আঞ্চলিক ভূরাজনীতির নতুন হিসাব-নিকাশ
১৯
জানুয়ারি ২০১৮ ট্রাম্প প্রশাসন নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল প্রকাশ করে। যেখানে
শত্রু হিসেবে চীন ও রাশিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধিকে বিশ্বে মার্কিন প্রভাবের ওপর
হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসের ভাষায়,
‘জঙ্গিবাদ নয়, যথার্থ ক্ষমতার লড়াই এখন মার্কিন প্রতিরক্ষার মূল লক্ষ্য।’
তাঁর মতে, ‘বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন কৌশলই বাঞ্ছনীয়।’ মার্কিন এই
কৌশল যেন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী
‘স্নায়ুযুদ্ধের’ প্রত্যাবর্তন। ট্রাম্পের নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে
বিশ্বজুড়ে চিন্তাভাবনা, বিতর্ক ও নানা সন্দেহ দানা বাঁধলেও এটাকে আসলে
ইউনিপোলার বা একক বৈশ্বিক শক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার
পতন হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই কৌশলে কার্যত চীন ও
রাশিয়ার ক্ষমতাকে সমপর্যায়ের হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং সব শক্তি
দিয়ে তা মোকাবিলার কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের বর্তমান
বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতায় পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে এবং ছোট-বড় সব দেশের ওপর
এর প্রভাব পড়বে। এর ফলাফল কী দাঁড়াবে, তা বুঝতে সময় লাগবে। তবে সাম্প্রতিক
অতীতের বিশ্বরাজনীতির নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে অনেক কিছুই আঁচ-অনুমান
করা সম্ভব। বিশ্বরাজনীতি যে নতুন বাস্তবতায় পড়তে যাচ্ছে, তার বলয় থেকে
বাংলাদেশ কোনোভাবেই মুক্ত নয়। বাংলাদেশে এর প্রভাব কী হতে পারে, তা বোঝার
জন্য এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিটি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী প্রায় চার দশকের স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়
নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। তারপর
পৃথিবীজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সেই একচ্ছত্র ক্ষমতা এখন ভাগাভাগি হতে যাচ্ছে চীন ও রাশিয়ার
সঙ্গে। প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় এই পক্ষগুলোর মধ্যে সব ধরনের ক্ষমতা বৃদ্ধির
প্রচেষ্টা চলবে। সাধারণভাবে বোঝা যায়, তাতে সব পক্ষই ক্ষমতা বাড়ানোর
মাধ্যমে একটা ‘ক্ষমতার ভারসাম্যের’ দিকে যেতে থাকবে।
তাতে ‘দ্বিমেরু’ বা
‘বহুমেরু’ ক্ষমতার আবির্ভাব হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র
বেচাকেনা, পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধি, জলে, স্থলে ও মহাকাশে নিজেদের আধিপত্য
প্রতিষ্ঠা এবং সে জন্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ হবে। এতে দেশগুলোর সেনা, নৌ
ও বিমানবাহিনীর শক্তি আরও বাড়বে। ট্রাম্প তাঁর প্রতিরক্ষা বাজেট ১০ শতাংশ
বাড়ানোর সুপারিশও করেছেন। বিগত দশকজুড়ে চীন ও রাশিয়ার ক্ষমতা খর্ব করতে এবং
যুক্তরাষ্ট্রের একক ক্ষমতা বজায় রাখতে ওবামা প্রশাসন রাশিয়া, চীন, ভারত,
পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ইরান, কিউবা সবার সঙ্গেই খুবই সূক্ষ্ম কূটনৈতিক
সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ট্রাম্পের নতুন কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র
অবস্থানের ইতি টানছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র খাতের বাজেট গত বছরে কমেছে
প্রায় ৩০ শতাংশ। এমন পরিস্থিতি বৈশ্বিক শান্তির ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা
নির্ধারণ করবে বেশ কিছু উপাদান বা সত্তার উপস্থিতির ওপর, যেমন বিভিন্ন
ছোট-বড় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সংস্থা,
রাজনৈতিক দল ও মতবাদ এবং জনগণ। বিগত দুই দশকে মার্কিন একক ক্ষমতার একটি
ইতিবাচক চর্চা ছিল গণতন্ত্রের বিস্তার ও স্বৈরাচারী ক্ষমতার পতন। পরাশক্তি
হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মতবাদ
বিস্তারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের
অধিকার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের
পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার
হামলার পর জঙ্গিবাদ ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে
এই দুই বিষয়ই কার্যত উপেক্ষিত। পৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের ক্ষমতা
বৃদ্ধির লড়াইয়ে মগ্ন থাকবে, তখন মানবিক অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত
দুর্যোগ, দুর্নীতি, আইন ও শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পড়বে। তবে
নয়-এগারোর পর ‘রাষ্ট্রহীন জঙ্গি বা জঙ্গি দলগুলো’ যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, তা
কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করা যেতে পারে। কারণ বৈশ্বিক রাজনীতিতে ‘ক্ষমতার
ভারসাম্য’ রক্ষা করার একটি প্রধান উপাদান হলো শত্রু ও মিত্রকে চেনা, তাদের
সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা রাখা। এমতাবস্থায় অচেনা শত্রু বা আকস্মিক
আক্রমণের মতো ঘটনাগুলো কেউই চাইবে না। তবে আইএসের মতো সংগঠনগুলো দুর্বল
হলেও তারা যে মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং তা যেভাবে দেশে দেশে বিস্তৃত
হয়েছে, তা মোকাবিলা সহজ না-ও হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের শক্তিকে ব্যবহারের
ফল যে ভালো হয়নি, তা উদাহরণ নিকট অতীতেই রয়েছে। ট্রাম্পের এই প্রতিরক্ষা
কৌশলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিজ নিজ
প্রভাববলয়ের অধীনে এনে জোট গঠন করা। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের’ ওপর জোর দেওয়া
এই কৌশলেরই অংশ। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগে রাখতে
চায়। এশিয়ায় চীনের প্রাধান্য মোকাবিলাই এর লক্ষ্য। ভারতীয় সাবেক নৌপ্রধান
অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক জোটের’ ব্যাখ্যায় বলেছেন, এটি
কেবল ভারতকেন্দ্রিক নয়, বরং ভারতীয় উপসাগরীয় অঞ্চলকে সংযোগ করে, যেখানে
বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে উল্লেখযোগ্য। চীনকে মোকাবিলা করার একক
ক্ষমতা ভারতের নেই। তার দরকার এশিয়া অঞ্চলে মিত্র, যাতে সে সব মনোযোগ ও
ক্ষমতা দিয়ে চীনের মোকাবিলা করতে পারে। এতে তার জোট করতে হবে বাংলাদেশ,
নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, মিয়ানমারের সঙ্গে। ফলে
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারত তার প্রভাব বাড়াতে থাকবে। অপরদিকে এই অঞ্চলের দুই
বিরোধপূর্ণ দেশ ভারত ও পাকিস্তানের নিজ নিজ অবস্থান জোরদার করতে আঞ্চলিক ও
আন্তর্জাতিক-সব পর্যায়ের মিত্রই লাগবে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ সময়ের
বিশ্বস্ত মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি দেশটিকে চীন-রাশিয়া বলয়ে
যুক্ত হতে বাধ্য করতে পারে। পাকিস্তানের আরেক পুরোনো মিত্র সৌদি আরবও এখন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে উদ্গ্রীব। পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক কি
আগের জায়গায় থাকবে? আমরা দেখছি, আফগানিস্তানের ওপরও ভারতের প্রভাব দিন দিন
বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদকে কে কীভাবে বা কার বিরুদ্ধে ব্যবহার
করবে-এই প্রশ্নগুলো সামনে চলে এসেছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ হিসেবে
বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে বা এ অঞ্চলে ভারতের শক্তি বৃদ্ধির পরিণতি কী
দাঁড়াবে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গিবাদের মদদ ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের ইস্যু বেশ বড়
ভূমিকা পালন করেছে। সামনে নির্বাচন আসছে, জঙ্গিবাদের ইস্যু বাংলাদেশের
রাজনীতিতে কী ও কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটাও বড় কৌতূহলের বিষয়। তবে
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রতিরক্ষানীতি এবং তার আলোকে এই অঞ্চলের পরিবর্তিত
ভূরাজনীতিও দেশের আগামী নির্বাচন ও রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
আইরিন খান: লেখক ও গবেষক।
আইরিন খান: লেখক ও গবেষক।
No comments