কার স্বার্থে দুদককে অকার্যকর করা হচ্ছে by বদিউল আলম মজুমদার
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংশোধিত আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। অনুমোদিত খসড়াটি মূলত মন্ত্রিপরিষদের অধীনে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রণীত হয়েছে বলেই মনে হয়। জাতীয় সংসদে এটি পাস হলে দুদকের ক্ষমতা খর্ব হবে এবং প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে অনেকের ধারণা। ইতিমধ্যে দুদক চেয়ারম্যান কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে প্রতিষ্ঠানটি নখ ও দন্তহীন বাঘে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করেছেন। তাহলে কেন বা কার স্বার্থেই বা তা করা হচ্ছে?
দাপ্তরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজে বা নিজের ঘনিষ্ঠজন বা সহযোগীদের লাভবান করার নামই দুর্নীতি। দুর্নীতির অপর নাম বেড়ায় খেত খাওয়া, রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হওয়া। বেড়ায় খেত খেলে যেমন কৃষকের উন্নতি হতে পারে না, তেমনি দুর্নীতি যেকোনো জাতির অগ্রগতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। পৃথিবীতে সেসব জাতিই উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে পেরেছে, যারা দুর্নীতিকে একটি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বস্তুত, দুর্নীতি দরিদ্রদের পেটে লাথি মারার সমতুল্য। তাই জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের দুর্নীতি দমনে আন্তরিক হতে হবে এবং এ ব্যাপারে সত্যিকারের অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।
বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আজ নাগরিক জীবনে যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার নেপথ্যেও রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস উৎপাদিত হয়নি, যা উৎপাদিত হয় তাও দুর্নীতির কবলে পড়ে যথাযথভাবে বিতরণ করা হচ্ছে না। তাই নাগরিকদের জন্য এসব অতি প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতির অবসান জরুরি।
দুর্নীতির কারণে আমাদের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও ধ্বংসপ্রায়। বিমান থেকে শুরু করে বন্দর পর্যন্ত আমাদের প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানই আজ দুর্নীতির আখড়া। হয় এগুলোর লোকসান জাতিকে গুনতে হয়, না হয় এগুলো সাধ্য অনুযায়ী উন্নয়নের জন্য সম্পদ জোগানে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিমান আর বন্দর ব্যবহার করে সিঙ্গাপুরের মতো প্রাকৃতিক সম্পদহীন দেশ আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠেছে। কিন্তু এগুলো আমাদের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
এ ছাড়া দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের কার্যকরতাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোই সাধারণত অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আমেরিকান ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন তার জুলাই-আগস্ট, ২০০৯ সংখ্যায় ১২টি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ‘ফেইলড স্টেট ইনডেক্স’ বা অকার্যকর রাষ্ট্রের সূচক প্রকাশ করেছে। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। বাংলাদেশের আগে রয়েছে নিম্নক্রমানুসারে সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, সুদান, চ্যাড, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইরাক, আফগানিস্তান, সেন্টাল আফ্রিকান রিপাবলিক, গিনি, পাকিস্তান, আইভরিকোস্ট, হাইতি, বার্মা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, নর্থ কোরিয়া ও ইয়েমেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ঘোষিত দুর্নীতির ধারণাসূচকে এসব দেশের প্রায় সব কটির স্কোরই বাংলাদেশের চেয়ে কম, সমান বা তার কাছাকাছি। তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে যে দুর্নীতি দমনে আন্তরিক না হলে আমাদের পরিণতিও অতি ভয়াবহ হতে পারে।
কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমনের জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন: একটি যথার্থ আইনি কাঠামো, দুদকের মতো শক্তিশালী ও বিচার বিভাগের মতো নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, ব্যাপক গণসচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ। ক্ষমতাসীনদের সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এগুলোর কোনোটিই অর্জন সম্ভব নয়।
স্বাধীনতা-পূর্ব কাল থেকেই আমাদের দেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে একটি আইনি কাঠামো বিরাজমান ছিল। তবে এটি যথাযথ ছিল না এবং দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো প্রতিষ্ঠানও সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। ফলে সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪’ প্রণয়ন এবং এর অধীনে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কমিশনারদের নিজেদের দুর্বলতা এবং তৎকালীন সরকারের অসহযোগিতার কারণে নবগঠিত প্রতিষ্ঠানটি কোনো রকম কার্যকরতা প্রদর্শন করতে পারেনি।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন ও জনবলকাঠামো নিয়ে জটিলতার অবসান ঘটানো এবং কমিশনকে পুনর্গঠন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৪ সালের আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীও আনা হয়। পুনর্গঠিত কমিশন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে জোরদার এবং কয়েক শ দুর্নীতির মামলা করে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারও কারও শাস্তিও হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আনীত সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনকে ‘একটি স্বাধীন, স্বশাসিত ও নিরপেক্ষ’ প্রতিষ্ঠানে [ধারা ৩(২)] পরিণত করা হয় (স্বশাসিত শব্দটি যোগ করা হয়)। এ ছাড়া এর মাধ্যমে কমিশনের আবশ্যক পূর্বানুমোদন ব্যতীত কমিশনের কর্মকর্তাদের ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত গৃহীত কার্যাবলির ভূতাপেক্ষ (ex post facto) অনুমোদনের বিধান করা হয় [ধারা ১৮(২)]। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০১-এর অধীনের অপরাধগুলোও এর মাধ্যমে কমিশনের আওতায় আনা হয়।
বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশদ্বয়কে অনুমোদন না করে গত বছরের মাঝামাঝি কমিশনের আইন পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্য সুপারিশের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদের অধীনে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। যেহেতু কমিশনের নিজস্ব সম্পদের উৎস নেই, তাই কমিটি আইন থেকে ‘স্বশাসিত’ শব্দটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মতামত দেয়। কমিটি সরকার কর্তৃক কমিশনের সচিব নিয়োগের সুপারিশও করে। এ ছাড়া কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি করার পক্ষে কমিটি সুপারিশ করে। পর্যালোচনা কমিটির সবচেয়ে বিতর্কিত সুপারিশটি হলো সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি। উল্লেখ্য, অতীতের এমনই একটি বিধান ২০০৪ সালের আইনের মাধ্যমে রহিত করা হয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিটির এসব সুপারিশ প্রস্তাবিত খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া খসড়া আইনে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন না করার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হলে কমিশনকে সমপদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপনকারীর বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার বিধান আইনে রাখা হয়েছে। দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী কোনো সরকারি কর্মকর্তার সহায়তা নেওয়ার সুযোগও আইনে রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়ার সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য বিধান হলো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অনুমতির বাধ্যবাধকতা। শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটির এমন সুপারিশ সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। সরল বিশ্বাসে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে সরকারি কর্মকর্তারা দায়মুক্ত হতে পারলে অন্যান্য নাগরিকদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য হবে না কেন? এ ছাড়া এমন বিধান আইনে থাকলে কমিশন আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতোই অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। কারণ, এটি আজ সর্বজনবিদিত যে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে এক ধরনের অশুভ আঁতাতের ফলেই বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষার বিধান করে দুর্নীতি দমনের যেকোনো অভিযান ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান প্রণয়নের পর গণপরিষদের শেষ অধিবেশনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন: ‘সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। তাঁরা আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তাঁরা কোনো different class নয়।...আইনের চক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার। মজদুর, কৃষকদের টাকা দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং মজদুর, কৃষকদের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদের সেই অধিকার থাকবে। এর বেশি অধিকার তাঁরা পেতে পারেন না। সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যে তাঁরা শাসক নন, তাঁরা সেবক।’ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদান এ চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ।
প্রস্তাবিত আইনে কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি করার সুপারিশের যৌক্তিকতা নিয়েও অনেকের মনে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ... প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ তাই দুদককে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ করলে প্রতিষ্ঠানটি মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। এ ছাড়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে দুদকের কমিশনারদের অপসারণের বিধান আইনে এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উপরন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কমিটির সচিব নিয়োগের বিধানও কমিনের স্বাধীনতা খর্ব করবে। মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করার জন্য দুদকের একই পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগের বাধ্যবাধকতাও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
কমিটির আরেকটি সুপারিশও, যা খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না আমরা জানি না, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধান ও তদন্তকার্যে বাধা অপসারণের লক্ষ্যে দুদকের পক্ষ থেকে ২০০৪ সালের আইনের ১৯(১) এ ‘আপাতত বলবত্ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ, যাহা কিছুই থাকুক না কেন’ শব্দগুলো সংযোজনে দুদকের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়। কমিটি এ প্রস্তাবের বিপক্ষে সুপারিশ করে। দুর্নীতি দমন কার্যক্রমকে সত্যিকারার্থে জোরদার ও ফলপ্রসূ করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনকে অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমরা মনে করি।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্বল করলে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না এবং জনগণের স্বার্থও সংরক্ষিত হবে না। পক্ষান্তরে এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজেরা অন্যায় করে, তথা দরিদ্রদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে এবং দেশের ভবিষ্যেক জলাঞ্জলি, এমনকি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে পার পেয়ে যাবে। আমরা কি তা-ই চাই? এর মাধ্যমে কি আমরা ২০২১ সালের জন্য নির্ধারিত ‘ভিশন’ বা প্রত্যাশা পূরণে বাধাগ্রস্ত হব না? বস্তুত আমরা যদি সত্যিকারার্থেই বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চাই, যা করতে বর্তমান সরকার তার দিনবদলের সনদে অঙ্গীকারবদ্ধ, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা আবশ্যক। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংবিধান সংশোধন করে তা করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে বর্তমান সরকারের রয়েছে।
তবে জাতি হিসেবে আমাদের বড় দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশ প্রায় সর্বদাই শাসকদের ক্ষুদ্র ও কোটারিস্বার্থে পরিচালিত হয়েছে। এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতেও কুণ্ঠাবোধ করা হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দিনবদলের সরকারের আমলেও এর খুব একটা ব্যত্যয় লক্ষ করা যায় না। যেমন, মাননীয় সাংসদদের স্বার্থে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত লঙ্ঘন করলে দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা রহিত করে নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে। একইভাবে দলীয় ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতে মনোনীত করে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা অতীতের মতো আবারও প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়েছে। নীতিনির্ধারকেরা কি ভাবেন না—কার স্বার্থ এতে সংরক্ষিত হবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
দাপ্তরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজে বা নিজের ঘনিষ্ঠজন বা সহযোগীদের লাভবান করার নামই দুর্নীতি। দুর্নীতির অপর নাম বেড়ায় খেত খাওয়া, রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হওয়া। বেড়ায় খেত খেলে যেমন কৃষকের উন্নতি হতে পারে না, তেমনি দুর্নীতি যেকোনো জাতির অগ্রগতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। পৃথিবীতে সেসব জাতিই উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে পেরেছে, যারা দুর্নীতিকে একটি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বস্তুত, দুর্নীতি দরিদ্রদের পেটে লাথি মারার সমতুল্য। তাই জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের দুর্নীতি দমনে আন্তরিক হতে হবে এবং এ ব্যাপারে সত্যিকারের অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।
বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আজ নাগরিক জীবনে যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার নেপথ্যেও রয়েছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস উৎপাদিত হয়নি, যা উৎপাদিত হয় তাও দুর্নীতির কবলে পড়ে যথাযথভাবে বিতরণ করা হচ্ছে না। তাই নাগরিকদের জন্য এসব অতি প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতির অবসান জরুরি।
দুর্নীতির কারণে আমাদের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও ধ্বংসপ্রায়। বিমান থেকে শুরু করে বন্দর পর্যন্ত আমাদের প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানই আজ দুর্নীতির আখড়া। হয় এগুলোর লোকসান জাতিকে গুনতে হয়, না হয় এগুলো সাধ্য অনুযায়ী উন্নয়নের জন্য সম্পদ জোগানে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিমান আর বন্দর ব্যবহার করে সিঙ্গাপুরের মতো প্রাকৃতিক সম্পদহীন দেশ আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠেছে। কিন্তু এগুলো আমাদের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই।
এ ছাড়া দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের কার্যকরতাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোই সাধারণত অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আমেরিকান ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন তার জুলাই-আগস্ট, ২০০৯ সংখ্যায় ১২টি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ‘ফেইলড স্টেট ইনডেক্স’ বা অকার্যকর রাষ্ট্রের সূচক প্রকাশ করেছে। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। বাংলাদেশের আগে রয়েছে নিম্নক্রমানুসারে সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, সুদান, চ্যাড, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইরাক, আফগানিস্তান, সেন্টাল আফ্রিকান রিপাবলিক, গিনি, পাকিস্তান, আইভরিকোস্ট, হাইতি, বার্মা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, নর্থ কোরিয়া ও ইয়েমেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ঘোষিত দুর্নীতির ধারণাসূচকে এসব দেশের প্রায় সব কটির স্কোরই বাংলাদেশের চেয়ে কম, সমান বা তার কাছাকাছি। তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে যে দুর্নীতি দমনে আন্তরিক না হলে আমাদের পরিণতিও অতি ভয়াবহ হতে পারে।
কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমনের জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন: একটি যথার্থ আইনি কাঠামো, দুদকের মতো শক্তিশালী ও বিচার বিভাগের মতো নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, ব্যাপক গণসচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ। ক্ষমতাসীনদের সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এগুলোর কোনোটিই অর্জন সম্ভব নয়।
স্বাধীনতা-পূর্ব কাল থেকেই আমাদের দেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে একটি আইনি কাঠামো বিরাজমান ছিল। তবে এটি যথাযথ ছিল না এবং দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো প্রতিষ্ঠানও সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। ফলে সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪’ প্রণয়ন এবং এর অধীনে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কমিশনারদের নিজেদের দুর্বলতা এবং তৎকালীন সরকারের অসহযোগিতার কারণে নবগঠিত প্রতিষ্ঠানটি কোনো রকম কার্যকরতা প্রদর্শন করতে পারেনি।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন ও জনবলকাঠামো নিয়ে জটিলতার অবসান ঘটানো এবং কমিশনকে পুনর্গঠন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৪ সালের আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীও আনা হয়। পুনর্গঠিত কমিশন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে জোরদার এবং কয়েক শ দুর্নীতির মামলা করে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারও কারও শাস্তিও হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আনীত সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনকে ‘একটি স্বাধীন, স্বশাসিত ও নিরপেক্ষ’ প্রতিষ্ঠানে [ধারা ৩(২)] পরিণত করা হয় (স্বশাসিত শব্দটি যোগ করা হয়)। এ ছাড়া এর মাধ্যমে কমিশনের আবশ্যক পূর্বানুমোদন ব্যতীত কমিশনের কর্মকর্তাদের ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত গৃহীত কার্যাবলির ভূতাপেক্ষ (ex post facto) অনুমোদনের বিধান করা হয় [ধারা ১৮(২)]। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০১-এর অধীনের অপরাধগুলোও এর মাধ্যমে কমিশনের আওতায় আনা হয়।
বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশদ্বয়কে অনুমোদন না করে গত বছরের মাঝামাঝি কমিশনের আইন পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্য সুপারিশের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদের অধীনে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। যেহেতু কমিশনের নিজস্ব সম্পদের উৎস নেই, তাই কমিটি আইন থেকে ‘স্বশাসিত’ শব্দটি বাদ দেওয়ার পক্ষে মতামত দেয়। কমিটি সরকার কর্তৃক কমিশনের সচিব নিয়োগের সুপারিশও করে। এ ছাড়া কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি করার পক্ষে কমিটি সুপারিশ করে। পর্যালোচনা কমিটির সবচেয়ে বিতর্কিত সুপারিশটি হলো সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি। উল্লেখ্য, অতীতের এমনই একটি বিধান ২০০৪ সালের আইনের মাধ্যমে রহিত করা হয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিটির এসব সুপারিশ প্রস্তাবিত খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া খসড়া আইনে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন না করার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হলে কমিশনকে সমপদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপনকারীর বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার বিধান আইনে রাখা হয়েছে। দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী কোনো সরকারি কর্মকর্তার সহায়তা নেওয়ার সুযোগও আইনে রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়ার সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য বিধান হলো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অনুমতির বাধ্যবাধকতা। শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটির এমন সুপারিশ সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। সরল বিশ্বাসে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে সরকারি কর্মকর্তারা দায়মুক্ত হতে পারলে অন্যান্য নাগরিকদের বেলায়ও তা প্রযোজ্য হবে না কেন? এ ছাড়া এমন বিধান আইনে থাকলে কমিশন আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতোই অকার্যকর হয়ে পড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। কারণ, এটি আজ সর্বজনবিদিত যে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে এক ধরনের অশুভ আঁতাতের ফলেই বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষার বিধান করে দুর্নীতি দমনের যেকোনো অভিযান ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান প্রণয়নের পর গণপরিষদের শেষ অধিবেশনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন: ‘সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। তাঁরা আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তাঁরা কোনো different class নয়।...আইনের চক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার। মজদুর, কৃষকদের টাকা দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং মজদুর, কৃষকদের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদের সেই অধিকার থাকবে। এর বেশি অধিকার তাঁরা পেতে পারেন না। সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যে তাঁরা শাসক নন, তাঁরা সেবক।’ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদান এ চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ।
প্রস্তাবিত আইনে কমিশনকে রাষ্ট্রপতির কাছে জবাবদিহি করার সুপারিশের যৌক্তিকতা নিয়েও অনেকের মনে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ... প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ তাই দুদককে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ করলে প্রতিষ্ঠানটি মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। এ ছাড়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে দুদকের কমিশনারদের অপসারণের বিধান আইনে এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উপরন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কমিটির সচিব নিয়োগের বিধানও কমিনের স্বাধীনতা খর্ব করবে। মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করার জন্য দুদকের একই পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগের বাধ্যবাধকতাও সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
কমিটির আরেকটি সুপারিশও, যা খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না আমরা জানি না, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুসন্ধান ও তদন্তকার্যে বাধা অপসারণের লক্ষ্যে দুদকের পক্ষ থেকে ২০০৪ সালের আইনের ১৯(১) এ ‘আপাতত বলবত্ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ, যাহা কিছুই থাকুক না কেন’ শব্দগুলো সংযোজনে দুদকের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়। কমিটি এ প্রস্তাবের বিপক্ষে সুপারিশ করে। দুর্নীতি দমন কার্যক্রমকে সত্যিকারার্থে জোরদার ও ফলপ্রসূ করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনকে অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমরা মনে করি।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্বল করলে বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না এবং জনগণের স্বার্থও সংরক্ষিত হবে না। পক্ষান্তরে এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজেরা অন্যায় করে, তথা দরিদ্রদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে এবং দেশের ভবিষ্যেক জলাঞ্জলি, এমনকি হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে পার পেয়ে যাবে। আমরা কি তা-ই চাই? এর মাধ্যমে কি আমরা ২০২১ সালের জন্য নির্ধারিত ‘ভিশন’ বা প্রত্যাশা পূরণে বাধাগ্রস্ত হব না? বস্তুত আমরা যদি সত্যিকারার্থেই বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চাই, যা করতে বর্তমান সরকার তার দিনবদলের সনদে অঙ্গীকারবদ্ধ, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা আবশ্যক। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংবিধান সংশোধন করে তা করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে বর্তমান সরকারের রয়েছে।
তবে জাতি হিসেবে আমাদের বড় দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশ প্রায় সর্বদাই শাসকদের ক্ষুদ্র ও কোটারিস্বার্থে পরিচালিত হয়েছে। এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতেও কুণ্ঠাবোধ করা হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে দিনবদলের সরকারের আমলেও এর খুব একটা ব্যত্যয় লক্ষ করা যায় না। যেমন, মাননীয় সাংসদদের স্বার্থে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত লঙ্ঘন করলে দলের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা রহিত করে নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে। একইভাবে দলীয় ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতে মনোনীত করে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা অতীতের মতো আবারও প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়েছে। নীতিনির্ধারকেরা কি ভাবেন না—কার স্বার্থ এতে সংরক্ষিত হবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments