অজ্ঞান পার্টির হোতারা অধরা by শুভ্র দেব
রাজধানীর
মগবাজারের একটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাসায় ফিরছিলেন ৩৮ বছর বয়সী আসাদুর
রহমান। পথে ফুটপাথের একটি দোকান থেকে চা খান। ফের বাসার উদ্দেশে রওনা দেন।
হাঁটার সময় তার শরীরে ঝিমুনি আসে। তারপর আর তিনি কিছু বলতে পারেন নি। এই
ঘটনার তিনদিন পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
মেডিসিন বিভাগের একটি ওয়ার্ডে। ততক্ষণে তার সঙ্গে থাকা ২৫ হাজার টাকা ও
একটি স্যামসাং ব্র্যান্ডের মোবাইলফোন খোয়া গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে চলতি মাসের
প্রথম সপ্তাহে।
এরপর ঢামেকে দুই সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন। মানবজমিনকে তিনি বলেন, চা খাওয়ার সময় সেখানে আরো কয়েকজন লোক ছিলেন। চায়ের অর্ডার দেয়ার পরে আমি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। এই সুযোগে হয়তো কেউ চায়ের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। মূলত অজ্ঞানপার্টি চক্রের কোনো সদস্য আমার সঙ্গে এমনটাই ঘটিয়েছে।
শুধু আসাদুর রহমান নন রাজধানীসহ সারা দেশে এখন অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তাদের কবল থেকে বাদ যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী ও নারী শিশু। অর্থ, দামি জিনিস খোয়ানোর পাশাপাশি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। গত বছরের পহেলা ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখানে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে কাশেম হাওলাদার নামের এক তেল বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছে। ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অজ্ঞানপার্টি চক্রের খপ্পরে পড়ে মারা গেছেন এক ব্যবসায়ী। তার নাম দুলাল বণিক (৫০)। ওই দিন নগরীর কাস্টম মোড়ে একটি বাস থেকে অচেতন অবস্থায় দুলালকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। গত বছরের ১৬ই নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগতি-চট্টগ্রাম রুটের এ ওয়ান ট্র্যাভেলস নামের একটি নৈশকোচে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৬ বছর বয়সী খোরশেদ আলমের। গত বছরের আগস্ট মাসে ডুমুরিয়ায় অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে অধীর মণ্ডল নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
সূত্র বলছে, বাসস্ট্যান্ড ও ব্যস্ততম এলাকায় নানা ছদ্মবেশে ওঁৎ পেতে থাকে তারা। অভিনব কায়দায় শিকার ধরছে। রাস্তার ধারে ডাব, কোমল পানীয়, বিক্রির আড়ালে চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ভূমিকায় শিকার ধরার চেষ্টা চালায়। কোমল পানীয় বা বোতলের পানির সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করছে। অজ্ঞান হলেই চক্রের সদস্যরা তাকে বাঁচানোর নাম করে নিরাপদে নিয়ে সব কিছু কেড়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। গণপরিবহনের আসনে ক্লোরোফোম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঢামেকের চারটি মেডিসিন ওয়ার্ডে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে গড়ে প্রতিদিন পাঁচজন করে রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ হিসাবে মাসে ১৫০ জন ও বছরে কম বেশি ১ হাজার ৮শ’ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই অপরিচিত ও অজ্ঞান অবস্থায় আসেন। জ্ঞান ফেরার পরেও তাদের অনেকেই বাসার ঠিকানা ও স্বজনদের মোবাইল নম্বর দিতে ব্যর্থ হন। দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা নিয়ে কেউ সুস্থ হন আবার কেউ মারা যান। রাজধানীতে অজ্ঞানপার্টি চক্রের কবলে পড়া ভুক্তভোগীরা ঢামেক ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) চিকিৎসা নেন। ঢামেকের মতো এই দুই হাসাপাতালে বছরে আরো হাজেরখানেক ভুক্তভোগী চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র একই রকম।
সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত অর্ধশতাধিক অজ্ঞানপার্টি চক্রের হোতা। তাদের মধ্যে- কানা শহীদ, ফরিদ, টঙ্গির মজিবুর, আকতার মোল্লা, শ্যামপুরের ফারুক, স্বপন, আসলাম, সবুজ, জনি, হোসেন, আবুল, মিন্টু, শিপন, ইয়াকুব, শাহাজাহান, আলমগীর, সেন্টু, লাল মিয়া, কামাল, মাসুম, গিয়াস, লোকমান, শাহীন, ফেরদৌস, আলী, আলম, রনি, জাহিদ, ইদ্রিস, মামুন, রিয়াজ, আজমত, মোস্তফা, রফিক, লিংকন, মুন্না, সালাম, হাশেম, মনোয়ার, রইছ, নুর হোসেন, জলিল, হাফিজ, রহমত, কাশেম অন্যতম। এ ছাড়া নামে বেনামে আরো একাধিক হোতা রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গ্রুপ রয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, অজ্ঞানপার্টি চক্র সাধারণত চারটি ধাপে তাদের কাজ করে। এই চারটি ধাপের প্রথম ধাপে থাকে চক্রের প্রধান হোতা যাদেরকে বলা হয় সর্দার। যাদের শহরের বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজ মালিকের সঙ্গে একটা যোগসাজশ থাকে। এরপরে থাকেন মধ্যেস্থতাকারীরা। যারা বিভিন্ন সময় গাড়িচালককে অজ্ঞান করে নিয়ে আসা গাড়ি মালিকের কাছে টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে দিতে মিডিয়া হিসেবে কাজ করে। আর মাঠপর্যায়ে মানুষকে অজ্ঞান করে মালামাল লুট করার কাজে থাকেন আরো কিছু সদস্য।
তাদেরকে বলা হয় চুর। লুণ্ঠিত মালামাল ও অর্জিত আয়ের ভাগ সবাইকে চুক্তি অনুসারে দেয়া হয়। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হয় অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যরা। থানায় মামলা করে তাদেরকে পাঠানো হয় কারাগারে। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর তারা জামিনে বের হয়ে ফের শুরু করে একই কাজ। গোয়েন্দাসূত্র বলছে, মাঠে ঘাটে থেকে যাদেরকে গ্রেপ্তার করে আনা হয় তারা ছিঁচকে চোর। তারা ছাড়াও এসব চক্রে বিভিন্ন ধাপে আরো সদস্য জড়িত আছেন। মূলহোতা চক্রের সর্দার সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তাই মাঠপর্যায়ের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও তাদেরকে জামিনে মুক্ত করা হয় আবার নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিম ১৯শে জানুয়ারি উত্তরা পশ্চিম থানার জমজম টাওয়ারের পেছন থেকে অজ্ঞানপার্টি চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো- মো. অলী (২৩), তানভীর ইসলাম (২৪), নুর মোহাম্মদ (৩৭), মো. তাইজুউদ্দিন (৪৫), মো. জাকির (৪৫) ও মো. শিপলু (৩০)। আটকের পর তারা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে অজ্ঞান করার চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। গোয়েন্দাসূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা খুব ভোরে বের হয়। বের হওয়ার সময় তারা বিভিন্ন গ্যারেজ থেকে চালক সেজে সিএনজি ভাড়া নেয়। ওই সিএনজিতে আরো দুজন থাকে যারা যাত্রী হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ঘোরাঘুরির সময় তারা যাত্রীবিহীন সিএনজির পিছু নেয়। সুবিধাজনক কোনো চায়ের দোকানে গিয়ে যদি ওই সিএনজি থামে তবে তারাও সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
সেখানে গিয়ে অজ্ঞানপার্টি চক্রের সিএনজিচালক দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজিচালকের সঙ্গে গল্প শুরু করে। গল্পের ছলে সে তাকে চা খাওয়ার প্রস্তাব করে। তারা আগে থেকে ছোট কোনো কৌটায় চেতনানাশক ওষুধ পানির সঙ্গে মিশিয়ে রাখে। সেটা দেখতে অনেকটা বাদামী রংয়ের। কৌশলে সেই চেতনানাশক লিকিউড ওষুধটা চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এ সময় চক্রের অন্যান্য সদস্যরা কোথাও যাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী চালককে ভাড়া করেন। ওই চালক তাদের নিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর ঝিমিয়ে পড়ে। এই অবস্থা বুঝতে পেরে চক্রের সদস্যরা মাঝপথে কিছু কেনার নাম করে আবার যাত্রা বিরতি দেয়। ততক্ষণে ভুক্তভোগী সিএনজিচালক পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যায়। কৌশলে তাকে সিএনজি থেকে নামিয়ে তার সিএনজি নিয়ে চম্পট দেয় চক্রের সদস্যরা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সিএনজি নিয়ে যাওয়ার পর ওই চক্রের সদস্যরা তাদের আওতাধীন গ্যারেজে নিয়ে রাখে। পরে সিএনজিতে থাকা কাগজপত্র নিয়ে চক্রের মধ্যেস্থতাকারীরা সিএনজির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রে মালিককে থানা পুলিশের ঝামেলা যাতে না করে সেজন্য সতর্ক করে দেয়। আর গাড়ির কন্ডিশন বুঝে মালিকের কাছের টাকার পরিমাণ বলা হয়। তখন শুরু হয় দর কষাকষি। সাধারণত চুরি হওয়া সিএনজি ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয় বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছে। টাকার পরিমাণ নিশ্চিত হওয়ার পর মোবাইল নম্বর দেয়া হয়। ওই নম্বরে টাকা পাওয়ার পর চক্রের সদস্যরা একটি জায়গা থেকে সিএনজি নিয়ে যেতে বলেন। নির্ধারিত স্থানে বেশিরভাগ সময় সিএনজি পাওয়া যায় না। অন্তত ৪/৫টি স্পট ঘুরিয়ে একটি স্থানে সিএনজি রেখে তারা সটকে পড়ে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন মানবজমিনকে বলেন, সিএনজিচালককে অজ্ঞান করে ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ হচ্ছে। ঢাকা মেট্রো এলাকায় নম্বর প্লেটসহ সিএনজির মূল্যে অনেক বেড়ে গেছে। কোনোভাবে একটা সিএনজি চুরি করে নিয়ে গেলে মালিক সেটা লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক সময় চুরি করে তাদের গ্যারেজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হচ্ছে না। যাওয়ার পথেই অনেক সময় মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা টাকার বিনিময়ে সিএনজি বুঝিয়ে দেয়। সাকলায়েন বলেন, ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগ সময় পুলিশকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন না।
এদিকে, গোয়েন্দারা জানিয়েছেন বিভিন্ন সময় অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে তাদের কাছে ট্রেনেক, এটিভেন, নকটিন, এপিট্রা, মাইলাম, ডরমিকাম, মিডাজোলাম, নাইট্রাজিপাম, লোরাজিপাম, ঘুমের ওষুধ, ডায়বেটিকসের ইনসুলিন, বিষাক্ত মলম পাওয়া গেছে। এসব ওষুধ ব্যবহার করেই তারা মানুষকে অজ্ঞান করে। এসব ওষুধ ব্যবহারের কারণে অনেক সময়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তির মৃত্যু হয়। সূত্র বলছে, রাজধানীর ব্যস্ততম যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, সায়েদাবাদ, আরামবাগ, গাবতলী, মিরপুর, গুলিস্তান, ফার্মগেট, চিড়িয়াখানা, পল্টন, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুল, ব্যাংক পাড়া মতিঝিল ছাড়াও আরো বিশেষ বিশেষ স্থানে তাদের অবস্থান থাকে। অর্ধশতাধিক অজ্ঞানপার্টি চক্রের অন্তত তিন শতাধিক সদস্যরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তৎপতা চালাচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে তাদের তৎপরতা রয়েছে। সাভার, টঙ্গী, গাজীপুরে সক্রিয় একাধিক দল। পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে ইদানীং অজ্ঞানপার্টি চক্রের অনেক সদস্য আটক হয়েছেন। তাই তাদের তৎপরতা কিছুটা কমেছে। এখনো যারা এই কাজে জড়িত আছেন পুলিশ সদস্যরা তাদেরকে নির্মূল করতে কাজ করে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে অজ্ঞানপার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মুগদার জব্বার আলী। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি এখন রাজধানীর অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করেন। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন তখনকার নানা কথা। তিনি বলেন, এ ধরনের জঘন্য কাজ করার জন্য হয়তো আজকে আমার এই অবস্থা। অনেকবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েছি। জামিনে মুক্ত হয়েছি। ফের শুরু করেছি এই কাজ। আজ বুঝতে পারছি এটা কতটা অপরাধের কাজ ছিল। জেল জরিমানায় এই অপরাধের শাস্তি হতে পারে না। কেন এই কাজ করতেন জবাবে তিনি বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনাজপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। গ্রামের বাজারে ছোট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। বিক্রিবাট্টা ভালোই হতো। এক সময় ক্রেতার কাছে বাকির পরিমাণটা বেশি হয়ে যায়। নতুন করে কোনো মালামাল দোকানে উঠাতে পারি নাই। একসময় দোকান বন্ধ করে পূর্ব পরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০১০ সালের মে মাসে চলে আসি ঢাকায়। এখানে এসে কোনো কাজ জোটেনি। কাওরানবাজারে রাতের বেলা মেন্থির কাজ করতাম। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের খরচ মিটিয়ে বাড়িতে পাঠানো সম্ভব হতো না। বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও আরো তিন সন্তান ছিল। তাদের কোনো টাকা দিতে পারতাম না। অনেকবার ভেবেছি বাড়ি চলে যাব। কিন্তু এলাকার মানুষ হাসাহাসি করবে তাই আর যাওয়া হয়নি। কাওরানবাজারের একটি চায়ের দোকানে পরিচয় হয় কুমিল্লার বাসিন্দা মামুনের সঙ্গে।
তার পাল্লায় পড়েই এ পথে আসি। জব্বার বলেন এসবের পেছনে বড় সিন্ডিকেট কাজ করে। আলাল নামের এক সর্দারের চক্রে আমি কাজ করতাম। পাঁচ বছরেও তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই। অজ্ঞান করার কাজে আমরা একসঙ্গে ছয়জন কাজ করতাম। কখনো কোনো সিএনজিচালক আবার কখনো টাকা আছে এমন ব্যক্তিকে টার্গেট করতাম। কাজ বুঝে প্রতি কাজের জন্য ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পাওয়া যেত। কাজ করতে গিয়ে ৫/৬ বার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ধরা পড়ার পরে জামিনে বের হয়ে আর এই কাজ করি নাই। এখন সবজি বিক্রি করেই সংসার চালাই। কিভাবে অজ্ঞান করতেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, চটপটি, ক্রিম জাতীয় বিস্কুট, চকলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে দিতাম। এ ছাড়া অনেক সময় মরিচের গুঁড়া ও ক্লোরোফোম জাতীয় জিনিস ব্যবহার করতাম। পরে কৌশলে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে খাইয়ে দিতাম। অজ্ঞান হওয়ার পর আমরাই কৌশলে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে সব কিছু লুটে নিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে রাখতাম।
এরপর ঢামেকে দুই সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন। মানবজমিনকে তিনি বলেন, চা খাওয়ার সময় সেখানে আরো কয়েকজন লোক ছিলেন। চায়ের অর্ডার দেয়ার পরে আমি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। এই সুযোগে হয়তো কেউ চায়ের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। মূলত অজ্ঞানপার্টি চক্রের কোনো সদস্য আমার সঙ্গে এমনটাই ঘটিয়েছে।
শুধু আসাদুর রহমান নন রাজধানীসহ সারা দেশে এখন অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তাদের কবল থেকে বাদ যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী ও নারী শিশু। অর্থ, দামি জিনিস খোয়ানোর পাশাপাশি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। গত বছরের পহেলা ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখানে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে কাশেম হাওলাদার নামের এক তেল বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছে। ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অজ্ঞানপার্টি চক্রের খপ্পরে পড়ে মারা গেছেন এক ব্যবসায়ী। তার নাম দুলাল বণিক (৫০)। ওই দিন নগরীর কাস্টম মোড়ে একটি বাস থেকে অচেতন অবস্থায় দুলালকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। গত বছরের ১৬ই নভেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগতি-চট্টগ্রাম রুটের এ ওয়ান ট্র্যাভেলস নামের একটি নৈশকোচে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৬ বছর বয়সী খোরশেদ আলমের। গত বছরের আগস্ট মাসে ডুমুরিয়ায় অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে অধীর মণ্ডল নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
সূত্র বলছে, বাসস্ট্যান্ড ও ব্যস্ততম এলাকায় নানা ছদ্মবেশে ওঁৎ পেতে থাকে তারা। অভিনব কায়দায় শিকার ধরছে। রাস্তার ধারে ডাব, কোমল পানীয়, বিক্রির আড়ালে চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন ভূমিকায় শিকার ধরার চেষ্টা চালায়। কোমল পানীয় বা বোতলের পানির সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করছে। অজ্ঞান হলেই চক্রের সদস্যরা তাকে বাঁচানোর নাম করে নিরাপদে নিয়ে সব কিছু কেড়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। গণপরিবহনের আসনে ক্লোরোফোম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ঢামেকের চারটি মেডিসিন ওয়ার্ডে অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে গড়ে প্রতিদিন পাঁচজন করে রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ হিসাবে মাসে ১৫০ জন ও বছরে কম বেশি ১ হাজার ৮শ’ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই অপরিচিত ও অজ্ঞান অবস্থায় আসেন। জ্ঞান ফেরার পরেও তাদের অনেকেই বাসার ঠিকানা ও স্বজনদের মোবাইল নম্বর দিতে ব্যর্থ হন। দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা নিয়ে কেউ সুস্থ হন আবার কেউ মারা যান। রাজধানীতে অজ্ঞানপার্টি চক্রের কবলে পড়া ভুক্তভোগীরা ঢামেক ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিটফোর্ড) চিকিৎসা নেন। ঢামেকের মতো এই দুই হাসাপাতালে বছরে আরো হাজেরখানেক ভুক্তভোগী চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র একই রকম।
সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত অর্ধশতাধিক অজ্ঞানপার্টি চক্রের হোতা। তাদের মধ্যে- কানা শহীদ, ফরিদ, টঙ্গির মজিবুর, আকতার মোল্লা, শ্যামপুরের ফারুক, স্বপন, আসলাম, সবুজ, জনি, হোসেন, আবুল, মিন্টু, শিপন, ইয়াকুব, শাহাজাহান, আলমগীর, সেন্টু, লাল মিয়া, কামাল, মাসুম, গিয়াস, লোকমান, শাহীন, ফেরদৌস, আলী, আলম, রনি, জাহিদ, ইদ্রিস, মামুন, রিয়াজ, আজমত, মোস্তফা, রফিক, লিংকন, মুন্না, সালাম, হাশেম, মনোয়ার, রইছ, নুর হোসেন, জলিল, হাফিজ, রহমত, কাশেম অন্যতম। এ ছাড়া নামে বেনামে আরো একাধিক হোতা রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গ্রুপ রয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, অজ্ঞানপার্টি চক্র সাধারণত চারটি ধাপে তাদের কাজ করে। এই চারটি ধাপের প্রথম ধাপে থাকে চক্রের প্রধান হোতা যাদেরকে বলা হয় সর্দার। যাদের শহরের বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজ মালিকের সঙ্গে একটা যোগসাজশ থাকে। এরপরে থাকেন মধ্যেস্থতাকারীরা। যারা বিভিন্ন সময় গাড়িচালককে অজ্ঞান করে নিয়ে আসা গাড়ি মালিকের কাছে টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে দিতে মিডিয়া হিসেবে কাজ করে। আর মাঠপর্যায়ে মানুষকে অজ্ঞান করে মালামাল লুট করার কাজে থাকেন আরো কিছু সদস্য।
তাদেরকে বলা হয় চুর। লুণ্ঠিত মালামাল ও অর্জিত আয়ের ভাগ সবাইকে চুক্তি অনুসারে দেয়া হয়। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হয় অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যরা। থানায় মামলা করে তাদেরকে পাঠানো হয় কারাগারে। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর তারা জামিনে বের হয়ে ফের শুরু করে একই কাজ। গোয়েন্দাসূত্র বলছে, মাঠে ঘাটে থেকে যাদেরকে গ্রেপ্তার করে আনা হয় তারা ছিঁচকে চোর। তারা ছাড়াও এসব চক্রে বিভিন্ন ধাপে আরো সদস্য জড়িত আছেন। মূলহোতা চক্রের সর্দার সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তাই মাঠপর্যায়ের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও তাদেরকে জামিনে মুক্ত করা হয় আবার নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিম ১৯শে জানুয়ারি উত্তরা পশ্চিম থানার জমজম টাওয়ারের পেছন থেকে অজ্ঞানপার্টি চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো- মো. অলী (২৩), তানভীর ইসলাম (২৪), নুর মোহাম্মদ (৩৭), মো. তাইজুউদ্দিন (৪৫), মো. জাকির (৪৫) ও মো. শিপলু (৩০)। আটকের পর তারা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে অজ্ঞান করার চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। গোয়েন্দাসূত্রে জানা গেছে, অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা খুব ভোরে বের হয়। বের হওয়ার সময় তারা বিভিন্ন গ্যারেজ থেকে চালক সেজে সিএনজি ভাড়া নেয়। ওই সিএনজিতে আরো দুজন থাকে যারা যাত্রী হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ঘোরাঘুরির সময় তারা যাত্রীবিহীন সিএনজির পিছু নেয়। সুবিধাজনক কোনো চায়ের দোকানে গিয়ে যদি ওই সিএনজি থামে তবে তারাও সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
সেখানে গিয়ে অজ্ঞানপার্টি চক্রের সিএনজিচালক দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজিচালকের সঙ্গে গল্প শুরু করে। গল্পের ছলে সে তাকে চা খাওয়ার প্রস্তাব করে। তারা আগে থেকে ছোট কোনো কৌটায় চেতনানাশক ওষুধ পানির সঙ্গে মিশিয়ে রাখে। সেটা দেখতে অনেকটা বাদামী রংয়ের। কৌশলে সেই চেতনানাশক লিকিউড ওষুধটা চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এ সময় চক্রের অন্যান্য সদস্যরা কোথাও যাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী চালককে ভাড়া করেন। ওই চালক তাদের নিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর ঝিমিয়ে পড়ে। এই অবস্থা বুঝতে পেরে চক্রের সদস্যরা মাঝপথে কিছু কেনার নাম করে আবার যাত্রা বিরতি দেয়। ততক্ষণে ভুক্তভোগী সিএনজিচালক পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যায়। কৌশলে তাকে সিএনজি থেকে নামিয়ে তার সিএনজি নিয়ে চম্পট দেয় চক্রের সদস্যরা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সিএনজি নিয়ে যাওয়ার পর ওই চক্রের সদস্যরা তাদের আওতাধীন গ্যারেজে নিয়ে রাখে। পরে সিএনজিতে থাকা কাগজপত্র নিয়ে চক্রের মধ্যেস্থতাকারীরা সিএনজির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রে মালিককে থানা পুলিশের ঝামেলা যাতে না করে সেজন্য সতর্ক করে দেয়। আর গাড়ির কন্ডিশন বুঝে মালিকের কাছের টাকার পরিমাণ বলা হয়। তখন শুরু হয় দর কষাকষি। সাধারণত চুরি হওয়া সিএনজি ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয় বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছে। টাকার পরিমাণ নিশ্চিত হওয়ার পর মোবাইল নম্বর দেয়া হয়। ওই নম্বরে টাকা পাওয়ার পর চক্রের সদস্যরা একটি জায়গা থেকে সিএনজি নিয়ে যেতে বলেন। নির্ধারিত স্থানে বেশিরভাগ সময় সিএনজি পাওয়া যায় না। অন্তত ৪/৫টি স্পট ঘুরিয়ে একটি স্থানে সিএনজি রেখে তারা সটকে পড়ে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন মানবজমিনকে বলেন, সিএনজিচালককে অজ্ঞান করে ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ হচ্ছে। ঢাকা মেট্রো এলাকায় নম্বর প্লেটসহ সিএনজির মূল্যে অনেক বেড়ে গেছে। কোনোভাবে একটা সিএনজি চুরি করে নিয়ে গেলে মালিক সেটা লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক সময় চুরি করে তাদের গ্যারেজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হচ্ছে না। যাওয়ার পথেই অনেক সময় মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা টাকার বিনিময়ে সিএনজি বুঝিয়ে দেয়। সাকলায়েন বলেন, ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগ সময় পুলিশকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন না।
এদিকে, গোয়েন্দারা জানিয়েছেন বিভিন্ন সময় অজ্ঞানপার্টি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে তাদের কাছে ট্রেনেক, এটিভেন, নকটিন, এপিট্রা, মাইলাম, ডরমিকাম, মিডাজোলাম, নাইট্রাজিপাম, লোরাজিপাম, ঘুমের ওষুধ, ডায়বেটিকসের ইনসুলিন, বিষাক্ত মলম পাওয়া গেছে। এসব ওষুধ ব্যবহার করেই তারা মানুষকে অজ্ঞান করে। এসব ওষুধ ব্যবহারের কারণে অনেক সময়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তির মৃত্যু হয়। সূত্র বলছে, রাজধানীর ব্যস্ততম যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, সায়েদাবাদ, আরামবাগ, গাবতলী, মিরপুর, গুলিস্তান, ফার্মগেট, চিড়িয়াখানা, পল্টন, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুল, ব্যাংক পাড়া মতিঝিল ছাড়াও আরো বিশেষ বিশেষ স্থানে তাদের অবস্থান থাকে। অর্ধশতাধিক অজ্ঞানপার্টি চক্রের অন্তত তিন শতাধিক সদস্যরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তৎপতা চালাচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে তাদের তৎপরতা রয়েছে। সাভার, টঙ্গী, গাজীপুরে সক্রিয় একাধিক দল। পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে ইদানীং অজ্ঞানপার্টি চক্রের অনেক সদস্য আটক হয়েছেন। তাই তাদের তৎপরতা কিছুটা কমেছে। এখনো যারা এই কাজে জড়িত আছেন পুলিশ সদস্যরা তাদেরকে নির্মূল করতে কাজ করে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে অজ্ঞানপার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মুগদার জব্বার আলী। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি এখন রাজধানীর অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করেন। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন তখনকার নানা কথা। তিনি বলেন, এ ধরনের জঘন্য কাজ করার জন্য হয়তো আজকে আমার এই অবস্থা। অনেকবার পুলিশের কাছে ধরা পড়েছি। জামিনে মুক্ত হয়েছি। ফের শুরু করেছি এই কাজ। আজ বুঝতে পারছি এটা কতটা অপরাধের কাজ ছিল। জেল জরিমানায় এই অপরাধের শাস্তি হতে পারে না। কেন এই কাজ করতেন জবাবে তিনি বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনাজপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। গ্রামের বাজারে ছোট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। বিক্রিবাট্টা ভালোই হতো। এক সময় ক্রেতার কাছে বাকির পরিমাণটা বেশি হয়ে যায়। নতুন করে কোনো মালামাল দোকানে উঠাতে পারি নাই। একসময় দোকান বন্ধ করে পূর্ব পরিচিত একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০১০ সালের মে মাসে চলে আসি ঢাকায়। এখানে এসে কোনো কাজ জোটেনি। কাওরানবাজারে রাতের বেলা মেন্থির কাজ করতাম। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের খরচ মিটিয়ে বাড়িতে পাঠানো সম্ভব হতো না। বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও আরো তিন সন্তান ছিল। তাদের কোনো টাকা দিতে পারতাম না। অনেকবার ভেবেছি বাড়ি চলে যাব। কিন্তু এলাকার মানুষ হাসাহাসি করবে তাই আর যাওয়া হয়নি। কাওরানবাজারের একটি চায়ের দোকানে পরিচয় হয় কুমিল্লার বাসিন্দা মামুনের সঙ্গে।
তার পাল্লায় পড়েই এ পথে আসি। জব্বার বলেন এসবের পেছনে বড় সিন্ডিকেট কাজ করে। আলাল নামের এক সর্দারের চক্রে আমি কাজ করতাম। পাঁচ বছরেও তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই। অজ্ঞান করার কাজে আমরা একসঙ্গে ছয়জন কাজ করতাম। কখনো কোনো সিএনজিচালক আবার কখনো টাকা আছে এমন ব্যক্তিকে টার্গেট করতাম। কাজ বুঝে প্রতি কাজের জন্য ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পাওয়া যেত। কাজ করতে গিয়ে ৫/৬ বার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ধরা পড়ার পরে জামিনে বের হয়ে আর এই কাজ করি নাই। এখন সবজি বিক্রি করেই সংসার চালাই। কিভাবে অজ্ঞান করতেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, চটপটি, ক্রিম জাতীয় বিস্কুট, চকলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে দিতাম। এ ছাড়া অনেক সময় মরিচের গুঁড়া ও ক্লোরোফোম জাতীয় জিনিস ব্যবহার করতাম। পরে কৌশলে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে খাইয়ে দিতাম। অজ্ঞান হওয়ার পর আমরাই কৌশলে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে সব কিছু লুটে নিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে রাখতাম।
No comments