদিকে বাগান, উদ্যানের ছড়াছড়ি। আগ্রা ফোর্টের সামনে শাহজাহান গার্ডেন তো এলাহী ব্যাপার। আর আছে মোড়ে মোড়ে নেতৃবৃন্দের ভাস্কর্য। নেতাজি সুভাষ বসুর মূর্তি পেলাম। পেলাম উত্তর ভারতের পুরনো হিন্দু শাসক পৃথ্বিরাজ চৌহানের মূর্তি। উত্তর প্রদেশ বিজেপি শাসনে থাকায় প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য পুনরুত্থানের বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় এসেই প্রাচীন নগর এলাহাবাদের নাম বদলে রেখেছেন প্রয়াগ। বিখ্যাত মুঘলসরাই রেলজংশন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নামও বদল করা হয়েছে। শুনতে পেলাম, আগ্রার নামও বদলে অগ্রবন রাখা হবে। কিন' ইতিহাসবিদ ও সুশীল সমাজ তা হতে দিচ্ছেন না। তারা অগ্রবন নামের অস্তিত্ব পাচ্ছেন না। বরং আগ্রা নামের মজবুত ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে। মুঘলদের আগে লোদি বংশও আগ্রায় অনেক স্থাপনা করেছে। আগ্রা সম্পূর্ণভাবে মুঘল ও মুঘল-পূর্ব মুসলিম শাসকদের শহর। ফলে নামবদলের বিষয়টি খানিক পিছিয়ে গেছে।
আলোশোভিত, উদ্যানময় এভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম আগ্রার বিখ্যাত জামে মসজিদের কাছে। মুঘলরা যেখানেই গিয়েছে প্রাসাদ ও দুর্গের পাশাপাশি বড় আকারের মসজিদ নির্মাণ করেছে। আগ্রার জামে মসজিদও বিরাট চত্বর, মিনার, গম্বুজ, ক্যালিগ্রাফিতে সমৃদ্ধ। মসজিদটি চট করে দেখলে মধ্য এশীয় কোনও স্থাপনা বলে ভ্রম হবেই। পাথুরে কাঠামোতে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় উজ্জ্বল হয়ে আছে মুঘল ঐতিহ্য। রাতের বেলাতেও দেশি-বিদেশি পর্যটক-দর্শনার্থীদের ভিড় দেখতে পাওয়া গেল মসজিদের চারপাশে।

মসজিদের লাগোয়া আগ্রার বিখ্যাত পাইকারি বাজারগুলো অবসি'ত। চামড়ার জুতা, পোশাক, ধাতব তৈজসপত্র ইত্যাদিতে ঠাসা ছোট ছোট অসংখ্য দোকান। পুরান ঢাকার চকবাজার বা লালবাগের মুঘল নগর বিন্যাসের আদল এখানেও লক্ষণীয়। দোকানের মালামাল আর হরেক রকম ক্রেতায় ঠাসাঠাসি ভিড়। দামও আধুনিক মলের চেয়ে অনেক কম। সস্তায় মজাদার খাবারের অনেক হোটেলও পাওয়া গেল। কাবাব ও মাংসের প্রাধান্যে মুঘলাই রান্নার প্রাচুর্য হোটেলগুলোতে।
অনেকেই আমাদের আগ্রা ভ্রমণের সময় অবশ্যই ইতিমুদ্দৌলাহ নামের একটি সমাধিস'লে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলে, যাকে শিশু তাজমহল বলা হয়। এটা দিল্লির হুমায়ুন মাকবার আর সেকেন্দ্রার আকবর মাকবার অনুরূপ। মাকবারা মানে সমাধিস'ল। মুঘলরা মধ্য এশীয় রীতিতে সমাধি সৌধ নির্মাণ করতেন, যার অনেকগুলো এখনো ভারতের নানা স্থানে অটুট। ইতিমুদ্দৌলা যমুনা নদীর পূর্ব পাশে অবসি'ত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ও মাতা আসমৎ বেগমের কবরস্থান। নূরজাহান নিজের অর্থে এই সুরম্য সৌধ নির্মাণ করেন।

আরেকটি জায়গায় যাওয়ার জন্যও পরামর্শ ছিল। সেটার নাম মাহতাব বাগ, যার বাংলা হলো চন্দ্রালোকিত বাগান (মুনলাইট গার্ডেন)। সম্রাট বাবর এটি নির্মাণ করেন যমুনার অপর তীরে, যেখান থেকে ভিন্ন কৌণিক অ্যাঙ্গেলে তাজমহল ও আগ্রা দুর্গকে দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষত রাতে এবং জোছনায় মাহতাব বাগ থেকে তাজের অসামান্য সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নদীর জোছনা প্লাবিত স্রোতে বিম্বিত শ্বেত মর্মর তাজের অনিন্দ্য অবয়ব দেখার জন্য মোহতাব বাগ শ্রেষ্ঠ স্থান।

বৃষ্টিমগ্ন আবহাওয়া এবং সময় স্বল্পতার কারণে এসব স্থানের মতো আরো কিছু ছোটখাটো স্থাপনা, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব হলো না এবারে ভ্রমণে। মনে মনে ঠিক করলাম, এটা কেবল প্রাথমিক দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়।
না দেখার আফসোস আর যতটুকু দেখেছি, তার তৃপ্তি নিয়ে নগর পরিভ্রমণ শেষে হোটেলে ফিরে এলাম। আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেটি একটি বিশাল ও আধুনিক স্থাপনার তিনতলার পুরো ফ্লোর নিয়ে অবসি'ত। একতলায় দেখতে পেলাম কোচিং সেন্টার চলছে। বাইকে চেপে জিন্স আর টি-শার্ট চাপিয়ে শত শত ছেলেমেয়ে ক্লাসে আসছে, যাচ্ছে। সম্ভবত দিনে কোনও চাকরি করে রাতের দিকটায় প্রাইভেটে তারা পড়াশোনা করছে। ক্যারিয়ার আগে বাড়াতে এসব প্রতিযোগিতামূলক শহরে ডিগ্রি, ট্রেনিং নিয়েই চলতে হয়। ইতিহাসের প্রাচীন আগ্রাতেও আধুনিক জীবনের গতিময় তেমন ধারা চলছে।

দিল্লি বা বেঙ্গালুরুর মতো নারীর নিরাপত্তাহীনতা আগ্রায় ততটা প্রকট মনে হলো না। রাত ১১/১২টা পর্যন্ত অনায়াসে তরুণ-তরুণীরা নিজস্ব বাইকে চলাফেরা করছে। দীপক রাঠোর নামে একটি ১৯/২০ বছরের ছেলে হোটেলে দেখা করতে এলো। আমাদের জয়পুরের বন্ধুর পরিচিত ছেলেটি কলেজে পড়ে এবং স্থানীয় ক্লাবে ক্রিকেট খেলে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক খোঁজ-খবরই সে রাখে। সুস্বাস'্যবান দীপক ছাড়াও প্রতিটি ছেলে-মেয়েকেই স্বাস'্য সচেতন মনে হলো। দীপকের বাইকে আশেপাশের এলাকায় এক চক্কর দিতে দিতে পথে জিম দেখেছি অনেকগুলো। জীবনকে উপভোগ করতে হলে অটুট স্বাসে'্যর অধিকারী হওয়ার মন্ত্র তরুণ প্রজন্মের চোখে-মুখে। নিজের কাজ অন্য কারো ভরসা ছাড়া নিজেকেই যে করতে হবে, এই কাণ্ডজ্ঞানটি আগ্রায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রকট। পথে পথে অলস আড্ডায় মেতে চা খেয়ে, সিগারেট ফুঁকে ফুটপাথ দখল করতে বিশেষ কাউকে দেখিনি। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত এবং সেটা অবশ্যই উদ্দেশ্যভিত্তিক, লাভজনক ও প্রয়োজনীয়। আর বিখ্যাত পর্যটক শহর বলে এখানে নানা কিসিমের কাজের কমতি নেই।
শুধু স্বাস'্য নয়, আগ্রায় বসবাস করতে আরেকটি জিনিস লাগবে, তা হলো মুঘল বাদশাহ হয়ে জন্মানোর ভাগ্য। বিরাট বিরাট বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি ও তকমাধারী স্থাপনা ছাড়াও আগ্রায় ছড়িয়ে আসে অসংখ্য রাজকীয় ঢঙের প্রাসাদ, বাড়িঘর। ইংরেজ আমলে তৈরি রাজসিক ভবনও কম নয়। সম্ভবত এসব দেখেই কথাটি বলেছিলেন কবি ও অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু। যাদবপুরের অধ্যাপক বুদ্ধদেব এক চিঠিতে দার্শনিক দেবীপ্রসাদকে কথাটি জানিয়েও ছিলেন। সেই ভাষ্যটিই তুলে দিচ্ছি:
‘আমি এখন আগ্রায়। এসব শহরে বসবাস করতে হলে মুঘল বাদশাহ হয়েই জন্মাতে হয়। আগ্রা ফোর্টে জাহান আরার ঘরগুলো ভারি ভালো, ও-রকম বাড়িতে থাকতে পারলে তবেই এ-অঞ্চলে বসবাস সম্ভব। কিংবা তাজমহলের ভেতরটাও মন্দ নয়। এ ছাড়া আর ঠাণ্ডা জায়গা এখানে আছে বলে মনে হয় না। যে যুগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না, সে যুগে ও-ধরনের বিরাট কেল্লা গড়তেই হতো শাহানশাহদের, নয়তো প্রাণ কি বাঁচতো? স্নানের কী বিলাসিতা! শ্বেতপাথরের কী উদার মসৃণ শীতলতা! ইলেকট্রিসিটি থাকলে অত দরকার হতো না, এয়ার কন্ডিশন করে দিলেই হতো। তবু ওরা ওগুলো করেছিলেন বলেই আজ সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা একটু বুঝতে পারি যে ভারতবর্ষ এককালে সত্যিই ইংরেজ বর্জিত ছিলো এবং ইংরেজ-বর্জিত সে ভারত তখনকার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের চাইতে কোনো অংশে ছোটও ছিল না। নবাবী আমলের সূর্যাস্তের সোনা এ অঞ্চলে চেখে বেড়াচ্ছি,-পচে গেছে, কিন' একটা রূপ আছে।
১৯৪১ সালের ১০ই অক্টোবর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে বুদ্ধদেব বসু চিঠিতে কথাগুলো বলেছিলেন। আগ্রায় শত শত বছরের প্রাচীন মুঘল ঐতিহ্যের অপসৃয়মান দ্যুতিময় রশ্মি এখনো সেইসব স্থাপনার চমকাচ্ছে।   
 
আগ্রা দুর্গে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি
বৃষ্টির মধ্যেই সকাল হলো আগ্রায়। বাংলাদেশের বর্ষার মতো উত্তর ভারতে মনে হয় বৃষ্টি এসেই চলে যায় না। আসা অবধি দেখছি, ক’দিন ধরেই উত্তর ভারত জুড়ে অবিরাম বর্ষণের রেশ থেমে থেমে চলছে। সকালের শুরুতে তাজমহলের দিকে এক চক্কর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, সেটা স'গিত করতে হলো আবহাওয়ার বিরূপতায়। কিছুক্ষণ হোটেলে অপেক্ষার পর বৃষ্টি সহনীয় হলে চলে এলাম আগ্রা দুর্গে।
আগ্রা দুর্গ নামটি শুনে মনে হতে পারে পারে যে, এটি কোনও সামরিক ছাউনি বিশেষ। আসলে মোটেও তা নয়। আসলে আগ্রা দুর্গ হলো একটি আস্ত শহর। মুঘল সচিবালয়, বাসগৃহ, সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি মিলিয়ে পরিকল্পিত এক রাজধানী, মধ্যযুগের আরবান সেটেলমেন্ট।
তাজমহল থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে অবসি'ত আগ্রা দুর্গের সামনে, রাস্তার আরেক পাশে শাহজাহান গার্ডেন। বিশাল মুঘল উদ্যান আর আগ্রা দুর্গের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে প্রশস্ত এভিনিউ। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম একপাশের সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা দুর্গ-নগরী আর অন্যপাশের সুবিস্তৃত শাহজাহান গার্ডেন।

৯৪ একক আয়তন বিশিষ্ট অতিকায় আগ্রা দুর্গে প্রবেশের জন্য দুটি প্রবেশ তোরণ আছে। একটির নাম অমর সিং গেট, যাকে লাহোর গেটও বলা হয়। আরেকটি দিল্লি গেট, যা দুর্গের পশ্চিমাংশে অবসি'ত। বর্তমানে দিল্লি গেট বন্ধ আর একমাত্র প্রবেশ পথ হলো অমর সিং গেট। তবে দুর্গের আরো দুটি ছোট আকারের প্রবেশ পথ আছে। দুর্গে অনেকটাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাসুট ব্রিগেডের সদর দপ্তর আগ্রা দুর্গের উত্তরাংশে অবসি'ত।   
আগ্রা দুর্গ হলো একমাত্র স্থান, যেখানে ভারতের সব শাসকরাই কর্তৃত্ব করেছেন। আফগান-গজনির শাসকরা যখন প্রথম আগ্রায় সামরিক ছাউনি গড়েন, তা ছিল এই দুর্গের চৌহদ্দিতেই। পরে চৌহান, রাজপুত, জাঠ, শিখরা এখানে কর্তৃত্ব করেন। দিল্লি দখল করে সেখানেই রাজধানী স্থাপন করা হলেও সিকান্দার লোদি আগ্রায় রাজধানী নিয়ে আসেন ষোড়শ শতকেই। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ী হয়ে বাবরও এ দুর্গ থেকেই রাজত্ব শুরু করেন। পুত্র হুমায়ূনের রাজ-অভিষেকও আগ্রা দুর্গে সম্পন্ন হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল আইন-ই-আকবরি গ্রনে' জানিয়েছেন। তা হলো আগ্রা দুর্গের নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার কারিগরগণ, সঙ্গে ছিলেন গুজরাটের শ্রমিকরা। 

হুমায়ূনের শাসনামলে বাংলার আফগান-সুরি বংশ শের শাহের নেতৃত্বে ভারত তথা দিল্লি দখল করে আগ্রা থেকে শাসন চালায়। পরে মুঘলরা আবার ভারতের ক্ষমতা দখল করলে আগ্রার দুর্গ হয় শাসনের মূল কেন্দ্র। আকবর আগ্রা দুর্গকে বর্ধিত করেন এবং বিশাল আকারে অনেকগুলো স্থাপনা নির্মাণ করেন। তিনি কিছুদিনের জন্য রাজধানী পাশের ফতেহপুর সিক্রিতে নিয়ে গেলেও পরবর্তী মুঘল শাসকরা আগ্রাকেই রাজধানী হিসেবে বেছে নেন। পরে রাজধানী কিছু দিনের জন্য লাহোর এবং আবার দিল্লি স্থানান্তরিত হলেও মুঘল শাসনে আগ্রার গৌরব, শক্তি ও ঐতিহ্য সমুন্নত ছিল। ফলে আগ্রা দুর্গের প্রতিটি বালি-কণা ও ইটে বহু বছরের বিচিত্র ইতিহাসের জানা-অজানা বহু কথা ও কাহিনি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়।
আগ্রার দুর্গ একজনের হাতে নয়, অনেক মুঘল নৃপতির দ্বারা সংস্কার ও পরিবর্ধন লাভ করে। তবে আকবরের সময় এর সর্বোচ্চ বিকাশ হয়। তিনি রাজস্থানের লাল বেলে পাথর দিয়ে আগ্রা দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো স্থাপনা নির্মাণ করেন এবং সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে পুরো স্থাপনাকে পরিবেষ্টন করেন।    

আগ্রার দুর্গস' সমগ্র এলাকা অর্ধবৃত্তাকার ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে নির্মিত। প্রবেশ তোরণ থেকে শুরু করে দুর্গের প্রতিটি স্থাপনা অত্যন্ত সুনির্মিত ও কারুকার্যময়। লাল বেলে পাথরের সঙ্গে সাদা মার্বেলের ব্যবহারও দুর্গটির বিশেষ নির্মাণ বৈশিষ্ট্য। ফলে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ দুর্গের দিকে তাকালেই গা ছমছম করে।
রাজকীয় মুঘলাই ফটক দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করে লালের সঙ্গে সবুজের মিতালিতে চোখ জুড়িয়ে গেল। মুঘল রীতি ও ঐতিহ্যানুযায়ী সাজানো উদ্যান দুর্গের ভেতরেও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মুঘলরা যেখানেই গেছেন, যে স্থাপনাই গড়েছে, তাতে বাগানের উপসি'তি আবশ্যিক। হালকা বৃষ্টি থাকলেও দর্শনার্থীর ভিড় কম নেই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম মুঘল ঐতিহ্যের অনবদ্য আকর্ষণ আগ্রা দুর্গ।
দুর্গের ভেতরেও একটি গেট আছে, যাকে বলা হয় হাতি গেট। খুবই পরিকল্পিত স্থাপত্য বিন্যাস চারিদিকে। অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে কালের করাল গ্রাস থেকে সামান্যই রক্ষা পেয়েছে। শত শত যুদ্ধ, দাঙ্গা, বিশেষত দখলদার ইংরেজদের হাতে অনেক সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে। ভাঙা-গড়া হয়েছে ভেতরের অনেক ইমারত ও প্রাসাদ। মুঘল সম্রাটের অধিষ্ঠানের ময়ূর সিংহাসন আর কোহিনূর হীরক সম্পদও ইংরেজরা এখান থেকে লুট করে নিয়ে গেছে বিলাতে। সিপাহি বিপ্লবের পর বিজয়ী হয়ে ইংরেজরা শুধু গণহত্যাই করেনি, হীরা-জহরত, বই-পত্র, তৈজসপত্র, ব্যবহার সামগ্রী লুটে নিয়ে গেছে। ইংল্যান্ডের মিউজিয়াম, বাজার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় এসবের কিছু কিছু এখনো রয়েছে।

আগ্রা দুর্গের প্রধান আকর্ষণ দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জাহাঙ্গীর হৌস, যা আকবর নির্মাণ করিয়েছিলেন পুত্রের জন্য। বাবরের আমলে নির্মিত বাওলি (পানির কূপ) আছে। আছে মসজিদ, আকবর মহল। সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত মহলও আছে, যাতে তার দুই কন্যা রওশান আরা ও জাহান আরা বসবাস করতেন।
আশ্চর্য হলাম, আগ্রার দুর্গে বাংলা মহল দেখে। কথিত আছে, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান এটি নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মাণশৈলীতে বাংলার কুটিরের ছাপ আছে। নূরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরিণত সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে ছিলেন বাংলার এক সুবেদারের স্ত্রী। ফলে পারসিক বংশধারার হলেও নূরজাহানের একটি সম্পর্ক ছিল বাংলার সঙ্গে। বাংলার আম গাছ তিনি আগ্রার দুর্গে রোপণ করেছিলেন এবং ঢাকাই মসলিন কাপড়ের উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।
দুর্গের ভেতর যমুনা নদীমুখী একটি আবাসে সম্রাজ শাহজাহানের বন্দি জীবন কেটেছিল। এর বারান্দা থেকে দূরের তাজমহল দেখা যায়। বন্দি সম্রাটের জীবন কাটে এখান থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাজ দেখে আর তাজে শায়িত প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজমহলের স্মৃতিতে।
আগ্রার দুর্গ নিয়ে প্রচলিত আছে বহু উপকথা ও কাহিনী। দুর্গের নিচে সুড়ঙ্গপথ নাকি নানা জায়গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ছিল অনেক গোপন কুঠরী, যেখানে সংকটকালে সম্রাট আত্মগোপন করতে পারতেন বা প্রতিপক্ষকে লোকচক্ষুর আড়ালে বন্দি করে রাখতে পারতেন।

মুঘল হেরেম নিয়ে শত শত উপাখ্যানের ভিত্তিভূমিও আগ্রার দুর্গ। যেখানে সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) ও আনারকলির করুণ প্রেম-উপাখ্যান ছাড়াও বহু বাদশাহজাদি ও শাহজাদার নানা রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত প্রচলিত রয়েছে। বলতে গেলে মুঘল ইতিহাসের আখ্যান রচনা করতে গেলে সর্বাগ্রে চলে আসবে আগ্রা দুর্গের নাম। বিশ্বসেরা গোয়েন্দা শার্লক হোমস পর্যন্ত আগ্রা দুর্গের পটভূমিতে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। শার্লক হোমসের রচয়িতা স্যার আর্থার কোনাল ডুয়েল  দ্য সাইন অব ফোর গ্রন'টিতে আগ্রা দুর্গের পটভূমি নিয়ে এসেছেন। এমন আরো শত শত গ্রন' আছে আগ্রা দুর্গের সামগ্রিক বা বিশেষ বিশেষ ঘটনার আলোকে। স্থাপত্য ও নির্মাণ প্রকৌশলেও আগ্রা দুর্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। মধ্যযুগে বাগদাদ, দামেস্কো, ইস্পাহান, সিরাজ, কায়রোর মতোই আগ্রা ছিল এক আন্তর্জাতিক শহর, যার প্রাণকেন্দ্র ছিল আগ্রা দুর্গ কেন্দ্রিক রাজপ্রাসাদসমূহ, আবাসস'ল ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলো।
বৃষ্টি কমে এক সময় হাল্কা রোদ ঝলক দেওয়ায় মনে হলো শত শত বছরের ঘুম ছেড়ে চমকে উঠেছে আগ্রা দুর্গের ভেতরের স্থাপনাগুলো। শুধু দর্শনীয় স্থান হিসেবে দুর্গের নানা স্থাপনা দেখতেই সময় কেটে যায় না, প্রতিটি স্থানের পেছনের ইতিহাস ও ইতিবৃত্তও সামনে চলে আসে হারিয়ে যাওয়া অতীতের ঝঙ্কার তুলে।

সুদূর মধ্য এশীয় অঞ্চলের মোঙ্গল-তুর্ক-পারস্য ঐতিহ্য নিয়ে যে মুঘলরা ভারতে এসেছিলেন, তারা শাসন ও সংস্কৃতির প্রতিটি অঙ্গনকে করেছিলেন আলোকিত ও সমৃদ্ধ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে আধুনিক জীবনবোধ ও যাপন প্রণালী মিলে আছে অর্ধ-সহস্র বছরের মুঘল শাসনের পরতে পরতে। তাদের প্রাসাদ, হর্ম্য, স্থাপনা, প্রশাসনিক রীতি, খাদ্য, পোশাক, লোকাচার, কাব্য, সঙ্গীত ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই শুধু ভারত নয়, বিশ্ব সভ্যতা ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল রত্নস্বরূপ। সেই মুঘলদের নাভিমূল আগ্রার দুর্গে প্রতিটি পদক্ষেপে কানে বাজে ইতিহাসের শব্দ-সঙ্গীত। অতীত পুরনো হলেও যে দীপ্তি হারায় না, মুঘল ঐতিহ্যের হৃৎপিণ্ড ও রাজধানী আগ্রা সে সত্যটিই মনে করিয়ে দেয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম রাজধানী আগ্রা
আগ্রার দুর্গ থেকে বের হলাম পড়ন্ত বিকাল বেলায়। অতীতের উজ্জ্বলতায় ঝলমল আগ্রা শহরের কথায় ইতিহাসের নানা কথা মনে পড়ে। যদিও বিশাল ভারতবর্ষের কথা আসলেই চলে আসে দিল্লির নাম, তথাপি দিল্লি নয়, অধিকাংশ সময় আগ্রা ছিল মুঘল ভারতের রাজধানী। মধ্যযুগে ভারতবর্ষের রাজধানী হিসাবে যেসব শহরের নাম জানা যায়, তার মধ্যে আগ্রা ছিল সুদীর্ঘকাল। দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রা ছাড়া অন্য কোনো শহর এতো অধিক বছর রাজধানীর মর্যাদা পায় নি।
মুসলিমরা ভারত জয় করে রাজধানী গড়েন দিল্লিতে। দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় মুহাম্মদ ঘোরীকে। দিল্লি সালতানাতের শাসনকালেরই একপর্যায়ে আগ্রায় রাজধানী স্থাপন করা হয়, যেখানে কয়েক শত বছর আগে গজনীর সুলতান মাহমুদ দুর্গ গড়েছিলেন। আগ্রা থেকে উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ভারত শাসন ছিল সহজতর। এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে গমনের পথও ছিল সুগম। ফলে আগ্রা রাজধানী ও কেন্দ্রীয় শহরের মর্যাদা পায় রাজনৈতিক এবং ভূকৌশলগত গুরুত্বের কারণে।

পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের মতোই মুঘলরাও ছিলেন প্রধানত আগ্রা কেন্দ্রিক। উপমহাদেশের নানা স্থানে নানা স্থাপনা, দুর্গ, প্রাসাদ নির্মাণ করলেও মুঘলদের মূল আবাস ছিল আগ্রা এবং শাসনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এই শহর। যদিও আকবর কিছুদিনের জন্য রাজধানী আগ্রার পাশে ফতেহপুর সিক্রিতে স্থানান্তরিত করেন, যা আসলের আগ্রারই সম্প্রসারিত এলাকা বিশেষ। গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য হলো এই যে, মাত্র একটি ছাড়া, মুঘলদের সবগুলো রাজধানীই বর্তমান ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবসি'ত। ভারতের বাইরে একমাত্র শহর পাকিস্তানের লাহোর, যেখানে সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় স্বল্পকালের জন্য। তারপর আগ্রা হয়ে দিল্লি হয় ভারতের রাজধানী। তথাপি মুঘল ক্ষমতা ও স্থাপনার অন্যতম শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী কেন্দ্র রূপে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে আগ্রা।
বাংলা তথা কলকাতায় ক্ষমতাসীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ভারত দখল করে ইংরেজরা রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে নতুন শহর কলকাতায়। তারপর ১৯১৩ সালে আবার ভারতের রাজধানী হয় দিল্লি। এভাবে আগ্রার ক্ষমতা ও শক্তি স্থানান্তরিত হয়। তথাপি মধ্যযুগের পটভূমিতে নানা শাসকের অধীনে আগ্রার চেয়ে সুদীর্ঘ বছর রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকার গৌরব ভারত বা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো শহরের নেই।

শাহজাহান বাগিচা আর আগ্রা দুর্গের দিকে ফিরে আসার সময় পেছন তাকিয়ে দেখতে পেলাম, অস্তাচলগামী সূর্যের রক্তিমাভা আগ্রার লালাভ দুর্গ স্থাপনায় টকটক করছে। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে সূর্যের স্বচ্ছ আলো ছড়িয়েছে প্রাসাদ আর উদ্যান ঘেরা নগরী আগ্রার দিগন্তে। পায়ে পায়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে কানে বাজে রণধ্বনি, উৎসব আর হুল্লোড়ের কোলাহল। আগ্রার আশেপাশেই হয়েছে ভারতবর্ষে বিখ্যাত ও ভাগ্যনির্ণায়ক যুদ্ধগুলো। কাছেই মুহাম্মদ ঘোরী আজমিরের শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে ভারত অধিকার করেন। সন্নিকটের পানিপথে লোদি বংশকে পরাজিত করে বাবর বসেন মসনদে। আকবর এই পানিপথেই হিমুকে হারিয়ে ভারতের ক্ষমতা সুসংহত করেন। আফগান আহমাদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা-শিখদের বিতাড়িত করেন। আগ্রাকে নাভিশূলে রেখেই মধ্যযুগের ভারতের ক্ষমতার পালাবদল আর বিন্যাস রচিত হয়েছে।

এতো যুদ্ধ ও দামামার মধ্যেও আগ্রাকে সাজানো হয়েছে সুরম্যভাবে। লোদি গার্ডেন, শাহজাহান গার্ডেন, মাহতাব বাগ ইত্যাদি বহু কিছু এখনো অটুট সবুজে-শ্যামলে। আর স্থাপনার তো শেষ নেই! ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া তাজমহল, ফতেহপুর সিক্রি, আগ্রা দুর্গ ছাড়াও শত শত মসজিদ, প্রাসাদ ইত্যাদি মুঘল স্থাপনা ছড়িয়ে রয়েছে আগ্রার সর্বত্র।
বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্তে আগ্রা লাভ করেছে স্বপ্নের শহরের মর্যাদা। শান-শওকত, আভিজাত্য, সমৃদ্ধিতে আগ্রাকে তুলনা করা হয়েছে ভেনিস, প্যারিসের সঙ্গে। আগ্রার নান্দনিক অবয়ব লোভনীয় হয়ে ধরা দিয়েছিল পৃথিবীর মানুষের কাছে। তৎকালের ভাগ্যান্বেষী মানুষের ঢল নেমেছিল আগ্রা নগরীতে। বহুবিচিত্র মানব সমাবেশের কারণে আগ্রা পরিণত হয়েছিল মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অগ্রণী আন্তর্জাতিক শহর বা কসমোপলিটন সিটিতে।

আগ্রা দুর্গ পরিদর্শনের পর প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর কথা মনে পড়ে। কি নেই এই দুর্গে। একটি আস্ত শহর আড়াই-তিন মাইল জায়গা জুড়ে সুপরিকল্পিতভাবে সজ্জিত করার কৃতিত্ব মুঘলদের। বসবাস, রাজকাজ, প্রশাসনিক দপ্তর, যুদ্ধ কৌশল প্রণয়ন, বিনোদন ইত্যাদি সবই হয়েছে এখানে। খেলার মাঠ, মল্লযুদ্ধ, হাতি বা বাঘের লড়াইয়ের ব্যবস্থাও ছিল দুর্গের ভেতরেই। শীশ মহল, স্নানাগার, হারেম ও হাভেলিতে মশগুল আগ্রার দুর্গে জীবন যেন প্রবহমান ছিল আরব্য রজনীর মখমল কার্পেটে।

আগ্রা দুর্গের বাইরেও সাধারণদের বসবাসের জায়গায় মিনাবাজার, মসজিদ, প্রমোদালয়, বিশ্রামাগার, সরাইখানার অন্ত ছিল না। এখনো আগ্রার পথে পথে গম্বুজওয়ালা প্রহরী ছাউনির দেখা পাওয়া যায়, যা মুঘল নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হয়ে স্মৃতিস্বরূপ বিরাজমান।
শুধু ইতিহাস আর ঐতিহ্যই নয়, কিংবা যুদ্ধ আর বিজয়ই নয়, আগ্রার উপর দিয়ে বয়ে গেছে মর্মান্তিক রক্তস্রোত। সিপাহি বিদ্রোহে মুঘল-ভারতীয় পক্ষ পরাজিত হলে দিল্লির মতো আগ্রাতেও বয়ে যায় রক্তের বন্যা। শুধু মুঘল পরিবারের সদস্যই নয়, মুসলিম সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ও সৈনিকদের গণহারে হত্যা করা হয়। দিল্লির পতন হলে বিপুল মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আগ্রা দুর্গে। তাদের ধরতে সশস্ত্র অভিযান ও গণহত্যা চালানো হয় আগ্রায়।

এখনো আগ্রার পথে-প্রান্তরে, দুর্গের দেয়ালে কালচে রক্তের ছোপ মিশে আছে। নিহতের আহাজারি আর নিগৃহীত রমণীর বিলাপ গুমড়ে কাঁদে আগ্রায়। আগ্রার একটি প্রচলিত উপকথার বিষয়ে স্থানীয় লোকমুখে শুনেছি। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে ইংরেজরা বন্দি বানিয়ে পাঠিয়ে দেয় সুদূর বার্মার রেঙ্গুনে। তার পরিবারের অনেককেই হত্যা করা হয় দিল্লিতে। দিল্লির হুমায়ূন মাকবারা বা কবরগাহে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। সেই স্থানে কাতারবন্দি করে মুঘল পরিবারের শত শত সদস্যকে হত্যা করে ইংরেজ সেনাপতি। আগ্রায় যারা লুকিয়ে এসেছিলেন, তাদেরকেও দুর্গের ভেতরে চিরুনি তল্লাশি করে খুঁজে খুঁজে বের করে মারা হয়। আজও নাকি সেসব নিহত আত্মা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আগ্রা দুর্গে ফিরে আসে। অনেকেই দুর্গের অভ্যন্তরে, খিলান ও স্তম্ভের পাশে নারী ও শিশুদের কান্না শুনতে পান!

এসব কাহিনীর সত্যাসত্য যাচাই করা দুরূহ। কিন' যে বীভৎসতা এ নগরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সাজানো-সুন্দর শহরকে ছারখার শ্মশানে পরিণত করার কষ্ট শুধু মানবতার কষ্ট নয়, সভ্যতার জন্যও বেদনার। আগ্রা এখনো বেঁচে আছে মৃত্যুর বিষাদ নিয়ে। সঙ্গে আছে সভ্যতার এমন বহু চিহ্ন, যা ধ্বংস ও আক্রমণের কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে মুঘল সভ্যতার জয়গান গাইছে।
আমরা আবার ফিরে যাবো জয়পুরে, সেখান থেকে দিল্লি। ভ্রমণ পরিকল্পনায় ভুল করায় এখান থেকে সহজে দিল্লি যাওয়ার বদলে আবার উল্টো দিকের জয়পুর ফিরে গিয়ে দিল্লি যেতে হচ্ছে। ফেরার পথে গাড়িতে একে একে চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল তাজমহল, অসংখ্য বাগিচা, স্থাপনা, আগ্রা দুর্গের মজবুত দেয়াল, ফতেহপুর সিক্রির আবছা কাঠামো, যা প্রমাণ করে এই সত্য যে, ধ্বংস করলেই সব শেষ হয় না; হত্যা করলেও সবকিছুর অবসান ঘটানো যায় না। সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে নিষ্পেষিত হয়েও শত বছরের মুঘল ঐতিহ্য ঠিকই মাথা উঁচিয়ে আছে সারা ভারতে, দক্ষিণ এশিয়ায়, সমগ্র বিশ্বে। বিশ্বসভ্যতার অংশ হয়ে বিশ্বসাংস্কৃতিক গৌরব বৃদ্ধি করছে মুঘল ঐতিহ্য। আর প্রতিনিয়ত শাসক ও শোষকদের সামনে হাজির করছে, ইতিহাসের সেই শিক্ষা, যে শিক্ষা স্বৈরাচারীরা কখনোই গ্রহণ করে না। এটাও এক অমোঘ ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় বিষয়, ইতিহাস শিক্ষা দিলেও ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তবু ইতিহাস শিক্ষা দিয়েই যাচ্ছে। একদার মুঘল রাজধানী সুরম্য আগ্রা নগরী ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে নিজেকে রক্ষা করে তেমনই এক ইতিহাসের শিক্ষালয় হয়ে আছে। আগ্রা, জীবন্ত ইতিহাস বইয়ের মতো ইতিহাসের কঠিন অধ্যায়গুলোর শিক্ষা বিতরণ করছে আজ এবং আগামীর পৃথিবীকে।  
      
ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের বর্ণনায় আগ্রা
বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের মুঘল শাসিত ভারতে এসেছিলেন এবং একপর্যায়ে তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের চিকিৎসক নিযুক্ত হন। তার ভ্রমণ-বৃত্তান্তে সেকালের বাদশাহী জীবন তো বটেই, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনেরও অতুলনীয় ইতিহাস রয়েছে। বিশেষত রাজধানী আগ্রা এবং মুঘল দরবার ও হারেমের অন্তরঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় তার ভাষ্যে। বার্নিয়েরের অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন স্বয়ং কাল মার্কস ও ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস।
বার্নিয়েরে বিবরণের গুরুত্ব একটি বিশেষ কারণে অপরিসীম। আর তা হলো, আগ্রা বা তাজমহল সম্পর্কে আমরা যা দেখি বা পড়ি, তা অন্তত কয়েক শত বছর পরের অভিজ্ঞতা। বার্নিয়েরের মাধ্যমে ঠিক সেই সময়কার ইতিবৃত্ত জানা যায়। তিনি জানিয়েছেন, আগ্রার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো দুটি স্থাপনা। একটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৈরি আকবর বাদশাহের সমাধি-স্মৃতিস্তম্ভ। আর একটি সম্রাট শাহজাহানের তৈরি বেগম মমতাজের সমাধি-স্মৃতিস্তম্ভ তাজমহল। তার পর্যবেক্ষণ মতে, আকবর বাদশাহের সমাধি-স্মৃতিস্তম্ভ ও স্থাপনার যে সৌন্দর্য তা তাজমহলের মধ্যে আরো চমৎকারভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তাজমহলের বিস্তারিত বর্ণনা বার্নিয়ের তার ভ্রমণ কাহিনীতে চার পৃষ্ঠার অধিক জায়গা জুড়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাজমহল সম্পর্কে সমকালীন পর্যটক ও বিশ্লেষক বার্নিয়েরের মূলকথা বা সারমর্ম ছিল এই রকম:
তাজমহল বাস্তবিকই বিস্ময়কর কীর্তি। হয়তো বলবেন যে, আমার রুচি অনেকটা ভারতীয় ধরনের হয়ে গেছে, দীর্ঘকাল ভারতবর্ষে থাকার জন্য। কিন' তা নয়। আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে মিশরীয় পিরামিড আগ্রার তাজমহলের তুলনায় এমন কিছু আশ্চর্য কীর্তির নিদর্শন নয়। মিশরের পিরামিডের কথা অনেক শুনেছি এবং দু-দুবার নিজের চোখে দেখেও যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দ পাইনি, একথা স্বীকার করতে আমার কোনো কুণ্ঠা নেই। নিরাকার পাথরের স্তূপ ছাড়া মিশরীয় পিরামিড আমার কাছে আর কিছু মনে হয়নি। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই স্তরে স্তরে সাজিয়ে একটা কিমাকার কিছু গড়ে তুললেই বিস্ময়কর কীর্তি হয় না। তার মধ্যে মানুষের কল্পনা বা কারিগরির নিদর্শন কিছু নেই। কিন' আগ্রার তাজমহলের মধ্যে তা আছে।
বার্নিয়ের এক চিঠিতে মুঘল সম্রাটদের প্রধান শহর দিল্লি এবং রাজধানী আগ্রা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী রূপে অতি জীবন্ত একটি বিবরণ দিয়েছেন। ১৬৬৩ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের মঁশিয়ে দ্য লা ভেয়ারের কাছে লিখা চিঠিকে মুঘল রাজ-দরবারের জীবনধারা, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি তথা মধ্যযুগের মুঘল শাসিত ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন তিনি:
মঁশিয়ে, আমি জানি আমি স্বদেশে ফিরে আসবার পর আপনি প্রথমেই আমাকে হিন্দুস্থানের রাজধানী তথা দিল্লি ও আগ্রা শহরের কথা জিজ্ঞাসা করবেন। সৌন্দর্যে, আয়তনে ও লোকজনের বসবাসের দিক থেকে ফরাসি শহর প্যারিসের সঙ্গে দিল্লি ও আগ্রার তুলনা হয় কিনা, সেকথা জানবার জন্য এবং আমার কাছ থেকে শুনবার জন্য আপনি ব্যাকুল হয়ে উঠবেন।
দিল্লি ও আগ্রার সৌন্দর্য-প্রসঙ্গে প্রথমেই একটি কথা আমি বলতে চাই। আমি দেখেছি, অনেক সময় ইউরোপীয় পর্যটকরা বেশ একটা উদাসীন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হিন্দুস্থানের এইসব শহরের কথা বলে থাকেন। তাদের মন্তব্য শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। পাশ্চাত্য শহরের সঙ্গে এসব শহরের সৌন্দর্য্যের তুলনা করেন যখন তারা তখন একটি কথা একেবারেই ভুলে যান যে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী স্থাপত্যের বিভিন্ন স্টাইলের বিকাশ হয়। প্যারিস, লন্ডন বা আমস্টার্ডামের স্থাপত্য আর হিন্দুস্থানের স্থাপত্য এক ও অভিন্ন হতে পারে না। কারণ, ইউরোপে যা বাসোপযোগী, হিন্দুস্থানে তা ব্যবহার্য নয়। কথাটা যে কতখানি সত্য তা রাজধানী স্থানান্তরিত করলেই বোঝা যেতে পারে। ইউরোপের শহর যদি হিন্দুস্থানে স্থানান্তরিত করা যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে নতুন পরিকল্পনায় আবার গড়ে তোলার দরকার হবে। ইউরোপের শহরের সৌন্দর্য অতুলনীয় স্বীকার করি। কিন' তার একটা নিজস্ব রূপ আছে, যেটা শীতপ্রধান দেশের রূপ। সেইরকম দিল্লি-আগ্রারও একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, যেটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশের শহরের সৌন্দর্য।     

বার্নিয়ের জানান, যমুনা তীরে বর্তমান সম্রাট আওরঙ্গজেবের পিতা সম্রাট শাহজাহান দিল্লি শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন নিজের নাম অমর করার জন্য। নতুন রাজধানীর নামকরণ তার নামেই হবে, এই ছিল তার বাসনা। সে মতে, দিল্লি শহর যখন নতুন করে তৈরি হলো, তখন তার নাম রাখা হয়  শাহজাহানাবাদ বা সংক্ষেপে  জাহানাবাদ। যার অর্থ, সম্রাট শাহজাহানের বাসস্থান।
সম্রাট শাহজাহান সি'র করেন, নতুন নির্মিত দিল্লি বা শাহজাহানাবাদেই তিনি আগ্রা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন। কারণ, আগ্রায় গ্রীষ্মের উত্তাপ এতো বেশি যে, সেখানে তার পক্ষে বাস করাই সম্ভব নয়। (শেষ জীবনে একটি দীর্ঘ সময় তাকে কিন' আগ্রা দুর্গে বন্দি হয়েই কাটাতে হয়।) মুহাম্মদ ঘোরি প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন দিল্লির ধ্বংসাবশেষের ওপর সম্রাট শাহজাহান প্রতিষ্ঠিত নতুন দিল্লি নগরী গড়ে উঠলো। হিন্দুস্থানে এখন আর কেউ দিল্লিকে দিল্লি বলেন না, জাহানাবাদ বলেন।  

আগ্রা কিন' দিল্লির চাইতেও প্রাচীন শহর। অনেক মুসলিম ও মুঘল সম্রাট শহরটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। তবে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে শহরটি পরিপূর্ণ অবয়ব ও মর্যাদা লাভ করে। সেজন্য আগ্রার প্রাচীন নাম ছিল আকবরাবাদ। দিল্লির চাইতে অনেক বড় শহর আগ্রা। আগ্রায় আমির-ওমরাহ, রাজা-রাজড়াদের বাড়িঘরও অনেক বেশি। পাকাবাড়ি, ইটপাথরের বাড়ির সংখ্যা দিল্লির চাইতে আগ্রায় অধিক। ক্যারাভান, সরাইয়ের সংখ্যাও দিল্লির চেয়ে আগ্রায় অনেক বেশি। বিশেষত, বিখ্যাত কীর্তিস্তম্ভের জন্য আগ্রার খ্যাতি সমধিক। আগ্রার রাস্তাঘাট অবশ্য দিল্লির মতন সুপরিকল্পিত নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র চার-পাঁচটি রাস্তা মোটামুটি সুন্দর, ঘরবাড়িও মন্দ নয়। তা ছাড়া বাকি সব রাস্তা খুবই সংকীর্ণ, ঘিঞ্জি ও আঁকাবাঁকা।

দিল্লি তুলনায় আগ্রাকে অনেকটা মফস্বল শহরের মতন মনে হয়। আমির-ওমরাহ, রাজা-রাজড়াদের বাড়িঘর অনেকটা বাগানবাড়ির মতন উদ্যান পরিবেষ্টিত, খোলামেলা এবং রাজকীয় ঢঙে নির্মিত। তার মধ্যে ধনী হিন্দু বেনিয়ান ও ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলো ঠিক প্রাচীন দুর্গের মতো দেখায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বিচার করলে আগ্রা শহর দিল্লির তুলনায় অনেক বেশি মনোরম মনে হয়। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সবুজের সমারোহ যে কতো মনোমুগ্ধকর তা বর্ণনা করা যায় না।  

আগ্রা শহরে জেসুইটদের একটি গির্জা আছে। একটি প্রতিষ্ঠানও আছে পৃথক বাড়িতে, যাকে  কলেজ বলা হয়। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটি খ্রিষ্টান পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এখানে খ্রিষ্টধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়া হয়। বার্নিয়েরের মতে, কোথা থেকে কীভাবে এই খ্রিষ্টান পরিবারগুলো এখানে জুটলো, তা জানি না। এইটুকু জানি যে, জেসুইটদের আর্থিক দানের লোভেই তারা এখানে এসেছে এবং তার ওপর নির্ভর করেই তারা বসবাস করছে। এই পাদ্রি সাহেবরা আকবর বাদশাহের আমলে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন এখানে। ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের প্রতিপত্তি ছিল যখন খুব বেশি, তখন সম্রাট আকবর এই ধর্মযাজকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন। সম্রাট আকবর এই পাদ্রিদের একটা বাৎসরিক আয়েরই যে ব্যবস্থা করেছিলেন, শুধু তাই নয়, আগ্রায় ও লাহোরে তাদের গির্জা নির্মাণ করার অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। জেসুইট পাদ্রিরা অবশ্য আকবর বাদশাহের পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা ও সমর্থন পান। কিন' সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে তারা পান প্রচণ্ড বিরোধিতা ও শত্রুতা। তবে খ্রিষ্টান গির্জার ঘড়ির শব্দ সারা আগ্রা শহরে শোনা যেতো।

ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের যে আমলের আগ্রা ও তাজমহলের বিবরণ দিয়েছেন, তা সম্রাট শাহজাহান পরবর্তী সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কালের কথা। কালের করাল গ্রাসে সেসব চিত্রের অনেক কিছুই বিলীন হয়ে গিয়েছে। তথাপি আগ্রা মুঘল ঐতিহ্য আর তাজমহলের গৌরব নিয়ে বহাল রয়েছে। বহু ধর্ম ও বর্ণে মানুষের মতো আগ্রা এখনো বিশ্বের নানা জাতির পর্যটকদের আকর্ষণ করছে একটি আন্তর্জাতিক কসমোপলিটন শহরের মতো।   

দক্ষিণ এশিয়ার আইকন আগ্রার তাজমহল
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে মানুষ আছে দুই ধরনের। একদল, যারা তাজমহল দেখেছে। আরেক দল, যারা তাজমহল দেখেনি। দেখুক বা না দেখুক, আগ্রার তাজমহল তাবৎ পৃথিবীর মানুষকেই আকৃষ্ট করছে অহর্নিশি। সারা বিশ্ব তো বটেই, পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের একক কোনো ব্র্যান্ডের নাম করতে হলেও বলতে হয় তাজমহলের নাম। দক্ষিণ এশিয়ার আইকন রূপে চিহ্নিত করা যায় আগ্রার তাজমহলকে। উপমহাদেশের পশ্চিম প্রান্তের আফগান সীমান্তের খাইবার পাস থেকে পূর্ব প্রান্তের মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন চট্টগ্রামের টেকনাফ পর্যন্ত এবং উত্তরের কাশ্মীর থেকে দক্ষিণের কন্যাকুমারী পর্যন্ত এমন কোনো ছোট-বড় শহর, জনপদ নেই, যেখানে তাজের নাম উচ্চারিত হয় না।

আমার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের জনপ্রিয় খাবারের দোকানের নাম তাজ হোটেল। ময়মনসিংহ শহরের সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠানটি রেল স্টেশনের সামনের তাজমহল হোটেল। ঢাকা-চট্টগ্রামে সড়ক পথে যাতায়াতের সময় কুমিল্লায় যে একাধিক অভিজাত হোটেলে বিরতি দেয়া হয়, তার অন্যতম একটি হলো তাজমহল। চট্টগ্রাম শহরের আনন্দকিল্লায় সবচেয়ে বনেদি প্রতিষ্ঠানের নাম তাজ সায়েন্টিফিক, যেখানে নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়।
নেপালে যেমন যেদিকেই তাকানো যাক, হিমালয় নামের পানি, বাস, হোটেল, দোকানের ছড়াছড়ি, দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র তেমনি তাজ নামটি দৃষ্টিগোচর হয়। হয়তো অনেকেই তাজমহল দেখেন নি। তথাপি দেখার আগ্রহ বুকে ধারণ করেন এবং নিজের প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন। সাধারণ মানুষও তাজ নামকে একান্ত নিজস্ব ও আপন ভেবে গ্রহণ করেন।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন ও অভিজাত হোটেল চেইনের সঙ্গে মিশে আছে তাজমহলের নাম, যা একদিকে উপমহাদেশীয় গৌরব ও বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে স্বদেশী প্রত্যয়ের প্রতীকস্বরূপ এবং জাতীয় জাগরণের ঐতিহাসিক ছোঁয়ায় মহিমান্বিত। একথা সবারই জানা যে, টাটাদের প্রথম দিকের উদ্যোগগুলো যেসব ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে ও নানা মাত্রায় বৃটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনার সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত এটা সবচেয়ে বর্ণময় রূপে দেখা গিয়েছিল বোম্বাইয়ের একটি সর্বোচ্চ স্তরের বিশ্বমানের হোটেল প্রতিষ্ঠার জন্য জামসেদজী টাটার দৃঢ় সংকল্পের মধ্যদিয়ে, যার নেপথ্যে একটি বহুকথিত কাহিনী রয়েছে।

একবার জামসেদজী টাটা তার এক বিদেশি বন্ধুকে খাওয়ানোর জন্য তৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পায়ার্কস অ্যাপোলো হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে বলা হয় যে হোটেলটিতে কেবলমাত্র ইউরোপীয়দের প্রবেশাধিকার রয়েছে। ফলে হোটেলে তার বন্ধুকে স্বাগত জানানো হচ্ছে, কিন' তাকে নয়। তারপরই জামসেদজী ১৯০৩ সালে তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা-প্রসূত হোটেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন, যার নাম ঠিক করেন তাজমহল। তাজমহল ছিল বোম্বাইয়ে প্রথম বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত ভবন এবং যা অচিরেই সমারসেট মম থেকে গ্রেগরি পেক-এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করেছিল। স্পষ্টতই এই গল্পে সত্যতা রয়েছে, যা আর. এম. লাল তার ক্রিয়েশন অব ওয়েলথ গ্রনে' লিপিবদ্ধ করেছেন। অমর্ত্য সেন মনে করেন, কাহিনীটি আত্মপরিচয় ও অগ্রাধিকার সম্পর্কে জামসেদজীর বোধ সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করেছে। আর এক্ষেত্রে হাতিয়ার ছিল মুঘল গৌরবসিক্ত তাজমহলের নাম ও মাহাত্ম্য।     

টাটাদের তাজ হোটেল সারা ভারত ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে পৌঁছে গেছে। কলকাতাতেও সবচেয়ে নামি হোটেলের নাম তাজ বেঙ্গল। উপমহাদেশের সর্বত্র শ্রেষ্ঠ থেকে সাধারণ মানের হোটেলের সঙ্গে তাজের নাম যুক্ত হওয়ার ঘটনাটি দৃষ্টান্তমূলক। সারা দক্ষিণ এশিয়ায় তাজ/তাজমহল ছাড়া আরেকটি নাম পাওয়া যাবে না, যা ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল নির্বিশেষে সকলের কাছেই সার্বজনীনভাবে সাদরে গৃহীত হয়েছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, ইউরোপ ও আমেরিকার যেখানেই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অভিবাসীরা রয়েছেন, সেখানেই তাজ বা তাজমহল নামের একটি প্রতিষ্ঠান, নিদেনপক্ষে হোটেল রয়েছে।
আগ্রা ও তাজমহল নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখির অন্ত নেই। তাজমহল নিয়ে যত উক্তি করা হয়েছে, তা নিয়েও ইংরেজি ভাষায় একাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন' রয়েছে। তাজমহলের অতীত, ইতিহাস, রোমাঞ্চ এবং তাতে বসবাসকারী বা জড়িতদের নিয়েও গল্প, উপন্যাসের কমতি নেই। তাজমহলে শায়িত মমতাজমহলের মতোই নানা গবেষক ও লেখক আকৃষ্ট হয়েছেন আগ্রা তথা মুঘল ইতিহাসের বিভিন্ন চরিত্রের প্রতি। যাদের মধ্যে একাধিক মুঘল সম্রাট ছাড়াও রয়েছেন নূরজাহান, জাহান আরা, রওশান আরা, আনারকলি প্রভৃতি আলোচিত চরিত্র।

অ্যালেক্স রাদারফোর্ড রচনা করেছেন Empire of Moghil: Ruler of the World নামের সুবিখ্যাত গ্রন'। অ্যালেক্স রাদারফোর্ড হলো দুইজনের পেন নেইম বা লেখক নাম। তারা হলেন ডায়না প্রিস্টন এবং মাইকেল প্রিস্টন। মুঘল ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী পশ্চিমা লেখকদের অন্যতম এই দুইজন লেখক অ্যালেক্স রাদারফোর্ড নামে Empire of Moghil: Ruler of the World বিখ্যাত গ্রন' ছাড়াও মুঘল বিষয়ক Empire of Moghil সিরিজের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন' প্রকাশ করেছেন। এগুলো হলো: Empire of Moghil: Raiders from North, Empire of Moghil: Brothers at Wat, Empire of Moghil: Ruler of the World, Empire of Moghil: The Tainted Throne, Empire of Moghil: The SerpentÕs Tooth, Empire of Moghil: Traitors in the Shadwos।
তাছাড়া মুঘল ঘটনাবলির বিশ্বস্ত সাংস্কৃতিক বিবরণ পাওয়া যায় তাজমহল ট্রিলজির রচয়িতা ভারতীয়-আমেরিকান লেখক ইন্দু সুন্দারেসানের অ্যাখ্যানে। তাজমহল ট্রিলজিতে যে তিনটি গ্রন' রয়েছে, সেগুলো হলো: BOOK ONE:  The Twentieth Wife, BOOK TWO: The Feast of Roses, BOOK THREE:  Shadow Princess। কাহিনীগুলোর সূত্রপাত প্রাচীন পারস্য থেকে ভারতের পথে আগত আমত্য গিয়াস বেগের পরিবারের যাত্রাপথের রোমাঞ্চকর বিবরণের মধ্যে আবর্তিত। পথিমধ্যে আফগানিস্তানের কান্দাহারে গিয়াস-পত্নী মেহেরুন নেসা নামে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। নানা বির্পযয় পেরিয়ে এক সময় গিয়াস বেগ সম্রাট আকবরের রাজদরবারে স্থান লাভ করেন। তার কন্যা বিবাহসূত্রে আগ্রা থেকে বাংলায় চলে আসেন। প্রাথমিক অবস্থায় কন্যার বৈবাহিক জীবনে নানা বিপদ ও সমস্যা নেমে আসে। অবশেষে বহু উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে জন্মের ৩৪ বছর পর এই কন্যা নূরজাহান নামে মুঘল ভারতের সম্রাজ্ঞীর আসন লাভ করেন। এটাই ট্রিলজি বা তিনখণ্ডের প্রথম বইটির মূল উপজীব্য বিষয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রনে' সম্রাট শাহজাহান-পত্নী মমতাজ মহল আর তদীয় কন্যা জাহান আরার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। আগ্রার মুঘল রাজপরিবার ও হেরেমের অন্তরঙ্গ বিবরণ, প্রেম ও প্রণয়ের বহুমাত্রিক ভাষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘তাজমহল ট্রিলজিতে’।

বাংলা ভাষায় আনিস সিদ্দিকী  মুঘল হেরেমের অন্তরালে নামের এক চমৎকার গ্রন' রচনা করেন, যা মূলত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভাগ্যহত জীবনের উত্থান-পতনের নাটকীয় কাহিনীগুলোকে চিত্রিত করেছে। এতে আগ্রা শহর, আগ্রা দুর্গ, আগ্রার বিশিষ্ট চরিত্রসমূহ, যেমন তাজমহলে চিরনিদ্রায় শায়িত সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল, সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহান আরা, রওশন আরা প্রমুখের জীবনালেখ্যের কথাও এসেছে। সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে মুঘল রাজধানী আগ্রা শহর আর রাজ-অন্তঃপুর ছিল উত্তাল। সেসময় জাহান আরা দারাশিকোহর এবং রওশন আরা আওরঙ্গজেবের পক্ষে ছিলেন। আগ্রার রাজদরবারের মতোই হেরেমের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই ও রাজনৈতিক মেরূকরণ জমে উঠেছিল।

এসব কারণে আগ্রার মুঘল হেরেম নিয়েও গবেষণার অন্ত নেই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রুবি লালের Domesticity and Power in the Early Mughal World, কে. এস. লালের The Mughal Harem, করুণা শর্মার A Visit to the Mughal Harem: Lives of Royal Women, South Asia, তিরমিজি সাই-এর Edicts from the Mughal Harem, সুগন্ধা রাওয়াতের The Women Of Mughal Harem, বাঁশি শর্মার The Naked Mughals: Forbidden Tales of Harem and Butchery, রেশমি বাচ্চুর গঁমযধষ ঐধৎবস, সুভদ্রা সেনগুপ্তার Mahal: Power and Pageantry in the Mughal Harem এবং তনুশ্রী পোদ্দারের Escape from Harem অন্যতম। এসব প্রসিদ্ধ গ্রনে' ঐশ্বর্যশালী মুঘল সাম্রাজ্যের বিবর্তনের সমান্তরালে রাজধানী আগ্রা, রাজদরবার ও হেরেমের উত্থান ও বিকাশ, আগ্রার অন্যতম প্রধান নির্মাতা সম্রাট আকবরের হাতে নগরীর মতোই হেরেমের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন, মুঘল রাজধানীর পাওয়ার, পলিটিক্স ও পার্সোনালিটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এসেছে আগ্রা নগরের আলোকিত ও অন্ধকার নানা দিকও। মুঘল আগ্রার পটভূমিতে বিশেষ বিশেষ কাউকে কেন্দ্র করে উপন্যাস বা আখ্যান বা কাহিনীও রচিত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বহু লোকশ্রুতি, মিথ ও উপাখ্যান।

বাংলার সাহিত্যের প্রায়-সকল প্রধান কবিই তাজমহল নিয়ে অসাধারণ কবিতা রচনা করেছেন। যে তালিকার উপরের দিকে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের নাম। উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যে তাজমহল পেয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। বিখ্যাত কবি ও গীতিকার সাহির লুধিয়ানভী ও লেখিকা অমৃতা প্রীতমের মধ্যে যে অভাবনীয় প্রেমময়তা বিরামজান ছিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আগ্রার তাজমহল। আগ্রার সঙ্গে মিশে রয়েছে এমন এক ট্র্যাজিক নায়িকার নাম, তিনি বাস্তব নাকি কাল্পনিক চরিত্র, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় থাকলেও জনপ্রিয় হয়ে আছেন তিনি আনারকলি নামে মানুষের মুখে মুখে, লোককথায়, চলচ্চিত্রে, নাটকে ও সাহিত্যে। অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র মুঘল-ই-আজম নির্মিত হয়েছে যার করুণ প্রেমের ভিত্তিতে।
মুঘল ভারতের অলিন্দে এখনো লুক্কায়িত ইতিহাসের অধ্যায়, প্রেমের আখ্যান, আনন্দের ধ্বনি এবং বেদনার ইতিবৃত্ত, যা গৌরব ও ঐতিহ্যের সমান্তরাল ধারায় রোমাঞ্চকর শিহরণে আজও প্রবহমান। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.