তৃতীয় মত: নারী, দেহ, ভ্যাট এবং সংবিধান by সাজেদুল হক
সময়
১৯৫২। ভাষা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত রাজপথ। সবার মুখে
একই স্লোগান- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এরই মধ্যে একজন হঠাৎ স্লোগান ধরলেন,
বাংলাভাষা রাষ্ট্র চাই। পাশ থেকে তাকে বলা হলো সেসময় এখনও আসেনি। আসলেই সে
সময় তখনও আসেনি। ১৯৫২ সালে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পেয়েছি। তবে
বাংলা ভাষার রাষ্ট্র পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
রক্তস্নাত পথে সে রাষ্ট্র পেয়েছি আমরা। প্রতিটি আন্দোলনেই কিছু কিছু
স্লোগান বিপুল আলোচিত হয়। যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলন মঞ্চ গণজাগরণ মঞ্চের
‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ স্লোগান যেমন ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। কেউ কেউ অবশ্য
এর সমালোচনাও করেছিলেন। বলেছিলেন, এ স্লোগান ফ্যাসিবাদী। চলমান ভ্যাটবিরোধী
আন্দোলনের কিছু কিছু স্লোগানও এরই মধ্যে বিপুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম
দিয়েছে। সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের এবারের পর্বটি শুরু হয় গত বুধবার। ইস্ট-ওয়েস্ট
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালায়। পরদিন ঢাকার
বেশ কয়েকটি স্পটে বিক্ষোভ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে
পুরো ঢাকা শহর অচল হয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর ভ্যাট নিয়ে সরকারি মহলের নানা
বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির
রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়
থেকে করা আটটি উক্তির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি ফেসবুকে
লিখেছেন- ১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভ্যাট বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিতে হবে না। এটা দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ
কথা বলেন। ২. অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাট মওকুফের কোন সুযোগ নেই। এবার তারা
আন্দোলন করছেন বলে তাদের ভ্যাট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেবে। আগামী বছর
শিক্ষার্থীদের ভ্যাট তাদের নিজেদের দিতে হবে। ৩. ছাত্রছাত্রীদের ওপর কোন
ভ্যাট আরোপ করা নেই বলে জানিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি
চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। শেখ কবির হোসেন ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ জানান। তিনি বলেন,
শিক্ষার্থীদের ওপর কোন ভ্যাট আরোপ করা নেই। এখন ভ্যাটটা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ওপর। ৪. নতুন করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়ের উদ্দেশে মূসক আরোপ হয়নি;
টিউশন ফি-এর মধ্যে মূসক অন্তর্ভুক্ত আছে; মূসক বাবদ অর্থ পরিশোধ করার
দায়িত্ব সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, কোনমতেই শিক্ষার্থীদের নয়;
বিদ্যমান টিউশন ফি এর মধ্যে মূসক অন্তর্ভুক্ত থাকায়, টিউশন ফি বাড়ার কোন
সুযোগ নেই- এনবিআর ৫. এনবিআরের এ ব্যাখ্যাকে শুভঙ্করের ফাঁকি মনে করেন
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। তিনি বলেন, (১১ই
সেপ্টেম্বর), এনবিআর যা-ই বলুক না কেন, এটা শুভঙ্করের ফাঁকি। তারা যেভাবেই
ব্যাখ্যা দিক, এই মূসক শিক্ষার্থীদের ওপরই বর্তাবে। ৬. আওয়ামী লীগের
প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক
টাকাও ভ্যাট না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ৭. এনবিআরের সাবেক একজন চেয়ারম্যান
বলেন, ‘যেভাবেই বলা হোক না কেন ভোক্তা হিসেবে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের
ওপরই এ মূসক চাপবে।’ ৮. একটি বিষয় ভাবতে অবাক লাগে, যে শিক্ষার্থীরা
পিতামাতার অর্থে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছে, তাদের ওপর
বৈষম্যমূলকভাবে ভ্যাটের বোঝা আরোপ করা হচ্ছে। অথচ যারা অন্য
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে, তারা সামান্য খরচে পড়াশোনা
চালিয়ে যেতে পারছে। জাতি কি এ বৈষম্য স্বীকার করে? -মো. গোলাম রহমান:
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি। ভ্যাটবিরোধী এ আন্দোলন
নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা স্থানে আলোচনা চলছে। যে যার দলীয়
অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
বাণিজ্য করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ভাল না। বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড়লোকের ছেলে। এসব ব্যাপার বিশ্লেষণের পূর্বে
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ওই অনুচ্ছেদে বলা
হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের
মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও
সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের মধ্যে নিম্নলিখিত
বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়- ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও
চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা। সংবিধান যেখানে রাষ্ট্রকে
শিক্ষা নিশ্চিতের মৌলিক দায়িত্ব দিয়েছে সেখানে রাষ্ট্র নিজেই ভ্যাট
চাপাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
রাজপথে নামার পরই যেন সবার মনে পড়েছে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের কথা।
এসব অনিয়ম যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে সে কথা মিথ্যা নয়। তবে এসব অনিয়ম
রোধের দায়িত্ব কার? নিশ্চিতভাবেই সংবিধানের চেতনা হচ্ছে রাষ্ট্রকেই এ
দায়িত্ব পালন করতে হবে। আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে কি-না তা দেখার
জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন রয়েছে। ওই কমিশন কি তার দায়িত্ব পালন
করছে। আরেকটি কথা- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধনীর ছেলে- এমন
একটি প্রচারণা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। ইংরেজিতে একটি কথা রয়েছে- মিথ
অ্যান্ড রিয়েলিটি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মানেই ধনী এ মিথ আজ
বাংলাদেশের বাস্তবতায় মিথ্যা। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে অর্ধেকের বেশি
শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের। যে পরিবর্তন বোঝার ক্ষমতাও
হয়তো আমাদের নীতিনির্ধারকদের নেই। এ লেখা যখন লিখছি তখনও ঢাকা, চট্টগ্রাম
এবং সিলেটে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ আন্দোলনের পরিণতি
কি হতে পারে সে নিয়েও আলোচনা চলছে। প্রথমত, রাষ্ট্র সদয় হতে পারে। শিক্ষাকে
রাষ্ট্র ভ্যাটের আওতামুক্ত ঘোষণা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, শক্তি প্রয়োগের
মাধ্যমে এ আন্দোলন দমন করতে পারে। গত কয়েক বছর শক্তি প্রয়োগের মুখে
বাংলাদেশের সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি পিছু হটেছে। এবারও তা ঘটলে
বিস্ময়কর হবে না। তবে এ আন্দোলনের কয়েকটি ছবি নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি
হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে ‘মন পাবি, দেহ পাবি, তবু ভ্যাট পাবি না’-
এমন স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে এক শিক্ষার্থীর ছবি নিয়ে।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এক নারীর হাতে ওই প্ল্যাকার্ড থাকার কারণেই এ
আলোচনা-সমালোচনা। যদিও নাদিয়া রহমান বাঁধন নামের ওই শিক্ষার্থী এক ফেসবুক
স্ট্যাটাসে এ ব্যাপারে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, যদি
সরকার আমাদের কথা মানে তাহলে আমরা সরকারের উপর খুব হ্যাপি হবো (মন পাবি)।
যদি পুলিশ দিয়ে গুলি করতে চায় তাও রেডি আছি (দেহ পাবি), কিন্তু কোন ভ্যাট
নয়। এই সিম্পল কথাটা না বুঝে যারা উল্টা-পাল্টা কমেন্ট করছে তাদের কিছু
বলার নেই আমার। অন্যদের শ্রদ্ধা করলেই কেবল আপনি কারও কাছ থেকে শ্রদ্ধা
পেতে পারেন। বাঁধন দাবি করেন, তিনি অনেক প্লাকার্ড নিয়েই ছবি তুলেছেন, তবে
এসবের একটাও তার নিজের নয়। তিনি আরও লিখেছেন, এ প্লাকার্ডের লেখাটা ফানি
(মিনিংলেস না, কিন্তু সেটা বোঝার ক্ষমতা সবার নেই)। আমি মেয়ে বলে আসলে আমার
প্লাকার্ড ধরা ঠিক হয়নি? আমি নিজেকে মানুষ ভাবতে পছন্দ করি, নিজেকে
সেভাবেই ট্রিট করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের
অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন এ ব্যাপারে ফেসবুকে লিখেছেন- ‘তুই আমার দেহ
পাবি, কিন্তু মন পাবি না...,’ ঢাকাই সিনেমার নায়িকার ক্লিশে সংলাপকে No Vat
আন্দোলনের প্ল্যাকার্ডে নিয়ে আসা, পপুলার কালচারের এই Intertexual
ব্যবহার, অর্থমন্ত্রীর কাছে ঐকিক নিয়ম শেখার চেয়ে আকর্ষণীয়। একজন মেয়ে এই
প্ল্যাকার্ড ধরার সঙ্গে সঙ্গে টেক্সটের অর্থ পাঠকের কাছে কীভাবে বদলে যায়;
সেসব গালাগালি, যৌন- আক্রমণ কিংবা নীতিজ্ঞান বর্ষণের পাঠ, জেন্ডার
স্টাডিজের দিক থেকে প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু আলোচিত/বিতর্কিত/নিন্দিত ছবির
মানুষ, যখন প্রতিবাদী মানুষ হয়ে উত্তর দেয়, এ ঘুরে দাঁড়ানোর জবাব নাই। এটি
নিজেই একটি ধারা। তিনি আরও লিখেছেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত স্লোগান বেশ একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক
এবং বুদ্ধিজীবীরাও যে এ আন্দোলনের স্লোগান কি হওয়া উচিত তা নিয়ে
চিন্তাভাবনা করছেন, এটা কিন্তু বেশ আশার কথা! তার মানে তারা ‘নো ভ্যাট’
আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। নো ভ্যাটের স্লোগানগুলো আন্দোলনের
মতোই স্বতঃস্ফূর্ত, তাই নিশ্চয়ই ‘সহি স্লোগান’ হয়ে ওঠেনি। এ কথা অস্বীকার
করার জো নেই যে, এ আন্দোলনে ব্যবহৃত কিছু স্লোগান অবশ্যই আপত্তিকর। কারণ
কোন ক্ষেত্রেই শালীনতা অতিক্রম সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এ আন্দোলনের মূল
কৃতিত্ব একটি সাংবিধানিক স্লোগান ফিরিয়ে আনা- শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষা
অধিকার।
No comments