কান্না থামছে না ওদের by মামুনুর রশিদ
কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ওয়াসিম ও
সংগ্রামের পরিবারে কান্না থামছে না। তাদের মৃত্যু নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে
রহস্য। নিহতদের পরিবার ও র্যাবের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রহস্য আরও ঘনীভূত
হয়েছে। র্যাবের পক্ষ থেকে যে অপহরণের কথা বলা হয়েছে তা নিয়ে ওই এলাকায়ই
রয়েছে নানা আলোচনা। যে তারকে অপহরণের কথা বলা হয়েছে, ওই আখতার সেতুর টোল
আদায় কাজে জড়িত ছিলেন ওয়াসিমের অধীনে।
একসময় তার ঘনিষ্ঠজন
হিসেবে পরিচিত ছিলেন আখতার। এদিকে নিহত সংগ্রাম চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা
জানিয়েছেন, সংগ্রাম ও ওয়াসিমকে এর আগেও একবার র্যাব ধরে নিয়েছিল। তখন
র্যাবের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। কোন পক্ষের ইন্ধনে অপহরণ
নাটক সাজিয়ে সংগ্রাম ও ওয়াসিমকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে মারা হয়েছে বলে ওই
পরিবার দাবি করেছে।
গতকাল সরজমিন কদমতলী থানাধীন আলমবাগে গিয়ে দেখা গেছে র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত দু’টি পরিবারের পাশাপাশি গোটা এলাকায় পিনপতন নীরবতা। স্থানীয় সূত্র ও পরিবারের সদস্যরা জানান, র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ওয়াসিম ও সংগ্রামের নিহত হওয়ার নেপথ্যে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ইন্ধন রয়েছে। পোস্তগোলা সেতুর টোল আদায়কৃত টাকা-পয়সার আয়-ব্যয় নিয়মিত দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তারই বিশ্বস্ত আখতারের ওপর। এ সময় আখতার তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন ওয়াসিমের আলমবাগের বাড়ির পাঁচ তলায়। সেতু টোলের টাকা আদায়ের সব দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর নগদ টাকার লোভে পড়ে আখতার একাধিকবার হিসাবে গরমিল দেখাতে শুরু করে। এ নিয়ে ওয়াসিমের সঙ্গে তার চরম বিবাদ সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ও তার ছেলের মধ্যস্থতায় বেশ কয়েকবার তাদের দু’জনের কোন্দল মেটানো হয়। গত জানুয়ারি ওয়াসিমের টোল আদায়ের বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে আখতার পালানোর পর তাদের দু’জনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। টাকা উদ্ধার করতে সংগ্রামকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করতে থাকেন তিনি। কিন্তু এ ঘটনাটি আখতার জানতে পেরে ওয়াসিমের প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে হাত মেলায়। সংগ্রাম চৌধুরীর স্ত্রী সায়েমা চৌধুরী দাবি করেন, তারাই র্যাবকে দিয়ে অপহরণের নাটক সাজিয়ে বন্দুকযুদ্ধে তার স্বামী ও ওয়াসিমকে হত্যা করেছে। তিনি জানান, তার স্বামী সংগ্রাম, আখতার, সুমন, জনিসহ অনেকেই ওয়াসিমের সেতুর টোল আদায়ের কাজ করতেন। ওয়াসিম তাদের সবাইকে বিশ্বাস করতেন। গত ১০-১৫ দিন আগে সেতুর টোল আদায় ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ ওলামা আলী গ্রুপের রাজুর সঙ্গে তাদের একটি ঝামেলা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ৬ মাস আগে ওলামা আলীর লোকের ইন্ধনে র্যাব ওয়াসিম ও সংগ্রামকে নারায়াণগঞ্জ থেকে আটক করে। পরে ওয়াসিমের সঙ্গে র্যাবের গোপন রফা হলে সকালে তাদের দু’জনকে ছেড়ে দেয়। এদিকে নিহত ওয়াসিমের ছেলে আলী আহসান জানান, ওই সময় র্যাবের সদস্যরা তার পিতা ও সংগ্রামকে রাত দু’টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ধরে নিয়ে যান। পরের দিন সকালে র্যাবের টেলিফোন পেয়ে তাদের দু’জনকে তিনি বাড়িতে নিয়ে আসেন। এ সময় র্যাবের সঙ্গে তার পিতার কোন গোপন রফা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব ১০-এর অপারেশন অফিসার ফজলে রাব্বি জানান, ঘটনার পর অনেকে অনেক কথাই বলছে। ওয়াসিম ও সংগ্রামকে এর আগে র্যাব আটক করেছে বলে এমন তথ্য তার জানা নেই।
যেভাবে উত্থান ওয়াসিম-সংগ্রামের: এক সময় রিকশা ও বেবিট্যাক্সি চালালেও ওয়াসিম ও সংগ্রাম হয়ে ওঠেন কোটি টাকার মালিক। তাদের বিরুদ্ধে রিকশা ও সিএনজি চোর সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, এক যুগ আগেও রিকশা ও বেবিট্যাক্সি চালাতেন ওয়াসিম ও সংগ্রাম। পরে ওয়াসিম দীর্ঘদিন গাবতলী-সায়েদাবাদ ৮ নম্বর বাসের চালক হিসেবে গাড়ি চালান। ওয়াসিম ও সংগ্রাম ঋণ করে একটি বেবিট্যাক্সি কেনেন। কিন্তু ওয়াসিমের বেবিট্যাক্সি চুরি হয়ে যায়। এর পরে চোর ধরতে গিয়ে নিজেরাই চৌরচক্র পরিচালনায় জড়িয়ে পড়েন। সায়েদাবাদ-যাত্রবাড়ী-কদমতলী এলাকায় সিএনজি গাড়ি চোরাই চক্রের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন ওয়াসিম। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন আখতার হোসেন। সম্রাট ও সংগ্রামসহ অনেকেই ছিলেন তার অপরাধ সিন্ডিকেট সদস্য। টাকার মালিক বনে যাওয়ার পরে আলমবাগ এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়ি নির্মাণ করেন ওয়াসিম। স্থানীয় রাজনৈতিক মহারথী অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরে তিনি পোস্তগোলা বুড়িগঙ্গা এক নম্বর সেতুর টোল আদায়ের ইজারা নেন। অর্থ সম্পদের মালিক হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় ওয়াসিমের।
No comments