যে কারণে বাড়ছে তালাক by মরিয়ম চম্পা
রাজধানীতে
বাড়ছে তালাকের সংখ্যা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সাত বছরে রাজধানীতে
তালাকের পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ৩৪ ভাগ। বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে পুরুষের
চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু কেন বাড়ছে এই বিচ্ছেদ প্রবণতা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক পট পরিবতর্ন, ধর্মীয়
অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া
পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়াকেও বিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণ হিসেবে
দেখছেন তারা। বিচ্ছেদের আবেদন নিষ্পত্তি করেন এমন কর্মকর্তাদের মতে,
স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর
সন্দেহবাতিক মানসিকতা, পরকীয়া, স্বামী প্রবাসে থাকা, যৌতুক, মাদকাসক্তি,
ফেসবুকে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কারণে নারীরা বেশি আবেদন করছেন।
স্বামীর পক্ষে আবেদনের ক্ষেত্রে-স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের
ইচ্ছায় চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি কম মনোযোগ দেয়া, ধর্মকর্মে উদাসীনতা,
বন্ধাত্বসহ বিভিন্ন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামীরা।
সায়েরা ঢাকার একটি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।
২০১৭ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন উত্তরাঞ্চলের যুবক রহিমকে। তখনো তিনি জানতেন না তার স্বামী আগে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে তাদের পরিচয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানো, একসাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়া। কখন যে সায়েরা বিবাহিত রহিমকে মন দিয়ে বসেন সেটা নিজেই বুঝতে পারেননি। বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় রহিমের প্রতারণা ধরা পরে। বেড়িয়ে আসে আসল রূপ। তিনি মূলত সায়েরার সঞ্চিত কিছু অর্থ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাকে বিয়ে করেন। প্রত্যাশা মতো সেই টাকা না পাওয়ায় গোপনে ডিভোর্স দেন তাকে। ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর সায়েরা জানতে পারে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন। পরবর্তীতে সায়েরা নিজেই প্রতারক রহিমকে ডিভোর্স দেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের আবেদন বেড়েছে। আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে। গুলশান ও বনানীর অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারীরা বেশি তালাকের আবেদন করছেন। দক্ষিণ সিটিতে মোহাম্মদপুর, কাওরান বাজার এলাকায় পেশাজীবী নারীরা বেশি তালাক দিচ্ছেন।
দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সচেতনতা বাড়ায় মেয়েকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিজ পরিবারগুলোই এগিয়ে আসছে। যেখানে মেয়েরা আগে তালাকপ্রাপ্ত হলে পরিবারে আশ্রয়তো পেতেনই না বরং তাদের হেয় করা হতো। দুই পক্ষের মধ্যে তালাক আপোষ না হলে সিটি করপোরেশনের আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপোষ বা তালাক প্রত্যাহারের আবেদন না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হলেও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই শুনানির জন্য কোনো পক্ষই সিটি করপোরেশন অফিসে যায় না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তালাক হয়েছে সাড়ে ৪শ’টি। অঞ্চল-৫ এ ১লা জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত মোট তালাকের নোটিশের সংখ্যা ৬৩২টি। এর মধ্যে নারীদের আবেদন ৫০৭টি এবং পুরুষের ১২৫টি। চুড়ান্ত তালাক হয়েছে ৩০৮টি। আপোষ মীমাংসা হয়েছে ১১টি। চলমান ৩১৩টি। অঞ্চল-৪ এ প্রথম ৬ মাসে তালাকের আবেদন এসেছে ৩৭৭টি। এর মধ্যে পুরুষ ১০৮টি এবং নারী ২৬৯টি আবেদন করেছেন। মীমাংসা হয়েছে ৭টি। তালাক কার্যকর হয়েছে ২১০টি। চলমান ১৬০টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ এ প্রথম ৬ মাসে তালাকের আবেদন করা হয়েছে ৫৭৯টি। আপোষ হয়েছে ৮টি। তালাক কার্যকর হয়েছে ৫৭১টি। এরমধ্যে নারীদের আবেদন ৩৯৪টি এবং পুরুষের ১৮৫টি। অঞ্চল-৪ এ তালাকের নোটিশ বা আবেদন করা হয়েছে ১৭৪টি। পুরুষ আবেদনকারী ৪৬ এবং নারী ১০৩ জন। মীমাংসা হয়েছে ৫টি। নথিজাত ১৪টি। মোট ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে ৭৯টি। অঞ্চল-৫ এ মোট তালাকের নোটিশ এসেছে ৭৪৭টি। তালাক কার্যকর হয়েছে ৬২৯টি। আপোষ হয়েছে ৮টি। এরমধ্যে স্ত্রী কর্তৃক তালাক ৫৬১ এবং স্বামী কর্তৃক ১৮৬টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে বিবিএস ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় তালাকের আবেদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ আবেদন করেছে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অর্ধলাখের বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। সেই হিসাবে মাসে গড়ে ৭৩৬ টি, দিনে ২৪ টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি করে তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। দক্ষিণ সিটিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে মীমাংসা হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম। সারা দেশে ৭ বছরে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি তালাক হয়েছে বরিশালে। প্রতি হাজারে ২ দশমিক ৭ জন। সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম ও সিলেটে। প্রতি হাজারে ০ দশমিক ৬জন। এক্ষেত্রে শিক্ষিত স্বামী স্ত্রীদের মধ্যে তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে।
গত বছর জুন মাসে বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে প্রতি এক হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ১ দশমিক ৪টি তালাকের ঘটনা ঘটে। যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি।
একই বছর সিটি করপোরেশন সূত্র থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে দিনে ১৪টি সংসার ভাঙছে। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আবেদন করা হয়েছে ২০১৪ সালে ৫ হাজার ৯৮৫টি। ২০১৫ সালে আবেদন কিছুটা কমে হয় ৪ হাজার ৪৭৮টি। ২০১৬ সালে আবেদন বেড়ে হয় ৪ হাজার ৯৪৯টি।
সিলেটে কমছে বিবাহবিচ্ছেদ। সিটি করপোরেশনের এ-সংক্রান্ত নিবন্ধন শাখায় ২০১৮ সালে সোয়া দুই বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব লোপ পাওয়ার পাশাপাশি যৌতুক চাওয়ার প্রবণতা কমায় এ ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটের সমাজব্যবস্থায় এখনো যৌথ পরিবারের আধিক্য ও পারিবারিক প্রভাব থাকায় বিবাহবিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে কম বলে মনে করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে বিচ্ছেদের হার ছিল দশমিক ৬ জন, পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক ১ জন। বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন তাদের সংখ্যা বেশি (হাজারে এক দশমিক ৭ জন)। আর অশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৫। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের হার যেখানে হাজারে এক দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৮ জন। এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আবেদন করছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ২৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বিয়ে করেন তাদের দাম্পত্য জীবন তুলনামূলক বেশি মজবুত ও স্থায়ী হয়ে থাকে। অন্যদিকে যারা টিনএজ (১৩-১৯ বছর) বা ৩২+ বয়সে বিয়ে করে তাদের ডিভোর্সের হার বেশি। বিশেষ করে কম বয়সে বিবাহ বন্ধনে যারা আবদ্ধ হয় তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এ বিষয়ে নারী নেত্রী এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, বিচ্ছেদের অনেকগুলো কারণ থাকে। ইদানিং সংসার ভাঙ্গার প্রধানত দুই ধরনের কারণ আমরা দেখে থাকি। প্রথমত, স্বামী-স্ত্রীর যে মেলবন্ধন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধৈর্যশীলতা, একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা এবং সংসারের খুটিনাটি বিষয়গুলো মেনে বা মানিয়ে নেয়া। এছাড়া নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। এখনকার বাবা মায়েরা তাদের একমাত্র ছেলে বা মেয়ের বেশি সুখ দেখতে গিয়ে এই সমস্যাটা হচ্ছে। যে সকল পরিবারের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে সেসব পরিবারে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মেয়েকে তার মা বা পরিবারের অন্য কেউ প্রভাবিত করে। দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তারা বিভিন্ন পরকীয়াজনিত সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে পরকীয়ার কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে বিয়ের আগে ছেলে বা মেয়ের পরিবারের উচিৎ সন্তানদের কাউন্সিলিং করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা ইত্যাদির ওপর মোটিভেশনাল কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা। ছেলে এবং মেয়ের পরিবারের উভয়ের প্রতি ডমিনেটিং মনোভাবটা যতোদিন পর্যন্ত না কমানো যাবে ততোদিন এটা থামবে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হেমায়েত হোসেন বলেন, সম্প্রতি সময়ে দেখা গেছে নারীদের তালাকের আবেদনের সংখ্যাটা বেশি। তালাকের যে আইন আছে তাতে যে কেউ কাজীর কাছে গিয়ে তালাক দিতে বা নিতে পারে। এক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধনের ঘাটতি রয়েছে। বিয়ের সময় উকিল বাবাসহ অনেকেই উপস্থিত থাকে। কিন্তু ডিভোর্সের সময় তাদের কাউকে লাগে না। এক্ষেত্রে আইনটা যদি এমন হতো যে বিয়ের সময় যেমন দামি দামি সব লোক উপস্থিত থাকে তালাকের সময়ও তারা উপস্থিত থাকবে। তাহলে হয়তো এটা কিছুটা হলেও কমে আসতো।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফরিদা খানম বলেন, ডিভোর্সের আবেদনে নারীরা এগিয়ে এটা শুনতে ঠিক ভালো লাগেনি। কারন সংসার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে নারীরাইবা কেনো এগিয়ে থাকবে। একটি সংসার যখন হয় তখন নারী পুরুষ দুজনেই মিউচুয়ালি কমিটেড হয়। কাজেই পুরুষের সহিংসতাটা বেশি হয় বলেইতো নারীরা ডিভোর্স করতে চায়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে নারীদের প্রতি এই সহিংসতা কেনো কমছে না? এখনতো মানুষের অনেক সচেতন হওয়ার কথা। সবাই সচেতন হলেই ডিভোর্স কমে আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেছেন, যারা এখন সত্তোরোর্ধ তাদের সময় পারিবারিক অশান্তি বা অমিল যতোই থাকুক না কেনো তাদের যাওয়ার জায়গা ছিল না। আর্থিক সঙ্গতিও ছিল না। হয় বাবার বাড়ি। নয়তো ভাইয়ের বাড়ি। ভাইয়ের বাড়ি গেলেও তাকে ঝিয়ের কাজ করতে হতো। বাবার বাড়িও একই অবস্থা। এখন মানুষের আয় বেড়েছে। সঙ্গতি হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হলেই মেয়ে ফোন করে বলে মা গাড়ি পাঠিয়ে দাও। আমি থাকবো না। তখন মা কিছুই মনে করে না। গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে যদি মূল্যবোধ চর্চার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে এটা কিছুটা কমবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে একইসাথে ডিভোর্সের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন মানুষ অনেক স্বাবলম্বি হয়েছে। সবার মধ্যে একটি আত্মসম্মান বোধ জন্মেছে। এমনকি গার্মেন্টেস এর মেয়েরাও আজকাল স্বামীর সাথে বনিবনার সমস্যা হলে চলে আসে।
সায়েরা ঢাকার একটি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।
২০১৭ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন উত্তরাঞ্চলের যুবক রহিমকে। তখনো তিনি জানতেন না তার স্বামী আগে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে তাদের পরিচয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানো, একসাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়া। কখন যে সায়েরা বিবাহিত রহিমকে মন দিয়ে বসেন সেটা নিজেই বুঝতে পারেননি। বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় রহিমের প্রতারণা ধরা পরে। বেড়িয়ে আসে আসল রূপ। তিনি মূলত সায়েরার সঞ্চিত কিছু অর্থ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাকে বিয়ে করেন। প্রত্যাশা মতো সেই টাকা না পাওয়ায় গোপনে ডিভোর্স দেন তাকে। ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর সায়েরা জানতে পারে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন। পরবর্তীতে সায়েরা নিজেই প্রতারক রহিমকে ডিভোর্স দেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের আবেদন বেড়েছে। আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে। গুলশান ও বনানীর অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারীরা বেশি তালাকের আবেদন করছেন। দক্ষিণ সিটিতে মোহাম্মদপুর, কাওরান বাজার এলাকায় পেশাজীবী নারীরা বেশি তালাক দিচ্ছেন।
দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন সচেতনতা বাড়ায় মেয়েকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিজ পরিবারগুলোই এগিয়ে আসছে। যেখানে মেয়েরা আগে তালাকপ্রাপ্ত হলে পরিবারে আশ্রয়তো পেতেনই না বরং তাদের হেয় করা হতো। দুই পক্ষের মধ্যে তালাক আপোষ না হলে সিটি করপোরেশনের আর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপোষ বা তালাক প্রত্যাহারের আবেদন না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হলেও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই শুনানির জন্য কোনো পক্ষই সিটি করপোরেশন অফিসে যায় না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তালাক হয়েছে সাড়ে ৪শ’টি। অঞ্চল-৫ এ ১লা জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত মোট তালাকের নোটিশের সংখ্যা ৬৩২টি। এর মধ্যে নারীদের আবেদন ৫০৭টি এবং পুরুষের ১২৫টি। চুড়ান্ত তালাক হয়েছে ৩০৮টি। আপোষ মীমাংসা হয়েছে ১১টি। চলমান ৩১৩টি। অঞ্চল-৪ এ প্রথম ৬ মাসে তালাকের আবেদন এসেছে ৩৭৭টি। এর মধ্যে পুরুষ ১০৮টি এবং নারী ২৬৯টি আবেদন করেছেন। মীমাংসা হয়েছে ৭টি। তালাক কার্যকর হয়েছে ২১০টি। চলমান ১৬০টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ এ প্রথম ৬ মাসে তালাকের আবেদন করা হয়েছে ৫৭৯টি। আপোষ হয়েছে ৮টি। তালাক কার্যকর হয়েছে ৫৭১টি। এরমধ্যে নারীদের আবেদন ৩৯৪টি এবং পুরুষের ১৮৫টি। অঞ্চল-৪ এ তালাকের নোটিশ বা আবেদন করা হয়েছে ১৭৪টি। পুরুষ আবেদনকারী ৪৬ এবং নারী ১০৩ জন। মীমাংসা হয়েছে ৫টি। নথিজাত ১৪টি। মোট ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে ৭৯টি। অঞ্চল-৫ এ মোট তালাকের নোটিশ এসেছে ৭৪৭টি। তালাক কার্যকর হয়েছে ৬২৯টি। আপোষ হয়েছে ৮টি। এরমধ্যে স্ত্রী কর্তৃক তালাক ৫৬১ এবং স্বামী কর্তৃক ১৮৬টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। ২০১৮ সালে বিবিএস ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় তালাকের আবেদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এখানে প্রায় ৭৫ শতাংশ আবেদন করেছে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অর্ধলাখের বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। সেই হিসাবে মাসে গড়ে ৭৩৬ টি, দিনে ২৪ টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি করে তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। দক্ষিণ সিটিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে মীমাংসা হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম। সারা দেশে ৭ বছরে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি তালাক হয়েছে বরিশালে। প্রতি হাজারে ২ দশমিক ৭ জন। সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম ও সিলেটে। প্রতি হাজারে ০ দশমিক ৬জন। এক্ষেত্রে শিক্ষিত স্বামী স্ত্রীদের মধ্যে তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে।
গত বছর জুন মাসে বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে প্রতি এক হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ১ দশমিক ৪টি তালাকের ঘটনা ঘটে। যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি।
একই বছর সিটি করপোরেশন সূত্র থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে দিনে ১৪টি সংসার ভাঙছে। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আবেদন করা হয়েছে ২০১৪ সালে ৫ হাজার ৯৮৫টি। ২০১৫ সালে আবেদন কিছুটা কমে হয় ৪ হাজার ৪৭৮টি। ২০১৬ সালে আবেদন বেড়ে হয় ৪ হাজার ৯৪৯টি।
সিলেটে কমছে বিবাহবিচ্ছেদ। সিটি করপোরেশনের এ-সংক্রান্ত নিবন্ধন শাখায় ২০১৮ সালে সোয়া দুই বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব লোপ পাওয়ার পাশাপাশি যৌতুক চাওয়ার প্রবণতা কমায় এ ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটের সমাজব্যবস্থায় এখনো যৌথ পরিবারের আধিক্য ও পারিবারিক প্রভাব থাকায় বিবাহবিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে কম বলে মনে করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে বিচ্ছেদের হার ছিল দশমিক ৬ জন, পরবর্তীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক ১ জন। বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের মধ্যে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন তাদের সংখ্যা বেশি (হাজারে এক দশমিক ৭ জন)। আর অশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৫। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের হার যেখানে হাজারে এক দশমিক ৩ শতাংশ আর শহরে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৮ জন। এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আবেদন করছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ২৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে বিয়ে করেন তাদের দাম্পত্য জীবন তুলনামূলক বেশি মজবুত ও স্থায়ী হয়ে থাকে। অন্যদিকে যারা টিনএজ (১৩-১৯ বছর) বা ৩২+ বয়সে বিয়ে করে তাদের ডিভোর্সের হার বেশি। বিশেষ করে কম বয়সে বিবাহ বন্ধনে যারা আবদ্ধ হয় তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এ বিষয়ে নারী নেত্রী এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান মানবজমিনকে বলেন, বিচ্ছেদের অনেকগুলো কারণ থাকে। ইদানিং সংসার ভাঙ্গার প্রধানত দুই ধরনের কারণ আমরা দেখে থাকি। প্রথমত, স্বামী-স্ত্রীর যে মেলবন্ধন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধৈর্যশীলতা, একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা এবং সংসারের খুটিনাটি বিষয়গুলো মেনে বা মানিয়ে নেয়া। এছাড়া নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। এখনকার বাবা মায়েরা তাদের একমাত্র ছেলে বা মেয়ের বেশি সুখ দেখতে গিয়ে এই সমস্যাটা হচ্ছে। যে সকল পরিবারের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে সেসব পরিবারে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মেয়েকে তার মা বা পরিবারের অন্য কেউ প্রভাবিত করে। দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তারা বিভিন্ন পরকীয়াজনিত সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে পরকীয়ার কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে বিয়ের আগে ছেলে বা মেয়ের পরিবারের উচিৎ সন্তানদের কাউন্সিলিং করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা ইত্যাদির ওপর মোটিভেশনাল কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা। ছেলে এবং মেয়ের পরিবারের উভয়ের প্রতি ডমিনেটিং মনোভাবটা যতোদিন পর্যন্ত না কমানো যাবে ততোদিন এটা থামবে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হেমায়েত হোসেন বলেন, সম্প্রতি সময়ে দেখা গেছে নারীদের তালাকের আবেদনের সংখ্যাটা বেশি। তালাকের যে আইন আছে তাতে যে কেউ কাজীর কাছে গিয়ে তালাক দিতে বা নিতে পারে। এক্ষেত্রে সামাজিক বন্ধনের ঘাটতি রয়েছে। বিয়ের সময় উকিল বাবাসহ অনেকেই উপস্থিত থাকে। কিন্তু ডিভোর্সের সময় তাদের কাউকে লাগে না। এক্ষেত্রে আইনটা যদি এমন হতো যে বিয়ের সময় যেমন দামি দামি সব লোক উপস্থিত থাকে তালাকের সময়ও তারা উপস্থিত থাকবে। তাহলে হয়তো এটা কিছুটা হলেও কমে আসতো।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফরিদা খানম বলেন, ডিভোর্সের আবেদনে নারীরা এগিয়ে এটা শুনতে ঠিক ভালো লাগেনি। কারন সংসার ভাঙ্গার ক্ষেত্রে নারীরাইবা কেনো এগিয়ে থাকবে। একটি সংসার যখন হয় তখন নারী পুরুষ দুজনেই মিউচুয়ালি কমিটেড হয়। কাজেই পুরুষের সহিংসতাটা বেশি হয় বলেইতো নারীরা ডিভোর্স করতে চায়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে নারীদের প্রতি এই সহিংসতা কেনো কমছে না? এখনতো মানুষের অনেক সচেতন হওয়ার কথা। সবাই সচেতন হলেই ডিভোর্স কমে আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেছেন, যারা এখন সত্তোরোর্ধ তাদের সময় পারিবারিক অশান্তি বা অমিল যতোই থাকুক না কেনো তাদের যাওয়ার জায়গা ছিল না। আর্থিক সঙ্গতিও ছিল না। হয় বাবার বাড়ি। নয়তো ভাইয়ের বাড়ি। ভাইয়ের বাড়ি গেলেও তাকে ঝিয়ের কাজ করতে হতো। বাবার বাড়িও একই অবস্থা। এখন মানুষের আয় বেড়েছে। সঙ্গতি হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হলেই মেয়ে ফোন করে বলে মা গাড়ি পাঠিয়ে দাও। আমি থাকবো না। তখন মা কিছুই মনে করে না। গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে যদি মূল্যবোধ চর্চার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে এটা কিছুটা কমবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে একইসাথে ডিভোর্সের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন মানুষ অনেক স্বাবলম্বি হয়েছে। সবার মধ্যে একটি আত্মসম্মান বোধ জন্মেছে। এমনকি গার্মেন্টেস এর মেয়েরাও আজকাল স্বামীর সাথে বনিবনার সমস্যা হলে চলে আসে।
No comments