তত্ত্বাবধায়ক সরকারঃ দেশ অনিবার্য সংঘাতের দিকে by জাকির হোসেন
দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং বিএনপিকে এ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্যকে উস্কানিমূলক এবং প্রলোভনযুক্ত বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছেন। কারণ ভিন্ন কোনো পন্থায় এই নির্বাচন অতিক্রম করে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই নানারকম হিসাব-নিকাশ শেষে আগামী নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই প্রধানমন্ত্রী এখন থেকেই নানারকম উস্কানিমূলক ও প্রলোভনযুক্ত কথা বলছেন।
তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টই বলেছেন দলীয় সরকারের অধীনে তার দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া যে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়—এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ ভালো করেই জানেন। তিনি সবকিছু জেনেশুনেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। তিনি এও জানেন যে, তার বক্তব্য সত্য নয় এবং এটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তবে এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত এবং বর্তমানে তা সংঘাতের পরিস্থিতিকেই জোরদার করছে। তারা আরও বলেন, বর্তমান অচলাবস্থার সহজ সমাধান হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে উচ্চ আদালতের রায় মেনে নিয়ে সংবিধানের নতুন সংশোধনী সাধন করা। অর্থাত্ আগামী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। তবে এক্ষেত্রে সদ্য বিদায়ী বিচারপতি ছাড়া অন্য কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করার একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।
গতকাল দৈনিক আমার দেশকে দেয়া পৃথক প্রতিক্রিয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংবাদ বিশ্লেষক ফয়েজ আহ্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব আসাফ্উদ্দৌলাহ্, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও অন্যতম নীতিনির্ধারক তরিকুল ইসলাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চেয়ারম্যান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এসব কথা বলেন।
প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংবাদ বিশ্লেষক ফয়েজ আহ্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের প্রশ্নে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। কারণ ভিন্ন কোনো পন্থায় এই নির্বাচন অতিক্রম করে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচনে ব্যতিক্রমী ফলাফলের আশঙ্কায় এখন থেকেই তিনি নানারকম উস্কানিমূলক ও প্রলোভনযুক্ত কথা বলছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো আইন নেই যে, কোনো ব্যক্তি বা দলকে নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। এ ধরনের আইন যদি বর্তমান সরকার করে, তবে তার ফল তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টই বলেছেন—দলীয় সরকারের অধীনে তার দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভয় নয়—এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন। তিনি জেনেশুনেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী জানেন তার বক্তব্য সত্য নয় এবং এটা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি এবং কর্মকর্তারা অনেক টাকা কামিয়েছেন। দলের দুঃসময়ে তারা থাকবেন পলাতক। আওয়ামী লীগে অচিরেই ভাঙন ধরতে পারে—এটা প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন। এটা বুঝেই তিনি সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি এবং কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। ফয়েজ আহ্মদ মনে করেন, আগামী নির্বাচনের প্রশ্নে একটি সহজ সমাধান হবে। এ মুহূর্তে নেতানেত্রীদের বক্তব্যের তেমন কোনো মূল্য তখন থাকবে না। ফলে শেখ হাসিনাকে তার এ মুহূর্তের বক্তব্যকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও অন্যতম নীতিনির্ধারক তরিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগের ‘স্বপ্ন’ বিরোধী দল পূরণ হতে দেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সরকারের অধীনে নির্বাচন করে জয়লাভের স্বপ্ন দেখছে। বিএনপি থাকতে তাদের এই খায়েশ পূরণ হতে দেয়া হবে না।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব আসাফ্উদ্দৌলাহ্ বলেছেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মন্তব্য ও বক্তব্য তার মনের জেদকে প্রকাশ করেছে। তার এ জেদের কারণে দেশ একটি অনিবার্য সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এজন্য দেশের সব মানুষের সঙ্গে আমিও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে, দেশ একটি ভয়াবহ সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী কথা বলার সময় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে খেয়াল রাখেননি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অবশিষ্ট প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দেখতে চায়। উচ্চ আদালতও আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে হওয়ার বিষয়ে বলেছেন। যদিও উচ্চ আদালতের রায় এখনও প্রকাশ হয়নি। কিন্তু সবার মতামত উপেক্ষা করে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। মূলত এখান থেকে সংঘাতের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর ওপরে বর্তমানে দেশে দ্রব্যমূল্য, গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কট, শেয়ারবাজারের অর্থ লুটপাট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিসহ শত শত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছেন।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চেয়ারম্যান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমাদের দেশে সরকারে যারা থাকে তারা মনে করে তারাই সব কিছু। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো দলকে নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সম্ভব নয়। কারণ কোনো রাজনৈতিক দলই এ ব্যাপারে আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাই দেশের মানুষের চাহিদা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। দেশের মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে দেশকে সংঘাতপূর্ণ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেশকে একটি সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে বলে মনে হয়। এটা খুবই দুর্ভাগ্য যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটি মহল বার বার দেশে সংঘাত সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে যে মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বপক্ষে যুক্তিগুলো প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। অতীতে তার নিজের মুখেই বহুবার এগুলো উচ্চারিত হয়েছে। এখন অবশ্য উনার মুখের যুক্তিগুলো বিএনপি চেয়ারপারসনের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপ্রয়োজনীয় প্রচুর যুক্তি বিরোধীদলীয় নেত্রী বহুবার তুলে ধরেছেন যা এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে। এ ধরনের লেনদেন ভালোই হতো যদি তা সমঝোতার পরিবেশকে এগিয়ে নিত। কিন্তু বর্তমানে তা সংঘাতের পরিস্থিতিকেই জোরদার করছে। তিনি বলেন, বর্তমান অচলাবস্থার সহজ সমাধান হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে উচ্চ আদালতের রায় মেনে নিয়ে সংবিধানের নতুন সংশোধনী সাধন করা। অর্থাত্ আগামী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। তবে এক্ষেত্রে সদ্য বিদায়ী বিচারপতি ব্যতিরেকে অন্য কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করার একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা অনুসরণ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী অনড় অবস্থা ব্যক্ত করেছেন। তার বক্তব্য দেশের রাজনীতিকে একটি সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, সংসদীয় পদ্ধতি বলতে আমরা বুঝি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু বর্তমান সরকার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করছে। তিনি আরও বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গোটা জাতিকে হতাশ ও হতবাক করেছে। প্রধানমন্ত্রী গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের তিক্ততার কথা তুলে ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বর্জিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ভরাডুবি হবে তা বুঝতে পেরেই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে আমেরিকায় এবং গত শনিবার ঢাকায় পৃথক সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকায় দেয়া বক্তব্যে যে কোনো নাগরিকের কষ্ট পাওয়ার কথা। তার ওই বক্তব্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অভাব ছিল। আমাদের দেশে এমনিতেই সরকারি দল আর বিরোধী দলের মধ্যে সুসম্পর্কের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে উভয় দলের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উভয় সংবাদ সম্মেলনেই আগামী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গটি এসেছে। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জোরালো দাবি করে আসছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই হবে। প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাদ দেয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলছেন। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে প্রভাবমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। নির্বাচন কমিশনকে যতই শক্তিশালী করা হোক না কেন, ক্ষমতাসীনদের সাজানো প্রশাসনের সামনে তারা কিছুই করতে পারবে না। আমাদের দেশে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আর এ বিষয়টি উল্লেখ করেই আদালত পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে করার কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য সব রাজনৈতিক দল এমনকি চিন্তাশীল নাগরিকরা ও পেশাজীবীরাও সংঘাত এড়াতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। পানি-বিদ্যুত্- গ্যাস সঙ্কট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, শেয়ারবাজারের অর্থ লুট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবিগুলো ছাড়াও বিরোধী দল এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করার বিষয়টিকে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দাবি হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সরাসরি নাকচ করে দেয়ার অর্থই হচ্ছে দেশকে একটি নিশ্চিত সংঘাতের টিকে ঠেলে দেয়া। দেশের মানুষ কোনো অবস্থায়ই সংঘাত দেখতে চায় না।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও দেশে তৈরি হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে যাতে সংসদে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক থাকার দরকার বাংলাদেশ তা থেকে এখনও অনেক দূরে। গত ২০ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনই যেখানে কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সেখানে সংঘাত-সংঘর্ষে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নই অবান্তর। তিনি বলেন, সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেশবাসী গ্রহণ করবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান দেশকে অনিবার্যভাবে আরও বৈরিতা ও সংঘাত-সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেবে এবং সে পরিস্থিতিতে দেশের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাও গুরুতরভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
গতকাল দৈনিক আমার দেশকে দেয়া পৃথক প্রতিক্রিয়ায় প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংবাদ বিশ্লেষক ফয়েজ আহ্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব আসাফ্উদ্দৌলাহ্, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও অন্যতম নীতিনির্ধারক তরিকুল ইসলাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চেয়ারম্যান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এসব কথা বলেন।
প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংবাদ বিশ্লেষক ফয়েজ আহ্মদ বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের প্রশ্নে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। কারণ ভিন্ন কোনো পন্থায় এই নির্বাচন অতিক্রম করে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচনে ব্যতিক্রমী ফলাফলের আশঙ্কায় এখন থেকেই তিনি নানারকম উস্কানিমূলক ও প্রলোভনযুক্ত কথা বলছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে এমন কোনো আইন নেই যে, কোনো ব্যক্তি বা দলকে নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। এ ধরনের আইন যদি বর্তমান সরকার করে, তবে তার ফল তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টই বলেছেন—দলীয় সরকারের অধীনে তার দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভয় নয়—এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন। তিনি জেনেশুনেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী জানেন তার বক্তব্য সত্য নয় এবং এটা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি এবং কর্মকর্তারা অনেক টাকা কামিয়েছেন। দলের দুঃসময়ে তারা থাকবেন পলাতক। আওয়ামী লীগে অচিরেই ভাঙন ধরতে পারে—এটা প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন। এটা বুঝেই তিনি সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি এবং কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। ফয়েজ আহ্মদ মনে করেন, আগামী নির্বাচনের প্রশ্নে একটি সহজ সমাধান হবে। এ মুহূর্তে নেতানেত্রীদের বক্তব্যের তেমন কোনো মূল্য তখন থাকবে না। ফলে শেখ হাসিনাকে তার এ মুহূর্তের বক্তব্যকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও অন্যতম নীতিনির্ধারক তরিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগের ‘স্বপ্ন’ বিরোধী দল পূরণ হতে দেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সরকারের অধীনে নির্বাচন করে জয়লাভের স্বপ্ন দেখছে। বিএনপি থাকতে তাদের এই খায়েশ পূরণ হতে দেয়া হবে না।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব আসাফ্উদ্দৌলাহ্ বলেছেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মন্তব্য ও বক্তব্য তার মনের জেদকে প্রকাশ করেছে। তার এ জেদের কারণে দেশ একটি অনিবার্য সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এজন্য দেশের সব মানুষের সঙ্গে আমিও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে, দেশ একটি ভয়াবহ সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী কথা বলার সময় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে খেয়াল রাখেননি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া অবশিষ্ট প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দেখতে চায়। উচ্চ আদালতও আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে হওয়ার বিষয়ে বলেছেন। যদিও উচ্চ আদালতের রায় এখনও প্রকাশ হয়নি। কিন্তু সবার মতামত উপেক্ষা করে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। মূলত এখান থেকে সংঘাতের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর ওপরে বর্তমানে দেশে দ্রব্যমূল্য, গ্যাস-বিদ্যুত্ সঙ্কট, শেয়ারবাজারের অর্থ লুটপাট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিসহ শত শত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছেন।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চেয়ারম্যান বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমাদের দেশে সরকারে যারা থাকে তারা মনে করে তারাই সব কিছু। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনো দলকে নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সম্ভব নয়। কারণ কোনো রাজনৈতিক দলই এ ব্যাপারে আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাই দেশের মানুষের চাহিদা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। দেশের মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে দেশকে সংঘাতপূর্ণ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেশকে একটি সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে বলে মনে হয়। এটা খুবই দুর্ভাগ্য যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটি মহল বার বার দেশে সংঘাত সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে যে মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে তা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বপক্ষে যুক্তিগুলো প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। অতীতে তার নিজের মুখেই বহুবার এগুলো উচ্চারিত হয়েছে। এখন অবশ্য উনার মুখের যুক্তিগুলো বিএনপি চেয়ারপারসনের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপ্রয়োজনীয় প্রচুর যুক্তি বিরোধীদলীয় নেত্রী বহুবার তুলে ধরেছেন যা এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে। এ ধরনের লেনদেন ভালোই হতো যদি তা সমঝোতার পরিবেশকে এগিয়ে নিত। কিন্তু বর্তমানে তা সংঘাতের পরিস্থিতিকেই জোরদার করছে। তিনি বলেন, বর্তমান অচলাবস্থার সহজ সমাধান হচ্ছে ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে উচ্চ আদালতের রায় মেনে নিয়ে সংবিধানের নতুন সংশোধনী সাধন করা। অর্থাত্ আগামী দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা। তবে এক্ষেত্রে সদ্য বিদায়ী বিচারপতি ব্যতিরেকে অন্য কাউকে প্রধান উপদেষ্টা করার একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা অনুসরণ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী অনড় অবস্থা ব্যক্ত করেছেন। তার বক্তব্য দেশের রাজনীতিকে একটি সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, সংসদীয় পদ্ধতি বলতে আমরা বুঝি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু বর্তমান সরকার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করছে। তিনি আরও বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গোটা জাতিকে হতাশ ও হতবাক করেছে। প্রধানমন্ত্রী গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের তিক্ততার কথা তুলে ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বর্জিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ভরাডুবি হবে তা বুঝতে পেরেই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে আমেরিকায় এবং গত শনিবার ঢাকায় পৃথক সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকায় দেয়া বক্তব্যে যে কোনো নাগরিকের কষ্ট পাওয়ার কথা। তার ওই বক্তব্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অভাব ছিল। আমাদের দেশে এমনিতেই সরকারি দল আর বিরোধী দলের মধ্যে সুসম্পর্কের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে উভয় দলের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উভয় সংবাদ সম্মেলনেই আগামী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গটি এসেছে। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জোরালো দাবি করে আসছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই হবে। প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের নেতারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাদ দেয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলছেন। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে প্রভাবমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। নির্বাচন কমিশনকে যতই শক্তিশালী করা হোক না কেন, ক্ষমতাসীনদের সাজানো প্রশাসনের সামনে তারা কিছুই করতে পারবে না। আমাদের দেশে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আর এ বিষয়টি উল্লেখ করেই আদালত পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে করার কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য সব রাজনৈতিক দল এমনকি চিন্তাশীল নাগরিকরা ও পেশাজীবীরাও সংঘাত এড়াতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। পানি-বিদ্যুত্- গ্যাস সঙ্কট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, শেয়ারবাজারের অর্থ লুট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবিগুলো ছাড়াও বিরোধী দল এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করার বিষয়টিকে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দাবি হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সরাসরি নাকচ করে দেয়ার অর্থই হচ্ছে দেশকে একটি নিশ্চিত সংঘাতের টিকে ঠেলে দেয়া। দেশের মানুষ কোনো অবস্থায়ই সংঘাত দেখতে চায় না।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও দেশে তৈরি হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে যাতে সংসদে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সম্পর্ক থাকার দরকার বাংলাদেশ তা থেকে এখনও অনেক দূরে। গত ২০ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনই যেখানে কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সেখানে সংঘাত-সংঘর্ষে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নই অবান্তর। তিনি বলেন, সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তাদের দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেশবাসী গ্রহণ করবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান দেশকে অনিবার্যভাবে আরও বৈরিতা ও সংঘাত-সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেবে এবং সে পরিস্থিতিতে দেশের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাও গুরুতরভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
No comments