৯০,০০০ বন্দি মানবেতর জীবন -মানবজমিন অনুসন্ধান by রুদ্র মিজান
এক
ব্যক্তির ঘুমানোর স্থানে ঘুমাচ্ছে দুই থেকে তিন জন। শীতের রাত যেন এক একটি
বছর। কাঁথা নেই, কম্বল নেই। মশারি নেই। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে কাটে প্রতিটি
রাত। শৌচাগারে দীর্ঘ লাইন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েও অমানবিক দুর্ভোগ।
মামলায় হাজিরা দিতে গেলে দিনভর থাকতে হয় না খেয়ে।
‘রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ’ স্লোগানে চলা দেশের কারাগারগুলোর চিত্র এটি। ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দি নিয়ে চলা কারাগারগুলোতে যেন সমস্যা আর সংকটের শেষ নেই। বাড়তি বন্দির কারণে বাড়তি সমস্যা। অসুস্থ হলেও চিকিৎসা পেতে পোহাতে হয় ঝক্কি। হাসপাতালে নিতে গেলে প্রহর গুনতে হয়। এম্বুলেন্স সংকট। কারাগারে থাকা বন্দিদের বেশির ভাগেরই সাজাপ্রাপ্ত না। তারা সত্যিকার অর্থে অপরাধী কি-না তাও প্রমাণ হয়নি। বন্দিদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক মামলার আসামি।
আর একক মামলা হিসেবে মাদকের মামলার আসামি মোট বন্দির এক-তৃতীয়াংশের বেশি। অনেকেই বন্দি হয়েছেন ‘গায়েবি’ মামলায়। জামিন হলে কেউ কেউ মুক্ত হচ্ছেন। যাদের জামিন হয়নি তারা প্রহর গুনছেন মুক্তির। সারা দেশে রয়েছে ৫৫টি জেলা কারাগার ও ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার মিলে মোট ৬৮টি কারাগার। কারাগারগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৬শ’ ৬৪ জন। কিন্তু ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ বন্দি থাকেন কোনো কোনো কারাগারে। স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ সংখ্যক বন্দি ছিল গত বছরের শেষদিকে। গত সোমবারের হিসাব অনুসারে সারা দেশে কারাগারে বন্দি রয়েছে ৯১ হাজার ৭শ’ ৪২ জন। তার আগের দিন রোববারে এই সংখ্যা ছিল ৯২ হাজার ১শ’ ৭৭ জন। এর মধ্যে মাদক মামলার আসামি ২৯ হাজার ৬৩ জন। নারী আসামি ৩ হাজার ৩ শ’ ৩২। গত ডিসেম্বরে কারাবন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ।
কারা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই সারা দেশে কারাবন্দির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তাদের বেশির ভাগই নাশকতা, বিস্ফোরক ও আইনি কাজে বাধার অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার। আগস্টে সারা দেশে বন্দি ছিল ৮৩ হাজার ৫ শ’ ৬ জন। সেপ্টেম্বর মাসে বন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৯ শ’ ৭৫ জন। বন্দির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় তখন চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ লঘু অপরাধে আটক প্রায় ৭ হাজার জনকে মুক্তি দেয়া হয়। তারপরও বন্দির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। অক্টোবরে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৬শ’ ২৫ জনে। ঢাকা বিভাগের ১৭ কারাগারে বন্দি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ৩৪২ জনের। গত আগস্টে এসব কারাগারে বন্দি ছিল ২৮ হাজার ৩শ’ ৪৯ জন। নভেম্বরে বন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৬শ’ জনে।
এই বিপুল সংখ্যক বন্দিকে মানবিক সুবিধা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কারা কর্তৃপক্ষ। দেশের অনেক কারাগারে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। শীতের রাতে ঘরের বাইরেও থাকতে হয়েছে বন্দিদের। কাঁথা জুটে তো বালিশ জুটে না। নিচের বিছানার জন্য কম্বল জুটলেও গায়ের উপরে কম্বল জুটছে না। এসব কম্বলকে ব্যবহার অনুপযোগী বলছেন বন্দিরা। এভাবেই কাটছে বন্দি জীবন। কারা ইতিহাসে বন্দির বালিশ ছিল না। গত নভেম্বর থেকে কারাবন্দিদের মধ্যে বালিশ বিতরণ করা হচ্ছে। খাবার নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কারাবন্দিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকালে দেয়া হয় পুরনো আটার একটি রুটি ও ছোট এক টুকরো গুড়। দুপুরে নিম্নমানের চালের ভাত, পাতলা ডাল ও সবজি। রাতে সবজি ও মাছ। সপ্তাহে একদিন গরু ও মুরগির মাংস দেয়া হয়।
জেল থেকে বের হয়েছেন এমন বন্দিদের অভিযোগ, সপ্তাহে একদিন মাংস দেয়া হলেও বেশির ভাগের পাতে যায় শুধু ঝোল। আর মাংস পেলেও বোঝা যায় না তা কিসের মাংস।
জুনায়েদ মিয়া নামের কারামুক্ত একজন জানান, কারাগারের খাবার খাওয়ার মতো না। মনে হয় সিদ্ধ সবজি, যেন মসলাহীন রান্না। এমনকি লবণও ঠিকমতো দেয়া হয় না। সাধারণ কারাবন্দিদের এভাবেই থাকতে হয়। তবে টাকা ব্যয় করলে আছে ভিন্ন ব্যবস্থা।
বিকাল ৫টা থেকে ৫টা ৩০ মিনিটের মধ্যে কয়েদিদের রাতের খাবার সরবরাহ করা হয়। যাদের আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে যাওয়া হয় তারা বঞ্চিত হন কারাগারের খাবার থেকে। তারা কারাগারে পৌঁছানোর আগেই খাবার বিতরণ শেষ হয়।
কারামুক্ত ইকবাল চৌধুরী জানান, তাকে একটি ‘গায়েবি’ মামলায় ধানমণ্ডি থেকে গত বছরের ১০ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। স্থান হয় কেরানীগঞ্জে কারা ওয়ার্ড পদ্মায়। কারাগারের কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, রাত গভীর হলে বাড়ে শীতের তীব্রতা। কাঁপতে থাকেন বন্দিরা। বয়স্কদের অবস্থা করুণ। ফ্লোরে ঢালাও বিছানায় ২০ জনের স্থানে ৫০ জনকে ঘুমাতে হয়। প্রায় জড়াজড়ি অবস্থা। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসেরও উষ্ণতাও শীতের প্রভাবকে মুক্ত করতে পারে না। ঘুমের ঘোরে শীত থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই পাশের ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরেন। ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হন অনেকে। সর্দি-কাশি, জ্বর লেগেই থাকে। একটি ওয়ার্ডের ৪৫-৫০ জনের জন্য একটি মাত্র শৌচাগার। দিনে-রাতে লাইন লেগেই থাকে। রাতের গভীরেও কেউ না কেউ থাকেন সেখানে। করাগারে কী দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছেন বন্দিরা। দিনটা যেমন তেমন কাটে, রাতটা দুঃসহ। শীতের রাতে গরম কাপড়, কম্বল বলতে কিছু নেই।
অনেকেই বাইরে থেকে কম্বল কিনেছেন। কিন্তু দরিদ্র বন্দিদের করুণ অবস্থা। কেঁপে-কেশে রাত কাটে তাদের। পাশে শুয়ে অন্য কারও কম্বলে আশ্রয় নেন তারা। একে তো শীতের কষ্ট সেই সঙ্গে আছে মশার উপদ্রব। সারারাত মশার কামড়। সহজে ঘুম আসে না। এই অবস্থায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারা চিকিৎসক জানান, কারাগারে থাকা কয়েদিরা প্রায়ই চুলকানি জাতীয় চর্মরোগ, পুষ্টিহীনতা, শ্বাসকষ্ট, শারীরিক দুর্বলতা, মনোবিকৃতির মতো জটিলতায় ভোগেন। তবে হঠাৎ কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে বিপাকে পড়তে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। কারাগারে রয়েছে চিকিৎসক ও এম্বুলেন্স সংকট। দেশের ৬৮টি কারাগারে রয়েছে মাত্র আট জন চিকিৎসক ও ১১টি এম্বুলেন্স। এমনকি বন্দির সংখ্যা লাখ ছুঁয়ে গেলেও বন্দিদের সেবা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জনবল সংকট রয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক কারাগার পরিস্থিতি নিয়ে মানবজমিনকে বলেন, ৪০ হাজার বন্দির স্থানে রাখা হচ্ছে ৯০ হাজারেরও বেশি লোককে। এতে তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার সুযোগ থাকছে না। বন্দিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারাগারের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। সেখানে পানির অভাব আছে, বন্দিরা রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। জায়গার অভাবে বন্দিরা পালাক্রমে ঘুমাচ্ছেন। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দণ্ডপ্রাপ্তদের সংশোধন করতে কারাগারে নানা ব্যবস্থা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ইমাম আছেন, বই পাঠের জন্য লাইব্রেরি আছে। এমনকি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে।
এতকিছুর পরও আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে কারাগারে মরণনেশা মাদক ঢুকছে। মাদক কারাগারে ঢোকার সুযোগ থাকলে অনেকক্ষেত্রেই সংশোধনের আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এসব বিষয়ে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে জানান তিনি।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কারা বিভাগে ১২ হাজার ১শ’ ৭৩টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ১ হাজার ৫শ’ ৮৯টি। এসব বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন মানবজমিনকে বলেন, নানা সংকটের মধ্য দিয়েই সেবা দিচ্ছে কারাকর্তৃপক্ষ। শীতে যাতে কারাবন্দিদের কষ্ট না হয় এজন্য অতিরিক্ত ২৫ ভাগ কম্বল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কারাগারে ঘরের বাইরেও অনেক বন্দির রাতযাপন সম্পর্কে তিনি বলেন, বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। দু’একটি কারাগারে স্থানের সমস্যা হয়েছে। এটা স্থায়ী কোনো সমস্যা না।
‘রাখিব নিরাপদ দেখাবো আলোর পথ’ স্লোগানে চলা দেশের কারাগারগুলোর চিত্র এটি। ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দি নিয়ে চলা কারাগারগুলোতে যেন সমস্যা আর সংকটের শেষ নেই। বাড়তি বন্দির কারণে বাড়তি সমস্যা। অসুস্থ হলেও চিকিৎসা পেতে পোহাতে হয় ঝক্কি। হাসপাতালে নিতে গেলে প্রহর গুনতে হয়। এম্বুলেন্স সংকট। কারাগারে থাকা বন্দিদের বেশির ভাগেরই সাজাপ্রাপ্ত না। তারা সত্যিকার অর্থে অপরাধী কি-না তাও প্রমাণ হয়নি। বন্দিদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক মামলার আসামি।
আর একক মামলা হিসেবে মাদকের মামলার আসামি মোট বন্দির এক-তৃতীয়াংশের বেশি। অনেকেই বন্দি হয়েছেন ‘গায়েবি’ মামলায়। জামিন হলে কেউ কেউ মুক্ত হচ্ছেন। যাদের জামিন হয়নি তারা প্রহর গুনছেন মুক্তির। সারা দেশে রয়েছে ৫৫টি জেলা কারাগার ও ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার মিলে মোট ৬৮টি কারাগার। কারাগারগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৬শ’ ৬৪ জন। কিন্তু ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ বন্দি থাকেন কোনো কোনো কারাগারে। স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ সংখ্যক বন্দি ছিল গত বছরের শেষদিকে। গত সোমবারের হিসাব অনুসারে সারা দেশে কারাগারে বন্দি রয়েছে ৯১ হাজার ৭শ’ ৪২ জন। তার আগের দিন রোববারে এই সংখ্যা ছিল ৯২ হাজার ১শ’ ৭৭ জন। এর মধ্যে মাদক মামলার আসামি ২৯ হাজার ৬৩ জন। নারী আসামি ৩ হাজার ৩ শ’ ৩২। গত ডিসেম্বরে কারাবন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ।
কারা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই সারা দেশে কারাবন্দির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তাদের বেশির ভাগই নাশকতা, বিস্ফোরক ও আইনি কাজে বাধার অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার। আগস্টে সারা দেশে বন্দি ছিল ৮৩ হাজার ৫ শ’ ৬ জন। সেপ্টেম্বর মাসে বন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৯ শ’ ৭৫ জন। বন্দির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় তখন চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ লঘু অপরাধে আটক প্রায় ৭ হাজার জনকে মুক্তি দেয়া হয়। তারপরও বন্দির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। অক্টোবরে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৬শ’ ২৫ জনে। ঢাকা বিভাগের ১৭ কারাগারে বন্দি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ৩৪২ জনের। গত আগস্টে এসব কারাগারে বন্দি ছিল ২৮ হাজার ৩শ’ ৪৯ জন। নভেম্বরে বন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৬শ’ জনে।
এই বিপুল সংখ্যক বন্দিকে মানবিক সুবিধা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন কারা কর্তৃপক্ষ। দেশের অনেক কারাগারে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। শীতের রাতে ঘরের বাইরেও থাকতে হয়েছে বন্দিদের। কাঁথা জুটে তো বালিশ জুটে না। নিচের বিছানার জন্য কম্বল জুটলেও গায়ের উপরে কম্বল জুটছে না। এসব কম্বলকে ব্যবহার অনুপযোগী বলছেন বন্দিরা। এভাবেই কাটছে বন্দি জীবন। কারা ইতিহাসে বন্দির বালিশ ছিল না। গত নভেম্বর থেকে কারাবন্দিদের মধ্যে বালিশ বিতরণ করা হচ্ছে। খাবার নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কারাবন্দিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকালে দেয়া হয় পুরনো আটার একটি রুটি ও ছোট এক টুকরো গুড়। দুপুরে নিম্নমানের চালের ভাত, পাতলা ডাল ও সবজি। রাতে সবজি ও মাছ। সপ্তাহে একদিন গরু ও মুরগির মাংস দেয়া হয়।
জেল থেকে বের হয়েছেন এমন বন্দিদের অভিযোগ, সপ্তাহে একদিন মাংস দেয়া হলেও বেশির ভাগের পাতে যায় শুধু ঝোল। আর মাংস পেলেও বোঝা যায় না তা কিসের মাংস।
জুনায়েদ মিয়া নামের কারামুক্ত একজন জানান, কারাগারের খাবার খাওয়ার মতো না। মনে হয় সিদ্ধ সবজি, যেন মসলাহীন রান্না। এমনকি লবণও ঠিকমতো দেয়া হয় না। সাধারণ কারাবন্দিদের এভাবেই থাকতে হয়। তবে টাকা ব্যয় করলে আছে ভিন্ন ব্যবস্থা।
বিকাল ৫টা থেকে ৫টা ৩০ মিনিটের মধ্যে কয়েদিদের রাতের খাবার সরবরাহ করা হয়। যাদের আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে যাওয়া হয় তারা বঞ্চিত হন কারাগারের খাবার থেকে। তারা কারাগারে পৌঁছানোর আগেই খাবার বিতরণ শেষ হয়।
কারামুক্ত ইকবাল চৌধুরী জানান, তাকে একটি ‘গায়েবি’ মামলায় ধানমণ্ডি থেকে গত বছরের ১০ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। স্থান হয় কেরানীগঞ্জে কারা ওয়ার্ড পদ্মায়। কারাগারের কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, রাত গভীর হলে বাড়ে শীতের তীব্রতা। কাঁপতে থাকেন বন্দিরা। বয়স্কদের অবস্থা করুণ। ফ্লোরে ঢালাও বিছানায় ২০ জনের স্থানে ৫০ জনকে ঘুমাতে হয়। প্রায় জড়াজড়ি অবস্থা। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসেরও উষ্ণতাও শীতের প্রভাবকে মুক্ত করতে পারে না। ঘুমের ঘোরে শীত থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই পাশের ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরেন। ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হন অনেকে। সর্দি-কাশি, জ্বর লেগেই থাকে। একটি ওয়ার্ডের ৪৫-৫০ জনের জন্য একটি মাত্র শৌচাগার। দিনে-রাতে লাইন লেগেই থাকে। রাতের গভীরেও কেউ না কেউ থাকেন সেখানে। করাগারে কী দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছেন বন্দিরা। দিনটা যেমন তেমন কাটে, রাতটা দুঃসহ। শীতের রাতে গরম কাপড়, কম্বল বলতে কিছু নেই।
অনেকেই বাইরে থেকে কম্বল কিনেছেন। কিন্তু দরিদ্র বন্দিদের করুণ অবস্থা। কেঁপে-কেশে রাত কাটে তাদের। পাশে শুয়ে অন্য কারও কম্বলে আশ্রয় নেন তারা। একে তো শীতের কষ্ট সেই সঙ্গে আছে মশার উপদ্রব। সারারাত মশার কামড়। সহজে ঘুম আসে না। এই অবস্থায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারা চিকিৎসক জানান, কারাগারে থাকা কয়েদিরা প্রায়ই চুলকানি জাতীয় চর্মরোগ, পুষ্টিহীনতা, শ্বাসকষ্ট, শারীরিক দুর্বলতা, মনোবিকৃতির মতো জটিলতায় ভোগেন। তবে হঠাৎ কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে বিপাকে পড়তে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে। কারাগারে রয়েছে চিকিৎসক ও এম্বুলেন্স সংকট। দেশের ৬৮টি কারাগারে রয়েছে মাত্র আট জন চিকিৎসক ও ১১টি এম্বুলেন্স। এমনকি বন্দির সংখ্যা লাখ ছুঁয়ে গেলেও বন্দিদের সেবা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জনবল সংকট রয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক কারাগার পরিস্থিতি নিয়ে মানবজমিনকে বলেন, ৪০ হাজার বন্দির স্থানে রাখা হচ্ছে ৯০ হাজারেরও বেশি লোককে। এতে তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার সুযোগ থাকছে না। বন্দিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারাগারের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। সেখানে পানির অভাব আছে, বন্দিরা রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। জায়গার অভাবে বন্দিরা পালাক্রমে ঘুমাচ্ছেন। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দণ্ডপ্রাপ্তদের সংশোধন করতে কারাগারে নানা ব্যবস্থা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ইমাম আছেন, বই পাঠের জন্য লাইব্রেরি আছে। এমনকি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে।
এতকিছুর পরও আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে কারাগারে মরণনেশা মাদক ঢুকছে। মাদক কারাগারে ঢোকার সুযোগ থাকলে অনেকক্ষেত্রেই সংশোধনের আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এসব বিষয়ে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে জানান তিনি।
কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কারা বিভাগে ১২ হাজার ১শ’ ৭৩টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ১ হাজার ৫শ’ ৮৯টি। এসব বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন মানবজমিনকে বলেন, নানা সংকটের মধ্য দিয়েই সেবা দিচ্ছে কারাকর্তৃপক্ষ। শীতে যাতে কারাবন্দিদের কষ্ট না হয় এজন্য অতিরিক্ত ২৫ ভাগ কম্বল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কারাগারে ঘরের বাইরেও অনেক বন্দির রাতযাপন সম্পর্কে তিনি বলেন, বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। দু’একটি কারাগারে স্থানের সমস্যা হয়েছে। এটা স্থায়ী কোনো সমস্যা না।
No comments