উন্নয়ন করছেন, দুর্নীতিও বন্ধ করুন by মইনুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন
মহাজোট সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দাবি
করেছেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহীত নীতিগুলোর বাস্তবায়নের ফলে দেশ
অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে উত্তীর্ণ হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে
প্রবেশ করেছে এবং দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। তাঁর বক্তৃতায় এই উত্তরণের
বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও সূচক উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি তাঁর দাবিকে প্রতিষ্ঠিত
করার প্রয়াস নিয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ‘উড্ডয়ন’ বা ‘টেক অফ’
পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সে সম্পর্কে এখন বিশ্বের উন্নয়ন চিন্তাবিদ এবং
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে এবং এ
জন্য উন্নয়ন-সম্পর্কিত আলোচনা-বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত
করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইতে থাকলে তার কৃতিত্ব ক্ষমতাসীন
সরকার নেবে না কেন? সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের একটা উক্তি এ
ক্ষেত্রে স্মরণীয়: ‘ইট ইজ দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’। নির্বাচনী গণতন্ত্রে
জনসমর্থনের মূল চাবিকাঠি ধারণ করে আছে অর্থনীতি, জনপ্রিয়তার উত্থান-পতনের
মূল নির্ধারককে সরকার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করবেই।
অন্যদিকে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিয়মানুযায়ী ভাষণের পরদিন এর প্রতিক্রিয়ায় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে বিএনপির পক্ষ থেকে মঈন খান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করলেন যে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে নয়, লুটপাটের মহাসড়কে অবস্থান করছে। বিএনপির এই দাবিকেও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, দেশের এই ব্যাধিটিও অতি পুরোনো ও দুরারোগ্য। কঠোর হাতে এই ব্যাধির যথাযোগ্য চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়ের সদিচ্ছা সরকার গত সাত বছরে দেখিয়েছে বলা যাবে না। আমার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে এটাই জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর প্রতিবন্ধক’। মানে, এ দেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা গেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নয়, এত দিনে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। দেশের অর্থনীতি যে উড়াল দিয়েছে, তা নিচের আশা-জাগানিয়া সাফল্যগুলো প্রমাণ করছে:
১. ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮২ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, কিন্তু ২০১০ সালের হাউস হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারীদের হার জনসংখ্যার ২৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
২. মোটা ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটানোর জন্য ধান লাগত বার্ষিক দেড় কোটি টন, অথচ ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৮৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে দেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন খাদ্য রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করেছে। গত ৪৫ বছরে দেশের মাছ উৎপাদন বেড়েছে ছয় গুণ। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। শাকসবজি উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
৩. ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে এ দেশের জিডিপির অনুপাত হিসাবে বৈদেশিক ঋণ/অনুদান ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই অনুপাত জিডিপির ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরও স্বস্তিকর হলো, বৈদেশিক ঋণ/সাহায্যের ৯৮ শতাংশই এখন প্রকল্প ঋণ, মাত্র ২ শতাংশ খাদ্যসাহায্য। বাংলাদেশ এখন আর পণ্য সাহায্য নেয় না। অথচ সত্তরের দশকে গড়ে প্রায় ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য নেওয়া হতো খাদ্যসাহায্য হিসেবে, ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ নেওয়া হতো পণ্য সাহায্য হিসেবে আর বাকি ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল প্রকল্প ঋণ। আমাদের রাজনীতিবিদ এবং আমলারা প্রকল্প থেকে মার্জিন আত্মসাৎ করার লোভে এখনো প্রকল্প ঋণ গ্রহণের বদখাসলত ছাড়তে পারছেন না, নইলে এখন বৈদেশিক ঋণ না নিলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনোই ক্ষতি হবে না।
৪. বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে দুই বছর বাদে গত ১০ বছর ধরে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হচ্ছে। বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি পূরণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স যথেষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ভারতের পরই। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। আরও ৮-১০ বিলিয়ন ডলার হুন্ডি ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে (হয়তো ডলার আসছে না)। এই বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি করেছে।
৫. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার, মানে ৩১০০ কোটি ডলার। অথচ, ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে তা ছিল মাত্র ৮২ কোটি ডলার। তৈরি পোশাক ছাড়াও চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য এবং মৎস্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর আশাব্যঞ্জক থাকছে। চীনের পর এখন পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে।
৬. বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর ৬ শতাংশের বেশি হচ্ছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতি-লুটপাট কমাতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির হারকে ৮ শতাংশে উন্নীত করা যাবে।
৭. বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক প্রবর্তিত ÿক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতি প্রান্তিক অবস্থানের ভূমিহীন নারীদের কাছে ব্যাংকঋণ পৌঁছে দেওয়ার সফল ও লাগসই ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্ব-স্বীকৃতি পেয়েছে নোবেল পুরস্কার জয় করার মাধ্যমে। ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও প্রান্তিক অবস্থানের উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীর কাছে পুঁজি সরবরাহের এই পদ্ধতিগত উদ্ভাবনকে আরও গ্রহণযোগ্য ও টেকসই করাটাই এখন জাতির চ্যালেঞ্জ।
৮. ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির প্রশংসনীয় অগ্রগতি বাংলাদেশের আনাচকানাচে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবের সুফল পৌঁছে দিচ্ছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৩ কোটি এখন মোবাইল টেলিফোনের আওতায় চলে এসেছে, যার খরচ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সর্বনিম্ন। দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
৯. বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ আসছে শিল্প খাত থেকে, ১৮ শতাংশ আসছে কৃষি খাত থেকে আর ৫২ শতাংশ আসছে টারশিয়ারি (প্রধানত সেবা ও বাণিজ্য) খাত থেকে। জিডিপি কম্পোজিশনের এই উল্লেখযোগ্য রূপান্তর দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত ও টেকসই হওয়ার লক্ষণ।
অন্যদিকে, উন্নয়নের পথে যাত্রা সত্ত্বেও সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন ও পুঁজি লুণ্ঠনের ‘সিস্টেমের’ দৌরাত্ম্য গত সাত বছরে একবারেই কমেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষ যেমন দৈনন্দিন জীবনে ঘুষ-দুর্নীতির তাণ্ডবে দিশেহারা, তেমনি সরকারের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে যে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে, সেটা প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলিত ব্যয়ের কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
কয়েকটি উদাহরণ দেখুন: ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় শেষ পর্যন্ত প্রতি বর্গমিটারে যা দাঁড়িয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক। পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের (পিপিপি) নির্মিত এই প্রকল্পে যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যয় বাড়ানো হয়েছে, সেটা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। খবর নিয়ে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়ী-ঠিকাদারদের বিভিন্ন মহলকে বখরা দিয়ে মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি এই অবিশ্বাস্য খরচ ফাঁপানোর কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকল্প চালু হওয়ার পর চুক্তির শর্তাবলি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দুই বছর ধরে কয়েক গুণ বেশি হারে টোল আদায় করে যাওয়া সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনকভাবে বিষয়টির আইনি সুরাহার প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে প্রশস্তকরণ প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বিলম্বের ওজর দেখিয়ে এত বেশি ব্যয়বৃদ্ধিকে জায়েজ করা যাবে না। কারণ, গত সাত বছরে নির্মাণসামগ্রীর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাম এত বেশি বাড়েনি যে তা দিয়ে প্রকল্পের কয়েক গুণ ব্যয়বৃদ্ধিকে যৌক্তিক প্রমাণ করা যাবে। এই বড় প্রকল্পটির পাশাপাশি সড়ক-সম্পর্কীয় সব প্রকল্পের খরচ দফায় দফায় বাড়ানো এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথকে ডাবল ট্র্যাক করার প্রকল্পের ব্যয়ও কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। রেলওয়ের তাবৎ প্রকল্প বিলম্বিত হওয়াই নিয়মে পরিণত হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, প্রকল্প মানেই উন্নয়ন—এটা আমাদের রাজনীতিতে বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে বহুদিন আগেই। আর প্রকল্প থেকে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী-ঠিকাদারেরা মার্জিন আহরণ করে অনর্জিত আয়-রোজগার করার বিষয়টিও এখন আমাদের ধাতস্থ হয়ে গেছে। বিএনপির তুলনায় এ ব্যাপারে বরং আওয়ামী লীগের পারঙ্গমতা কিছুটা কম বলে ধারণা রয়েছে। অতএব, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উত্তীর্ণ হলে যে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক-ব্যবসায়িক পুঁজি লুণ্ঠন বাড়াই স্বাভাবিক, সেটা বিএনপির নেতারাও ভালোভাবে জানেন। আমার মতে, লুটপাটের মহাসড়কে অবস্থানের ব্যাপারে বিএনপির এহেন মন্তব্য যদি সুস্পষ্ট তথ্য-উপাত্তভিত্তিক হয়, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেগুলোকে আমলে নিয়ে কার্যকর তদন্ত শুরু করলে এবং অভিযোগগুলোকে আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে নিয়ে এলে জাতি উপকৃত হবে। বিরোধী দল বলেই চলেছে, দুদক শুধু অতীতের ক্ষমতাসীন মহলের দুর্নীতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করায় বেশি পারদর্শিতা প্রদর্শন করছে। এ ব্যাপারে দুদককে সাবধানতার সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেই হবে। আমিও মনে করি ‘স্বাধীন’ দুদকের আরেকটু বেশি সাহসী হওয়ার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে চলেছেন, তাঁকে কেনা যায় না। তাঁর এই সাহসী বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে তাঁকে দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাঁর এবং তাঁর দলের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের এটাই একমাত্র পথ। তাঁর সরকারের সাফল্যগুলোকে বরবাদ করার জন্য দুর্নীতিই হবে প্রতিপক্ষের হাতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। এই অস্ত্রকে ভোঁতা করার প্রয়োজনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং অবিলম্বে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্যদিকে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিয়মানুযায়ী ভাষণের পরদিন এর প্রতিক্রিয়ায় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে বিএনপির পক্ষ থেকে মঈন খান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করলেন যে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে নয়, লুটপাটের মহাসড়কে অবস্থান করছে। বিএনপির এই দাবিকেও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, দেশের এই ব্যাধিটিও অতি পুরোনো ও দুরারোগ্য। কঠোর হাতে এই ব্যাধির যথাযোগ্য চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়ের সদিচ্ছা সরকার গত সাত বছরে দেখিয়েছে বলা যাবে না। আমার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে এটাই জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর প্রতিবন্ধক’। মানে, এ দেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা গেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নয়, এত দিনে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। দেশের অর্থনীতি যে উড়াল দিয়েছে, তা নিচের আশা-জাগানিয়া সাফল্যগুলো প্রমাণ করছে:
১. ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮২ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, কিন্তু ২০১০ সালের হাউস হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারীদের হার জনসংখ্যার ২৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
২. মোটা ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটানোর জন্য ধান লাগত বার্ষিক দেড় কোটি টন, অথচ ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন, ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লাখ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ধান উৎপাদন ৩ কোটি ৮৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে, যার ফলে দেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন খাদ্য রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করেছে। গত ৪৫ বছরে দেশের মাছ উৎপাদন বেড়েছে ছয় গুণ। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। শাকসবজি উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
৩. ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে এ দেশের জিডিপির অনুপাত হিসাবে বৈদেশিক ঋণ/অনুদান ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই অনুপাত জিডিপির ১ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরও স্বস্তিকর হলো, বৈদেশিক ঋণ/সাহায্যের ৯৮ শতাংশই এখন প্রকল্প ঋণ, মাত্র ২ শতাংশ খাদ্যসাহায্য। বাংলাদেশ এখন আর পণ্য সাহায্য নেয় না। অথচ সত্তরের দশকে গড়ে প্রায় ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্য নেওয়া হতো খাদ্যসাহায্য হিসেবে, ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ নেওয়া হতো পণ্য সাহায্য হিসেবে আর বাকি ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল প্রকল্প ঋণ। আমাদের রাজনীতিবিদ এবং আমলারা প্রকল্প থেকে মার্জিন আত্মসাৎ করার লোভে এখনো প্রকল্প ঋণ গ্রহণের বদখাসলত ছাড়তে পারছেন না, নইলে এখন বৈদেশিক ঋণ না নিলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনোই ক্ষতি হবে না।
৪. বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে দুই বছর বাদে গত ১০ বছর ধরে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হচ্ছে। বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি পূরণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স যথেষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ভারতের পরই। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। আরও ৮-১০ বিলিয়ন ডলার হুন্ডি ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে (হয়তো ডলার আসছে না)। এই বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি করেছে।
৫. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার, মানে ৩১০০ কোটি ডলার। অথচ, ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে তা ছিল মাত্র ৮২ কোটি ডলার। তৈরি পোশাক ছাড়াও চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য এবং মৎস্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর আশাব্যঞ্জক থাকছে। চীনের পর এখন পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে।
৬. বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছর ৬ শতাংশের বেশি হচ্ছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতি-লুটপাট কমাতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির হারকে ৮ শতাংশে উন্নীত করা যাবে।
৭. বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক প্রবর্তিত ÿক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতি প্রান্তিক অবস্থানের ভূমিহীন নারীদের কাছে ব্যাংকঋণ পৌঁছে দেওয়ার সফল ও লাগসই ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্ব-স্বীকৃতি পেয়েছে নোবেল পুরস্কার জয় করার মাধ্যমে। ক্ষুদ্রঋণব্যবস্থার কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও প্রান্তিক অবস্থানের উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীর কাছে পুঁজি সরবরাহের এই পদ্ধতিগত উদ্ভাবনকে আরও গ্রহণযোগ্য ও টেকসই করাটাই এখন জাতির চ্যালেঞ্জ।
৮. ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির প্রশংসনীয় অগ্রগতি বাংলাদেশের আনাচকানাচে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবের সুফল পৌঁছে দিচ্ছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৩ কোটি এখন মোবাইল টেলিফোনের আওতায় চলে এসেছে, যার খরচ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সর্বনিম্ন। দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
৯. বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ আসছে শিল্প খাত থেকে, ১৮ শতাংশ আসছে কৃষি খাত থেকে আর ৫২ শতাংশ আসছে টারশিয়ারি (প্রধানত সেবা ও বাণিজ্য) খাত থেকে। জিডিপি কম্পোজিশনের এই উল্লেখযোগ্য রূপান্তর দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত ও টেকসই হওয়ার লক্ষণ।
অন্যদিকে, উন্নয়নের পথে যাত্রা সত্ত্বেও সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন ও পুঁজি লুণ্ঠনের ‘সিস্টেমের’ দৌরাত্ম্য গত সাত বছরে একবারেই কমেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষ যেমন দৈনন্দিন জীবনে ঘুষ-দুর্নীতির তাণ্ডবে দিশেহারা, তেমনি সরকারের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে যে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে, সেটা প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলিত ব্যয়ের কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে।
কয়েকটি উদাহরণ দেখুন: ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় শেষ পর্যন্ত প্রতি বর্গমিটারে যা দাঁড়িয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক। পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের (পিপিপি) নির্মিত এই প্রকল্পে যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যয় বাড়ানো হয়েছে, সেটা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। খবর নিয়ে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়ী-ঠিকাদারদের বিভিন্ন মহলকে বখরা দিয়ে মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি এই অবিশ্বাস্য খরচ ফাঁপানোর কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকল্প চালু হওয়ার পর চুক্তির শর্তাবলি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দুই বছর ধরে কয়েক গুণ বেশি হারে টোল আদায় করে যাওয়া সত্ত্বেও সরকার রহস্যজনকভাবে বিষয়টির আইনি সুরাহার প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে প্রশস্তকরণ প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রায় চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। শুধু বিলম্বের ওজর দেখিয়ে এত বেশি ব্যয়বৃদ্ধিকে জায়েজ করা যাবে না। কারণ, গত সাত বছরে নির্মাণসামগ্রীর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দাম এত বেশি বাড়েনি যে তা দিয়ে প্রকল্পের কয়েক গুণ ব্যয়বৃদ্ধিকে যৌক্তিক প্রমাণ করা যাবে। এই বড় প্রকল্পটির পাশাপাশি সড়ক-সম্পর্কীয় সব প্রকল্পের খরচ দফায় দফায় বাড়ানো এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথকে ডাবল ট্র্যাক করার প্রকল্পের ব্যয়ও কয়েক গুণ বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। রেলওয়ের তাবৎ প্রকল্প বিলম্বিত হওয়াই নিয়মে পরিণত হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, প্রকল্প মানেই উন্নয়ন—এটা আমাদের রাজনীতিতে বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে বহুদিন আগেই। আর প্রকল্প থেকে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী-ঠিকাদারেরা মার্জিন আহরণ করে অনর্জিত আয়-রোজগার করার বিষয়টিও এখন আমাদের ধাতস্থ হয়ে গেছে। বিএনপির তুলনায় এ ব্যাপারে বরং আওয়ামী লীগের পারঙ্গমতা কিছুটা কম বলে ধারণা রয়েছে। অতএব, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উত্তীর্ণ হলে যে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক-ব্যবসায়িক পুঁজি লুণ্ঠন বাড়াই স্বাভাবিক, সেটা বিএনপির নেতারাও ভালোভাবে জানেন। আমার মতে, লুটপাটের মহাসড়কে অবস্থানের ব্যাপারে বিএনপির এহেন মন্তব্য যদি সুস্পষ্ট তথ্য-উপাত্তভিত্তিক হয়, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সেগুলোকে আমলে নিয়ে কার্যকর তদন্ত শুরু করলে এবং অভিযোগগুলোকে আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে নিয়ে এলে জাতি উপকৃত হবে। বিরোধী দল বলেই চলেছে, দুদক শুধু অতীতের ক্ষমতাসীন মহলের দুর্নীতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করায় বেশি পারদর্শিতা প্রদর্শন করছে। এ ব্যাপারে দুদককে সাবধানতার সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেই হবে। আমিও মনে করি ‘স্বাধীন’ দুদকের আরেকটু বেশি সাহসী হওয়ার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে চলেছেন, তাঁকে কেনা যায় না। তাঁর এই সাহসী বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে তাঁকে দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাঁর এবং তাঁর দলের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের এটাই একমাত্র পথ। তাঁর সরকারের সাফল্যগুলোকে বরবাদ করার জন্য দুর্নীতিই হবে প্রতিপক্ষের হাতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। এই অস্ত্রকে ভোঁতা করার প্রয়োজনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং অবিলম্বে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments