কিছু অলিখিত সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার সময় এখন

এই পৃথিবীতে লিখিত চুক্তির সংখ্যা যত, অলিখিত সামাজিক চুক্তি তার চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি। আমরাসহ সমগ্র বিশ্ববাসী যে শৃংখলার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করছি, তা সম্ভব হয়েছে সামাজিক অলিখিত চুক্তিগুলোর কল্যাণেই। প্রকৃতির রাজ্য (State of nature) থেকে ধীরে ধীরে ‘রাষ্ট্র’ নামক যে ভৌগোলিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটল, সেটাও অলিখিত সামাজিক চুক্তিরই (Social contract theory of state) ফসল। সে থাক। বস্তুত মানুষ যত না ভয় করে রাষ্ট্রীয় লিখিত আইনকে, তার চেয়ে অনেক বেশি মান্য ও সমীহ করে অলিখিত সামাজিক চুক্তি। সময়ের কথাই ধরা যাক। সময় অখণ্ড, এর কোনো শুরু-শেষ নেই, নেই এককও (unit), থাকার কথা নয়, সময়ের একক তৈরি করলে এর সৌন্দর্যও নষ্ট হয়। কিন্তু আমরা আমাদেরই সুবিধার্থে সময়ের একক বের করে চুক্তি করে তা মেনে চলেছি। বলছি এটা ২০১৭ সাল, আজ বৃহস্পতিবার, এখন দশটা বাজে ইত্যাদি। এতে কত সুবিধা! প্রেমিকাকে বলতে পারছি, তিনটায় শাহবাগে থেকো, সে-ও সময়মতো চলে আসছে। সময়ের একক না থাকলে মিলতাম কীভাবে? অথবা স্ত্রীকে বলতাম কীভাবে- আজ না আমাদের দশম বিয়ে বার্ষিকী! এক রসিক কর্মচারী রোজ দেরি করে অফিসে যায়। একদিন তার বস্ বললেন, কী রফিক সাহেব, সময়মতো অফিসে আসেন না কেন?
তিনি শো’কজের জবাব দিলেন এই বলে- সময়? সময় আবার কী? বলেন তো সপ্তাহ যদি হতো পাঁচ দিনে আর মাস ১৫ দিনে, তাহলে পলাশীর যুদ্ধ কত সপ্তাহ আগে এবং কত সালে সংঘটিত হয়েছিল? ভাষাও একটি সামাজিক অলিখিত চুক্তি। পৃথিবীতে ভাষা ও উপভাষা মিলে যে সংখ্যাটা দাঁড়ায়, তা কয়েক লাখ তো হবেই। পানি বদলায় প্রতি চার মাইল অন্তর আর ভাষা সূক্ষ্মভাবে প্রতি দুই মাইল পরপর। তো প্রতিটি ভাষারই রয়েছে অসংখ্য শব্দ এবং কোন্ শব্দ উচ্চারণ করলে কী বুঝব, সেটারও রয়েছে অলিখিত চুক্তি। যেমন, ‘বুক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে বাঙালির চুক্তি অনুযায়ী বুঝতে হবে শরীরের গলা ও পেটের মধ্যবর্তী প্রশস্ত জায়গা আর ইংরেজ জাতি এই মর্মে চুক্তি করেছে যে, বুঝতে হবে দুই মলাটের মধ্যে আবদ্ধ মুদ্রিত কিছু কাগজ। চুক্তি করে মানুষ কত কাণ্ডই না করছে। তার একটি বাজে চুক্তি হচ্ছে, সে যখন খাদ্য কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে গরু-ছাগলের মতো নিরীহ পশুও হত্যা করে, তখন তার সমগোত্রীয়রা অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতি তাকে হিংস্র বলে না; কিন্তু কোনো পশুর আগ্রাসী আচরণ দেখলেই একজোটে বলে উঠবে- হিংস্র বাঘ অথবা জংলি হাতি, ওটাকে হত্যা করো অথবা খাঁচায় পোরো। আবার দেখুন, মানুষ ভালো বা মন্দ, সৎ বা অসৎ, নিষ্ঠুর বা দয়ালু- তবে কেউই অদ্ভুত নয়। অদ্ভুত যদি, তাহলে সবাই। গরু তো সব মানুষকেই অদ্ভুত প্রাণী ভাবে। অথচ চুক্তি করে সব ভাষাতেই একটা শব্দ যুক্ত করেছি আমরা- ‘অদ্ভুত’। মানুষকে আমরা ভাগ করেছি এভাবে- নরমাল, সাব-নরমাল, সুপার-নরমাল, প্যারা-নরমাল ইত্যাদি। শেষের তিন শ্রেণীর যে কোনো একটির কাউকে দেখলেই, সেই যে চুক্তি করেছিলাম,
সমস্ব^রে বলে উঠি- লোকটা কী অদ্ভুত! সমকামিতা যেমন জেনেটিক সংকট, কোনো পাপ নয়, ব্যবহারিক অস্বাভাবিকতাও (Behaviorial abnormality) তেমন মানসিক সমস্যা। মানুষ যখন পরিবেশগত কোনো চাপ নিতে পারে না, তখন সে অন্যদের চেয়ে ভিন্ন আচরণ (maladapted behaviour) করে। কিন্তু কোনোক্রমেই সে অদ্ভুত নয়। এমনকি সৌন্দর্যের ব্যাপারেও রয়েছে সামাজিক অলিখিত চুক্তি। ঐশ্বরিয়া যে বিশ্বসুন্দরী হয়ে গেল, সেটা কোন্ মাপকাঠিতে? কে কার সৌন্দর্য মাপে! ঐশ্বরিয়া হতে পারল, আফ্রিকার ওই থ্যাবড়া নাকের কালো মেয়েটি প্রিলিমিনারিতেও যেতে পারল না কেন? অথবা আমার প্রেমিকা? ইন্টেলেকচুয়াল বিউটিতে যে মার্কিং করা হয়েছে, সেটা একটা স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতে বুঝলাম। কিন্তু শারীরিক সৌন্দর্যের আবার স্ট্যান্ডার্ড কী! বস্তুতে কি দোষ থাকে, নাকি দোষটা মাথার? আসলে বিচারকরা একটা অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল যে, সমাজের সাধারণ সৌন্দর্যচেতনার ভিত্তিতেই দিতে হবে নম্বরটা। আমি যদি সেই ক্রাইটেরিয়া না মানি? এক কথায় বললে আমরা একটা অলিখিত চুক্তির অধীনে থেকে ঐশ্বরিয়াকে বিশ্বসুন্দরী মেনে নিয়েছি।
২. হাল্কা কথা বেশি হয়ে যাচ্ছে। আসলে অলিখিত সামাজিক চুক্তিগুলোর রয়েছে অসীম ক্ষমতা। এই চুক্তির সুবাদেই নির্জন রাস্তায় স্বর্ণালংকারশোভিত নারী হেঁটে যায় নির্ভয়ে (চুক্তি ভঙ্গকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম), দুর্বল কৃষকের গরু কেড়ে নেয় না শক্তিমান মাতব্বর, যা না করলেও লিখিত আইন দোষ ধরবে না, মানুষ সেই সম্মান দেখায় আরেক মানুষকে। বিয়েটা হল লিখিত চুক্তির মাধ্যমেই; কিন্তু সেটা টিকে আছে অলিখিত অসংখ্য সমঝোতার ভিত্তিতেই। অলিখিত সামাজিক চুক্তির এতই যখন ক্ষমতা, তখন বর্তমান বাংলাদেশে আমাদেরই স্বার্থে আমরা তৈরি করতে পারি বেশ কিছু সামাজিক চুক্তি। সেগুলো লিপিবদ্ধ করে তাতে নাগরিক সম্প্রদায়ের স্বাক্ষর করারও দরকার নেই। হ্যাঁ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থা দেশের সার্বিক শৃংখলা রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা প্রকারান্তরে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর। হজরত মোহাম্মদ (সা.)ই শেষ নবী, যদি তিনি তা না হতেন এবং অন্য কোনো প্রফেট আবির্ভূত হয়ে বলতেন- তোমরা ধৈর্য ধরো, এই ব্যর্থতা সাময়িক- আমরা সেই প্রফেসিকেই অবলম্বন করতাম। কিন্তু না, লক্ষণ বলছে এই ব্যর্থতা সাময়িক নয়, এর নিরাময়ও সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে গুল্লি মারো ধৈর্য-টৈর্য, কিছু সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বস্ত থাকতে হবে সেগুলোর প্রতি। যেমন ধরুন, সিএনজি আটোরিকশাচালক মিটারে যেতে চাইছে না।
ভাড়া হাঁকছে অস্বাভাবিক। চুক্তিটি হবে এমন, আশপাশের সবাই মিলে ত্রিচক্র যানটিসহ তাকে নিকটবর্তী থানায় নিয়ে গিয়ে সোপর্দ করতে হবে পুলিশের কাছে। সেখানে দায়ের করতে হবে আইন ভঙ্গের মামলা। অথবা ধরুন, বাস-ড্রাইভার বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে ওভারটেক করে চলেছে অথবা কন্ডাক্টর হাঁকছে বেআইনি ভাড়া। এবারের চুক্তিটি হল, দাঁড়িয়ে যেতে হবে সব প্যাসেঞ্জারকে, এরপর বাস থামিয়ে এখানেও থানা-পুলিশ। এক্ষেত্রে সমস্যা দুটি। প্রথমত, এই কার্যক্রমকে অনেকে বিড়ম্বনা ভাবতে পারেন। কিন্তু সইতে হবে এই বিড়ম্বনা এবং তা পরবর্তী নিশ্চিন্ত যাত্রাগুলোর স্বার্থে। ধরে নেয়া যায়, এ ধরনের বেশ কিছু কাণ্ড ঘটাতে পারলে ড্রাইভার সম্প্রদায়ের অনিয়ম কমে আসবে সহনীয় মাত্রায়। দ্বিতীয় সমস্যাটি অবশ্য সংকটে রূপ নিতে পারে। দেখা গেল, সতীর্থের পক্ষ নিয়ে ড্রাইভারকুল গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। নাচুনি বুড়িকে আবার ঢোলের বাড়ি দিয়ে উৎসাহিত করছে পরিবহন শ্রমিক নেতারা। দায়িত্বটা তখন বর্তাবে সরকারের ওপর। যেতে হবে অ্যাকশনে। জনজীবনে বিঘ্ন ঘটানো এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টির অপরাধে জেলে পুরতে হবে যতসংখ্যক সম্ভব শ্রমিকনেতা ও ধর্মঘটী শ্রমিককে। ভয়টা আসলে বনে নয়, মনে। বলে দেয়া যায়, কয়েকদিনের দুর্ভোগ ছাড়া এই অ্যাকশনে জাতির কোনোই ক্ষতি হবে না। সময়কে যেহেতু আটকে রাখা যাবে না, রাষ্ট্রেরও সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ায় কোনো সমস্যা হবে না। জনদুর্ভোগের যে সমস্যা, সেটাও থাকবে না কয়েকদিন পর। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে অনেকে বলতেন ‘বুড়ো সাত্তার’, এই বুড়োই আশির দশকের গোড়ায় রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় যুবকের চেয়ে বেশি সাহস দেখিয়েছিলেন। ব্যাংকিং সেক্টরে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের একটা সময় বেঁধে দিয়ে সেই সময় পার হওয়ার পর পাইকারি হারে বরখাস্ত করেছিলেন এ খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এতে কি বাংলাদেশে ব্যাংকিং প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে? কয়েকদিন গ্রাহক ভোগান্তির পর সবকিছুই নরমাল। পেটের দায় বড় দায়, এই দায়ের কাছে ফাজলামো বেশিদিন চলে না।
শুধু পরিবহন শ্রমিক নয়, রোগীদের জিম্মি করে ধর্মঘটে যায় যে ডাক্তার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন বন্ধ রেখে ছাত্রসমাজকে শিক্ষাবঞ্চিত করে যে শিক্ষক, সবার ক্ষেত্রেই কঠোর হতে হবে সরকারকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বলে তেমন কিছু ছিল না, বস্তুত সর্বক্ষেত্রেই ছিল অচলাবস্থা। তাতে কি বাঙালি মরে গেছে? বরং নয় মাসের দুর্ভোগ আমাদের এনে দিয়েছে যুগ-যুগান্তরের স্বস্তি। ভয়টা কীসের? কার কাছে যেন এক পাগলের গল্প শুনেছিলাম। পাকিস্তান আমলে ঢাবির রোকেয়া হলের সামনে সেই পাগল ঘোরাঘুরি করত। তার একটা অশ্লীল খেলা ছিল- বিশ্রী মুখভঙ্গি করে মেয়েদের ডেকে বলত- অ্যাই দেখবি? দেখবি? মেয়েরা ভয়ের চোটে দৌড়ে পালাত। পাগল মজা নিত এই দৌড় দেখে। তো একদিন এক মেয়ে সাহস করে বলেই ফেলল, হ্যাঁ দেখব! যেই না বলা, পাগল ... উল্টোদিকে দে দৌড়! ওই পাগলই শুধু ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক’ নয়, মাতাল মাত্রই তালে ঠিক। এই তাল হল জীবিকা। জীবিকাধর্মের ওপর আছে নাকি কোনো ধর্ম? এই ধর্মের শক্তিবলেই কিছু লোকের শাস্তি দেখে বাকিরা সাইজ হয়ে যাবে। বর্তমান বাংলাদেশে অনেক অনেক সামাজিক চুক্তির সঙ্গে একটি বড় চুক্তি জরুরি ভিত্তিতে সম্পাদন করা দরকার। আমাদের আজকের এজেন্ডা জঙ্গিবাদ নয় কিংবা নয় ’৭১-এর গণহত্যা অথবা জংলিভূমিতে ভদ্রসমাজের কাউকে দেখা গেলে ট্রাইবাল নেতার নির্দেশে যে নরবলি ঘটে তা-ও নয়, আমরা এখন বলব তথাকথিত এই সভ্য সমাজেই নির্দোষ, নিষ্কলংক নর-নারী ও শিশুর অকালমৃত্যুর কথা। পণ্যের আগাম মূল্য পরিশোধের মতো আগাম জীবনশোধ করে যাচ্ছে এদেশের মানুষ একের পর এক।
ড্রেন দিয়ে রক্ত গড়ায়, মানুষ বন্যপ্রাণীর আকার ধারণ করে, কখনও সতেরো-আঠারো বছরের অর্বাচীন, জীবনের মূল্য পরিমাপ করতে শেখেনি যে তরুণ এখনও, তার গুলি কিংবা কোপের আঘাতে মাটিতে লুটায় অনেক রহস্য, অনেক খেসারত দিয়ে গড়া মানবদেহ- আমরা নির্বাক, বড়জোর হতবাক, যেন যন্ত্রণাকাতর সেই দৃশ্য দেখছি সিনেমার পর্দায় টিকিট কেটে। আহ্-উহ্, সে তো নিষ্ঠুরতা দেখলে মানুষ করেই থাকে, এটা তার স্বভাবেরই অন্তর্গত। এর অতিরিক্ত কী এমন করছি এই সুঠাম দেহ নিয়ে? এর চেয়ে একটা সামাজিক চুক্তি করলে হয় না? যখন যেখানেই দেখব কিরিচ অথবা পিস্তল, তা যত চকচকেই হোক, সমস্বরে একটি মাত্র শব্দে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করব আকাশ-বাতাস- র্ধ! একই সঙ্গে চতুর্দিকব্যাপী তৈরি করা যায় না কি মানবব্যারিকেড? ব্যাটা পালাবি কোথায়? স্বীকার করতেই হয়, আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে দেহ কুলোয় না। কিন্তু সেটা একক দেহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একক যখন সমষ্টি, তখন? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে পড়েছিলাম- Quantitative change brings about qualitative change- পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। এক যদি শক্তি হয়ে থাকে, অনেক তাহলে মহাশক্তি। এই শক্তি তৈরি করে নেতৃত্বও। ৭ মার্চে যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একজন শ্রোতা বসে থাকত, পারতেন কি বঙ্গবন্ধু অমন একটি বক্তৃতা দিতে? হ্যাঁ, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যর্থ, তখন আমরাই নিজস্ব নিয়মে গড়ে তুলি না কেন এক নতুন মতবাদ- collectivism অর্থাৎ সমষ্টিতন্ত্র। এই মতবাদে যদি জেগে উঠতে পারি একবার, স্যালাইন খোঁজারও সময় পাবে না সেই দুরাত্মার দল। হতে পারে, সমষ্টিতন্ত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে কিছু প্রাণ যাবে। হ্যাঁ, কখনও কখনও এমন সময় আসে, যখন জীবনের দামে কিনতে হয় সুন্দর ভবিষ্যৎ।
’৭১-এ তো আমরা লাখের হিসাবে দিয়েছিলাম প্রাণ, এবার না হয় ডজনের হিসাবে দেব। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মরণশীলতার সংস্কৃতিই এখন পার্মানেন্ট বাংলাদেশে, বাকি সব টেমপোরারি। পার্মানেন্টকে তাই এখন বলতে হবে- বাছা, তুমিও টেমপোরারি। অজ্ঞ নিয়ম মেনে চলে আর বিজ্ঞ বানায় নিয়ম। অজ্ঞ থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে, এখন জেগে উঠতে হবে বিজ্ঞতায়। কিছু প্রাণের বিনিময়ে অসংখ্য প্রাণ বাঁচবে- এটাই তো ইতিহাসের শিক্ষা। আমরা নিশ্চিত হতে পারি, দু-চার-দশটা সামষ্টিক কীর্তি ঘটাতে পারলে দেশে অন্তত লোকালয়ের নির্বিচার হত্যার সংখ্যা কমে আসতে থাকবে ক্রমেই। একটা তর্ক উঠবেই, প্রথম চিৎকারটা কে দেবে? এত লোক থাকতে সে-ই বা কেন নেবে ঝুঁকি? এটা সেই ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’-এর মতো কূটতর্ক। এই মানুষই নির্ঘাত মৃত্যু জেনে সায়ানাইডের স্বাদ পরখ করতে চেয়েছে এবং মরেছে। জঙ্গিরা যদি আত্মঘাতী হতে পারে, তাহলে বেঁচে থাকার স্বার্থে এবং বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সঙ্গে নিয়েই ঝুঁকি নেয়া যাবে না কেন? নাকি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোথাও লেখা রয়েছে- শুধু স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনেই ঝুঁকি নেয়া চলবে, নিরাপদ জীবনের লক্ষ্যে তা করা যাবে না? মনোবিজ্ঞানের এক অব্যাখ্যেয় নিয়মে বাঙালি এক অসম্ভব দ্রুততায় সয়ে যাওয়ার ও মানিয়ে নেয়ার অভ্যাস রপ্ত করেছে। তার হৃদয় এখনও অক্ষত আছে বটে, অধিকাংশ অনুভূতিই মরে গেছে। তার অনুভূতি এখন কেবল নিজেকে নিয়ে, পরিবার নিয়ে- রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনাচারে বৃক্ষের চেয়ে স্থবির, নিশ্চল সে। বুকে থাবা মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ার কই গেল সেই দিন! বলতেই হয়, সংসারের অসংগতি, মন খারাপ করা খুঁটিনাটি মানিয়ে চলা মহৎ বটে- তা সেটা স্ত্রী/স্বামীর, সন্তান কিংবা বাবা-মার, এমনকি বন্ধুর আচরণের সঙ্গেও; কিন্তু চতুর্দিকের অন্যায়-অনাচারের সঙ্গে মিলে যাওয়ার যে শিক্ষাটা নিলাম আমরা, সেটা কি সুশিক্ষা?
পুনশ্চ : গত কলামে একটি তথ্য দিয়ে লিখেছিলাম- চন্দ্রবিজয়ের পর দুটি বাদে পৃথিবীর সব ইংরেজি পত্রিকার প্রধান শিরোনামের ভাষায় কোনো তারতম্য ছিল না। এক পাঠক সেই ব্যতিক্রম দুটি জানতে চেয়েছেন। মনে নেই ভাই। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চাঁদ নিয়ে কত স্বপ্ন, জ্যোৎস্নার কত রাত! আবার দাদি-নানিরা মধুর মিথ্যা শোনাতেন- সেখানে নাকি এক বুড়ি চরকায় সুতা কাটে! তবে বুড়ি সুতা না কাটলেও শৈশবে আমরা ছড়া কাটতাম- ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা।’ মামা কখনও ভাগ্নে-ভাগ্নির কপালে টিপ দিতে আসেননি। তবে দুষ্ট ভাগ্নে আর্মস্ট্রং তার পিঠে এঁকে দিয়েছেন পায়ের ছাপ! আরেকবার স্যালুট আর্মস্ট্রং তোমায়। হ্যাঁ, ওই সময়টায় আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। তোপখানার আমেরিকান ইনফরমেশন সেন্টারে গিয়ে দেশটির পত্রপত্রিকা পড়তাম নিয়মিতই। টাইম ম্যাগাজিনের লিড আইটেমের শিরোনামটি মনে আছে- A small footprint but a giant leap for mankind- একটি ছোট্ট পদচিহ্ন, কিন্তু মানবজাতির জন্য দৈত্যাকৃতির এক বিশাল লম্ফ!
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.