ওরা কি গান গাইতে দেবে না? by মান্নান হীরা
১৮ জানুয়ারি সোমবার গিয়েছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। দেশবাসী জানেন ও গণমাধ্যমে দেখেছেন, একটি মোবাইল ফোনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মাদ্রাসার একদল ছাত্রের দ্বারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর কেমন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র বলব না, কারণ এ নিষ্ঠুর যজ্ঞে একাই তাণ্ডব চালিয়েছে তারা। প্রায় নীরব ছিল প্রশাসন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একটি প্রতিনিধিদল, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুছ, হাসান আরিফ, আখতারুজ্জামান, আহমেদ গিয়াসসহ কয়েকজন দুপুর ১২টা নাগাদ পৌঁছে যাই শহরে। স্থানীয় সংস্কৃতিসেবী, নাট্যবন্ধু এবং সাংবাদিকেরা আমাদের প্রথমে নিয়ে যান ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বরে। এ এক ঐতিহাসিক স্থান। সবাই জানেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ অধিবেশনে কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই মহৎ মানুষটিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সমগ্র জাতি তাঁর অবদান ও ত্যাগের কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
ধীরেন্দ্রনাথ চত্বরে রয়েছে একাধিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার, ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য একাডেমি, তিতাস ললিতকলা। সেখানে পেঁৗছে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই—সব তছনছ করে দিয়েছে ওরা। পাঠাগার ধ্বংস করেছে, আসবাব ভেঙেছে, এমনকি শিশু সংগঠন শিশুনাট্যমও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। চত্বরের মাঝখানে এখনো তার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেছিলেন। সাহিত্য একাডেমির জয়দুল হোসেনকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম অনেক সময়। তাঁর মতো অনেকেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন—এ কী তাণ্ডব!
সেখান থেকে শিল্পকলার চূর্ণবিচূর্ণ দেয়ালের কাচ মাড়িয়ে পৌঁছালাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে। মুহূর্তে মনে হলো, ৪৪ বছর পর একাত্তরের মতো ধ্বংসযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সবগুলো কক্ষ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত সরোদ ভেঙে-পুড়ে অঙ্গারের কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে, ব্যবহৃত তবলা ছিন্নভিন্ন! আরও কত! ওই জাদুঘরটির ছবিগুলো ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন পোড়ানো হয়েছে নির্মমভাবে। আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলি। আবারও এ বিশ্বাস দৃঢ় হয়, ধর্মান্ধদের প্রধান শত্রু সংস্কৃতি। কারণ, সংস্কৃতি জীবনের মেলবন্ধনের কথা বলে, প্রগতির পথ দেখায়, সভ্যতার আলো জ্বালে। সংস্কৃতি সর্বদাই উগ্র ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলে।
হয়তো হামলাকারীরা ধরা পড়বে অথবা পড়বে না। হয়তো সরকার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভবনটি সংস্কার করবে। কিন্তু জাতি কি আর ফিরে পাবে তাঁর স্পর্শধন্য সেই সরোদ, তবলা, স্মৃতিচিহ্ন!
দুপুরের পর বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে এক স্থানীয় শিক্ষক, যিনি আমাদের মুক্ত নাটকের পুরোনো বন্ধু, সবার আড়ালে নিয়ে আমার এক হাত জাপটে ধরে আরেক হাত কাঁধে রেখে বললেন, ‘আমার আট বছরের মেয়েটি আলাউদ্দিন খাঁ ভবনের পোড়া তবলা দেখে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, “বাবা, ওরা কি আর কোনো দিন আমাকে গান শিখতে দেবে না?”’
মেয়ের চোখের জল তখন বাবার চোখে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে সফরসঙ্গীদের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। ফেরার পথে অনুভব করলাম, সংগীত শিক্ষার্থী কন্যাটির বাবার চোখের জল আমার চোখকেও আর্দ্র করে তুলল।
মান্নান হীরা: নাট্যকার ও পরিচালক।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একটি প্রতিনিধিদল, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুছ, হাসান আরিফ, আখতারুজ্জামান, আহমেদ গিয়াসসহ কয়েকজন দুপুর ১২টা নাগাদ পৌঁছে যাই শহরে। স্থানীয় সংস্কৃতিসেবী, নাট্যবন্ধু এবং সাংবাদিকেরা আমাদের প্রথমে নিয়ে যান ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চত্বরে। এ এক ঐতিহাসিক স্থান। সবাই জানেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ অধিবেশনে কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই মহৎ মানুষটিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সমগ্র জাতি তাঁর অবদান ও ত্যাগের কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
ধীরেন্দ্রনাথ চত্বরে রয়েছে একাধিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাগার, ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য একাডেমি, তিতাস ললিতকলা। সেখানে পেঁৗছে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই—সব তছনছ করে দিয়েছে ওরা। পাঠাগার ধ্বংস করেছে, আসবাব ভেঙেছে, এমনকি শিশু সংগঠন শিশুনাট্যমও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। চত্বরের মাঝখানে এখনো তার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেছিলেন। সাহিত্য একাডেমির জয়দুল হোসেনকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম অনেক সময়। তাঁর মতো অনেকেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন—এ কী তাণ্ডব!
সেখান থেকে শিল্পকলার চূর্ণবিচূর্ণ দেয়ালের কাচ মাড়িয়ে পৌঁছালাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে। মুহূর্তে মনে হলো, ৪৪ বছর পর একাত্তরের মতো ধ্বংসযজ্ঞের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সবগুলো কক্ষ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত সরোদ ভেঙে-পুড়ে অঙ্গারের কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে, ব্যবহৃত তবলা ছিন্নভিন্ন! আরও কত! ওই জাদুঘরটির ছবিগুলো ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন পোড়ানো হয়েছে নির্মমভাবে। আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলি। আবারও এ বিশ্বাস দৃঢ় হয়, ধর্মান্ধদের প্রধান শত্রু সংস্কৃতি। কারণ, সংস্কৃতি জীবনের মেলবন্ধনের কথা বলে, প্রগতির পথ দেখায়, সভ্যতার আলো জ্বালে। সংস্কৃতি সর্বদাই উগ্র ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলে।
হয়তো হামলাকারীরা ধরা পড়বে অথবা পড়বে না। হয়তো সরকার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ভবনটি সংস্কার করবে। কিন্তু জাতি কি আর ফিরে পাবে তাঁর স্পর্শধন্য সেই সরোদ, তবলা, স্মৃতিচিহ্ন!
দুপুরের পর বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে এক স্থানীয় শিক্ষক, যিনি আমাদের মুক্ত নাটকের পুরোনো বন্ধু, সবার আড়ালে নিয়ে আমার এক হাত জাপটে ধরে আরেক হাত কাঁধে রেখে বললেন, ‘আমার আট বছরের মেয়েটি আলাউদ্দিন খাঁ ভবনের পোড়া তবলা দেখে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, “বাবা, ওরা কি আর কোনো দিন আমাকে গান শিখতে দেবে না?”’
মেয়ের চোখের জল তখন বাবার চোখে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে সফরসঙ্গীদের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। ফেরার পথে অনুভব করলাম, সংগীত শিক্ষার্থী কন্যাটির বাবার চোখের জল আমার চোখকেও আর্দ্র করে তুলল।
মান্নান হীরা: নাট্যকার ও পরিচালক।
No comments