পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ ভরত ভায়না
ভরত
ভায়না নামটি শুনলেই ভ্রমণপিপাসুদের মনে কৌতূহলের উদ্রেক হতে পারে। তবে
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে তারা উড়িয়ে দেন সব বাধা। অনুসন্ধানী
মনের জানালা খুলতে বেরিয়ে পড়েন দর্শনীয় স্থান ঘুরতে। পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ
তাই দক্ষিণবঙ্গের ভরত ভায়নার দেউল। দেউল শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘মন্দির’ বা
দেবালয়। জায়গাটি এমনই যে ছবির কোনো ক্যাপশন না দিলে মনে হবে আপনি হয়তো
বগুড়ার মহাস্থানগড় কিংবা নওগাঁর পাহাড়পুর অথবা কুমিল্লার ময়নামতি ঘুরে
এসেছেন। খুলনা-যশোর সীমান্তের কেশবপুর উপজেলার গৌরীঘোনা ইউনিয়নের ভদ্রা
নদীর পশ্চিমতীরে ভরত ভায়না গ্রামের ত্রিমোহনী নামক স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে
আনুমানিক দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগের এক পুরাকীর্তি। বাংলাদেশের বিখ্যাত
প্রতœতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে এই প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনটি স্থানীয় জনগণের
কাছে দীর্ঘদিন ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত। ভরত ভায়না বৌদ্ধ
মন্দিরটি দক্ষিণবঙ্গের একমাত্র আদি ঐতিহাসিক যুগের স্থাপনা হিসেবে এরই
মধ্যে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। শীত মওসুম শুরুর সাথে সাথেই
দূর-দূরান্ত আর দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে জায়গাটি দর্শনীয় স্থানে রূপ
নিয়েছে। ভরতের দেউলের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে একেক জন একেক রকম কথা বললেও
অনুসন্ধানে যদ্দুর জানা যায়, অনুমিত মূল মন্দিরটি এক একর ২৯ শতক জমির ওপর
অবস্থিত।
১৮০০ বছর আগে ভরত নামে তৎকালীন এক প্রভাবশালী রাজা কেশবপুর-খুলনার
সামীন্তবর্তী ভদ্রানদীর তীর এলাকাসহ সুন্দরবনের অনেকাংশে রাজত্ব করেন।
কালের আবর্তে তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তিনি ভদ্রানদীর তীরে ভরত ভায়না
গ্রামে নির্মাণ করেন দেউল। প্রতœতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এখানকার ব্যবহৃত ইট ও
প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এটি
খ্রিষ্টিয় ৭ থেকে ৯ শতকে নির্মিত একটি বৌদ্ধ মন্দির। পূর্ণাঙ্গ খনন ও
আশপাশের অন্যান্য স্থানের খননকাজ সম্পন্ন হলে প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে বলে
অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। ১৮৮৯ সালে বৃটিশ সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের
দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারিন্টেনডেন্ট কাশিনাথ দীক্ষিত এ দেউল পরিদর্শনে এসে
মন্তব্য করেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ১২ দশমিক ২২ মিটার উঁচু এবং ২৬৬ মিটার
পরিধি বিশিষ্ট একটি ঢিবির অস্তিত্ব ছিল। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এ দেউলের
উপরিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সতীশচন্দ্র মিত্র ভরত ভায়না সম্পর্কে যশোহর-খুলনার
ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, এটা এখনো ৫০ ফুট উচ্চ আছে, লোকে বলে এটা আগে আরো
উচ্চ ছিল। কিন্তু একবার ভূমিকম্পে এলাকাটা ধসে যায়। ভৌগোলিক অবস্থা অনুযায়ী
পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে ১২.২০ মিটার উঁচু ভরত ভায়না ঢিবিটিকে সমভূমির মাঝে
একটি অনুচ্চ পাহাড়ের মতো দেখায়। ১৯২২ সালে ভারতের প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ
বিভাগ ঢিবিটি সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ১৯৮৫ সালে
প্রথম এই ঢিবি খনন করে। এক দশক পর ১৯৯৫-৯৬ সালে পুনরায় এখানে খনন করা হয়।
তখন থেকে ১৯৯৬-৯৭ বাদে ২০০০-০১ পর্যন্ত প্রতি মওসুমে এখানে খননকাজ অব্যাহত
থাকে। অবশ্য খনন এখনো শেষ হয়নি। খননের ফলে একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের
অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা থেকে অনুমান করা যায় যে, স্থাপনাটির
উপরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। বিদ্যমান অংশ সম্ভবত ওপরে স্থাপিত
মনোরম অট্টালিকার ভিত্তি বা উঁচু মঞ্চ। এই অট্টালিকা এখন টিকে নেই। ভিত্তি
অংশটুকু ক্রুশাকৃতির। খননে সমগ্র প্রাসাদটির ভিত থেকে শেষ পর্যন্ত মোট ৯৪টি
কক্ষ পাওয়া যায়। চারপাশে চারটি উইং ওয়াল। এর মধ্যে ১২টি কক্ষ। বাকি ৮২টি
কক্ষের সমন্বয়ে এ বৌদ্ধ স্তূপটি তৈরি। স্তূপটির চূড়ায় চারটি কক্ষ। এ কক্ষের
দুই পাশে আরো আটটি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। বেশির ভাগ কক্ষ মাটি দ্বারা
পরিপূর্ণ। প্রততত্ত্ব অধিদফতরের করা স্কেচ থেকে দেখা যায়, মোট ৮২টি বদ্ধ
প্রকোষ্ঠ ধাপে ধাপে ওপরের দিকে উঠে গেছে। ঢিবির শীর্ষ ধাপটির দেয়াল ৯ ফুট
প্রশস্ত। এর মধ্যে ছয় ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থের বর্গাকৃতির চারটি প্রকোষ্ঠ
আছে। মূল অট্টালিকার প্রধান কক্ষটি এই প্রকোষ্ঠের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় ধাপের দেয়াল তিন ফুট চওড়া, এখানে বিভিন্ন আকৃতির ১৯টি প্রকোষ্ঠ
আছে। তিন ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া দেয়ালের তৃতীয় ধাপে প্রকোষ্ঠ ১৮টি। সাড়ে তিন ফুট
চওড়া দেয়ালের চতুর্থ ধাপটিতে ১৯টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। শেষ ধাপে ১০ থেকে ১৩
ফুট চওড়া দেয়ালের মধ্যে ২২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। তার নিচে প্রায় ১০ ফুট
চওড়া প্রদক্ষিণ পথ আছে। মূল মন্দিরের চার দিকে চারটি প্রবেশপথ আছে। এগুলোর
মধ্যেও এখন পর্যন্ত সাতটি প্রকোষ্ঠ দেখা গেছে। গঠনশৈলী বিবেচনায় পূর্ব
দিকটাই এর মূল প্রবেশপথ ছিল বলে ধারণা করা হয়। এর নির্মাণে যে ইট ব্যবহার
করা হয়েছে, তার পরিমাপ ৩৬ সেন্টিমিটার, ২৬ সেন্টিমিটার ও ৬ সেন্টিমিটার। এত
বড় ইট এই অঞ্চলের কোনো পুরাকীর্তিতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি। ধারণা করা
হয়, বৌদ্ধ সপ্তকের উপরিভাগে জাঁকজমকপূর্ণ একটি উপাসনালয় ছিল। প্রাসাদটির
চারপাশে তিন মিটার চওড়া রাস্তা রয়েছে। উপাসনালয়ের চারপাশে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা
প্রদক্ষিণ করে পুণ্য অর্জন করত। চারটি উইং দেয়ালে যে ঘরগুলো ছিল সম্ভবত
সেগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন বা অবসর সময় কাটাতেন। স্থানীয়রা
জানান, খননকাজ চলাকালে যেসব পুরাকীর্তি ও জিনিসপত্র পাওয়া গেছেÑ খুলনা
বিভাগীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে মানবদেহের ( যেমন
: মাথা, বাহু, হাত ও পা এবং কাপড় ও অলঙ্কার প্রভৃতি। প্রাণী দেহের যেমন
(ষাঁড়ের মাথা), উপস্থাপন বিশিষ্ট পোড়ামাটির ফলকচিত্রের ভগ্নাংশ আর বিভিন্ন
ধরনের অলঙ্কৃত ইট, বিভিন্ন দৈনন্দিন ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত
মৃৎপাত্র ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া মাটির বাঘের মুখমণ্ডল,
মানুষের মুখমণ্ডল, দেব-দেবীর হাতের ভগ্নাংশ। বিভিন্ন প্রকৃতির নকশা করা
ইট, পোড়া মাটির খেলনা। এ ছাড়া বিভিন্ন নকশা করা ইট ও চাড়া পাওয়া গেছে।
প্রতœতাত্ত্বিক জিনিসগুলোর স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়া মাত্র কয়েকটি
প্রতœবস্তু মূল্যবান যেমন গুপ্তযুগের একটি পোড়ামাটির মাথা, পোড়ামাটির
মানুষের হাত ও পায়ের কয়েকটি ভগ্ন টুকরা, কয়েকটি মাটির প্রদীপ, অলঙ্কৃত ইটের
টুকরা, পদচিহ্ন সংবলিত দুটি ইটের টুকরা এবং একটি মাটির ক্ষুদ্র পাত্র
সংগৃহীত হয়েছে। সংগৃহীত মৃৎপাত্রের টুকরাগুলো হলো বিভিন্ন গৃহস্থালি জিনিস
যেমন- কলসি, বাটি, পিরিচ, ঢাকনী, প্রদীপ, গোলাপদানির ওপরের অংশের গলা,
কান্দা ও তলা। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আঞ্চলিক
পরিচালক আফরোজা খান মিতা নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতœস্থানটি স্থাপত্যের দিক
থেকে বিশ্ব ঐতিহ্য তথা প্রতœমনস্ক জাতির বিচরণের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে
চাই। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় তিন একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। স্থানটিতে
সীমানা প্রাচীর, টিকিট কাউন্টার, পরিচিতি স্থাপন করা হয়েছে। একটি প্রদর্শনী
জাদুঘর গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রতœগবেষক ও
পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলমান
রয়েছে। পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে মূল সড়ক থেকে প্রতœস্থানটি পর্যন্ত
সড়ক সরু হওয়ায় এটি প্রশস্তকরণে অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করা
হয়েছে। যতদূর জেনেছি, সেটি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়ে সওজ এবং এলজিইডিকে
অবহিত করা হয়েছে। কিভাবে যাবেন : স্থানটি যশোর জেলাতে হলেও সাতক্ষীরা,
চুকনগর, খুলনা হয়ে আসা যায়। যেকোনো প্রান্ত থেকে খুলনা আসার বাস পাবেন। এ
ছাড়া ট্রেনে করে খুলনা আসতে পারবেন। সহজ পথ হলোÑ প্রথমে অটোতে দৌলতপুর হয়ে
মহসিন মোড়ে আসতে হবে। তারপর আবার অটোতে (মাহেন্দ্র) করে ডুমুরিয়া উপজেলার
শাহপুরবাজার আসতে হবে। শাহপুরবাজারে নেমে যেতে হবে ভরতের দেউল। ভ্যান অথবা
অটোতে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরত্ব। তবে ভ্যানচালকদের ‘ভত্তের দেল’ না বললে
চিনবে না। ফেরার পথে ভ্যান/অটো সহজে পাওয়া যায় না বলেই রিজার্ভ হলে ভালো
হয়।
No comments