গড়াইয়া নাচে বাহারি বৈসুর by জয়ন্তী দেওয়ান
ফাইখালে,
ফাইখালে, গড়াইয়া ফাইখালে...(এসেছে এসেছে গড়াইয়া নাচের দল)। পাহাড়ের
ত্রিপুরা গ্রামগুলোয় এখন এই শব্দগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব শব্দ লাগছে
পাহাড়ের গায়ে। তাতে দোল খাচ্ছে শেষ বসন্তে ফোটা বাহারী ফুল, গাছপালা। পাহাড়
মেতেছে উৎসবে। চাকমাদের বিজু, মারামাদের সাংগ্রাই আর ত্রিপুরাদের বৈসু
উৎসবে।
বৈসুর অপরিহার্য অনুষঙ্গ গড়াইয়া নাচের দুটি দলের দেখা মিলল খাগড়াছড়ি শহরের ভাইবোনছড়া ও খাগড়াপুর এলাকায়।
যে গৃহস্থের বাড়ির উঠান বড় অথবা যেখানে লোকসমাগম বেশি, সেখানে থামছিল তারা। সুসজ্জিত এই দল গোল হয়ে কিছুক্ষণ নাচ পরিবেশন করে আবার ঢোল আর বাঁশি বাজাতে বাজাতে পাহাড়ি পথ ধরে নাচের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে কোনো গৃহস্থের উঠানে। দলের সদস্যদের পরনে সাদা ধুতি এবং একই রঙের জামা। কোমর, মাথা ও হাতে রিসা নামে একটি লম্বা ঝুলের কাপড়।
নববর্ষ অর্থাৎ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসবের সপ্তাহখানেক আগে থেকে পুরোনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ত্রিপুরা গ্রামগুলোয় শুরু হয় গড়াইয়া নাচ। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, নাচের মধ্য দিয়ে তুষ্ট হন গড়াইয়া দেব। এতে পরিবার, এলাকাবাসীর ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি অটুট থাকে।
গড়াইয়া নাচে অংশগ্রহণকারীদের ‘খেয়েবাই’ বলা হয়ে থাকে। একজন আচাই বা ওঝা ও একজন দেওয়াই (দলনেতা) এই নাচ পরিচালনা করেন। গড়াইয়া নাচে রয়েছে ২২টি তাল ও মুদ্রা। এই ২২টি মুদ্রায় মানবজীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শিত হয়ে থাকে। এই নাচে কেউ একবার অংশ নিলে তাকে পরপর তিনবার অংশ নিতে হয়। কেউ যদি কোনো কারণে অংশ নিতে না পারে, তবে ক্ষমা চাইতে হয় গড়াইয়া দেবের কাছ থেকে।
ভাইবোনছড়া এলাকার গড়াইয়া নাচের দলের আচাই রবিধন ত্রিপুরা (৬৯)। তিনি বললেন, গড়াইয়ার দলের সদস্যরা গৃহস্থের উঠানে ২২টি মুদ্রা প্রদর্শন শেষে শুরু হয় বাড়ির কর্তা ও নারীদের নানা বায়না। নাচের মুদ্রায় কেউ দেখতে চান যুবক-যুবতীর প্রেম-বিরহ, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া।
রবিধন ত্রিপুরাদের দলটি নাচ শেষে পানীয়, টাকা, চালসহ নানা ফলমূল পেল গৃহস্থের কাছে থেকে। তারপর এ দল চলল আরেক বাড়িতে।
যেকোনো মাঙ্গলিক উৎসবেই গড়াইয়া নাচের প্রচলন আছে ত্রিপুরা সমাজে। একসময় যুদ্ধযাত্রার আগেও এ নাচ হতো।
ঠিক বর্ষবিদায় ও বরণের এই সময়ে গড়াইয়া নাচের উদ্দেশ্য ওই মঙ্গল কামনা—এমনটাই মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির গবেষক অরুনেন্দু ত্রিপুরা। তাঁর মতে, পাহাড়ে এই সময় গড়াইয়া নাচের মধ্যে একটি আর্থসামাজিক তাৎপর্য আছে। জুমনির্ভর গ্রামীণ পাহাড়ি সমাজের সঙ্গে আছে সাযুজ্য। চৈত্র শেষের এই সময়ে জুমের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেছে। বর্ষার জল পাওয়া মাত্রই জুমে বীজ বপন হবে। গড়াইয়ায় গৃহস্থের মঙ্গল কামনা করা হয়। তাঁর ধনসম্পদ বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়। ফসল ভালো না হলে গৃহস্থের মঙ্গল হবে কীভাবে। তাই তো ইষ্ট দেবতার কাছে প্রার্থনা হয় নাচের মাধ্যমে।
সমাজের সহজাত পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। পাহাড়ের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নানা দিকের নানা পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। গ্রামনির্ভর পুরো বাংলাদেশে নগরায়ণ হচ্ছে দ্রুত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি গ্রামীণ সমাজেও এসেছে পরিবর্তন।
স্থানীয় উন্নয়কর্মী মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা মনে করেন, এসব পরিবর্তনের অনিবার্য অভিঘাত পড়ছে পাহাড়ের সংস্কৃতিতে। মথুরা ত্রিপুরা বলছিলেন, ‘আগে সাত দিন সাত রাত গড়াইয়া নাচ নাচা হতো। এখন শুধু নিয়ম পালনের জন্যই এর চর্চা। সেই জমজমাট পরিবেশটা এখন নেই।’
বৈসুর অপরিহার্য অনুষঙ্গ গড়াইয়া নাচের দুটি দলের দেখা মিলল খাগড়াছড়ি শহরের ভাইবোনছড়া ও খাগড়াপুর এলাকায়।
যে গৃহস্থের বাড়ির উঠান বড় অথবা যেখানে লোকসমাগম বেশি, সেখানে থামছিল তারা। সুসজ্জিত এই দল গোল হয়ে কিছুক্ষণ নাচ পরিবেশন করে আবার ঢোল আর বাঁশি বাজাতে বাজাতে পাহাড়ি পথ ধরে নাচের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে কোনো গৃহস্থের উঠানে। দলের সদস্যদের পরনে সাদা ধুতি এবং একই রঙের জামা। কোমর, মাথা ও হাতে রিসা নামে একটি লম্বা ঝুলের কাপড়।
নববর্ষ অর্থাৎ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসবের সপ্তাহখানেক আগে থেকে পুরোনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ত্রিপুরা গ্রামগুলোয় শুরু হয় গড়াইয়া নাচ। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, নাচের মধ্য দিয়ে তুষ্ট হন গড়াইয়া দেব। এতে পরিবার, এলাকাবাসীর ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি অটুট থাকে।
গড়াইয়া নাচে অংশগ্রহণকারীদের ‘খেয়েবাই’ বলা হয়ে থাকে। একজন আচাই বা ওঝা ও একজন দেওয়াই (দলনেতা) এই নাচ পরিচালনা করেন। গড়াইয়া নাচে রয়েছে ২২টি তাল ও মুদ্রা। এই ২২টি মুদ্রায় মানবজীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শিত হয়ে থাকে। এই নাচে কেউ একবার অংশ নিলে তাকে পরপর তিনবার অংশ নিতে হয়। কেউ যদি কোনো কারণে অংশ নিতে না পারে, তবে ক্ষমা চাইতে হয় গড়াইয়া দেবের কাছ থেকে।
ভাইবোনছড়া এলাকার গড়াইয়া নাচের দলের আচাই রবিধন ত্রিপুরা (৬৯)। তিনি বললেন, গড়াইয়ার দলের সদস্যরা গৃহস্থের উঠানে ২২টি মুদ্রা প্রদর্শন শেষে শুরু হয় বাড়ির কর্তা ও নারীদের নানা বায়না। নাচের মুদ্রায় কেউ দেখতে চান যুবক-যুবতীর প্রেম-বিরহ, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া।
রবিধন ত্রিপুরাদের দলটি নাচ শেষে পানীয়, টাকা, চালসহ নানা ফলমূল পেল গৃহস্থের কাছে থেকে। তারপর এ দল চলল আরেক বাড়িতে।
যেকোনো মাঙ্গলিক উৎসবেই গড়াইয়া নাচের প্রচলন আছে ত্রিপুরা সমাজে। একসময় যুদ্ধযাত্রার আগেও এ নাচ হতো।
ঠিক বর্ষবিদায় ও বরণের এই সময়ে গড়াইয়া নাচের উদ্দেশ্য ওই মঙ্গল কামনা—এমনটাই মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির গবেষক অরুনেন্দু ত্রিপুরা। তাঁর মতে, পাহাড়ে এই সময় গড়াইয়া নাচের মধ্যে একটি আর্থসামাজিক তাৎপর্য আছে। জুমনির্ভর গ্রামীণ পাহাড়ি সমাজের সঙ্গে আছে সাযুজ্য। চৈত্র শেষের এই সময়ে জুমের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেছে। বর্ষার জল পাওয়া মাত্রই জুমে বীজ বপন হবে। গড়াইয়ায় গৃহস্থের মঙ্গল কামনা করা হয়। তাঁর ধনসম্পদ বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়। ফসল ভালো না হলে গৃহস্থের মঙ্গল হবে কীভাবে। তাই তো ইষ্ট দেবতার কাছে প্রার্থনা হয় নাচের মাধ্যমে।
সমাজের সহজাত পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। পাহাড়ের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নানা দিকের নানা পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে। গ্রামনির্ভর পুরো বাংলাদেশে নগরায়ণ হচ্ছে দ্রুত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি গ্রামীণ সমাজেও এসেছে পরিবর্তন।
স্থানীয় উন্নয়কর্মী মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা মনে করেন, এসব পরিবর্তনের অনিবার্য অভিঘাত পড়ছে পাহাড়ের সংস্কৃতিতে। মথুরা ত্রিপুরা বলছিলেন, ‘আগে সাত দিন সাত রাত গড়াইয়া নাচ নাচা হতো। এখন শুধু নিয়ম পালনের জন্যই এর চর্চা। সেই জমজমাট পরিবেশটা এখন নেই।’
No comments