রায় ঘোষণা করতে হয় প্রকাশ্য আদালতেই by ইকতেদার আহমেদ
সংবিধানের ভাষায় আদালত বলতে সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনো আদালতকে বোঝায়। সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক আদালত এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নামে দু’টি পৃথক বিভাগ রয়েছে। অপর দিকে, নিম্ন আদালত ফৌজদারি ও দেওয়ানি এ দু’ভাগে বিভক্ত। বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ নিম্ন আদালতের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের জজ ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
আদিম অধিক্ষেত্রের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতগুলো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পর উভয়পক্ষকে শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আপিল ও রিভিশনের ক্ষেত্রে সচরাচর সাক্ষ্যগ্রহণের আবশ্যকতা না থাকায় চূড়ান্ত শুনানি অন্তে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আদালতের এ সিদ্ধান্তটিই মামলার রায়। মামলার রায় দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত কী পদ্ধতি অনুসরণ করবেন তা সবিস্তারে আইন, বিধি এবং আদেশ ও নিয়মাবলিতে উল্লেখ রয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধিতে দেওয়ানি আদালতগুলোতে বিচারকার্য পরিচালনা-সংক্রান্ত পদ্ধতিগত বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধিতে পৃথকভাবে আদালতের কোনো সংজ্ঞা না দেয়ায় দেওয়ানি কার্যবিধির যেসব স্থানে বিশেষণের ব্যবহার ছাড়া ‘আদালত’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, সেসব স্থানে আদালত বলতে সংবিধানে উল্লিখিত সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালতকে বোঝানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে কিছু বিশেষায়িত মামলা যেমন- কোম্পানি, অ্যাডমিরালটি, রিট ও আদালত অবমাননা ছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাগুলোর আপিল ও রিভিশনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দেওয়ানি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৩৩ রায় এবং ডিক্রি সংক্রান্ত। ধারা নম্বর ৩৩-এ বলা হয়েছে- মামলার শুনানি হওয়ার পর আদালত রায় ঘোষণা করবেন এবং এরূপ রায়ের ভিত্তিতে ডিক্রি প্রণীত হবে। দেওয়ানি কার্যবিধিকে আরো কার্যক্ষম করার লক্ষ্যে প্রতিটি ধারা সংশ্লেষে বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এরূপ বিধিতে ধারাতে উল্লিখিত বিষয়গুলো অধিকতরভাবে কার্যকরণের লক্ষ্যে অতিরিক্ত ব্যবস্থাদির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধির আদেশ নম্বর ২০ রায় ও ডিক্রি সংক্রান্ত। আলোচ্য নিবন্ধের বিষয়বস্তুর আলোকে ২০ নম্বর আদেশের ১, ২ ও ৩ নম্বর বিধি প্রাসঙ্গিক। ২০ নম্বর আদেশের ১ নম্বর বিধিতে রায় ঘোষণার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বিধিতে বলা হয়েছে- মামলার শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ বা অনূর্ধ্ব সাত দিনের কোনো পরবর্তী তারিখে পক্ষগণকে বা তাদের আইনজীবীগণকে যথাযথ নোটিশ দিয়ে আদালত প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন।
একই আদেশের ২ নম্বর বিধি পূর্ববর্তী বিচারকের লিখিত রায় ঘোষণার ক্ষমতা-সংক্রান্ত। এ বিধিতে বলা হয়েছে- কোনো বিচারক তার পূর্ববর্তী বিচারকের লিখিত কিন্তু ঘোষিত হয়নি, এরূপ রায় ঘোষণা করতে পারেন।
২০ নম্বর আদেশের ৩ নম্বর বিধিতে রায়ে স্বাক্ষর দেয়ার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে। এ বিধিতে বলা হয়েছে- রায় ঘোষণা করার সময় প্রকাশ্য আদালতে বিচারক তাতে স্বাক্ষর ও তারিখ দেবেন এবং একবার স্বাক্ষরিত হলে তারপর কেবল ১৫২ ধারা অনুসারে বা রিভিউ ছাড়া এর কোনো সংশোধন বা সংযোজন করা চলবে না। ৩ নম্বর বিধিতে উল্লিখিত ১৫২ ধারার ব্যাপ্তি কতটুকু সে বিষয়ে ধারণা পেতে হলে ১৫২ ধারার ওপর আলোকপাত প্রয়োজন। ১৫২ ধারায় রায়, ডিক্রি বা আদেশ সংশোধন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে- করণিক বা গাণিতিক ভুল থাকলে অথবা কোনো আকস্মিক ফসকান (Accidental slip) বা বিচ্যুতির (Omission) কারণে সেখানে কোনো ভুল থাকলে যেকোনো সময় আদালত নিজ উদ্যোগে বা কোনো পক্ষের আবেদনক্রমে তা সংশোধন করতে পারেন।
দেওয়ানি কার্যবিধির আদেশ নম্বর ৪১ মূল ডিক্রি থেকে আপিল-সংক্রান্ত। আদেশ নম্বর ৪১-এর ৩০ ও ৩১ বিধিদ্বয় আলোচ্য নিবন্ধ সংশ্লেষে প্রাসঙ্গিক। ৩০ নম্বর বিধিতে রায় কখন এবং কোথায় ঘোষণা করা হয় সে বর্ণনা রয়েছে। ওই বিধি অনুযায়ী আপিল আদালত পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবীদের বক্তব্য শ্রবণের পর এবং আপিলের বা যে আদালতের ডিক্রি থেকে আপিল করা হয়েছে, সে আদালতের কার্যক্রমের কোনো অংশ রেফারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত হলে তা রেফার করে, তখনি অথবা অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দিনে পক্ষগণ বা আইনজীবীদের নোটিশ দিয়ে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন। ৩১ নম্বর বিধিতে রায়ের সারমর্ম, তারিখ এবং স্বাক্ষর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- আপিল আদালতের রায় লিখিত আকারে হতে হবে এবং ক. সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো; খ. বিষয়গুলোর ওপর সিদ্ধান্ত; গ. সিদ্ধান্তের কারণগুলো এবং ঘ. যে ক্ষেত্রে ডিক্রি বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়, সে ক্ষেত্রে আপিলকারী যে প্রতিকারের অধিকারী, তা বিবৃত করতে হবে এবং রায় ঘোষণার সময় বিচারক বা মতৈক্যশীল বিচারকেরা তাতে স্বাক্ষর করবেন ও তারিখ দেবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রুল, ১৯৮৮ তে (সর্বশেষ ২২ এপ্রিল, ২০০৮ পর্যন্ত সংশোধিত) রায়, ডিক্রি ও আদেশ বিষয়ে বলা হয়েছে- আদালত মামলার শুনানি শেষ হওয়ার পর তখনি অথবা অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দিনে পক্ষগণ অথবা তাদের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডকে যথাযথভাবে নোটিশ দিয়ে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন এবং সে অনুসারে ডিক্রি অথবা আদেশ প্রস্তুত করা হবে।
হাইকোর্ট বিভাগ রুলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডের পরিবর্তে আইনজীবীরা উল্লেখপূর্বক উপরিউক্ত বিষয়টি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ রুলে রায় বিষয়ে উল্লিখিত বিধানাবলি দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের মামলার রায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের রায় বিষয়ে উভয় আদালতের বিধিতে আরো বলা হয়েছে- আদেশ নম্বর ২৬-এ বিবৃত বিধানাবলি সাপেক্ষে, আদালতে প্রকাশ্যে ঘোষিত কোনো রায় অথবা আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে অথবা মতদ্বৈধতায় ঘোষিত রায় পরবর্তীতে করণিক অথবা গাণিতিক ভুল অথবা আকস্মিক ফসকান ও বিচ্যুতি হতে উদ্ভূত ভুল ব্যতীত পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না।
দেওয়ানি কার্যবিধির অনুরূপ ফৌজদারি কার্যবিধিতেও আদালতের কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৩৬৬ রায় দেয়ার পদ্ধতি-সংক্রান্ত। ওই ধারার ১(ক) আলোচ্য নিবন্ধের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। ধারা নম্বর ৩৬৬ (১) (ক) তে বলা হয়েছে- আদিম অধিক্ষেত্রের যেকোনো ফৌজদারি আদালতের প্রতিটি বিচারের ক্ষেত্রে রায় ঘোষণা করতে হবে অথবা ওই রায়ের সারমর্মের ব্যাখ্যা দিতে হবে- প্রকাশ্য আদালতে বিচারকার্য সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পর অথবা পরবর্তী কোনো সময় পক্ষগণ অথবা তাদের আইনজীবীদের নোটিশের মাধ্যমে অবহিত করণপূর্বক।
ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৩৬৭-তে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সুস্পষ্টরূপে উল্লিখিত হয়েছে- রায় ঘোষণাকালে প্রকাশ্য আদালতে বিচারক তাতে স্বাক্ষর ও তারিখ দেবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৯ নম্বর ধারাটি অনেকটা দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫২ ধারার অনুরূপ। ওই ধারায় বলা হয়েছে- এ বিধির (Code) অন্যত্র অথবা অপর কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকলে কোনো আদালত রায় স্বাক্ষর করার পর করণিক ভুল ব্যতীত ওই রায় কোনোরূপ সংশোধন বা রিভিউ করবেন না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৪২৪ নিম্ন আপিল আদালতের রায়-সংক্রান্ত। ওই ধারায় বলা হয়েছে- আদিম অধিক্ষেত্রের ফৌজদারি আদালতের মামলার রায় বিষয়ে অধ্যায় নম্বর ২৬-এ যেসব নিয়মাবলি বর্ণিত হয়েছে, তা হাইকোর্ট বিভাগ ছাড়া আপিল আদালতের রায়ের ক্ষেত্রে সাধ্যমতো প্রযোজ্য হবে।
তা ছাড়া দেওয়ানি আদেশ ও নিয়মাবলির ১৪০ নম্বর নিয়মে রায় ঘোষণা বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করতে হবে এবং ঘোষণাকালীন প্রকাশ্য আদালতে স্বাক্ষর ও তারিখ দিতে হবে।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি বদলিযোগ্য। নিম্ন আদালতের একজন বিচারক কোনো মামলার রায় না দিয়ে এক জেলায় কার্যভার হস্তান্তরপূর্বক অপর জেলায় যোগদান করলে পূর্ববর্তী জেলার তদ্কর্তৃক নিষ্পন্ন মামলার রায় দেয়া না হয়ে থাকলে তার দ্বারা পূর্ববর্তী স্বাক্ষরযুক্ত তারিখ দিয়ে ওই মামলার রায় দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। যদিও পূর্ববর্তী বিচারক কর্তৃক লিখিত রায় পরবর্তী বিচারক কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
নিম্ন আদালতের একজন বিচারক এক জেলা থেকে অপর জেলায় স্বপদে অথবা পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে বদলি হলে অথবা ৫৯ বছর পূর্তিতে চাকরির মেয়াদ অবসানে অবসর নিলে তদ্কর্তৃক পূর্বের কর্মস্থলের নিষ্পন্ন বা অনিষ্পন্ন কোনো মামলার রায় বা আদেশ দেয়ার সুযোগ একেবারে অনুপস্থিত। যে মুহূর্তে কর্মকর্তাটি অন্যত্র বদলি হওয়ার কারণে কার্যভার অর্পণ করলেন অথবা অবসর নিলেন সে মুহূর্তে ওই কর্মস্থলের ওই পদের জন্য তিনি Functus Officio হয়ে গেলেন। এর অর্থ পূর্বের পদের বিচারিক কর্তৃক রায়ের করণিক অথবা গাণিতিক ভুল ছাড়া অন্য কোনো ধরনের সংশোধন বা পরিবর্তন আইন সমর্থন করে না।
উচ্চাদালতের বিচারকেরা সাংবিধানিকভাবে শপথের অধীন। একজন ব্যক্তি উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার জন্য নির্ধারিত সংবিধানে উল্লিখিত শপথ পাঠ না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিচারকার্যে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অনুরূপভাবে ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেদিন তিনি চাকরি থেকে অবসরে চলে যাবেন সেদিন বা সেদিনের পূর্বের কোনো রায় তদকর্তৃক প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত না হয়ে থাকলে তার পক্ষে প্রকাশ্য আদালতে ওই রায়ের ঘোষণা বা ওই রায়ে স্বাক্ষর দেয়া আইনসম্মত কি না, তা পূর্বোল্লিখিত আলোচনার আলোকে বিবেচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় এরূপ সুযোগ আইন ও বিধিবিধান দিয়ে সমর্থিত নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক কোনো মামলার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ দেয়ার পর অবসরে চলে গেলে তার পক্ষে দীর্ঘ সময় যেমন এক বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মামলার পূর্ণ রায় লিখে তাতে পেছনের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর দেয়া আইনানুগ হবে কি না? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর- উচ্চ আদালতের বিচারপতি বা বিচারক অবসরে যাওয়ার পরমুহূর্তেই স্বীয় শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে যান। শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে গেলে পূর্বের কোনো সংক্ষিপ্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গরূপে তার সুচিন্তিত মতামতের ওপর তিনি পূর্বের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর করলে তা কতটুকু আইনানুগ হবে তা বিবেচনার দাবি রাখে। অনেকে হয়তো বলবেন এর আগে এ ধরনের একাধিক নজির রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন- যদি বিষয়টি বেআইনি, কর্র্র্র্তৃত্ববিহীন ও অনিয়ম হিসেবে গণ্য হয় সে ক্ষেত্রে আগের বেআইনি, কর্র্র্র্তৃত্ববিহীন কার্যকলাপ ও অনিয়ম সমর্থন করে একই ধারাবাহিকতায় বেআইনি, কর্র্র্র্তৃত্ববিহীন কাজ ও অনিয়ম করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
প্রণিধানযোগ্য যে, যেখানে সংবিধান, আইন ও বিধি বদলি বা অবসরজনিত কারণে একজন পদধারীর পদে বহাল থাকাকালীন অবস্থায় কৃত কোনো কার্যে পদ থেকে অবমুক্ত হওয়ার পর পরিবর্তন ও পরিবর্ধনসহ স্বাক্ষর দেয়া অনুমোদন করে না, সেখানে কেন অহেতুক ও অযথা ভুল ব্যাখ্যার অবলম্বনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস।
দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার রায় বিষয়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি আদেশ ও নিয়মাবলি এবং সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ রুলে যেসব বিধানাবলি বর্ণিত হয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে ধারণা পাওয়া যায়, আদিম অধিক্ষেত্রের আদালত ও আপিল আদালতের রায় প্রকাশ্য আদালতে শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক অথবা পরবর্তী কোনো দিন পক্ষগণ বা আইনজীবীদের নোটিশ দিয়ে ঘোষণা করতে হবে এবং তা প্রকাশ্য আদালতে তারিখ ও স্বাক্ষরযুক্ত হবে। এতদসংক্রান্ত বিধিতে পূর্ববর্তী বিচারক রায় ঘোষণা না করে থাকলে পরবর্তী বিচারককে সে রায় ঘোষণার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইন বা বিধির কোথাও পূর্ববর্তী বিচারক কর্তৃক নিষ্পন্নকৃত বা ঘোষিত রায়ে পূর্ববর্তী বিচারকের পূর্বের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর দেয়ার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। আইনে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন নিম্ন বা উচ্চ আদালতের বিচারকের বদলি বা অবসর-পরবর্তী আগের কর্মস্থলের বিচারিক রায়ে পূর্বের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর কতটুকু আইনসম্মত আর প্রকাশ্য আদালত ছাড়া এরূপ রায় ঘোষণা আইন ও বিধিবিধানের সমর্থনের অনুপস্থিতিতে বৈধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ কতটুকু?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com
আদিম অধিক্ষেত্রের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতগুলো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পর উভয়পক্ষকে শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আপিল ও রিভিশনের ক্ষেত্রে সচরাচর সাক্ষ্যগ্রহণের আবশ্যকতা না থাকায় চূড়ান্ত শুনানি অন্তে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আদালতের এ সিদ্ধান্তটিই মামলার রায়। মামলার রায় দেয়ার ক্ষেত্রে আদালত কী পদ্ধতি অনুসরণ করবেন তা সবিস্তারে আইন, বিধি এবং আদেশ ও নিয়মাবলিতে উল্লেখ রয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধিতে দেওয়ানি আদালতগুলোতে বিচারকার্য পরিচালনা-সংক্রান্ত পদ্ধতিগত বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধিতে পৃথকভাবে আদালতের কোনো সংজ্ঞা না দেয়ায় দেওয়ানি কার্যবিধির যেসব স্থানে বিশেষণের ব্যবহার ছাড়া ‘আদালত’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, সেসব স্থানে আদালত বলতে সংবিধানে উল্লিখিত সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালতকে বোঝানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে কিছু বিশেষায়িত মামলা যেমন- কোম্পানি, অ্যাডমিরালটি, রিট ও আদালত অবমাননা ছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাগুলোর আপিল ও রিভিশনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দেওয়ানি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৩৩ রায় এবং ডিক্রি সংক্রান্ত। ধারা নম্বর ৩৩-এ বলা হয়েছে- মামলার শুনানি হওয়ার পর আদালত রায় ঘোষণা করবেন এবং এরূপ রায়ের ভিত্তিতে ডিক্রি প্রণীত হবে। দেওয়ানি কার্যবিধিকে আরো কার্যক্ষম করার লক্ষ্যে প্রতিটি ধারা সংশ্লেষে বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এরূপ বিধিতে ধারাতে উল্লিখিত বিষয়গুলো অধিকতরভাবে কার্যকরণের লক্ষ্যে অতিরিক্ত ব্যবস্থাদির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধির আদেশ নম্বর ২০ রায় ও ডিক্রি সংক্রান্ত। আলোচ্য নিবন্ধের বিষয়বস্তুর আলোকে ২০ নম্বর আদেশের ১, ২ ও ৩ নম্বর বিধি প্রাসঙ্গিক। ২০ নম্বর আদেশের ১ নম্বর বিধিতে রায় ঘোষণার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বিধিতে বলা হয়েছে- মামলার শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ বা অনূর্ধ্ব সাত দিনের কোনো পরবর্তী তারিখে পক্ষগণকে বা তাদের আইনজীবীগণকে যথাযথ নোটিশ দিয়ে আদালত প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন।
একই আদেশের ২ নম্বর বিধি পূর্ববর্তী বিচারকের লিখিত রায় ঘোষণার ক্ষমতা-সংক্রান্ত। এ বিধিতে বলা হয়েছে- কোনো বিচারক তার পূর্ববর্তী বিচারকের লিখিত কিন্তু ঘোষিত হয়নি, এরূপ রায় ঘোষণা করতে পারেন।
২০ নম্বর আদেশের ৩ নম্বর বিধিতে রায়ে স্বাক্ষর দেয়ার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে। এ বিধিতে বলা হয়েছে- রায় ঘোষণা করার সময় প্রকাশ্য আদালতে বিচারক তাতে স্বাক্ষর ও তারিখ দেবেন এবং একবার স্বাক্ষরিত হলে তারপর কেবল ১৫২ ধারা অনুসারে বা রিভিউ ছাড়া এর কোনো সংশোধন বা সংযোজন করা চলবে না। ৩ নম্বর বিধিতে উল্লিখিত ১৫২ ধারার ব্যাপ্তি কতটুকু সে বিষয়ে ধারণা পেতে হলে ১৫২ ধারার ওপর আলোকপাত প্রয়োজন। ১৫২ ধারায় রায়, ডিক্রি বা আদেশ সংশোধন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে- করণিক বা গাণিতিক ভুল থাকলে অথবা কোনো আকস্মিক ফসকান (Accidental slip) বা বিচ্যুতির (Omission) কারণে সেখানে কোনো ভুল থাকলে যেকোনো সময় আদালত নিজ উদ্যোগে বা কোনো পক্ষের আবেদনক্রমে তা সংশোধন করতে পারেন।
দেওয়ানি কার্যবিধির আদেশ নম্বর ৪১ মূল ডিক্রি থেকে আপিল-সংক্রান্ত। আদেশ নম্বর ৪১-এর ৩০ ও ৩১ বিধিদ্বয় আলোচ্য নিবন্ধ সংশ্লেষে প্রাসঙ্গিক। ৩০ নম্বর বিধিতে রায় কখন এবং কোথায় ঘোষণা করা হয় সে বর্ণনা রয়েছে। ওই বিধি অনুযায়ী আপিল আদালত পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবীদের বক্তব্য শ্রবণের পর এবং আপিলের বা যে আদালতের ডিক্রি থেকে আপিল করা হয়েছে, সে আদালতের কার্যক্রমের কোনো অংশ রেফারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচিত হলে তা রেফার করে, তখনি অথবা অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দিনে পক্ষগণ বা আইনজীবীদের নোটিশ দিয়ে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন। ৩১ নম্বর বিধিতে রায়ের সারমর্ম, তারিখ এবং স্বাক্ষর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- আপিল আদালতের রায় লিখিত আকারে হতে হবে এবং ক. সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো; খ. বিষয়গুলোর ওপর সিদ্ধান্ত; গ. সিদ্ধান্তের কারণগুলো এবং ঘ. যে ক্ষেত্রে ডিক্রি বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়, সে ক্ষেত্রে আপিলকারী যে প্রতিকারের অধিকারী, তা বিবৃত করতে হবে এবং রায় ঘোষণার সময় বিচারক বা মতৈক্যশীল বিচারকেরা তাতে স্বাক্ষর করবেন ও তারিখ দেবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রুল, ১৯৮৮ তে (সর্বশেষ ২২ এপ্রিল, ২০০৮ পর্যন্ত সংশোধিত) রায়, ডিক্রি ও আদেশ বিষয়ে বলা হয়েছে- আদালত মামলার শুনানি শেষ হওয়ার পর তখনি অথবা অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দিনে পক্ষগণ অথবা তাদের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডকে যথাযথভাবে নোটিশ দিয়ে প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন এবং সে অনুসারে ডিক্রি অথবা আদেশ প্রস্তুত করা হবে।
হাইকোর্ট বিভাগ রুলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডের পরিবর্তে আইনজীবীরা উল্লেখপূর্বক উপরিউক্ত বিষয়টি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ রুলে রায় বিষয়ে উল্লিখিত বিধানাবলি দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের মামলার রায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের রায় বিষয়ে উভয় আদালতের বিধিতে আরো বলা হয়েছে- আদেশ নম্বর ২৬-এ বিবৃত বিধানাবলি সাপেক্ষে, আদালতে প্রকাশ্যে ঘোষিত কোনো রায় অথবা আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে অথবা মতদ্বৈধতায় ঘোষিত রায় পরবর্তীতে করণিক অথবা গাণিতিক ভুল অথবা আকস্মিক ফসকান ও বিচ্যুতি হতে উদ্ভূত ভুল ব্যতীত পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যাবে না।
দেওয়ানি কার্যবিধির অনুরূপ ফৌজদারি কার্যবিধিতেও আদালতের কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৩৬৬ রায় দেয়ার পদ্ধতি-সংক্রান্ত। ওই ধারার ১(ক) আলোচ্য নিবন্ধের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। ধারা নম্বর ৩৬৬ (১) (ক) তে বলা হয়েছে- আদিম অধিক্ষেত্রের যেকোনো ফৌজদারি আদালতের প্রতিটি বিচারের ক্ষেত্রে রায় ঘোষণা করতে হবে অথবা ওই রায়ের সারমর্মের ব্যাখ্যা দিতে হবে- প্রকাশ্য আদালতে বিচারকার্য সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পর অথবা পরবর্তী কোনো সময় পক্ষগণ অথবা তাদের আইনজীবীদের নোটিশের মাধ্যমে অবহিত করণপূর্বক।
ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৩৬৭-তে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সুস্পষ্টরূপে উল্লিখিত হয়েছে- রায় ঘোষণাকালে প্রকাশ্য আদালতে বিচারক তাতে স্বাক্ষর ও তারিখ দেবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৯ নম্বর ধারাটি অনেকটা দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫২ ধারার অনুরূপ। ওই ধারায় বলা হয়েছে- এ বিধির (Code) অন্যত্র অথবা অপর কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকলে কোনো আদালত রায় স্বাক্ষর করার পর করণিক ভুল ব্যতীত ওই রায় কোনোরূপ সংশোধন বা রিভিউ করবেন না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৪২৪ নিম্ন আপিল আদালতের রায়-সংক্রান্ত। ওই ধারায় বলা হয়েছে- আদিম অধিক্ষেত্রের ফৌজদারি আদালতের মামলার রায় বিষয়ে অধ্যায় নম্বর ২৬-এ যেসব নিয়মাবলি বর্ণিত হয়েছে, তা হাইকোর্ট বিভাগ ছাড়া আপিল আদালতের রায়ের ক্ষেত্রে সাধ্যমতো প্রযোজ্য হবে।
তা ছাড়া দেওয়ানি আদেশ ও নিয়মাবলির ১৪০ নম্বর নিয়মে রায় ঘোষণা বিষয়ে বলা হয়েছে- প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করতে হবে এবং ঘোষণাকালীন প্রকাশ্য আদালতে স্বাক্ষর ও তারিখ দিতে হবে।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি বদলিযোগ্য। নিম্ন আদালতের একজন বিচারক কোনো মামলার রায় না দিয়ে এক জেলায় কার্যভার হস্তান্তরপূর্বক অপর জেলায় যোগদান করলে পূর্ববর্তী জেলার তদ্কর্তৃক নিষ্পন্ন মামলার রায় দেয়া না হয়ে থাকলে তার দ্বারা পূর্ববর্তী স্বাক্ষরযুক্ত তারিখ দিয়ে ওই মামলার রায় দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। যদিও পূর্ববর্তী বিচারক কর্তৃক লিখিত রায় পরবর্তী বিচারক কর্তৃক ঘোষিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
নিম্ন আদালতের একজন বিচারক এক জেলা থেকে অপর জেলায় স্বপদে অথবা পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে বদলি হলে অথবা ৫৯ বছর পূর্তিতে চাকরির মেয়াদ অবসানে অবসর নিলে তদ্কর্তৃক পূর্বের কর্মস্থলের নিষ্পন্ন বা অনিষ্পন্ন কোনো মামলার রায় বা আদেশ দেয়ার সুযোগ একেবারে অনুপস্থিত। যে মুহূর্তে কর্মকর্তাটি অন্যত্র বদলি হওয়ার কারণে কার্যভার অর্পণ করলেন অথবা অবসর নিলেন সে মুহূর্তে ওই কর্মস্থলের ওই পদের জন্য তিনি Functus Officio হয়ে গেলেন। এর অর্থ পূর্বের পদের বিচারিক কর্তৃক রায়ের করণিক অথবা গাণিতিক ভুল ছাড়া অন্য কোনো ধরনের সংশোধন বা পরিবর্তন আইন সমর্থন করে না।
উচ্চাদালতের বিচারকেরা সাংবিধানিকভাবে শপথের অধীন। একজন ব্যক্তি উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার জন্য নির্ধারিত সংবিধানে উল্লিখিত শপথ পাঠ না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিচারকার্যে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অনুরূপভাবে ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেদিন তিনি চাকরি থেকে অবসরে চলে যাবেন সেদিন বা সেদিনের পূর্বের কোনো রায় তদকর্তৃক প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত না হয়ে থাকলে তার পক্ষে প্রকাশ্য আদালতে ওই রায়ের ঘোষণা বা ওই রায়ে স্বাক্ষর দেয়া আইনসম্মত কি না, তা পূর্বোল্লিখিত আলোচনার আলোকে বিবেচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় এরূপ সুযোগ আইন ও বিধিবিধান দিয়ে সমর্থিত নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক কোনো মামলার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ দেয়ার পর অবসরে চলে গেলে তার পক্ষে দীর্ঘ সময় যেমন এক বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মামলার পূর্ণ রায় লিখে তাতে পেছনের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর দেয়া আইনানুগ হবে কি না? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর- উচ্চ আদালতের বিচারপতি বা বিচারক অবসরে যাওয়ার পরমুহূর্তেই স্বীয় শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে যান। শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে গেলে পূর্বের কোনো সংক্ষিপ্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গরূপে তার সুচিন্তিত মতামতের ওপর তিনি পূর্বের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর করলে তা কতটুকু আইনানুগ হবে তা বিবেচনার দাবি রাখে। অনেকে হয়তো বলবেন এর আগে এ ধরনের একাধিক নজির রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন- যদি বিষয়টি বেআইনি, কর্র্র্র্তৃত্ববিহীন ও অনিয়ম হিসেবে গণ্য হয় সে ক্ষেত্রে আগের বেআইনি, কর্র্র্র্তৃত্ববিহীন কার্যকলাপ ও অনিয়ম সমর্থন করে একই ধারাবাহিকতায় বেআইনি, কর্র্র্র্তৃত্ববিহীন কাজ ও অনিয়ম করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
প্রণিধানযোগ্য যে, যেখানে সংবিধান, আইন ও বিধি বদলি বা অবসরজনিত কারণে একজন পদধারীর পদে বহাল থাকাকালীন অবস্থায় কৃত কোনো কার্যে পদ থেকে অবমুক্ত হওয়ার পর পরিবর্তন ও পরিবর্ধনসহ স্বাক্ষর দেয়া অনুমোদন করে না, সেখানে কেন অহেতুক ও অযথা ভুল ব্যাখ্যার অবলম্বনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস।
দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার রায় বিষয়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি আদেশ ও নিয়মাবলি এবং সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ রুলে যেসব বিধানাবলি বর্ণিত হয়েছে তাতে সুস্পষ্টভাবে ধারণা পাওয়া যায়, আদিম অধিক্ষেত্রের আদালত ও আপিল আদালতের রায় প্রকাশ্য আদালতে শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক অথবা পরবর্তী কোনো দিন পক্ষগণ বা আইনজীবীদের নোটিশ দিয়ে ঘোষণা করতে হবে এবং তা প্রকাশ্য আদালতে তারিখ ও স্বাক্ষরযুক্ত হবে। এতদসংক্রান্ত বিধিতে পূর্ববর্তী বিচারক রায় ঘোষণা না করে থাকলে পরবর্তী বিচারককে সে রায় ঘোষণার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু আইন বা বিধির কোথাও পূর্ববর্তী বিচারক কর্তৃক নিষ্পন্নকৃত বা ঘোষিত রায়ে পূর্ববর্তী বিচারকের পূর্বের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর দেয়ার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। আইনে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন নিম্ন বা উচ্চ আদালতের বিচারকের বদলি বা অবসর-পরবর্তী আগের কর্মস্থলের বিচারিক রায়ে পূর্বের তারিখযুক্ত স্বাক্ষর কতটুকু আইনসম্মত আর প্রকাশ্য আদালত ছাড়া এরূপ রায় ঘোষণা আইন ও বিধিবিধানের সমর্থনের অনুপস্থিতিতে বৈধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ কতটুকু?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com
No comments