আহমদ ছফার অবিনয় by তৌহিদ ইমাম
২৮ জুলাই আহমদ ছফার মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে |
আমরা
আটকে আছি ভীষণ ক্ষতিকর একটি প্রথাগত বিশ্বাসে—বিনয়ই সৌজন্য, ভদ্রতা; বিনয়ই
সর্ব উদ্দেশ্য সাধনের উপায়। আমাদের ধারণা, শ্রদ্ধা ও সম্মান একই বস্তু।
তাই আমরা যত পারি বিনয়ী হই, বিনয়ে মাথা নোয়াই। এই সুযোগটাই নেয় ক্ষমতাসীন
শক্তিমান; আমাদের নোয়ানো মাথা আর তুলতে দেয় না। আমরা তাদের পায়ের কাছে ঘাড়
গোঁজ করে পড়ে থাকি। আর প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান, শক্তিমান আমাদের মাথায় হাত
বুলিয়ে বুলিয়ে পোষ মানিয়ে রাখে।
আহমদ ছফা অস্বীকার করেছেন সমস্ত প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমানকে। তিনি জানতেন, এসবই পরিপূর্ণ বিকাশের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমান একেকটা পাথুরে দেয়াল। আহমদ ছফার সাধনা ছিল দেয়ালগুলো ভেঙে দিয়ে সৃষ্টিশীল বায়ুর অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। আহমদ ছফা তাঁর দিনপঞ্জিকার একটি অংশে (৪ মার্চ, ১৯৭৩) লিখেছেন, ‘সমস্ত শক্তি জড়ো করে সামনে যদি পথ না হাঁটি আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি নিজের ভেতরেই পচে উঠব। সুযোগ, সুবিধা, লোভ কিছুর কাছেই নতি স্বীকার করতে পারব না। নতি স্বীকার করা আর আমার মরে যাওয়া একই কথা।’ কোনো দুর্বল মুহূর্তে নিজের একান্ত মনোভাবনার প্রকাশ নয় এটি, বরং সারা জীবনের অবিচলিত সংকল্প। এজন্য অবশ্য আহমদ ছফাকে কম নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হয়নি।
সেটিই স্বাভাবিক ছিল। প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমান চায় ক্ষণ ভঙ্গুর মেরুদণ্ডহীন মানুষ। যে মানুষ কেবলই তাদের স্তব, স্তুতি করবে; অনুগত সারমেয়র মতো পদলেহী হবে। বিনিময়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধার প্রসাদ পেয়ে চেটেপুটে খাবে। কিন্তু আহমদ ছফা ছিলেন সিংহাসন উল্টে দেওয়া সংগ্রামী গণমানুষের প্রতিনিধি। যে মানুষই সভ্যতা গড়ে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হারিশপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। আহমদ ছফা খুব গর্বভরে নিজের পরিচয় দিতেন ‘কিষানের ছাওয়াল’ বলে। মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতি ছিল তাঁর অপার মমতা। যেহেতু তিনি উঠে এসেছেন সেই শ্রেণির ভেতর থেকে। কিন্তু ছিলেন প্রবল অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাঠ তিনি নিয়েছেন নজরুলের জীবন ও রচনাবলি থেকে।
শুধু নজরুল নয়, আহমদ ছফার চেতনা ও সৃষ্টিশীলতায় অনেকেরই প্রভাব ছিল; বিশেষভাবে গ্যেটে, রাসেল এবং রবীন্দ্রনাথ। এই তিন মনীষী শুধু যে তাঁর মনোগঠনে ভূমিকা রেখেছেন তা নয়, সৃষ্টিশীলতার দুরূহ দুর্গম পথের পথিক হতেও সৎসাহস জুগিয়েছেন। ইংরেজ মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল ও বাঙালি মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আহমদ ছফা অসাধারণ দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধ দুটি ১৯৮১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইয়ে সংকলিত হয়েছে। প্রবন্ধ দুটি পড়লে বিস্মিত হতে হয়; রাসেল ও রবীন্দ্রনাথকে আহমদ ছফা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন; সেটি একেবারেই ব্যতিক্রম, এর আগে কেউই সেভাবে ব্যাখ্যা করেননি। প্রবন্ধ দুটিতে চকিত একবার দৃষ্টি দেওয়া যাক।
বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’। ১৯৭০ সালের দিকে অধুনালুপ্ত ‘মুখপত্র’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। আহমদ ছফা রচনাটি লিখেছিলেন ছাত্রাবস্থায় ও ড. আহমদ শরীফের বাড়িতে একটি সাপ্তাহিক পাঠচক্রের সভায় পাঠের উদ্দেশ্যে। আহমদ ছফা প্রবন্ধটি শুরু করেছেন এভাবে—‘বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন ও মনীষার এক অংশ মাত্র সাধারণের চোখে পড়েছে। অপর অংশ চাঁদের অপর পিঠের মতো লোকলোচনের অন্তরালে রয়ে গেছে।’ এরপর পুরো প্রবন্ধের পরতে পরতে আহমদ ছফা যে ভাষায় ও ভঙ্গির তির্যকতায় রাসেলের ব্যক্তিজীবন ও কর্মের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা অনবদ্য। প্রবন্ধটির শেষ প্যারার কথা কটির ভেতর দিয়ে প্রায় অলৌকিক ও পৌরাণিক ভাবমূর্তি ভেঙে লৌকিক রাসেল বেরিয়ে এসেছেন। আহমদ ছফা প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এভাবে—‘প্রথম যৌবনে তিনি খ্যাতি, প্রতিপত্তি কিছু কামনা করেননি। শুধু চেয়েছিলেন সন্তানের জনক হতে। একেবারে আদিম কামনা। জুলু হটেন্টটের সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই। প্রথম সন্তানের জনক হওয়ার সংবাদে এমন বিভোর আনন্দ পরিবেশন করেছেন নেহায়েত জৈবকর্মে বিরক্ত মানুষের মনেও একঝলক দখিনা হাওয়া সমীরিত হয়। এই মানুষী আবেগটিই রাসেলের অমরত্বের কারণ। তিনি বিশাল পুরুষ, বিখ্যাত মানুষ। কণ্ঠস্বর আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে পাঁচ মহাদেশের কানে কানাকানি করে। এমন বিখ্যাত মানুষের আনন্দিত হওয়ার জন্য সুগায়কের গানের একটি কলি, জাতশিল্পীর ছবির একটু দর্শন, সবুজ বনানীর একটু অন্তরঙ্গ ছোঁয়া এই-ই যথেষ্ট। হাসি পাওয়ার মতো সাধারণ। সমস্ত অসাধারণেরাই অতিবেশি সাধারণ, কথাটি বোধ করি সত্য।’ কী অনন্যসাধারণ উপলব্ধি! বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রতি এই মুগ্ধতা আহমদ ছফাকে দিয়ে রাসেলের Sceptical Essays-এর অনুবাদ করিয়ে নিয়েছে; ‘সংশয়ী রচনা’ শিরোনামের অনুবাদগ্রন্থটি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়।
আহমদ ছফা অস্বীকার করেছেন সমস্ত প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমানকে। তিনি জানতেন, এসবই পরিপূর্ণ বিকাশের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমান একেকটা পাথুরে দেয়াল। আহমদ ছফার সাধনা ছিল দেয়ালগুলো ভেঙে দিয়ে সৃষ্টিশীল বায়ুর অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। আহমদ ছফা তাঁর দিনপঞ্জিকার একটি অংশে (৪ মার্চ, ১৯৭৩) লিখেছেন, ‘সমস্ত শক্তি জড়ো করে সামনে যদি পথ না হাঁটি আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি নিজের ভেতরেই পচে উঠব। সুযোগ, সুবিধা, লোভ কিছুর কাছেই নতি স্বীকার করতে পারব না। নতি স্বীকার করা আর আমার মরে যাওয়া একই কথা।’ কোনো দুর্বল মুহূর্তে নিজের একান্ত মনোভাবনার প্রকাশ নয় এটি, বরং সারা জীবনের অবিচলিত সংকল্প। এজন্য অবশ্য আহমদ ছফাকে কম নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হয়নি।
সেটিই স্বাভাবিক ছিল। প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমান চায় ক্ষণ ভঙ্গুর মেরুদণ্ডহীন মানুষ। যে মানুষ কেবলই তাদের স্তব, স্তুতি করবে; অনুগত সারমেয়র মতো পদলেহী হবে। বিনিময়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধার প্রসাদ পেয়ে চেটেপুটে খাবে। কিন্তু আহমদ ছফা ছিলেন সিংহাসন উল্টে দেওয়া সংগ্রামী গণমানুষের প্রতিনিধি। যে মানুষই সভ্যতা গড়ে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হারিশপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। আহমদ ছফা খুব গর্বভরে নিজের পরিচয় দিতেন ‘কিষানের ছাওয়াল’ বলে। মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতি ছিল তাঁর অপার মমতা। যেহেতু তিনি উঠে এসেছেন সেই শ্রেণির ভেতর থেকে। কিন্তু ছিলেন প্রবল অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাঠ তিনি নিয়েছেন নজরুলের জীবন ও রচনাবলি থেকে।
শুধু নজরুল নয়, আহমদ ছফার চেতনা ও সৃষ্টিশীলতায় অনেকেরই প্রভাব ছিল; বিশেষভাবে গ্যেটে, রাসেল এবং রবীন্দ্রনাথ। এই তিন মনীষী শুধু যে তাঁর মনোগঠনে ভূমিকা রেখেছেন তা নয়, সৃষ্টিশীলতার দুরূহ দুর্গম পথের পথিক হতেও সৎসাহস জুগিয়েছেন। ইংরেজ মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল ও বাঙালি মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আহমদ ছফা অসাধারণ দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধ দুটি ১৯৮১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইয়ে সংকলিত হয়েছে। প্রবন্ধ দুটি পড়লে বিস্মিত হতে হয়; রাসেল ও রবীন্দ্রনাথকে আহমদ ছফা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন; সেটি একেবারেই ব্যতিক্রম, এর আগে কেউই সেভাবে ব্যাখ্যা করেননি। প্রবন্ধ দুটিতে চকিত একবার দৃষ্টি দেওয়া যাক।
বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’। ১৯৭০ সালের দিকে অধুনালুপ্ত ‘মুখপত্র’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। আহমদ ছফা রচনাটি লিখেছিলেন ছাত্রাবস্থায় ও ড. আহমদ শরীফের বাড়িতে একটি সাপ্তাহিক পাঠচক্রের সভায় পাঠের উদ্দেশ্যে। আহমদ ছফা প্রবন্ধটি শুরু করেছেন এভাবে—‘বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন ও মনীষার এক অংশ মাত্র সাধারণের চোখে পড়েছে। অপর অংশ চাঁদের অপর পিঠের মতো লোকলোচনের অন্তরালে রয়ে গেছে।’ এরপর পুরো প্রবন্ধের পরতে পরতে আহমদ ছফা যে ভাষায় ও ভঙ্গির তির্যকতায় রাসেলের ব্যক্তিজীবন ও কর্মের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা অনবদ্য। প্রবন্ধটির শেষ প্যারার কথা কটির ভেতর দিয়ে প্রায় অলৌকিক ও পৌরাণিক ভাবমূর্তি ভেঙে লৌকিক রাসেল বেরিয়ে এসেছেন। আহমদ ছফা প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এভাবে—‘প্রথম যৌবনে তিনি খ্যাতি, প্রতিপত্তি কিছু কামনা করেননি। শুধু চেয়েছিলেন সন্তানের জনক হতে। একেবারে আদিম কামনা। জুলু হটেন্টটের সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই। প্রথম সন্তানের জনক হওয়ার সংবাদে এমন বিভোর আনন্দ পরিবেশন করেছেন নেহায়েত জৈবকর্মে বিরক্ত মানুষের মনেও একঝলক দখিনা হাওয়া সমীরিত হয়। এই মানুষী আবেগটিই রাসেলের অমরত্বের কারণ। তিনি বিশাল পুরুষ, বিখ্যাত মানুষ। কণ্ঠস্বর আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে পাঁচ মহাদেশের কানে কানাকানি করে। এমন বিখ্যাত মানুষের আনন্দিত হওয়ার জন্য সুগায়কের গানের একটি কলি, জাতশিল্পীর ছবির একটু দর্শন, সবুজ বনানীর একটু অন্তরঙ্গ ছোঁয়া এই-ই যথেষ্ট। হাসি পাওয়ার মতো সাধারণ। সমস্ত অসাধারণেরাই অতিবেশি সাধারণ, কথাটি বোধ করি সত্য।’ কী অনন্যসাধারণ উপলব্ধি! বার্ট্রান্ড রাসেলের প্রতি এই মুগ্ধতা আহমদ ছফাকে দিয়ে রাসেলের Sceptical Essays-এর অনুবাদ করিয়ে নিয়েছে; ‘সংশয়ী রচনা’ শিরোনামের অনুবাদগ্রন্থটি ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়।
- আহমদ ছফাকে পড়তে হলে বসতে হবে সমস্ত মনোযোগ ও মনন নিয়ে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব পাঠের অভিজ্ঞতা। কোনো অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে আহমদ ছফার রচনা হজম করা কঠিন।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরকে নিয়ে আহমদ ছফা যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, সেটি লিখিত হয়েছিল সেই
সময়, যখন পাকিস্তানের গভর্নর আইয়ুব খানের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী খাজা
শাহাবুদ্দিন রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। আহমদ
ছফার উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথবিষয়ক প্রবন্ধের একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়,
যার সম্পাদক ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি-সাধনা’ শীর্ষক
রচনাটি সেই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ভীষণ কাব্যিক এই প্রবন্ধটি
রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনের শিল্পসাধনার সারাৎসার। রবীন্দ্রনাথ কাদের
সৃষ্টিশীলতা ও চৈতন্যকে আত্তীকরণ করেছেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আহমদ ছফা
প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন—‘য়ুরোপের অহমিকা তাকে আহত করেছে, কিন্তু
গরিমাও মুগ্ধ করেছে। শেক্সপিয়রের মানবোপলব্ধি, মিল্টনের কল্পসাঁতার, শেলির
মুক্ত প্রমিথিউস, বায়রনের উদ্দামতা, কিটসের তন্ময়তা, ব্রাউনিঙের
অধ্যাত্মোপলব্ধি, গ্যয়টের মানবীয়তা, রাসকিনের প্রগাঢ়তা, টলস্টয়ের ব্যাপ্তি
এবং ফরাসি সাহিত্যিকদের বাগবৈদগ্ধ তাকে স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ করেছে।
তাছাড়া আরো নানা প্রাণের স্পর্শ প্রাণে এসে অবশ্যই লেগেছে।’ রবীন্দ্রনাথকে
নিয়ে আহমদ ছফা পরেও লিখেছেন, কিন্তু এই গদ্যটিই রবীন্দ্রনাথের ওপর আহমদ ছফা
লিখিত সেরা রচনা বলে মনে করি।
কিন্তু বার্ট্রান্ড রাসেল ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও যে মনীষী আহমদ ছফার চেতনালোককে অধিকতর আলোড়িত করেছেন বলে মনে করি, তিনি জার্মান কবি ও নাট্যকার যোহান ভন গ্যেটে। এই মনীষীর বৈভবময় জীবন ও বিপুল সৃষ্টি ছফাকে সূর্যাভিমুখী পুষ্পের মতো প্রস্ফুটিত করেছে। গ্যেটের অমর কাব্য ‘ফাউস্ট’, যেটি তিনি দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে রচনা করেছেন, সেই বৃহদায়তন রচনাটি অনুবাদের যে সৎসাহসিক উদ্যোগ আহমদ ছফা নিয়েছিলেন, তাই তাকে বাংলা সাহিত্যে চির অমর করে দিয়ে গেছে। এই কর্মটিই প্রমাণ করে আহমদ ছফা গ্যেটে দ্বারা কী ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন।
কিন্তু এসবই কি আহমদ ছফার অবিনয়? আমার তো তাই মনে হয়। ব্যক্তিজীবনে ও সৃষ্টিশীলতায় আহমদ ছফা যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেটি একেবারেই অপ্রথাগত। তিনি জীবনযাপনে ছিলেন উদ্দাম, বাঁধনহারা, সৃষ্টিশীলতায় ছিলেন বিচিত্রাভিসারী। তিনি যে সাহিত্যের নতুন কোনো ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন, তা নয়। তিনি কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন গল্প-উপন্যাস, লিখেছেন প্রবন্ধ-স্মৃতিকথা-দিনলিপি, করেছেন অনুবাদ; অর্থাৎ একেবারেই প্রচলিত ধারা ও ফর্মে। কিন্তু আহমদ ছফার বিশেষত্ব ও অসাধারণত্ব সেসবের ভেতর দিয়েই হীরের দ্যুতির মতো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। আহমদ ছফার লেখা পাঠ কোনো আরামদায়ক অভিজ্ঞতা নয়, বরং যথেষ্ট অস্বস্তিদায়ক। এমনকি উপন্যাসগুলো পর্যন্ত এতটা সুখপাঠ্য নয় যে, বালিশে আলতো হেলান দিয়ে পড়া যাবে। আহমদ ছফাকে পড়তে হলে বসতে হবে সমস্ত মনোযোগ ও মনন নিয়ে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব পাঠের অভিজ্ঞতা। কোনো অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে আহমদ ছফার রচনা হজম করা কঠিন।
সব কিছু নিয়েই আহমদ ছফার ছিল নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। তাঁর দেখার চোখ ছিল একেবারেই অন্যরকম। কোনো সামাজিক ঘটনা বা প্রপঞ্চ ব্যাখ্যাতেও থাকত তাঁর নিজস্বতার ছাপ। এমনকি সাহিত্যের কোনো সংঘটন কিংবা উপন্যাসের কোনো চরিত্র নিয়ে যখন তিনি আলোচনা করেছেন, সেখানেও পাওয়া গেছে নব আলোকের উদ্ভাস। উদাহরণ হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুল পঠিত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র একটি চরিত্র হোসেন মিয়ার কথা বলা যেতে পারে। এই চরিত্রটিকে আহমদ ছফা যে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, আহমদ ছফার আগে কিংবা পরে কারও পক্ষেই এমন অভিনব ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়নি। হোসেন মিয়াকে তিনি দেবরাজ জিউসের মতো সর্বইচ্ছা শক্তিসম্পন্ন চরিত্র হিসেবে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুকের বঙ্গীয় সংস্করণ হিসেবে। অথবা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে তাঁর যে ব্যাখ্যাসমূহ, সেগুলো বিস্ময়েরই উদ্রেক করে। লেখক হতে হলে কতটা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, কতটা মননদীপ্ত, কতটা বৈপ্লবিক হতে হয় আহমদ ছফা তাঁর সেরা দৃষ্টান্তগুলোর একজন।
অন্যদিকে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে তাঁর যে অবিসংবাদিত স্মৃতিগ্রন্থ ‘যদ্যপি আমার গুরু’, সেটি পড়লে যে আহমদ ছফাকে আমরা পাই, সেই আহমদ ছফা অত্যন্ত সংবেদনশীল, প্রচণ্ড পড়ুয়া ও অস্থির অনুসন্ধিৎসু। এবং অবশ্যই স্মৃতিধর।
আহমদ ছফার পরিচয়ের বহুমুখিতা এখানেই শেষ নয়; তিনি যে কতটা বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন, সেটি তাঁর জীবনযাপনই প্রমাণ করে। আহমদ ছফার কুসুমকোমল অন্তঃকরণের পরিচয় পাই অনুজ-তরুণ লেখকদের প্রতি প্রগাঢ় স্নেহশীলতায়। আজকে খ্যাতিমান, লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনেক লেখকেরই সেদিন ছিলেন সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, মহত্তম উৎসাহদাতা। সে সময়কার বহু তরুণের প্রথম বই আহমদ ছফার অর্থায়নে প্রকাশিত হয়েছে। এরই উল্টোদিকে আছে আহমদ ছফার রাগী, অনমনীয়, অনাপসী, সংকল্পদৃঢ় চরিত্র। জীবনে কোনো দিন কোনো অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি তিনি। শুধু নিজের সঙ্গে অন্যায় নয়, যখন দেখেছেন অন্যের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে, তখনও রুখে দাঁড়িয়েছেন। এস এম সুলতানের মতো একজন বিশ্বমানের চিত্রশিল্পী যখন শহুরেজনের নিরন্তর অবজ্ঞা-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, আহমদ ছফা তখন প্রতিজ্ঞা করে বসেন—যে করেই হোক সুলতানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবেন। কয়েক বছর পড়াশোনার পর তিনি লিখেন ‘বাঙালির চিত্র-ঐতিহ্য : এস এম সুলতানের সাধনা’ নামের দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ। সেই সময় প্রবন্ধটি শিক্ষাভিমানী শহরবাসীর ভেতরে প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। এ দেশের তথাকথিত শিল্পগুরুরা খড়গহস্ত হন সুলতানকে পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পীদের একজন বলে দাবি করায়। কিন্তু কোনো বিরোধিতাই সুলতানের প্রোজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে আর নিষ্প্রভ করতে পারেনি। এসবই সম্ভব হয়েছিল আহমদ ছফার ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে। আহমদ ছফা সেদিন অবিনয়ী ছিলেন বলেই কমটেম্পরারি গ্রেট মাস্টার্স পিকাসো, ডালি, মাতিস, পল ক্লে, মিকেল্যাঞ্জেলোদের কাতারে আমাদের সুলতানের আসন চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
ড. আহমদ শরীফ একবার ‘বেয়াদবি জিন্দাবাদ’ নামের একটি প্রবন্ধ লিখে ‘বেয়াদব’দের (?) স্তবগান গেয়েছিলেন। কারা এই বেয়াদব? তারাই, যারা অস্বীকার করে সমস্ত প্রথা, প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমানদের। নিজস্ব বিচার-বিবেচনা দিয়ে যারা সৃষ্টিশীলতাকেই মেনে নিয়েছে সর্বেশ্বর হিসেবে। অন্তরের আলোই যাদের চলার পথের পাথেয়। লোভ-লালসা যেমন এদের সম্মোহিত করতে পারে না, ভয়ের রক্তচক্ষুও টলাতে পারে না নিজের সংকল্প থেকে। আহমদ ছফার চরিত্রে না ছিল লোভ, না ছিল কোনো কিছুকে ভয়। ফলে জীবনের অনেক সংকটজনক পরিস্থিতিতে আহমদ ছফা এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কোনো গড়পড়তা মানুষের পক্ষে সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না।
সাহিত্যিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চিন্তাবিদ, মনীষী আহমদ ছফা ২০০১ সালের ২৮ জুলাই মারা যান। ১৯৪৩ থেকে ২০০১ সাল—আহমদ ছফার প্রায় ছয় দশকের জীবনযাপন আমাদের সামনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের এমন একজনকে তুলে ধরে, যিনি ছিলেন পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উন্মুখ। পরিপূর্ণ বিকাশ শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব, যিনি হতে পারেন স্বতঃসিদ্ধ স্বয়ংপুরুষ। আহমদ ছফার অভিজ্ঞতায় সাতচল্লিশের দেশভাগ অস্পষ্ট হলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন, ছদ্মগণতন্ত্র—আহমদ ছফার চিন্তাচেতনায় স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন কর্মোদ্যমে নিয়োজিত করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম বইটি আহমদ ছফারই রচিত। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশের অরাজকতা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আহমদ ছফাকে এতটাই ক্রুদ্ধ ও বেদনাহত করেছিল যে, তাকে তিনি আখ্যায়িত করেন ‘বেহাত বিপ্লব’ বলে। তবু আহমদ ছফা অফুরান আনন্দ, উৎসাহ আর কর্মোৎসাহের প্রেরণা হয়ে থাকবেন আমাদের কাছে। আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তার যে কীর্তিমান সন্তানগুলোর জন্য গর্ববোধ করবে, আহমদ ছফা হবেন তাঁদের ভেতরে উজ্জ্বলতরদের একজন।
কিন্তু বার্ট্রান্ড রাসেল ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও যে মনীষী আহমদ ছফার চেতনালোককে অধিকতর আলোড়িত করেছেন বলে মনে করি, তিনি জার্মান কবি ও নাট্যকার যোহান ভন গ্যেটে। এই মনীষীর বৈভবময় জীবন ও বিপুল সৃষ্টি ছফাকে সূর্যাভিমুখী পুষ্পের মতো প্রস্ফুটিত করেছে। গ্যেটের অমর কাব্য ‘ফাউস্ট’, যেটি তিনি দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে রচনা করেছেন, সেই বৃহদায়তন রচনাটি অনুবাদের যে সৎসাহসিক উদ্যোগ আহমদ ছফা নিয়েছিলেন, তাই তাকে বাংলা সাহিত্যে চির অমর করে দিয়ে গেছে। এই কর্মটিই প্রমাণ করে আহমদ ছফা গ্যেটে দ্বারা কী ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন।
কিন্তু এসবই কি আহমদ ছফার অবিনয়? আমার তো তাই মনে হয়। ব্যক্তিজীবনে ও সৃষ্টিশীলতায় আহমদ ছফা যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেটি একেবারেই অপ্রথাগত। তিনি জীবনযাপনে ছিলেন উদ্দাম, বাঁধনহারা, সৃষ্টিশীলতায় ছিলেন বিচিত্রাভিসারী। তিনি যে সাহিত্যের নতুন কোনো ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন, তা নয়। তিনি কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন গল্প-উপন্যাস, লিখেছেন প্রবন্ধ-স্মৃতিকথা-দিনলিপি, করেছেন অনুবাদ; অর্থাৎ একেবারেই প্রচলিত ধারা ও ফর্মে। কিন্তু আহমদ ছফার বিশেষত্ব ও অসাধারণত্ব সেসবের ভেতর দিয়েই হীরের দ্যুতির মতো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। আহমদ ছফার লেখা পাঠ কোনো আরামদায়ক অভিজ্ঞতা নয়, বরং যথেষ্ট অস্বস্তিদায়ক। এমনকি উপন্যাসগুলো পর্যন্ত এতটা সুখপাঠ্য নয় যে, বালিশে আলতো হেলান দিয়ে পড়া যাবে। আহমদ ছফাকে পড়তে হলে বসতে হবে সমস্ত মনোযোগ ও মনন নিয়ে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব পাঠের অভিজ্ঞতা। কোনো অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে আহমদ ছফার রচনা হজম করা কঠিন।
সব কিছু নিয়েই আহমদ ছফার ছিল নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। তাঁর দেখার চোখ ছিল একেবারেই অন্যরকম। কোনো সামাজিক ঘটনা বা প্রপঞ্চ ব্যাখ্যাতেও থাকত তাঁর নিজস্বতার ছাপ। এমনকি সাহিত্যের কোনো সংঘটন কিংবা উপন্যাসের কোনো চরিত্র নিয়ে যখন তিনি আলোচনা করেছেন, সেখানেও পাওয়া গেছে নব আলোকের উদ্ভাস। উদাহরণ হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুল পঠিত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র একটি চরিত্র হোসেন মিয়ার কথা বলা যেতে পারে। এই চরিত্রটিকে আহমদ ছফা যে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, আহমদ ছফার আগে কিংবা পরে কারও পক্ষেই এমন অভিনব ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়নি। হোসেন মিয়াকে তিনি দেবরাজ জিউসের মতো সর্বইচ্ছা শক্তিসম্পন্ন চরিত্র হিসেবে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুকের বঙ্গীয় সংস্করণ হিসেবে। অথবা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে তাঁর যে ব্যাখ্যাসমূহ, সেগুলো বিস্ময়েরই উদ্রেক করে। লেখক হতে হলে কতটা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, কতটা মননদীপ্ত, কতটা বৈপ্লবিক হতে হয় আহমদ ছফা তাঁর সেরা দৃষ্টান্তগুলোর একজন।
অন্যদিকে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে তাঁর যে অবিসংবাদিত স্মৃতিগ্রন্থ ‘যদ্যপি আমার গুরু’, সেটি পড়লে যে আহমদ ছফাকে আমরা পাই, সেই আহমদ ছফা অত্যন্ত সংবেদনশীল, প্রচণ্ড পড়ুয়া ও অস্থির অনুসন্ধিৎসু। এবং অবশ্যই স্মৃতিধর।
আহমদ ছফার পরিচয়ের বহুমুখিতা এখানেই শেষ নয়; তিনি যে কতটা বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন, সেটি তাঁর জীবনযাপনই প্রমাণ করে। আহমদ ছফার কুসুমকোমল অন্তঃকরণের পরিচয় পাই অনুজ-তরুণ লেখকদের প্রতি প্রগাঢ় স্নেহশীলতায়। আজকে খ্যাতিমান, লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনেক লেখকেরই সেদিন ছিলেন সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক, মহত্তম উৎসাহদাতা। সে সময়কার বহু তরুণের প্রথম বই আহমদ ছফার অর্থায়নে প্রকাশিত হয়েছে। এরই উল্টোদিকে আছে আহমদ ছফার রাগী, অনমনীয়, অনাপসী, সংকল্পদৃঢ় চরিত্র। জীবনে কোনো দিন কোনো অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি তিনি। শুধু নিজের সঙ্গে অন্যায় নয়, যখন দেখেছেন অন্যের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে, তখনও রুখে দাঁড়িয়েছেন। এস এম সুলতানের মতো একজন বিশ্বমানের চিত্রশিল্পী যখন শহুরেজনের নিরন্তর অবজ্ঞা-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, আহমদ ছফা তখন প্রতিজ্ঞা করে বসেন—যে করেই হোক সুলতানকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেবেন। কয়েক বছর পড়াশোনার পর তিনি লিখেন ‘বাঙালির চিত্র-ঐতিহ্য : এস এম সুলতানের সাধনা’ নামের দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ। সেই সময় প্রবন্ধটি শিক্ষাভিমানী শহরবাসীর ভেতরে প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। এ দেশের তথাকথিত শিল্পগুরুরা খড়গহস্ত হন সুলতানকে পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পীদের একজন বলে দাবি করায়। কিন্তু কোনো বিরোধিতাই সুলতানের প্রোজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে আর নিষ্প্রভ করতে পারেনি। এসবই সম্ভব হয়েছিল আহমদ ছফার ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে। আহমদ ছফা সেদিন অবিনয়ী ছিলেন বলেই কমটেম্পরারি গ্রেট মাস্টার্স পিকাসো, ডালি, মাতিস, পল ক্লে, মিকেল্যাঞ্জেলোদের কাতারে আমাদের সুলতানের আসন চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
ড. আহমদ শরীফ একবার ‘বেয়াদবি জিন্দাবাদ’ নামের একটি প্রবন্ধ লিখে ‘বেয়াদব’দের (?) স্তবগান গেয়েছিলেন। কারা এই বেয়াদব? তারাই, যারা অস্বীকার করে সমস্ত প্রথা, প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান আর শক্তিমানদের। নিজস্ব বিচার-বিবেচনা দিয়ে যারা সৃষ্টিশীলতাকেই মেনে নিয়েছে সর্বেশ্বর হিসেবে। অন্তরের আলোই যাদের চলার পথের পাথেয়। লোভ-লালসা যেমন এদের সম্মোহিত করতে পারে না, ভয়ের রক্তচক্ষুও টলাতে পারে না নিজের সংকল্প থেকে। আহমদ ছফার চরিত্রে না ছিল লোভ, না ছিল কোনো কিছুকে ভয়। ফলে জীবনের অনেক সংকটজনক পরিস্থিতিতে আহমদ ছফা এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কোনো গড়পড়তা মানুষের পক্ষে সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না।
সাহিত্যিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চিন্তাবিদ, মনীষী আহমদ ছফা ২০০১ সালের ২৮ জুলাই মারা যান। ১৯৪৩ থেকে ২০০১ সাল—আহমদ ছফার প্রায় ছয় দশকের জীবনযাপন আমাদের সামনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের এমন একজনকে তুলে ধরে, যিনি ছিলেন পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উন্মুখ। পরিপূর্ণ বিকাশ শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব, যিনি হতে পারেন স্বতঃসিদ্ধ স্বয়ংপুরুষ। আহমদ ছফার অভিজ্ঞতায় সাতচল্লিশের দেশভাগ অস্পষ্ট হলেও পাকিস্তানের সামরিক শাসন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন, ছদ্মগণতন্ত্র—আহমদ ছফার চিন্তাচেতনায় স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন কর্মোদ্যমে নিয়োজিত করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম বইটি আহমদ ছফারই রচিত। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশের অরাজকতা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আহমদ ছফাকে এতটাই ক্রুদ্ধ ও বেদনাহত করেছিল যে, তাকে তিনি আখ্যায়িত করেন ‘বেহাত বিপ্লব’ বলে। তবু আহমদ ছফা অফুরান আনন্দ, উৎসাহ আর কর্মোৎসাহের প্রেরণা হয়ে থাকবেন আমাদের কাছে। আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তার যে কীর্তিমান সন্তানগুলোর জন্য গর্ববোধ করবে, আহমদ ছফা হবেন তাঁদের ভেতরে উজ্জ্বলতরদের একজন।
No comments