মৌলভীবাজার আস্তানায় সোয়াতের অভিযান
সিলেটের
শিববাড়ীর আতিয়া মহলের পর মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় বুধবার
সন্ধ্যা থেকে সোয়াত অভিযান শুরু করেছে। অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন
হিটব্যাক’। সন্ধ্যায় অপারেশন হিটব্যাক চলার সময় থেকে উভয় পক্ষের মধ্যে
গুলিবিনিময় হয়। জঙ্গিরা সোয়াত টিমের দিকে একই সঙ্গে গুলি ও গ্রেনেড চার্জ
করে। বৃষ্টির মধ্যেই বাগানঘেরা ওই বাংলো ধাঁচের বাড়ির দিক থেকে টানা
গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে।
অন্ধকারে সমস্যা হওয়ায় চার ঘণ্টা পরিচালনার পর
রাত সাড়ে ১০টায় অপারেশন হিটব্যাক মুলতবি করা হয়। আজ ফের শুরু হবে এ অভিযান।
এ ছাড়া মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকার আরও একটি বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে।
এ বাড়িতেও জঙ্গিরা অবস্থান নিয়েছে। বড়হাট ও নাসিরপুরের বাড়ি দুটি একই
মালিকের। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা নিশ্চিত হওয়ার পর মঙ্গলবার রাত থেকে
নাসিরপুর ও বড়হাটের জঙ্গি আস্তানা দুটি ঘিরে রাখা হয়। জঙ্গিরা বিষয়টি বুঝতে
পেরে উভয় বাড়ির ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে থেমে থেমে গ্রেনেড ও গুলি
ছুড়তে থাকে। নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানীয় প্রশাসন এলাকা দুটিতে ১৪৪ ধারা
জারি করে। আস্তানা দুটির আশপাশের এলাকায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ
থেকে মাইকিং করে স্থানীয় জনগণকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো
হয়। এদিকে কুমিল্লার কোটবাড়ীর কাছে গন্ধমতি এলাকার একটি বাড়িতে জঙ্গি
আস্তানার সন্ধান পেয়ে ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও র্যাব। গাড়িচালক দেলোয়ার
হোসেনের নির্মাণাধীন তিন তলা ভবনে জঙ্গি আছে- এমন খবর পান আইনশৃংখলা
বাহিনীর সদস্যরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার
সদস্যরা বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে বাড়িটি ঘিরে রেখেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,
মৌলভীবাজারের দুটি জঙ্গি আস্তানার একটিতে তিন-চারজন, আরেকটিতে আরও কিছু
বেশি জঙ্গি থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। মৌলভীবাজারের পুলিশ
সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল যুগান্তরকে বলেন, নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে
পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে।
এলাকা পৃথক। দুটি বাড়ির দূরত্ব ২০
কিলোমিটার হলেও মালিক একজনই। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র্যাব-১১-এর
অধিনায়ক মেজর মোস্তফা কায়জার জানান, কুমিল্লায় সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানার
ভেতরে এখনও তল্লাশি শুরু হয়নি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর পদক্ষেপ নেয়া
হবে। মৌলভীবাজার থেকে আহমদুল হাসান আসিক, হোসাইন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক রাজা
জানান, মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাটের আস্তানাতে একজন নারীসহ কমপক্ষে তিন
জঙ্গি রয়েছে। অপরদিকে নাসিরপুরের আস্তানায় দুই নারীসহ অন্তত চার জঙ্গি
রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব জঙ্গি সক্রিয় হয়ে
ওঠে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বড়হাটের আস্তানায় তিনটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ
ঘটানো হয়। দুপুরে দুটি আস্তানা থেকে গুলি ও গ্রেনেড চার্জ করেছে জঙ্গিরা।
আতিয়া মহলে সেনা অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই মৌলভীবাজারে আরও দুটি জঙ্গি
আস্তানার সন্ধানে স্থানীয় জনগণের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। গোপন
সংবাদের ভিত্তিতে উভয় বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হন
আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তারা মঙ্গলবার রাতে একসঙ্গে বাড়ি দুটি
ঘিরে ফেলেন। দিনের বেলা ঢাকা থেকে রওনা দেয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম
অ্যান্ড টান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষায়িত টিম সোয়াত। বিকাল পৌনে
৫টার দিকে দলটি নাসিরপুরে পৌঁছে। এরপর তারা সময় নিয়ে প্রস্তুত হয়। সন্ধ্যা
৬টা ২০ মিনিটে নাসিরপুরের আস্তানায় অপারেশন হিটব্যাক শুরু করে। পুলিশের
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একাধিক
কর্মকর্তা জানান,
সম্প্রতি নব্য জেএমবির কয়েক জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তাদের
দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গোয়েন্দা
নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলে সেনা অভিযানে
নব্য জেএমবির সমন্বয়ক মাঈনুল ইসলাম মুসাসহ চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। ওই অভিযান
চলে টানা ১১১ ঘণ্টা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই এ দুটি আস্তানার সন্ধান
মেলে। জঙ্গি আস্তানার আশপাশে উৎসুক জনতার ভিড় কমাতে পুরো এলাকায় ১৪৪ ধারা
জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট, কুসুমবাগ এলাকা এবং
খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে পূর্বদিকে দুই কিলোমিটার এলাকায়
(নাসিরপুর গ্রামসহ) ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক
মো. তোফায়েল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বুধবার দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ
না দেয়া পর্যন্ত এসব এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। বড়হাট ও নাসিরপুরে পুলিশ
যে দুটি বাড়ি ঘিরে রেখেছে তার তত্ত্বাবধায়ক জুয়েল মিয়া যুগান্তরকে বলেন,
তিনি বাড়ির মালিক লন্ডন প্রবাসী সাইফুর রহমানের ফুফাতো ভাই। মঙ্গলবার রাতে
মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকায় সাইফুর রহমানের একটি বাড়ি ঘিরে রাখেন
পুলিশ সদস্যরা। ওই বাড়ির কর্মচারী তাকে ফোন করে বিষয়টি জানান। ওই বাড়ির
ভাড়াটিয়ার সঙ্গে নাসিরপুরের ভাড়াটিয়াদের যোগাযোগ ছিল। এ কারণে আমার সন্দেহ
হয়। পরে রাতেই পুলিশ আসে। ভোরে পুলিশ আমাকে দিয়ে দরজা নক করায়।
আমি
জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কি জঙ্গি? এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে গ্রেনেড
ছুড়ে মারে জঙ্গিরা। তিনি বলেন, গত জানুয়ারিতে নাসিরপুরের বাড়িটি জঙ্গিরা
ভাড়া নেয়। ভাড়াটে নিজের নাম বলেছে মাহফুজ। বাড়ি টাঙ্গাইলে। নিজেকে
‘প্রাণ-আরএফএলের’ ডিলার পরিচয় দিয়েছে। সাড়ে সাত হাজার টাকায় ভাড়া নেয়।
সেখানে আট সদস্য থাকে। বাড়িতে টিনের চালার তিনটি ঘর আছে। একটি ঘরে পরিবার
নিয়ে সে থাকে। একটি ঘরে এক রিকশাচালক থাকেন। অন্য ঘরটিতে ভাড়াটেরা থাকেন।
ওই বাড়ি থেকে রিকশাচালক ও তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। মৌলভীবাজার পৌরসভার
বাড়ির ভাড়াটে সম্পর্কে জুয়েল বলেন, ভাড়াটিয়া নিজের নাম বলেছে বেলাল। সেও
নিজেকে ‘প্রাণ-আরএফএলের’ ম্যানেজার পরিচয় দিয়েছে। জুয়েল আরও জানান, ভোরে
ভাড়াটের ঘরে কলিং বেল বাজালে ভেতর থেকে একজন দরজা খোলে। পুলিশ দেখে দরজা
বন্ধ করে দেয় সে। একটু পরে ঘরের ভেতরে শব্দ হয়। এর পরপরই ভেতর থেকে গ্রেনেড
ছুড়ে মারে। এদিকে সকালে সদরের বড়হাটের আস্তানায় জঙ্গিরা তাদের ঘিরে রাখা
অবস্থায় দেখে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং গ্রেনেড চার্জ করে। এ সময়
পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ে। জঙ্গিরা বাড়ির দোতলা থেকে গুলি ছোড়ে বলে জানিয়েছেন
রাজনগর থানার ওসি শ্যামল বণিক। পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়,
জঙ্গিদের কাছে বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড ও বিস্ফোরক রয়েছে। তাদের কাছে ছোট
আগ্নেয়াস্ত্রও রয়েছে। আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে জঙ্গিরা গুলি করে এর জবাব
দেয় বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান। বড়হাট আবুশাহ
দাখিল মাদ্রাসা গলিতে থাকা জঙ্গি আস্তানা ঘুরে এসে বুধবার বিকালে তিনি
সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, জঙ্গিদের কীভাবে নির্মূল করা যায়,
আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আলোচনা করে তা ঠিক করছেন। বাড়ি দুটিতে
দিনে দেখা যেত না কাউকে : মৌলভীবাজারে ঘিরে রাখা দুটি জঙ্গি আস্তানার
মধ্যে খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুরের আস্তানার একটি টিনশেড বাড়িতে থাকত তিন
নারী ও তিন পুরুষ। মাঝেমধ্যে দেখা যেত একটি শিশুকে। তবে দিনে ওই বাড়ির
কাউকে দেখা যেত না। এমনটি জানিয়েছেন পাশের বাড়ির মুন্না ও মেহেদী হাসান
রুবেল। স্থানীয়রা আরও জানান, বাড়ির দু-একজন পুরুষকে রাতে বের হতে দেখা যেত।
একটি শিশু মাঝেমধ্যে ওই বাড়ির বাইরে বের হতো। এ ছাড়া আর কাউকে কোনোদিন
দেখা যায়নি। গাছগাছালিতে ভরা টিনশেডের ওই বাড়িটি প্রায় এক একর জায়গার ওপর।
বড়হাট এলাকার স্থানীয়রা জানান, ওই বাড়ির এক ছেলেকে মাঝেমধ্যে স্থানীয় মসজিদে নামাজে দেখা যেত। এ ছাড়া ওই বাড়ির আর কাউকে তেমন একটা দেখা যায়নি। কম বসতিপূর্ণ এলাকায় আস্তানা গড়ে তুলছে নব্য জেএমবি : পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে জানায়, কম বসতিপূর্ণ এলাকাকে বেছে নিচ্ছে নব্য জেএমবি। এ ক্ষেত্রে তারা একটি সম্প্রদায়কে বেছে নিয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে তিনটি জঙ্গি আস্তানা এবং সিলেট বিভাগে নব্য জেএমবির আস্তানার সন্ধান মিলেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে মৌলভীবাজারে দুটি এবং কুমিল্লায় একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। পুলিশের জঙ্গি দমন বিভাগ বলছে, নব্য জেএমবি এখন কৌশল বদলেছে। তারা আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি করতে যেসব এলাকায় পুলিশের নজরদারি নেই সেসব এলাকা বেছে নিচ্ছে। এর আগে রাজধানী ও এর আশপাশে যেসব আস্তানার সন্ধান মিলেছিল সেসব আস্তানার অধিকাংশই ছিল ঘনবসতিপূর্ণ। তবে সম্প্রতি ঢাকার বাইরে যেসব আস্তানার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে এর অধিকাংশই কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। যেভাবে পাওয়া যায় মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান : পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কাছে নিশ্চিত তথ্য ছিল, সিলেট ও মৌলভীবাজারে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলেছে। অনুসন্ধান চালিয়ে সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম মুসা অবস্থান করছে- এমন তথ্য পাওয়া যায়। পরে সেখানে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালান। অভিযানের মধ্যেই আতিয়া মহলের বাইরে জঙ্গিরা আইইডির বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে দুই পুলিশসহ ছয়জন নিহত হয়। এরপর কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেয়। মঙ্গলবার রাতে বড়হাটে লন্ডন প্রবাসী সাইফুর রহমানের বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থানের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হন। পরে জানা যায়, ওই বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নাসিরপুরে তার আরও একটি বাড়ি রয়েছে। ওই বাড়িতেও জঙ্গিরা অবস্থান করছে। একটিতে অভিযান চালানো হলে অপর আস্তানার জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে পারে- এ কারণে সিদ্ধান্ত হয়, দুটি আস্তানায়ই একই সময়ে অভিযান চালানো হবে। পরে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় আস্তানা দুটি ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এ সময় আশপাশের বিভিন্ন বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হয়।
বড়হাট এলাকার স্থানীয়রা জানান, ওই বাড়ির এক ছেলেকে মাঝেমধ্যে স্থানীয় মসজিদে নামাজে দেখা যেত। এ ছাড়া ওই বাড়ির আর কাউকে তেমন একটা দেখা যায়নি। কম বসতিপূর্ণ এলাকায় আস্তানা গড়ে তুলছে নব্য জেএমবি : পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরকে জানায়, কম বসতিপূর্ণ এলাকাকে বেছে নিচ্ছে নব্য জেএমবি। এ ক্ষেত্রে তারা একটি সম্প্রদায়কে বেছে নিয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে তিনটি জঙ্গি আস্তানা এবং সিলেট বিভাগে নব্য জেএমবির আস্তানার সন্ধান মিলেছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে মৌলভীবাজারে দুটি এবং কুমিল্লায় একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। পুলিশের জঙ্গি দমন বিভাগ বলছে, নব্য জেএমবি এখন কৌশল বদলেছে। তারা আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি করতে যেসব এলাকায় পুলিশের নজরদারি নেই সেসব এলাকা বেছে নিচ্ছে। এর আগে রাজধানী ও এর আশপাশে যেসব আস্তানার সন্ধান মিলেছিল সেসব আস্তানার অধিকাংশই ছিল ঘনবসতিপূর্ণ। তবে সম্প্রতি ঢাকার বাইরে যেসব আস্তানার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে এর অধিকাংশই কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। যেভাবে পাওয়া যায় মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান : পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কাছে নিশ্চিত তথ্য ছিল, সিলেট ও মৌলভীবাজারে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলেছে। অনুসন্ধান চালিয়ে সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম মুসা অবস্থান করছে- এমন তথ্য পাওয়া যায়। পরে সেখানে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালান। অভিযানের মধ্যেই আতিয়া মহলের বাইরে জঙ্গিরা আইইডির বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে দুই পুলিশসহ ছয়জন নিহত হয়। এরপর কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেয়। মঙ্গলবার রাতে বড়হাটে লন্ডন প্রবাসী সাইফুর রহমানের বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থানের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হন। পরে জানা যায়, ওই বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নাসিরপুরে তার আরও একটি বাড়ি রয়েছে। ওই বাড়িতেও জঙ্গিরা অবস্থান করছে। একটিতে অভিযান চালানো হলে অপর আস্তানার জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে পারে- এ কারণে সিদ্ধান্ত হয়, দুটি আস্তানায়ই একই সময়ে অভিযান চালানো হবে। পরে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় আস্তানা দুটি ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এ সময় আশপাশের বিভিন্ন বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়া হয়।
কুমিল্লায় জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রেখেছে আইনশৃংখলা বাহিনী : কুমিল্লা ব্যুরো
জানায়, কুমিল্লায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে
আইনশৃংখলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। জেলার সদর দক্ষিণ থানাধীন কুমিল্লা
সিটি কর্পোরেশনের ২৪নং ওয়ার্ডের কোটবাড়ীর গন্ধমতি গ্রামের ওই বাড়িটির একটি
ফ্ল্যাটে কয়েকজন জঙ্গি শক্তিশালী বোমা ও বিস্ফোরক নিয়ে অবস্থান করছে- এমন
তথ্য নিশ্চিত হয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বুধবার দুপুর থেকে বাড়িটি ঘিরে
রেখেছেন। এদিকে এ ঘটনায় স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ
করে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের একদিন আগে এমন ঘটনায় পুরো
নির্বাচনী এলাকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এমন খবর শুনে কোটবাড়ী এলাকার
বাসিন্দাদের অনেককেই বাসাবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে দেখা গেছে। সন্ধ্যায় এ
বিষয়ে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ওই
বাড়িতে বোমা ও জঙ্গি আছে তা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এ
বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। বোমা নিষ্ক্রিয় দল ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে। তিনি
বলেন, ইতিমধ্যে আটক এক জঙ্গির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ বাড়িটি ঘেরাও করা হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর কোটবাড়ীর দক্ষিণ বাগমারা এলাকায় একটি সরু
রাস্তার পাশে ওই বাড়ির অবস্থান। বাড়ির দু’দিকে ধানক্ষেত ও গাছপালায় ঘেরা।
সামনে রয়েছে সড়ক। তিন তলা বাড়ির ছাদে ব্যবহৃত পোশাক ও বেডশিট রোদে শুকাতে
দেয়া ছিল।
ওই বাড়ির আশপাশ পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘিরে
রেখেছেন। মানুষ ও যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বুধবার বিকাল পর্যন্ত ওই
বাড়ি থেকে কেউ কথা বলেনি, গোলাগুলি বা বোমা বিস্ফোরণের কোনো শব্দ পাওয়া
যায়নি। জানা গেছে, বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন একজন গাড়িচালক। তার বাবার নাম
মো. আহম্মদ আলী। বাড়ি ঘেরাওর সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পুলিশের অভিযান
সম্পর্কে মো. আহম্মদ আলী যুগান্তরকে জানান, ‘বুধবার দুপুর ২টার পর
মাইক্রোবাসে আসা এক দল সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্য জিজ্ঞাসা করেছে,
দেলোয়ারের বাবা কে? আমি এগিয়ে এলে তারা বলেন, দেলোয়ারের বাড়িতে জঙ্গি আছে।
আপনার ছেলে কোথায়? আমার ছেলে গাড়ি চালাতে গেছে বলার পর তারা বাড়িতে থাকা
অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবাইকে বের করে আনার নির্দেশ দেন। নিচতলায় চারটি
ইউনিটের একটিতে জঙ্গিরা আছে, ওই ফ্ল্যাট বাদে বাকিগুলো থেকে বাসিন্দাদের
বের করে আনি। পরে পুলিশ আমার হাতে একটি তালা দিয়ে আমাকে বলে, জঙ্গিদের
ফ্ল্যাটে যেন ওই তালা আটকে দিই। তিনি বলেন, এর আগেই পুলিশ ওই ফ্ল্যাটে একটি
তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই ফ্ল্যাটে কারা আছে,
কতজন আছে তা জানি না। বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন মুঠোফোনে সাংবাদিকদের
বলেন, ওই ফ্ল্যাটে দু’জন ছাত্র থাকত। একজন মাঝেমধ্যে নামাজ পড়ত। তারা
দু’জনই সবার সঙ্গে মিশত। তাদের বাড়ি নোয়াখালী। তাদের কখনও জঙ্গি বলে মনে
হয়নি। স্থানীয় এক বাসিন্দা ফরিদ মিয়া বলেন, বুধবার দুপুর ২টার পরপর এক দল
সাদা পোশাকধারী পুলিশ ওই বাড়িতে যায়।
পরে তারা বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষকে
বলেছে, ওই বাড়িতে জঙ্গি আছে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করেন। এরপর আমরা এ
বাড়িতে যেতে না যেতেই আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের নিরাপদ স্থানে চলে
যেতে বলেন। তারা বলেন, আমরা একটি ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ অবস্থা দেখেছি। ওই
ফ্ল্যাটে কারা আছেন তা বাহির থেকে দেখা যায়নি। তারা জানান, বাড়িটির নিচতলায়
৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) আবদুল্লাহ
আল-মামুন জানান, বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এক বা একাধিক জঙ্গি এ বাড়ির
নিচতলায় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়িটি ঘেরাও করার পর দোতলার ম্যাচ
থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২-১৩ জন ছাত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়।
ঢাকা থেকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, সোয়াত ও বোমা বিশেষজ্ঞ দল আসার পর
জঙ্গি গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করা হবে। বুধবার রাতে দেখা গেছে, স্থানীয়
বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। শিরীন আক্তার নামে বাড়িটির একজন
বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, ‘জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু হলে ক্ষয়ক্ষতির
আশংকা আছে। তাই আমার দুই ছেলে ও বোনকে নিয়ে কুমিল্লার দেবিদ্বারে বাবার
বাড়িতে চলে যাচ্ছি।’
No comments