উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভ্যাট: ‘দুধ দেবে খামারিরা, গরু-ছাগল নয়!’ by ফারুক ওয়াসিফ
‘শিক্ষার্থীদের
ভ্যাট দিতেই হবে’-এমন তেজস্ক্রিয় মন্তব্য থেকে সরে এসেছেন অর্থমন্ত্রী।
এতে প্রমাণিত হয় শিক্ষার্থীদের অবস্থানই যৌক্তিক ছিল। তবে মানলেনই যদি
তাহলে আবার কেন বলেন, ‘আন্দোলনের যৌক্তিকতা পাই না।’ ভ্যাট বহাল রাখার
কৌশলটাও নিদারুণ। এনবিআরের তরফে বলা হচ্ছে, ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়,
শিক্ষার্থীরা নয়। ফেসবুকে সয়লাব হওয়া জবাব: ‘দুধ দেবে খামারিরা, গরু-ছাগল
নয়!’ ভ্যাট যে পাত্র থেকেই নেওয়া হোক, তা আদায় করা হবে শিক্ষার্থীদের কাছ
থেকেই।
ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের ওপর শিক্ষা কর বসানো হতো। শিক্ষার ব্যয় মেটাতে সরকার নির্দিষ্ট আয়ের ওপরের ধনীদের ব্যাপারে সে রকম পদক্ষেপ নিতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও ফি সীমার মধ্যে রাখার বন্দোবস্ত করা যায়। বেসরকারি শিক্ষাকে নিরেট মুনাফামুখী হওয়া ঠেকানোর তদারকি তো সরকারি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্চয়কে শিক্ষার অবকাঠামো ও মানের উন্নয়নে ব্যয় করাতে পারে কেবল সরকার। বিষয়টা হওয়ার কথা ছিল বাণিজ্যায়ন-বিরোধী; সরকারের দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার: মানবিক কারণে, শিক্ষা বিস্তারের স্বার্থে। অথচ যাঁদের আজ এভাবে রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হলো, তাঁরা সহজে ফিরবেন না। এভাবে বা অন্য কোনো ভাবে আবারও তাঁরা আসবেন।
এ রকম বাস্তবতা থেকেই জন্ম হয় প্রতিবাদের নতুন ভাষা ও দাবি: ‘নো ভ্যাট, করো গুলি’! গুলির কথা এসেছে, কারণ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তার পরও তাঁরা মারমুখো হননি। তারা দেখালেন, একটা গাড়িও না ভেঙে আন্দোলন করা যায়। তাঁদের এই প্রতিবাদের ভাষাও কিন্তু অহিংসই। আইন মেনে চূড়ান্ত ‘না’ বলার প্রতিরোধ এটা।
শিক্ষা আন্দোলনের এই জমায়েত অনেকেরই অচেনা। এই শিক্ষার্থীরা প্রজন্ম হিসেবে নতুন। তাঁদের ভাষাও নতুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের গৌরব ও ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁরা যোগ করছেন নিজেদের নতুন গৌরব ও আত্মবিশ্বাস।
এই অসংগঠিত ও আনাড়ি আন্দোলনকারীদের ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে কারও আপত্তি থাকতেই পারে। তাই বলে, নারীর জন্য অবমাননাকর ভাষা প্রয়োগ করে তাদের আরও হেনস্তা করতে হবে? কথায় বলে, মড়ারে মারো কেন? বলে, লড়ে চড়ে কেন? হ্যাঁ, নিশ্চল এই সমাজকে তাঁরা কিন্তু ধাক্কা দিয়েছেন। তাঁরা যে যুক্তি দেখাচ্ছেন, যে দাবি তুলছেন, তার ভেতরে সত্য ও মানবিকতা উপস্থিত। একে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। পুরোনো ও প্রাজ্ঞদেরই তো বেশি দায় নতুনকে বুঝে তার বিকাশে কাজ করার। আমরা কি কখনো তাঁদের বুঝতে চেয়েছি, তাঁদের কাছে গিয়েছি, তাঁদের দুঃখগুলো নিয়ে ভেবেছি?
কর্তাসুলভ অনেকেরই জানা নেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মধ্য ও নিম্নবিত্ত ঘরের। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া, অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই এই চিত্র দেখা যাবে। নিজস্ব আবাসন নেই বলে বাসা ভাড়া করে মেস বানিয়ে থাকতে হয়। ঢাকার বাসা ভাড়া কত বেশি, তা তো সবারই জানা। এ জগদ্দল শহরে চলাচলের কষ্ট ও খরচের বহরও তো অজানা থাকার কথা না। আমি এমন কজন ছাত্রকে চিনি যাঁদের পড়ার খরচ জোগাতে নাভিশ্বাস ওঠে। অনেকে দিনে ছোটখাটো চাকরি করে সন্ধ্যার পরে উচ্চতর ডিগ্রির সাধনা করে যান চাকরির বেতনের টাকায়। অনেককে পরিবার চালাতে হয়। শ্রেণি ডিঙানোর আশা, ভালো জীবনের স্বপ্নে তাঁরা এই বাড়তি বোঝাটা বয়ে চলেন। আমাদের মোটামুটি সচ্ছল পরিবার সন্তানের পেছনেই যা আছে সব বিনিয়োগ করেন। হয়তো বড় ভাইকে পড়াতেই পরিবার কমজোরি হয়ে যায়। পরের ভাই-বোনদের কপালে থাকে হতাশা। জমি বেচা টাকা, পার্টটাইম চাকরি করা টাকা তাঁরা দুর্নীতি বা বাণিজ্যের ভোগে দিতে কেন রাজি থাকবেন?
সরকারকে সংবিধান-বর্ণিত শিক্ষার অধিকার প্রশ্নে নীতিগতভাবেই সেবামূলক থাকতে হবে। কেবল শিক্ষাই এই সম্পদহীন দেশের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি, যা অর্জনে আমরা স্বাধীন। অথচ নিছক শিক্ষার অভাবেই, যথাযথ মানের অভাবেই দেশটা উঠতে উঠতে হোঁচট খাচ্ছে। এরপরও উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কৌশলপত্রের প্রতিটি সুপারিশ মেনে উল্টো যাত্রাতেই চলবে সরকার? ওই কৌশলপত্রের তৃতীয় পর্বে ধাপে ধাপে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির সুপারিশ করা আছে—ছাত্র আন্দোলনকে প্রধান বাধা বলে বর্ণনা করা আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-ব্যয়ও তো বাড়ছে ধীরে ধীরে। এটা কি কৌশলে উচ্চশিক্ষার সংকোচন নয়?
শিক্ষার্থীরা তো সংবিধানের ভরসাতেই দাবি করছেন, শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার, শিক্ষা পণ্য নয় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ। আজকের সন্তানেরা লড়ছেন আগামীর সন্তানদের জন্য। আজ তাঁরা জয়ী হলে ভবিষ্যতে আরও অনেকে উচ্চশিক্ষায় আসতে পারবেন। বিকাশমান অর্থনীতির স্বার্থেই আমাদের অনেক স্নাতক লাগবে। সার্বিক উন্নতির স্বার্থে এ খাতে বিনিয়োগ করবে রাষ্ট্র। শিক্ষা থাকবে সমাজের হাতে, চলবে রাষ্ট্রের খাতে, এই বুনিয়াদি অবস্থানে সরকারকে আসতেই হবে। পাবলিকের হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এটাই বলছে। রিকশা চালিয়ে পড়ালেখা করা যদি মহিমা পায়, তাহলে শ্রমজীবীর সন্তানের জন্য শিক্ষার সুযোগ খোলা রাখার দাবি কেন মহৎ নয়?
ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের ওপর শিক্ষা কর বসানো হতো। শিক্ষার ব্যয় মেটাতে সরকার নির্দিষ্ট আয়ের ওপরের ধনীদের ব্যাপারে সে রকম পদক্ষেপ নিতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও ফি সীমার মধ্যে রাখার বন্দোবস্ত করা যায়। বেসরকারি শিক্ষাকে নিরেট মুনাফামুখী হওয়া ঠেকানোর তদারকি তো সরকারি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্চয়কে শিক্ষার অবকাঠামো ও মানের উন্নয়নে ব্যয় করাতে পারে কেবল সরকার। বিষয়টা হওয়ার কথা ছিল বাণিজ্যায়ন-বিরোধী; সরকারের দায়িত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার: মানবিক কারণে, শিক্ষা বিস্তারের স্বার্থে। অথচ যাঁদের আজ এভাবে রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হলো, তাঁরা সহজে ফিরবেন না। এভাবে বা অন্য কোনো ভাবে আবারও তাঁরা আসবেন।
এ রকম বাস্তবতা থেকেই জন্ম হয় প্রতিবাদের নতুন ভাষা ও দাবি: ‘নো ভ্যাট, করো গুলি’! গুলির কথা এসেছে, কারণ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তার পরও তাঁরা মারমুখো হননি। তারা দেখালেন, একটা গাড়িও না ভেঙে আন্দোলন করা যায়। তাঁদের এই প্রতিবাদের ভাষাও কিন্তু অহিংসই। আইন মেনে চূড়ান্ত ‘না’ বলার প্রতিরোধ এটা।
শিক্ষা আন্দোলনের এই জমায়েত অনেকেরই অচেনা। এই শিক্ষার্থীরা প্রজন্ম হিসেবে নতুন। তাঁদের ভাষাও নতুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের গৌরব ও ঐতিহ্যের সঙ্গে তাঁরা যোগ করছেন নিজেদের নতুন গৌরব ও আত্মবিশ্বাস।
এই অসংগঠিত ও আনাড়ি আন্দোলনকারীদের ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে কারও আপত্তি থাকতেই পারে। তাই বলে, নারীর জন্য অবমাননাকর ভাষা প্রয়োগ করে তাদের আরও হেনস্তা করতে হবে? কথায় বলে, মড়ারে মারো কেন? বলে, লড়ে চড়ে কেন? হ্যাঁ, নিশ্চল এই সমাজকে তাঁরা কিন্তু ধাক্কা দিয়েছেন। তাঁরা যে যুক্তি দেখাচ্ছেন, যে দাবি তুলছেন, তার ভেতরে সত্য ও মানবিকতা উপস্থিত। একে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। পুরোনো ও প্রাজ্ঞদেরই তো বেশি দায় নতুনকে বুঝে তার বিকাশে কাজ করার। আমরা কি কখনো তাঁদের বুঝতে চেয়েছি, তাঁদের কাছে গিয়েছি, তাঁদের দুঃখগুলো নিয়ে ভেবেছি?
কর্তাসুলভ অনেকেরই জানা নেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মধ্য ও নিম্নবিত্ত ঘরের। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া, অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই এই চিত্র দেখা যাবে। নিজস্ব আবাসন নেই বলে বাসা ভাড়া করে মেস বানিয়ে থাকতে হয়। ঢাকার বাসা ভাড়া কত বেশি, তা তো সবারই জানা। এ জগদ্দল শহরে চলাচলের কষ্ট ও খরচের বহরও তো অজানা থাকার কথা না। আমি এমন কজন ছাত্রকে চিনি যাঁদের পড়ার খরচ জোগাতে নাভিশ্বাস ওঠে। অনেকে দিনে ছোটখাটো চাকরি করে সন্ধ্যার পরে উচ্চতর ডিগ্রির সাধনা করে যান চাকরির বেতনের টাকায়। অনেককে পরিবার চালাতে হয়। শ্রেণি ডিঙানোর আশা, ভালো জীবনের স্বপ্নে তাঁরা এই বাড়তি বোঝাটা বয়ে চলেন। আমাদের মোটামুটি সচ্ছল পরিবার সন্তানের পেছনেই যা আছে সব বিনিয়োগ করেন। হয়তো বড় ভাইকে পড়াতেই পরিবার কমজোরি হয়ে যায়। পরের ভাই-বোনদের কপালে থাকে হতাশা। জমি বেচা টাকা, পার্টটাইম চাকরি করা টাকা তাঁরা দুর্নীতি বা বাণিজ্যের ভোগে দিতে কেন রাজি থাকবেন?
সরকারকে সংবিধান-বর্ণিত শিক্ষার অধিকার প্রশ্নে নীতিগতভাবেই সেবামূলক থাকতে হবে। কেবল শিক্ষাই এই সম্পদহীন দেশের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি, যা অর্জনে আমরা স্বাধীন। অথচ নিছক শিক্ষার অভাবেই, যথাযথ মানের অভাবেই দেশটা উঠতে উঠতে হোঁচট খাচ্ছে। এরপরও উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কৌশলপত্রের প্রতিটি সুপারিশ মেনে উল্টো যাত্রাতেই চলবে সরকার? ওই কৌশলপত্রের তৃতীয় পর্বে ধাপে ধাপে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির সুপারিশ করা আছে—ছাত্র আন্দোলনকে প্রধান বাধা বলে বর্ণনা করা আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-ব্যয়ও তো বাড়ছে ধীরে ধীরে। এটা কি কৌশলে উচ্চশিক্ষার সংকোচন নয়?
শিক্ষার্থীরা তো সংবিধানের ভরসাতেই দাবি করছেন, শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার, শিক্ষা পণ্য নয় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ। আজকের সন্তানেরা লড়ছেন আগামীর সন্তানদের জন্য। আজ তাঁরা জয়ী হলে ভবিষ্যতে আরও অনেকে উচ্চশিক্ষায় আসতে পারবেন। বিকাশমান অর্থনীতির স্বার্থেই আমাদের অনেক স্নাতক লাগবে। সার্বিক উন্নতির স্বার্থে এ খাতে বিনিয়োগ করবে রাষ্ট্র। শিক্ষা থাকবে সমাজের হাতে, চলবে রাষ্ট্রের খাতে, এই বুনিয়াদি অবস্থানে সরকারকে আসতেই হবে। পাবলিকের হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এটাই বলছে। রিকশা চালিয়ে পড়ালেখা করা যদি মহিমা পায়, তাহলে শ্রমজীবীর সন্তানের জন্য শিক্ষার সুযোগ খোলা রাখার দাবি কেন মহৎ নয়?
No comments