অনাথালয়: পাহাড়ি শিশুর শিক্ষাস্বর্গ by আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলম
শিক্ষা, সংস্কৃতি বা অর্থনীতিতে আজো অনেকটা পিছিয়ে পাহাড়িরা। দেশের এই
প্রান্তিক সম্প্রদায়ের শিশুরাই বঞ্চিত সবচেয়ে বেশি। তাদের মৌলিক যে শিক্ষার
অধিকার সে দিক থেকেও যেন সমতলের শিশুদের চেয়ে শতমাইল পিছিয়ে তারা।
এসব
সুবিধাবঞ্চিত শিশুর প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়াস নিয়ে
তাদের একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎতের দিকে এগিয়ে নিতে পাহাড়েই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন
আশ্রম সেবা প্রতিষ্ঠান। তাদের মূল উদ্দেশ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত
শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া।

অনাথালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, শিক্ষাই সব ধরনের পশ্চাদপদতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান হাতিয়ার। এমনই এক সেবামুলক প্রতিষ্ঠান বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয়। এ অনাথালয়ের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও প্রতিষ্ঠানের সংগঠক সদ্য প্রয়াত ১৬তম বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু এর মেয়ে, রাজকন্যা ডনাই প্রু নেলীর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলমের। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম।
বান্দরবানে
অনাথালয় রয়েছে গুটি কয়েক। এর মধ্যে একটি মাদ্রাসা ছাড়া সবগুলো চালায় মূলত
বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। ভান্তে অর্থ্যাৎ সংসার ত্যাগী যারা, তারা ১৯৮৪ সালে একটা
আশ্রম তৈরির উদ্যোগ নেন। উদ্দেশ্য ছিল দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভান্তেদের
আশ্রয়। আশ্রমটা শুরু করেছিলেন ধর্মীয় গুরুরা। কিন্তু মানুষ হিসেবে,
মানুষের প্রতি মানুষের কিছু করার আছে সে বোধ থেকে সে সময় প্রয়াত ১৬তম বোমাং
রাজা ক্য সাইন প্রু এ উদ্যোগে যোগ দেন।
সেসময় বান্দরবান (বান্দরবান জেলা ছিল না) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্য সাইন প্রু ই মূলত এ অনাথালয় পুরোদমে শুরু করেন। অনাথালয়ের জায়গাটা অনাথালয়ের নামে একোয়ার করেন। সাধারণ সম্পাদক হন ধর্মীয় গুরু বা শ্রমণরা আর সভাপতি হন ক্য সাইন প্রু।
১৯৯২ সালে অন্য একজন অনাথালয়ের দায়িত্ব নেন। এ সময় অনাথালয়ের অবস্থা বেশ দরিদ্র হয়ে পড়ে। ১৯৯৪ সালে ক্য সাইন প্রু পুনরায় দায়িত্ব নেন। এর পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ক্য সাইন প্রু যখন থেকে দায়িত্ব নেন তখন থেকে বাবার সঙ্গে কাজ করতেন তার কন্যা ডনাই প্রু নেলী।
এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কথা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “বাবার পাশাপাশি আমি বাচ্চাদের দেখাশোনা করতাম। তারপর এক বার্ষিক সম্মেলনে শ্রমণরা বললেন- একজন নারী দরকার আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য, যিনি মায়ের মতো কাজ করবেন। ১৯৯৯ সাল থেকে মূলত আশ্রমের সঙ্গে আমার পুরোপুরি সম্পৃক্ত হওয়া। সাংগঠনিক হিসেবে এখানো আছি। যদিও নিজেকে তা মনে করি না। আমি মনে করি, আমি এদেরই মা। ১২০ জন বাচ্চার মা। মাঝে মাঝে ১০০ জন হয়ে যায় অর্থনৈতিক সংকটের জন্য।”
মূলত দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে বাচ্চারা এ অনাথালয়ে ভর্তি হয়। দশম শ্রেণি পর্যন্ত থাকতে পারে। বর্তমানে রয়েছে ১২২ জন ছাত্র। আগে শুধু মারমা সম্প্রদায় ছিল, এখন মারমা ছাড়া চাকমা, খিয়াংসহ অন্য সম্প্রদায়ের বাচ্চারাও আসছে।
মূলত দ্বিতীয় ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাচ্চা বেশি ভর্তি করা হয়। ‘বান্দরবান বুদ্ধ অনাথালয় নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামে একটা জুনিয়র স্কুল আছে যেটা সম্পূর্ণ বৌদ্ধ অনাথালয়ই চালায়। সে স্কুলের কারণেই মূলত ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাচ্চা বেশি ভর্তি কারানো হয়। এ বছর ৬ষ্ঠ ও ৩য় শ্রেণির বাচ্চা বেশি ভর্তি করানো হয়েছে। ৯ম শ্রেণিতে উঠলে বাচ্চাদের অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হয়। তবে এখানে থাকতে পারে তারা।
অনাথালয়
হলেও পুরাপুরি ফ্রি কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয় না। কারণ যে পরিমাণে খরচ
সেটা যোগাড় করা কঠিন হয়। এখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচ হাজার এবং ৬ষ্ঠ
শ্রেণি থেকে আট হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এ একবারই তাদের টাকা দিতে হয়।
এরপর যতদিন থকবে সব খরচ বহন করবে কর্তৃপক্ষ।
তবে বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয় নাম হলেও এখানে সবাই অনাথ নয়। যদিও এটা করা হয়েছিলো অনাথদের কথা চিন্তা করেই। মূলত অনাথ ছাড়াও যাদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর, সুযোগ-সুবিধা নেই সেসব এলাকা থেকে আসা বাচ্চাদের এখানে ভর্তি করা হয়। মূল উদ্দেশ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে নেলী বলেন, “যে সমস্ত এলাকার বাচ্চারা সুবিধাবঞ্চিত, যাদের এলাকায় স্কুল নেই, তাছাড়া পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আর বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা এখানে তাদের দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। আমাদের শ্রমণ, ভান্তে, বাবা ছিলেন আমরা আছি। আমরাই দেখাশুনা করছি।”
তিনি বলেন, “এরা অনেকটা এতিমের মতো থাকে। আমরা হয়ত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের ভালো খাওয়াতে পরাতে পারি না। সাংগ্রাইয়েও আমরা হয়ত তাদের ভালো খাবারও মুখে তুলে দিতে পারবো না। অন্যরা নতুন কাপড় কিনছে, আনন্দ করছে। কিন্তু আমার এ ১২০ জন বাচ্চা বাড়ি যাবে না। এখানে তাদের একবেলা ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে অনেক কষ্টে। এ ছাড়া তাদের জন্য আর কিছু করা সম্ভব নয়।”
এখানে থেকে তারা এসএসসি পাশ করে। এরপর আর এখানে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখান থেকে যারা মেধাবী তাদের ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করে রাজপরিবার। তাছাড়া অনাথালয়ের সঙ্গে জড়িত শুভাকাঙ্ক্ষীরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। নেলী নিজেই এখন পর্যন্ত এমন ১৬-১৭ জন ছাত্রের খরচ চালিয়েছেন, যারা অনার্স শেষ করেছে, ডিগ্রি শেষ করেছে। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের নানা সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
অনথালয় থেকে এসএসসি পাশ করে অনেকে বিভিন্ন দেশে গেছে। কেউ ভোকেশনাল লাইনে পড়েছে। কিন্তু মাস্টার্স পাশ করেছে এমন নেই। তবে অনেকে ছোট-খাট সরকারি চাকরি করছে। স্কুলের সহকারি শিক্ষক হয়েছে ৪-৫ জন।
অনাথালয়ে মেয়ে শিশুরা নেই কেন এমন প্রসঙ্গ উঠলে নেলী বলেন, “আমার বাবার একটা বড় স্বপ্ন ছিল মেয়েদের রাখবে। কিন্তু এর প্রধান সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সংকট। আশ্রমে ১০ একর জায়গা রয়েছে। এখানে কোনো বাউন্ডারি নেই। মেয়ে রাখতে গেলে আমার বাউন্ডারি লাগবে, আরেকটু নিরাপত্তা লাগবে। সে ব্যবস্থা আমরা এখনো করতে পারিনি। বাবা বলতেন এ জায়গাটা ছেলেদের জন্য থাক। উপরে মেয়েদের জন্য ব্যবস্থা করবো।”
তিনি
বলেন, “বাবার সেই স্বপ্নটা আমি পূরণ করতে চাই। আমার ইচ্ছে রয়েছে ২০ জন
মেয়ে দিয়ে আমরা সেটা শুরু করবো। এখানে ১২০জন বাচ্চা রয়েছে। এতোগুলো বাচ্চার
জন্য দেখাশোনার পর্যাপ্ত জনবল কিন্তু আমাদের নেই। শ্রমণ একজন থাকেন। আর ম
পু শৈ এ অনাথালয়ের জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করলো। ও এখনো বিয়ে করেনি। ও
যদি এখান থেকে চলে যায়, এ অনাথালয় কিন্তু অর্ধেক পঙ্গু হয়ে যাবে। ও এখানেই
বড় হয়েছে। যদিও ওর বাবা-মা আছেন। আমরা এখন একটা জিনিস ঠিক করেছি- যারা এখান
থেকে পাশ করে বের হবে তাদের এখানকার কলেজে ভর্তি করে দেব। তাদের থাকারও
একটা ব্যবস্থা হবে, আবার এখানের বাচ্চাদের দেখাশোনারও একটা লোক পাওয়া
যাবে।”
তিনি আরও বলেন “আমাদের একজন হাউস টিউটর দরকার। কিন্তু আমরা অর্থনৈতিক কারণে রাখতে পারছি না। বাবুর্চিও নেই। আমাদের ছেলেরা নিজেরা রান্না-বান্না করে খায়। এখানে ডিপ টিউবওয়েল বসানো সম্ভব। কিন্তু টাকার অভাবে সেটা করা যায় না। এখানে নলকূপ রয়েছে, কিন্তু বছরের দু’তিন মাস পানি থাকে। এখন পুকুরের পানি ব্যবহার করছি।”
পাশে একটি ব্রিগেড থাকার কারণে সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। এ মূল ভবন উদ্বোধন করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম শাখাওয়াৎ হোসেন। বিগেডের বুকের মাঝেই আশ্রম। বলতে গেলে তারাই সুরক্ষিত করে রেখেছে এ আশ্রম।
তিনি বলেন, “যখনই যে ব্রিগেড কমান্ডার আসেন আমরা তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। আমাদের সমস্যাগুলো বললে তারা আমাদের সহযোগিতা করেন। গতবছর একটি ভবনও তারা তৈরি করে দিয়েছিলেন শুধু বাবার সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্ক থেকে।”
অনাথালয়ের নিজস্ব দোকান ভাড়া, উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে কিছু সাহায্য পায়। কিন্তু একশ’ বিশ জন বাচ্চা, অথচ ভাতা পায় মাত্র ৪০ জন।
অন্যদের
ভাতার পরিমাণ বাড়ে, কিন্তু এ অনাথালয়ের ২ জন ছাত্রের ভাতা আরো বন্ধ করে
দিয়েছে। অথচ ইসলামী মাদ্রাসার ৪ জন ছাত্রের ভাতা বেড়েছে। এক এক জন বাচ্চাকে
দেয় মাত্র ৮০০ টাকা করে।”
এক এক জন ছেলের পেছনে মাসে অনাথালয়ের ন্যূনতম খরচ হয় ১৬০০ টাকা করে। জেলা পরিষদে যখন কিছু বরাদ্দ আসে তখন কিছু দেয়, পৌরসভার মেয়রও সহযোগিতা করেন।
যতদিন রাজা ক্য সাইন প্রু বেঁচে ছিলেন ততদিন অনাথালয় নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না কারো। কারণ সবচেয়ে বড় ডোনার ছিলেন তিনি। স্কুলের টিচারদের বেতনও তিনি দিতেন। যখনই টানাটানি পড়ে যেত এগিয়ে আসতেন।
শুধু রাজা না, রানীও নানাভাবে সাহায্য করতেন।
নেলী বলেন, “বাচ্চাদের চাল নেই, আমার মাকে দেখেছি আশপাশের অন্যদের বলতেন আপনারা মুঠো মুঠো চাল রাখেন বাচ্চাদের জন্য, আমি নিজেই সংগ্রহ করবো। অন্দরমহলে থেকেও আমার মা এ অনাথালয়ের পেছনে অনেক অবদান রেখেছেন। নাপ্পি ছাড়া পাহাড়িদের চলে না। এই নাপ্পিটা কিন্তু সরবরাহ করেন আমার মা।”
কথা হয় অনাথালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র চিরঞ্জিত তঞ্চঙ্গ্যার সঙ্গে। সে বলে, “এখানে ভালো আছি। থাকতে কষ্ট হয় না। আমার বাড়ি অনেক দূরে। ওখানে স্কুল নেই। আমার বাবাও নেই। তাই এখানে ভর্তি হয়েছি।”
এছাড়া কো য়াং শৈ, মুং পু সে, হ্লা মং সিং, মং কি সুসহ বেশ কিছু বাচ্চার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- তারা এখানে যেটুকু সুবিধা পায় তা নিয়েই তারা খুশি। কারণ এখানে যতটুকু তারা পায়, তাদের বাড়িতে থেকে তার সিকি অংশ পায় না।
স্কুলটি এখনো সরকারি হয়নি। বাচ্চাদের জন্য কোনো প্রাইভেট টিউটর নেই। স্কুলের চারজন শিক্ষক যা পড়ান তাই। একটি বিশাল হলরুমে সবার জন্য একটি করে সিট বরাদ্দ রয়েছে। সেখানেই তারা পড়াশুনা করে। তারপরেও তাদের রেজাল্ট খারাপ না।
বাচ্চাগুলোকে যদি একটু গাইড করা যায় তাহলে তারা ভালো করবে আশা প্রকাশ করেন ডনাই প্রু নেলী।
নেলী বলেন, “টু অথবা থ্রিতে যখন একটা বাচ্চাকে ভর্তি করা হয়, তখন আমাদের খুব কষ্ট করতে হয়। তাদের খাওয়ানো, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, ম্যানার শেখানো। তবু বলতে হয় খুব লক্ষ্মী আমাদের ছেলেরা। দেখেন চারদিকে কোনো ওয়াল নেই। তবু পালিয়ে গেছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। বাইরে গিয়ে মারামারি করেছে, দোকান থেকে চুরি করেছে এমন কোনো রেকর্ড আমার বাচ্চাদের নেই।”
স্কুলের
প্রাক্তণ ছাত্ররাও অনেকে মায়া ছাড়তে পারেনি। অনেকে কাজ করছেন আবার পড়াশুনা
করছে। অর্থের অভাবে রাঁধুনীও রাখা যায় না অনেক সময়। বাচ্চারা নিজেরা পালা
করে রান্না করে। তারপরও তাদের মধ্যে ক্লান্তির কোনো চিহ্ন নেই।
একটি রুমে থাকে ৩৫-৪০ জন ছাত্র। প্রত্যেক রুমেই দোতলা বেড। দু’হাত বাই চার হাত তাদের আবাস। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্র তাদের বিশাল। এখানে ঘুমিয়েই তারা স্বপ্ন দেখে আলোকিত বান্দরবান, আলোকিত জীবনের।
কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকার ও জেলা প্রশাসন যদি পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এদিকে একটু সুনজর দেন, তবে এসব শিশুও অবদান রাখতে পারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে।

অনাথালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, শিক্ষাই সব ধরনের পশ্চাদপদতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান হাতিয়ার। এমনই এক সেবামুলক প্রতিষ্ঠান বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয়। এ অনাথালয়ের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও প্রতিষ্ঠানের সংগঠক সদ্য প্রয়াত ১৬তম বোমাং রাজা ক্য সাইন প্রু এর মেয়ে, রাজকন্যা ডনাই প্রু নেলীর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর আসিফ আজিজ ও মীর সানজিদা আলমের। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নূর এ আলম।
সেসময় বান্দরবান (বান্দরবান জেলা ছিল না) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্য সাইন প্রু ই মূলত এ অনাথালয় পুরোদমে শুরু করেন। অনাথালয়ের জায়গাটা অনাথালয়ের নামে একোয়ার করেন। সাধারণ সম্পাদক হন ধর্মীয় গুরু বা শ্রমণরা আর সভাপতি হন ক্য সাইন প্রু।
১৯৯২ সালে অন্য একজন অনাথালয়ের দায়িত্ব নেন। এ সময় অনাথালয়ের অবস্থা বেশ দরিদ্র হয়ে পড়ে। ১৯৯৪ সালে ক্য সাইন প্রু পুনরায় দায়িত্ব নেন। এর পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ক্য সাইন প্রু যখন থেকে দায়িত্ব নেন তখন থেকে বাবার সঙ্গে কাজ করতেন তার কন্যা ডনাই প্রু নেলী।
এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কথা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “বাবার পাশাপাশি আমি বাচ্চাদের দেখাশোনা করতাম। তারপর এক বার্ষিক সম্মেলনে শ্রমণরা বললেন- একজন নারী দরকার আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য, যিনি মায়ের মতো কাজ করবেন। ১৯৯৯ সাল থেকে মূলত আশ্রমের সঙ্গে আমার পুরোপুরি সম্পৃক্ত হওয়া। সাংগঠনিক হিসেবে এখানো আছি। যদিও নিজেকে তা মনে করি না। আমি মনে করি, আমি এদেরই মা। ১২০ জন বাচ্চার মা। মাঝে মাঝে ১০০ জন হয়ে যায় অর্থনৈতিক সংকটের জন্য।”
মূলত দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে বাচ্চারা এ অনাথালয়ে ভর্তি হয়। দশম শ্রেণি পর্যন্ত থাকতে পারে। বর্তমানে রয়েছে ১২২ জন ছাত্র। আগে শুধু মারমা সম্প্রদায় ছিল, এখন মারমা ছাড়া চাকমা, খিয়াংসহ অন্য সম্প্রদায়ের বাচ্চারাও আসছে।
মূলত দ্বিতীয় ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাচ্চা বেশি ভর্তি করা হয়। ‘বান্দরবান বুদ্ধ অনাথালয় নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামে একটা জুনিয়র স্কুল আছে যেটা সম্পূর্ণ বৌদ্ধ অনাথালয়ই চালায়। সে স্কুলের কারণেই মূলত ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাচ্চা বেশি ভর্তি কারানো হয়। এ বছর ৬ষ্ঠ ও ৩য় শ্রেণির বাচ্চা বেশি ভর্তি করানো হয়েছে। ৯ম শ্রেণিতে উঠলে বাচ্চাদের অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হয়। তবে এখানে থাকতে পারে তারা।
তবে বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয় নাম হলেও এখানে সবাই অনাথ নয়। যদিও এটা করা হয়েছিলো অনাথদের কথা চিন্তা করেই। মূলত অনাথ ছাড়াও যাদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর, সুযোগ-সুবিধা নেই সেসব এলাকা থেকে আসা বাচ্চাদের এখানে ভর্তি করা হয়। মূল উদ্দেশ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে নেলী বলেন, “যে সমস্ত এলাকার বাচ্চারা সুবিধাবঞ্চিত, যাদের এলাকায় স্কুল নেই, তাছাড়া পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আর বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা এখানে তাদের দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। আমাদের শ্রমণ, ভান্তে, বাবা ছিলেন আমরা আছি। আমরাই দেখাশুনা করছি।”
তিনি বলেন, “এরা অনেকটা এতিমের মতো থাকে। আমরা হয়ত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের ভালো খাওয়াতে পরাতে পারি না। সাংগ্রাইয়েও আমরা হয়ত তাদের ভালো খাবারও মুখে তুলে দিতে পারবো না। অন্যরা নতুন কাপড় কিনছে, আনন্দ করছে। কিন্তু আমার এ ১২০ জন বাচ্চা বাড়ি যাবে না। এখানে তাদের একবেলা ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে অনেক কষ্টে। এ ছাড়া তাদের জন্য আর কিছু করা সম্ভব নয়।”
এখানে থেকে তারা এসএসসি পাশ করে। এরপর আর এখানে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখান থেকে যারা মেধাবী তাদের ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করে রাজপরিবার। তাছাড়া অনাথালয়ের সঙ্গে জড়িত শুভাকাঙ্ক্ষীরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। নেলী নিজেই এখন পর্যন্ত এমন ১৬-১৭ জন ছাত্রের খরচ চালিয়েছেন, যারা অনার্স শেষ করেছে, ডিগ্রি শেষ করেছে। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের নানা সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
অনথালয় থেকে এসএসসি পাশ করে অনেকে বিভিন্ন দেশে গেছে। কেউ ভোকেশনাল লাইনে পড়েছে। কিন্তু মাস্টার্স পাশ করেছে এমন নেই। তবে অনেকে ছোট-খাট সরকারি চাকরি করছে। স্কুলের সহকারি শিক্ষক হয়েছে ৪-৫ জন।
অনাথালয়ে মেয়ে শিশুরা নেই কেন এমন প্রসঙ্গ উঠলে নেলী বলেন, “আমার বাবার একটা বড় স্বপ্ন ছিল মেয়েদের রাখবে। কিন্তু এর প্রধান সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সংকট। আশ্রমে ১০ একর জায়গা রয়েছে। এখানে কোনো বাউন্ডারি নেই। মেয়ে রাখতে গেলে আমার বাউন্ডারি লাগবে, আরেকটু নিরাপত্তা লাগবে। সে ব্যবস্থা আমরা এখনো করতে পারিনি। বাবা বলতেন এ জায়গাটা ছেলেদের জন্য থাক। উপরে মেয়েদের জন্য ব্যবস্থা করবো।”
তিনি আরও বলেন “আমাদের একজন হাউস টিউটর দরকার। কিন্তু আমরা অর্থনৈতিক কারণে রাখতে পারছি না। বাবুর্চিও নেই। আমাদের ছেলেরা নিজেরা রান্না-বান্না করে খায়। এখানে ডিপ টিউবওয়েল বসানো সম্ভব। কিন্তু টাকার অভাবে সেটা করা যায় না। এখানে নলকূপ রয়েছে, কিন্তু বছরের দু’তিন মাস পানি থাকে। এখন পুকুরের পানি ব্যবহার করছি।”
পাশে একটি ব্রিগেড থাকার কারণে সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। এ মূল ভবন উদ্বোধন করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম শাখাওয়াৎ হোসেন। বিগেডের বুকের মাঝেই আশ্রম। বলতে গেলে তারাই সুরক্ষিত করে রেখেছে এ আশ্রম।
তিনি বলেন, “যখনই যে ব্রিগেড কমান্ডার আসেন আমরা তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। আমাদের সমস্যাগুলো বললে তারা আমাদের সহযোগিতা করেন। গতবছর একটি ভবনও তারা তৈরি করে দিয়েছিলেন শুধু বাবার সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্ক থেকে।”
অনাথালয়ের নিজস্ব দোকান ভাড়া, উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে কিছু সাহায্য পায়। কিন্তু একশ’ বিশ জন বাচ্চা, অথচ ভাতা পায় মাত্র ৪০ জন।
এক এক জন ছেলের পেছনে মাসে অনাথালয়ের ন্যূনতম খরচ হয় ১৬০০ টাকা করে। জেলা পরিষদে যখন কিছু বরাদ্দ আসে তখন কিছু দেয়, পৌরসভার মেয়রও সহযোগিতা করেন।
যতদিন রাজা ক্য সাইন প্রু বেঁচে ছিলেন ততদিন অনাথালয় নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না কারো। কারণ সবচেয়ে বড় ডোনার ছিলেন তিনি। স্কুলের টিচারদের বেতনও তিনি দিতেন। যখনই টানাটানি পড়ে যেত এগিয়ে আসতেন।
শুধু রাজা না, রানীও নানাভাবে সাহায্য করতেন।
নেলী বলেন, “বাচ্চাদের চাল নেই, আমার মাকে দেখেছি আশপাশের অন্যদের বলতেন আপনারা মুঠো মুঠো চাল রাখেন বাচ্চাদের জন্য, আমি নিজেই সংগ্রহ করবো। অন্দরমহলে থেকেও আমার মা এ অনাথালয়ের পেছনে অনেক অবদান রেখেছেন। নাপ্পি ছাড়া পাহাড়িদের চলে না। এই নাপ্পিটা কিন্তু সরবরাহ করেন আমার মা।”
কথা হয় অনাথালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র চিরঞ্জিত তঞ্চঙ্গ্যার সঙ্গে। সে বলে, “এখানে ভালো আছি। থাকতে কষ্ট হয় না। আমার বাড়ি অনেক দূরে। ওখানে স্কুল নেই। আমার বাবাও নেই। তাই এখানে ভর্তি হয়েছি।”
এছাড়া কো য়াং শৈ, মুং পু সে, হ্লা মং সিং, মং কি সুসহ বেশ কিছু বাচ্চার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- তারা এখানে যেটুকু সুবিধা পায় তা নিয়েই তারা খুশি। কারণ এখানে যতটুকু তারা পায়, তাদের বাড়িতে থেকে তার সিকি অংশ পায় না।
স্কুলটি এখনো সরকারি হয়নি। বাচ্চাদের জন্য কোনো প্রাইভেট টিউটর নেই। স্কুলের চারজন শিক্ষক যা পড়ান তাই। একটি বিশাল হলরুমে সবার জন্য একটি করে সিট বরাদ্দ রয়েছে। সেখানেই তারা পড়াশুনা করে। তারপরেও তাদের রেজাল্ট খারাপ না।
বাচ্চাগুলোকে যদি একটু গাইড করা যায় তাহলে তারা ভালো করবে আশা প্রকাশ করেন ডনাই প্রু নেলী।
নেলী বলেন, “টু অথবা থ্রিতে যখন একটা বাচ্চাকে ভর্তি করা হয়, তখন আমাদের খুব কষ্ট করতে হয়। তাদের খাওয়ানো, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, ম্যানার শেখানো। তবু বলতে হয় খুব লক্ষ্মী আমাদের ছেলেরা। দেখেন চারদিকে কোনো ওয়াল নেই। তবু পালিয়ে গেছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। বাইরে গিয়ে মারামারি করেছে, দোকান থেকে চুরি করেছে এমন কোনো রেকর্ড আমার বাচ্চাদের নেই।”
একটি রুমে থাকে ৩৫-৪০ জন ছাত্র। প্রত্যেক রুমেই দোতলা বেড। দু’হাত বাই চার হাত তাদের আবাস। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্র তাদের বিশাল। এখানে ঘুমিয়েই তারা স্বপ্ন দেখে আলোকিত বান্দরবান, আলোকিত জীবনের।
কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকার ও জেলা প্রশাসন যদি পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এদিকে একটু সুনজর দেন, তবে এসব শিশুও অবদান রাখতে পারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে।
No comments