নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও ইরানের ভবিষ্যৎ by মীযানুল করীম
‘সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ।’ দু’হাজার
বছর আগে সম্রাট আলেকজান্ডার কথাটা ঠিক বর্তমান বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেননি।
তবে এ যুগে সত্যিই আমাদের দেশটার রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকার ও শাসনের
বিভিন্ন চিত্র এতই অদ্ভুত যে, বলতেই হয়- ‘কী বিচিত্র এ দেশ।’ এক শ’ বছর
আগেই কবি ডি এল রায় বলে গেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি।’
এর চলমান প্রমাণ হলো, গোটা দুনিয়ায় জ্বালানি তেলের দাম কমে অর্ধেকে নেমে
গেছে; আর এই বিচিত্র দেশে এ সময়েও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়। ফলে বেড়ে যায়
যানবাহনের ভাড়াও।
যা হোক, টাটকা খবর হলো, তেলের দাম এ বছর আরো কমবে। এর বিশেষ কারণ, ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় দেশটির বিপুল পরিমাণ তেল আসবে আন্তর্জাতিক বাজারে। এভাবে সরবরাহ বেড়ে তেলের দাম দেবে কমিয়ে। কথা হলো, এতে বাংলাদেশেও কি তেলের দাম কমবে? উল্টো চলার দেশে তা হবে বলে মনে হয় না। অতএব, ইরান তেল রফতানি করল কি না, তেলের দাম কমল কি না, এসব বিষয়ে বাংলাদেশের আপাতত কিছু আসে যায় না। সাধে কি আর বলে, ‘বেল পাকলে তাতে কাকের কী?’
এই গৌরচন্দ্রিকার পর আসল কথায় আসা যাক। ব্যাপার হচ্ছে, ইরানের ওপর এক যুগ ধরে আন্তর্জাতিক অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার যে খড়গ ঝুলছিল, তা এতদিনে তুলে নেয়া হয়েছে। ইরান পরমাণু বোমা বানাবে না, আরো স্পষ্ট করে বললে- ‘বানাতে পারবে না’ মর্মে নিশ্চিত হয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য এবং মার্কিন প্রভাবাধীন জাতিসঙ্ঘ এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ‘নিউক্লিয়ার ক্লাব’-এর হোতা যুক্তরাষ্ট্র এবং এর অন্য মোড়লদের মনোভাব হলো, পারমাণবিক বোমা বানানোর অধিকার কেবল আমাদের ক’জনের। ইরানের মতো কোনো রাষ্ট্রকে তা বানাতে দেয়া হবে না। কারণ, আমাদের আপনজনদের (ইসরাইলসহ) বোমা বিশ্বশান্তির স্বার্থে; এর বাইরে যত দেশ আছে (বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত), ওদের বোমা বিশ্বকে ধ্বংস করবে।’ অবশ্য না বললেও চলে, ৭০ বছর আগে জাপানে পরমাণু বোমা ফেলে কয়েক লাখ মানুষ হত্যা করেছিল কারা।
গত জুলাই মাসে ভিয়েনাতে পাঁচ বৃহৎশক্তি আর জার্মানির সাথে ইরানের ফলপ্রসূ আলোচনার ফলে পরমাণু চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল। এর পর ছয় মাস ইরানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে বিশ্ব সংস্থা নিশ্চিত হয় যে, দেশটি অঙ্গীকারমাফিক ওই চুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন করেছে। তাই পূর্বনির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী, ইরান দীর্ঘকালের আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
এবার ভিয়েনায় আইএইএ সদর দফতরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মোগেরিনি এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। অতএব, ইরানের ১০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ আটকাবস্থা থেকে ছাড় করাতে আর বাধা রইল না। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সাথে সাথেই ইরান তেল রফতানির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
ইরান তার অবমুক্ত সম্পদের সাহায্যে জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সক্ষম হবে। অপর দিকে, তেলের বাজারে ইরানের জোরালো উপস্থিতি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ইরান জানিয়েছে, তারা দৈনিক পাঁচ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানি করার সক্ষমতা রাখে। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ইদানীং ৩০ ডলারের কাছাকাছি নেমে আসায় তেল রফতানিকারী দেশগুলোর মাঝে উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়েছে। ইরান তার বিপুল তেলভাণ্ডার নিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল এমনকি, ২০ ডলারেরও কম হয়ে যেতে পারে। ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরানের নয়াযুগের সূচনা হলো।’
এখন থেকে ইরান ও পাশ্চাত্য, পরস্পর থেকে যতটা সম্ভব, লাভবান হওয়ার প্রয়াস পাওয়াই স্বাভাবিক। তেমনি নজরদারিটাও কিন্তু একতরফা হবে না। শুধু যে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার মোড়ল-মাতব্বররা ইরানের প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনের কড়ায়গণ্ডায় হিসাব নিতে চায়, তা নয়। ইরানও পশ্চিমা জগতের হোতাদের মতিগতির দিকে সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখবে। কারণ যে পরমাণু চুক্তির বলে এক দশকের নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরান মুক্ত হয়েছে, তেহরান মনে করে এটা একতরফা পালনের বিষয় নয়; বরং এর সাথে উভয় পক্ষের অঙ্গীকার পূরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ জন্যই ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আয়াতুল্লাহ খামেনি লিখিতভাবে বলেছেন, পরমাণু বিষয়ে সমঝোতার অপরপক্ষ তার নিজের ওয়াদা রাখছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে গভীরভাবে। খামেনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মার্কিন নেতৃত্ব যেসব বক্তব্য দিয়েছে, তা খুব স্বস্তিকর নয়। প্রতিটি পদক্ষেপেই আমাদের থাকতে হবে সতর্ক।’
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার এমন সাবধানী মনোভাব যে অকারণ নয়, তার প্রমাণ হলো- ইরানের বিরুদ্ধে এ যাবৎ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পরদিনই নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ইরান ব্যালাস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে- এই কারণ দেখিয়ে ওয়াশিংটন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইরানের কিছু কোম্পানি এবং কয়েক ব্যক্তির ওপর। সাথে সাথে ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানালেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল তৈরি করার কর্মসূচি কিংবা এ জাতীয় কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। তাই নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৈধ নয়।’
ইরানের সম্পর্ক পাশ্চাত্যের সাথে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হবে হয়তো। ভারত-চীন-রাশিয়ার সাথে হলো- সম্পর্কে আপাতত কিছুটা ওঠানামা দেখা যেতে পারে। তবে অর্থনৈতিক স্বার্থে এই তিন দেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই থাকবে বলে আশা করা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন বাংলাদেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক কি বাড়বে? বাংলাদেশ কোনো বৃহৎশক্তি বা আঞ্চলিক শক্তি নয়। ইরানের প্রতিবেশীও নই আমরা। কিংবা ইরাক-ইয়েমেন-সিরিয়া-আজারবাইজান-বাহরাইনের মতো শিয়া-অধ্যুষিত বা প্রভাবিত রাষ্ট্রও নয় বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ ও ইরান মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তদুপরি, বাংলাদেশ জনসংখ্যার বিচারে তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র যা বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময়। এই বিবেচনায় বাংলাদেশ-ইরান সম্পর্ক ‘দহরম-মহরম’ পর্যায়ে না পৌঁছলেও কখনো ঢিলে বা দায়সারা গোছের হওয়ার কথা নয়। এবার জানা গেছে, বাংলাদেশ ইরানে সারকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব:) আবদুর রশিদ আশা করেছেন, বাংলাদেশের সাথে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইরানের সহায়তা ও সম্ভাবনা বাড়বে।
এই পরমাণু চুক্তির সাফল্য নির্ভর করছে ইরান দেশটির সাত কোটি ৯০ লাখ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধির ওপর। ইরানে বেকারত্ব, মন্দা, মূল্যস্ফীতি অত্যন্ত প্রকট। কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সহজ কথা নয়। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বিদেশী বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে সময়মতো। এদিকে, আগামী মাসে ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তায়ও একটা সমস্যা হতে পারে।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, ইরানে সরকারবিরোধীরা পরমাণু চুক্তির সমালোচনা করে বলছেন, ‘এটা ইরানের অর্জনের সিমেন্টনির্মিত সমাধি।’ এ কথা বলার কারণ, কিছু দিন আগে ভিয়েনায় স্বাক্ষরিত ওই চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইরানের আরক নামের জায়গার হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর বা চুল্লি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে সেখানে যে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, তা ভরাট করা হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। লক্ষ করার মতো আরেকটি বিষয় হলো, ইরানের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য কিছুটা সমস্যা হলেও ইরানের ক্ষমতাসীনেরা এটা তাদের বিরাট বিজয় হিসেবে রাজনৈতিক সুফল পাওয়ার আশা করছেন। আগামী মাসে ইরানে নির্বাচন, তাই প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি চেয়েছিলেন, এর আগেই যেন নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
ইরানের ওপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আর নেই বলে ইসরাইল সাঙ্ঘাতিকরকম বিক্ষুব্ধ। তাদের দৃষ্টিতে, এটা হচ্ছে- ইরানের প্রতি পাশ্চাত্যের আপসকামিতা। এদিকে ইরানবিরোধী আরব দেশগুলোও অসন্তুষ্ট। অপর দিকে, ইরান সরকার সমালোচিত হচ্ছে নিজের দেশের বিরোধী দল কর্তৃক। এ দিক দিয়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানি আর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওবামা একই সমস্যার সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্রে কট্টরপন্থী রিপাবলিকানেরা ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিরোধিতা করেছেন। এই ইস্যুকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে, পাশ্চাত্যের একটি প্রভাবশালী মহল ইরানের নিষেধাজ্ঞামুক্তির ঘটনায় খুশি না হয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লিখেছে, ইরান পরমাণু চুক্তির বিনিময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আটক হয়ে থাকা তার ১০ হাজার কোটি ডলার ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তারা বিশ্ববাণিজ্যে ফের প্রবেশাধিকার পাবে। তেহরানের সমালোচকদের আশঙ্কা, এ অর্থ ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যকে ফের অস্থিতিশীল করে তোলা হতে পারে। ইরানের শাসকদের উচিত, এ অর্থ তাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যবহার করা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যা-লয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ রুহুল আমীন ‘বিশ্ব আসলে কতটা নিরাপদ’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ইরানের ওপর পারমাণবিক ইস্যুতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সাথে সাথে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইস্যুতে নতুন করে দেশটির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, তা বিশ্বনিরাপত্তার প্রশ্নটিকেও অনিরাপদ করবে বলে মনে হয়।
১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ‘ইসলামি বিপ্লব’ সংঘটিত হয় মার্কিনপন্থী শাহেন শাহ রেজা পাহলভিকে উৎখাতের মাধ্যমে। এর পরই বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে এবং অচিরেই সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তখন ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান’ এবং ইসরাইলকে ‘ছোট শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করত। সে সময় থেকে আমেরিকার সাথে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই তিন যুগ ধরে। গত ৩৬ বছরের বিভিন্ন পর্যায়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের প্রভাবশালী অধিকাংশ দেশ ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এমনকি জাতিসঙ্ঘেরও সম্পর্কে টানাপড়েন ঘটেছে ইরানের। এসব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি ছিল পরমাণু ইস্যুকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞা।
আসলে ইরানের পরমাণু শক্তি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই দেশটি অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার। ১৯৯৫ সালে এটা পুরোমাত্রায় কার্যকর হয়। পরের বছর বিদেশী ব্যবসায় এবং তেল-গ্যাসে ইরানি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০২ সালে এ মর্মে পাশ্চাত্যের দাবি শোনা যায় যে, ইরানের গোপন পরমাণু চুল্লি শনাক্ত করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কারণ দেখিয়ে আর্থিক সম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। পরের বছর অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। ২০০৮ সালে ইরানের সামরিক-বেসামরিক ব্যবহারের সম্পদ এবং মার্কিন ব্যাংকগুলোর মধ্যস্থতার বিষয় নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে। ২০১০-এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ট্যাংক, মিসাইল, যুদ্ধবিমানসহ ভারী অস্ত্র, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ব্যাংকিংয়ের ওপর। ২০১১ সালে আরো সম্পদ এবং বিশেষ ক’জন ব্যক্তির নাম নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ওঠে। ২০১২ সালে তেল সম্পদের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয় ইরানি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার লক্ষ্যে। কারণ, জ্বালানি তেলের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রিজার্ভগুলোর এবং সর্ববৃহৎ রফতানিকারকদের অন্যতম এই ইরান। একই বছর ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেন বন্ধ করা হয়।
২০১৩ সালে অটোমোবাইল খাত এবং ইরানি মুদ্রার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারিত হয়। ২০১৪ সালে অবশ্য হাওয়া কিছুটা উল্টো বইতে শুরু করে। সে বছর অর্থ, সোনা আর পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর, ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ‘ভিয়েনা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হলো। এ জন্য শর্ত দেয়া হয়, ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাবে না। এটা মনিটর করার দায়িত্ব বর্তায় জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ সংস্থা আইএইএর ওপর। এর সদর দফতর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে বিধায় সেখানে চুক্তি সই করা হয়েছে বৈঠকশেষে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তিসংস্থাকে সংক্ষেপে আইএইএ বলা হয়। যা হোক, তাদের অনুকূল প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হলো। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং জাতিসঙ্ঘের।
ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে মনে করার কারণ নেই যে, সব ফাঁড়া কেটে গেছে এবং তেহরানের সামনে আর কোনো বাধা নেই। পাশ্চাত্য শক্তির কাছে বরাবরই আপন থাকবে ইসরাইল; তার প্রচণ্ড বিরোধী ইরান নয়। ইরান কিংবা অন্য কোনো দেশের আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার আকাক্সক্ষা, প্রয়াস বা সামর্থ্য থাকতে পারে, এমনকি আশপাশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও চালাতে পারে। এসব কিছু আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও রীতিনীতির লঙ্ঘন হলে অবশ্যই আপত্তিকর ও অবাঞ্ছিত। কিন্তু কথা হলো, পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে ইসরাইলের আগ্রাসন ও সম্প্রসারণের নীতি মোটেও অন্যায় নয়, বরং ইহুদিবাদী অপরাষ্ট্রের জন্য এটা নাকি ‘অপরিহার্য’। অথচ সেই একই পাশ্চাত্য শক্তি ইরান তো দূরের কথা, সৌদি আরব বা অন্য কোনো ‘পাশ্চাত্যবান্ধব’ মুসলিম রাষ্ট্রেরও পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের তীব্র বিরোধী। এ অবস্থায় ইরানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের প্রখর নজরদারি বজায় থাকাটা অবশ্যম্ভাবী। ইরানের সাথে বাহ্যিকভাবে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে ইউরোপ-আমেরিকার মোড়লেরা নিজেদের ফায়দা যতটা সম্ভব তুলে নেয়ার চেষ্টা করবে। তবে ইরান তাদের সন্দেহমুক্ত সহজে হতে পারবে বলে মনে হয় না।
‘এক মাঘে শীত যায় না।’ আরো ফাঁড়া রয়ে গেছে ইরানের। হয়তো, এগুলো পাহাড়সমান বাধা নয়, তবে বেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জ তো বটেই। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, ইরানকে আরো কিছু বড় সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হেরে গিয়ে যদি ক্ষমতায় আসে রিপাবলিকান পার্টি, তা হলে ইহুদি লবি ও কট্টরপন্থীদের চাপে ইরানের পরমাণু চুক্তি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, পরমাণু চুক্তির আওতায় এমন সব নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে, যেগুলো পরমাণু ইস্যু সংশ্লিষ্ট। কিন্তু মানবাধিকারসহ অন্যান্য ইস্যুর সাথে সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ উঠছে না। তদুপরি মার্কিন কংগ্রেসের নতুন আইন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য তৃতীয় দেশের সুপারিশ নেয়া ইরানিদের জন্য বাধ্যতামূলক।
ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে নানামুখী আলোচনা ও পর্যালোচনা হচ্ছে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক সম্ভাব্য কী কী প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতির অঙ্গনে পড়তে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হচ্ছে অভিমত। এটা স্পষ্ট যে, এখন ইরানের সুযোগ ও সম্ভাবনার পাশাপাশি দায়দায়িত্বও বেড়েছে। ইরান গত কয়েক বছরে নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে, অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে (এমনকি এর বাইরেও), বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বলন্ত ইস্যুতে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এর কারণ যাই থাকুক, বাস্তবে পরিস্থিতি শুধু জটিল নয়, অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিগর্ভ। এতদিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার সাথে দেশটি রাজনৈতিক চাপেও ছিল। এখন স্বস্তিদায়ক নতুন পরিস্থিতিতে তেহরানকে নিজের পররাষ্ট্রনীতি, আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্ক, মুসলিম উম্মাহর প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান প্রভৃতি বিষয় যথাযথভাবে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিছক আবেগ নয়, বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান ইরানের নবজন্ম এবং যার উত্তরাধিকারের দাবিদার এখনকার ইরানও, সে বিপ্লবের মূল আদর্শের ধারাবাহিকতা ৩৬ বছর পরে কতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে, আর কতটা অক্ষুণ্ন রয়েছে, সেটাও হিসাব করা দরকার। ইরানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের কাছে মুসলিম দেশগুলোসহ তৃতীয় বিশ্বের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণের খতিয়ানও নেয়া উচিত। নিষেধাজ্ঞামুক্ত ইরান তার বর্ধিত শক্তিমত্তার কারণে বর্ধিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে বলে আমরা আশা করি।
যা হোক, টাটকা খবর হলো, তেলের দাম এ বছর আরো কমবে। এর বিশেষ কারণ, ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় দেশটির বিপুল পরিমাণ তেল আসবে আন্তর্জাতিক বাজারে। এভাবে সরবরাহ বেড়ে তেলের দাম দেবে কমিয়ে। কথা হলো, এতে বাংলাদেশেও কি তেলের দাম কমবে? উল্টো চলার দেশে তা হবে বলে মনে হয় না। অতএব, ইরান তেল রফতানি করল কি না, তেলের দাম কমল কি না, এসব বিষয়ে বাংলাদেশের আপাতত কিছু আসে যায় না। সাধে কি আর বলে, ‘বেল পাকলে তাতে কাকের কী?’
এই গৌরচন্দ্রিকার পর আসল কথায় আসা যাক। ব্যাপার হচ্ছে, ইরানের ওপর এক যুগ ধরে আন্তর্জাতিক অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞার যে খড়গ ঝুলছিল, তা এতদিনে তুলে নেয়া হয়েছে। ইরান পরমাণু বোমা বানাবে না, আরো স্পষ্ট করে বললে- ‘বানাতে পারবে না’ মর্মে নিশ্চিত হয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য এবং মার্কিন প্রভাবাধীন জাতিসঙ্ঘ এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ‘নিউক্লিয়ার ক্লাব’-এর হোতা যুক্তরাষ্ট্র এবং এর অন্য মোড়লদের মনোভাব হলো, পারমাণবিক বোমা বানানোর অধিকার কেবল আমাদের ক’জনের। ইরানের মতো কোনো রাষ্ট্রকে তা বানাতে দেয়া হবে না। কারণ, আমাদের আপনজনদের (ইসরাইলসহ) বোমা বিশ্বশান্তির স্বার্থে; এর বাইরে যত দেশ আছে (বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত), ওদের বোমা বিশ্বকে ধ্বংস করবে।’ অবশ্য না বললেও চলে, ৭০ বছর আগে জাপানে পরমাণু বোমা ফেলে কয়েক লাখ মানুষ হত্যা করেছিল কারা।
গত জুলাই মাসে ভিয়েনাতে পাঁচ বৃহৎশক্তি আর জার্মানির সাথে ইরানের ফলপ্রসূ আলোচনার ফলে পরমাণু চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল। এর পর ছয় মাস ইরানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে বিশ্ব সংস্থা নিশ্চিত হয় যে, দেশটি অঙ্গীকারমাফিক ওই চুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন করেছে। তাই পূর্বনির্ধারিত ঘোষণা অনুযায়ী, ইরান দীর্ঘকালের আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
এবার ভিয়েনায় আইএইএ সদর দফতরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মোগেরিনি এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। অতএব, ইরানের ১০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ আটকাবস্থা থেকে ছাড় করাতে আর বাধা রইল না। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সাথে সাথেই ইরান তেল রফতানির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
ইরান তার অবমুক্ত সম্পদের সাহায্যে জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সক্ষম হবে। অপর দিকে, তেলের বাজারে ইরানের জোরালো উপস্থিতি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ইরান জানিয়েছে, তারা দৈনিক পাঁচ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানি করার সক্ষমতা রাখে। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ইদানীং ৩০ ডলারের কাছাকাছি নেমে আসায় তেল রফতানিকারী দেশগুলোর মাঝে উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়েছে। ইরান তার বিপুল তেলভাণ্ডার নিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল এমনকি, ২০ ডলারেরও কম হয়ে যেতে পারে। ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরানের নয়াযুগের সূচনা হলো।’
এখন থেকে ইরান ও পাশ্চাত্য, পরস্পর থেকে যতটা সম্ভব, লাভবান হওয়ার প্রয়াস পাওয়াই স্বাভাবিক। তেমনি নজরদারিটাও কিন্তু একতরফা হবে না। শুধু যে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার মোড়ল-মাতব্বররা ইরানের প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনের কড়ায়গণ্ডায় হিসাব নিতে চায়, তা নয়। ইরানও পশ্চিমা জগতের হোতাদের মতিগতির দিকে সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখবে। কারণ যে পরমাণু চুক্তির বলে এক দশকের নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরান মুক্ত হয়েছে, তেহরান মনে করে এটা একতরফা পালনের বিষয় নয়; বরং এর সাথে উভয় পক্ষের অঙ্গীকার পূরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ জন্যই ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আয়াতুল্লাহ খামেনি লিখিতভাবে বলেছেন, পরমাণু বিষয়ে সমঝোতার অপরপক্ষ তার নিজের ওয়াদা রাখছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে গভীরভাবে। খামেনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মার্কিন নেতৃত্ব যেসব বক্তব্য দিয়েছে, তা খুব স্বস্তিকর নয়। প্রতিটি পদক্ষেপেই আমাদের থাকতে হবে সতর্ক।’
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার এমন সাবধানী মনোভাব যে অকারণ নয়, তার প্রমাণ হলো- ইরানের বিরুদ্ধে এ যাবৎ আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পরদিনই নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ইরান ব্যালাস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে- এই কারণ দেখিয়ে ওয়াশিংটন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইরানের কিছু কোম্পানি এবং কয়েক ব্যক্তির ওপর। সাথে সাথে ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানালেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল তৈরি করার কর্মসূচি কিংবা এ জাতীয় কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। তাই নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৈধ নয়।’
ইরানের সম্পর্ক পাশ্চাত্যের সাথে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হবে হয়তো। ভারত-চীন-রাশিয়ার সাথে হলো- সম্পর্কে আপাতত কিছুটা ওঠানামা দেখা যেতে পারে। তবে অর্থনৈতিক স্বার্থে এই তিন দেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই থাকবে বলে আশা করা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন বাংলাদেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক কি বাড়বে? বাংলাদেশ কোনো বৃহৎশক্তি বা আঞ্চলিক শক্তি নয়। ইরানের প্রতিবেশীও নই আমরা। কিংবা ইরাক-ইয়েমেন-সিরিয়া-আজারবাইজান-বাহরাইনের মতো শিয়া-অধ্যুষিত বা প্রভাবিত রাষ্ট্রও নয় বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ ও ইরান মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তদুপরি, বাংলাদেশ জনসংখ্যার বিচারে তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র যা বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময়। এই বিবেচনায় বাংলাদেশ-ইরান সম্পর্ক ‘দহরম-মহরম’ পর্যায়ে না পৌঁছলেও কখনো ঢিলে বা দায়সারা গোছের হওয়ার কথা নয়। এবার জানা গেছে, বাংলাদেশ ইরানে সারকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব:) আবদুর রশিদ আশা করেছেন, বাংলাদেশের সাথে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইরানের সহায়তা ও সম্ভাবনা বাড়বে।
এই পরমাণু চুক্তির সাফল্য নির্ভর করছে ইরান দেশটির সাত কোটি ৯০ লাখ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমৃদ্ধির ওপর। ইরানে বেকারত্ব, মন্দা, মূল্যস্ফীতি অত্যন্ত প্রকট। কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সহজ কথা নয়। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বিদেশী বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে সময়মতো। এদিকে, আগামী মাসে ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তায়ও একটা সমস্যা হতে পারে।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, ইরানে সরকারবিরোধীরা পরমাণু চুক্তির সমালোচনা করে বলছেন, ‘এটা ইরানের অর্জনের সিমেন্টনির্মিত সমাধি।’ এ কথা বলার কারণ, কিছু দিন আগে ভিয়েনায় স্বাক্ষরিত ওই চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইরানের আরক নামের জায়গার হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর বা চুল্লি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে সেখানে যে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, তা ভরাট করা হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। লক্ষ করার মতো আরেকটি বিষয় হলো, ইরানের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের জন্য কিছুটা সমস্যা হলেও ইরানের ক্ষমতাসীনেরা এটা তাদের বিরাট বিজয় হিসেবে রাজনৈতিক সুফল পাওয়ার আশা করছেন। আগামী মাসে ইরানে নির্বাচন, তাই প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি চেয়েছিলেন, এর আগেই যেন নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
ইরানের ওপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আর নেই বলে ইসরাইল সাঙ্ঘাতিকরকম বিক্ষুব্ধ। তাদের দৃষ্টিতে, এটা হচ্ছে- ইরানের প্রতি পাশ্চাত্যের আপসকামিতা। এদিকে ইরানবিরোধী আরব দেশগুলোও অসন্তুষ্ট। অপর দিকে, ইরান সরকার সমালোচিত হচ্ছে নিজের দেশের বিরোধী দল কর্তৃক। এ দিক দিয়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানি আর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওবামা একই সমস্যার সম্মুখীন। যুক্তরাষ্ট্রে কট্টরপন্থী রিপাবলিকানেরা ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিরোধিতা করেছেন। এই ইস্যুকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে, পাশ্চাত্যের একটি প্রভাবশালী মহল ইরানের নিষেধাজ্ঞামুক্তির ঘটনায় খুশি না হয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লিখেছে, ইরান পরমাণু চুক্তির বিনিময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আটক হয়ে থাকা তার ১০ হাজার কোটি ডলার ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তারা বিশ্ববাণিজ্যে ফের প্রবেশাধিকার পাবে। তেহরানের সমালোচকদের আশঙ্কা, এ অর্থ ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যকে ফের অস্থিতিশীল করে তোলা হতে পারে। ইরানের শাসকদের উচিত, এ অর্থ তাদের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যবহার করা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যা-লয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ রুহুল আমীন ‘বিশ্ব আসলে কতটা নিরাপদ’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, ইরানের ওপর পারমাণবিক ইস্যুতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সাথে সাথে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইস্যুতে নতুন করে দেশটির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, তা বিশ্বনিরাপত্তার প্রশ্নটিকেও অনিরাপদ করবে বলে মনে হয়।
১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ‘ইসলামি বিপ্লব’ সংঘটিত হয় মার্কিনপন্থী শাহেন শাহ রেজা পাহলভিকে উৎখাতের মাধ্যমে। এর পরই বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে এবং অচিরেই সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তখন ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান’ এবং ইসরাইলকে ‘ছোট শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করত। সে সময় থেকে আমেরিকার সাথে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই তিন যুগ ধরে। গত ৩৬ বছরের বিভিন্ন পর্যায়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের প্রভাবশালী অধিকাংশ দেশ ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এমনকি জাতিসঙ্ঘেরও সম্পর্কে টানাপড়েন ঘটেছে ইরানের। এসব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি ছিল পরমাণু ইস্যুকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞা।
আসলে ইরানের পরমাণু শক্তি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই দেশটি অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার। ১৯৯৫ সালে এটা পুরোমাত্রায় কার্যকর হয়। পরের বছর বিদেশী ব্যবসায় এবং তেল-গ্যাসে ইরানি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০২ সালে এ মর্মে পাশ্চাত্যের দাবি শোনা যায় যে, ইরানের গোপন পরমাণু চুল্লি শনাক্ত করা হয়েছে। ২০০৬ সালে ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কারণ দেখিয়ে আর্থিক সম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট অনেকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। পরের বছর অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। ২০০৮ সালে ইরানের সামরিক-বেসামরিক ব্যবহারের সম্পদ এবং মার্কিন ব্যাংকগুলোর মধ্যস্থতার বিষয় নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে। ২০১০-এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ট্যাংক, মিসাইল, যুদ্ধবিমানসহ ভারী অস্ত্র, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ব্যাংকিংয়ের ওপর। ২০১১ সালে আরো সম্পদ এবং বিশেষ ক’জন ব্যক্তির নাম নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ওঠে। ২০১২ সালে তেল সম্পদের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয় ইরানি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার লক্ষ্যে। কারণ, জ্বালানি তেলের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রিজার্ভগুলোর এবং সর্ববৃহৎ রফতানিকারকদের অন্যতম এই ইরান। একই বছর ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ এবং আন্তঃব্যাংক লেনদেন বন্ধ করা হয়।
২০১৩ সালে অটোমোবাইল খাত এবং ইরানি মুদ্রার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারিত হয়। ২০১৪ সালে অবশ্য হাওয়া কিছুটা উল্টো বইতে শুরু করে। সে বছর অর্থ, সোনা আর পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর, ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ‘ভিয়েনা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হলো। এ জন্য শর্ত দেয়া হয়, ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাবে না। এটা মনিটর করার দায়িত্ব বর্তায় জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ সংস্থা আইএইএর ওপর। এর সদর দফতর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে বিধায় সেখানে চুক্তি সই করা হয়েছে বৈঠকশেষে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তিসংস্থাকে সংক্ষেপে আইএইএ বলা হয়। যা হোক, তাদের অনুকূল প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হলো। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং জাতিসঙ্ঘের।
ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে মনে করার কারণ নেই যে, সব ফাঁড়া কেটে গেছে এবং তেহরানের সামনে আর কোনো বাধা নেই। পাশ্চাত্য শক্তির কাছে বরাবরই আপন থাকবে ইসরাইল; তার প্রচণ্ড বিরোধী ইরান নয়। ইরান কিংবা অন্য কোনো দেশের আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার আকাক্সক্ষা, প্রয়াস বা সামর্থ্য থাকতে পারে, এমনকি আশপাশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও চালাতে পারে। এসব কিছু আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও রীতিনীতির লঙ্ঘন হলে অবশ্যই আপত্তিকর ও অবাঞ্ছিত। কিন্তু কথা হলো, পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে ইসরাইলের আগ্রাসন ও সম্প্রসারণের নীতি মোটেও অন্যায় নয়, বরং ইহুদিবাদী অপরাষ্ট্রের জন্য এটা নাকি ‘অপরিহার্য’। অথচ সেই একই পাশ্চাত্য শক্তি ইরান তো দূরের কথা, সৌদি আরব বা অন্য কোনো ‘পাশ্চাত্যবান্ধব’ মুসলিম রাষ্ট্রেরও পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের তীব্র বিরোধী। এ অবস্থায় ইরানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পাশ্চাত্যের প্রখর নজরদারি বজায় থাকাটা অবশ্যম্ভাবী। ইরানের সাথে বাহ্যিকভাবে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে ইউরোপ-আমেরিকার মোড়লেরা নিজেদের ফায়দা যতটা সম্ভব তুলে নেয়ার চেষ্টা করবে। তবে ইরান তাদের সন্দেহমুক্ত সহজে হতে পারবে বলে মনে হয় না।
‘এক মাঘে শীত যায় না।’ আরো ফাঁড়া রয়ে গেছে ইরানের। হয়তো, এগুলো পাহাড়সমান বাধা নয়, তবে বেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জ তো বটেই। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, ইরানকে আরো কিছু বড় সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হেরে গিয়ে যদি ক্ষমতায় আসে রিপাবলিকান পার্টি, তা হলে ইহুদি লবি ও কট্টরপন্থীদের চাপে ইরানের পরমাণু চুক্তি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, পরমাণু চুক্তির আওতায় এমন সব নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে, যেগুলো পরমাণু ইস্যু সংশ্লিষ্ট। কিন্তু মানবাধিকারসহ অন্যান্য ইস্যুর সাথে সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ উঠছে না। তদুপরি মার্কিন কংগ্রেসের নতুন আইন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য তৃতীয় দেশের সুপারিশ নেয়া ইরানিদের জন্য বাধ্যতামূলক।
ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে নানামুখী আলোচনা ও পর্যালোচনা হচ্ছে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক সম্ভাব্য কী কী প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতির অঙ্গনে পড়তে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হচ্ছে অভিমত। এটা স্পষ্ট যে, এখন ইরানের সুযোগ ও সম্ভাবনার পাশাপাশি দায়দায়িত্বও বেড়েছে। ইরান গত কয়েক বছরে নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে, অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে (এমনকি এর বাইরেও), বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বলন্ত ইস্যুতে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এর কারণ যাই থাকুক, বাস্তবে পরিস্থিতি শুধু জটিল নয়, অনেক ক্ষেত্রে অগ্নিগর্ভ। এতদিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার সাথে দেশটি রাজনৈতিক চাপেও ছিল। এখন স্বস্তিদায়ক নতুন পরিস্থিতিতে তেহরানকে নিজের পররাষ্ট্রনীতি, আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্ক, মুসলিম উম্মাহর প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান প্রভৃতি বিষয় যথাযথভাবে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিছক আবেগ নয়, বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বর্তমান ইরানের নবজন্ম এবং যার উত্তরাধিকারের দাবিদার এখনকার ইরানও, সে বিপ্লবের মূল আদর্শের ধারাবাহিকতা ৩৬ বছর পরে কতটা ক্ষুণ্ন হয়েছে, আর কতটা অক্ষুণ্ন রয়েছে, সেটাও হিসাব করা দরকার। ইরানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের কাছে মুসলিম দেশগুলোসহ তৃতীয় বিশ্বের যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণের খতিয়ানও নেয়া উচিত। নিষেধাজ্ঞামুক্ত ইরান তার বর্ধিত শক্তিমত্তার কারণে বর্ধিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে বলে আমরা আশা করি।
No comments