মেধা ও তারুণ্যের প্রতি রাষ্ট্রের উপেক্ষা

গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলের আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের কারণে দীর্ঘ সময় নিয়ে এই পরীক্ষা নিতে হয়েছে। বেশির ভাগ পরীক্ষা হয়েছে শুক্র ও শনিবার। অন্য দিন বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ থাকায় পরীক্ষা হতে পারেনি। গত বছর একই সমস্যা হয়েছিল এসএসসি, জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষার বেলায়ও। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় গত বছর আগস্টের মাঝামাঝি। এখন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। এর মধ্যে ছয় মাস চলে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ভর্তির প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। মার্চ নাগাদ ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হলেও ক্লাস শুরু হতে এপ্রিল-মে পর্যন্ত গড়াবে। মাঝখানে পুরো একটি বছর হারিয়ে যাবে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবন থেকে। সাধারণত একটি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নতুন শ্রেণীতে ভর্তির প্রক্রিয়া তিন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। গত এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার অজুহাত দেওয়া হলেও ভর্তি প্রক্রিয়ার এই বিলম্ব সব সময় ঘটে থাকে। কেন ঘটে, কারা ঘটান, তার ব্যাখ্যা নেই। ইতিমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাধিক সেমিস্টার শেষ করেছে।
আমাদের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও এ নিয়ে আন্দোলন করে না। আর সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতারা মনে করেন, পরীক্ষা যত বিলম্বে হবে, তত তাঁদের লাভ। নেতৃত্ব প্রলম্বিত হবে; সেই সঙ্গে চাঁদাবাজি আর দখলবাজিও। কেবল ভর্তি পরীক্ষা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব পরীক্ষা, ক্লাস ও কোর্স শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কম-বেশি সেশনজট আছে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে। গড়ে দুই থেকে তিন বছর সেশনজট চলছে এই প্রতিষ্ঠানটিতে। এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদেরই এবং বলা বাহুল্য, তাঁদের সংখ্যাই বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্নাতক ও স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ২১ থেকে ২২ লাখ। যার মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ পড়াশোনা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অন্যরা অর্থাৎ তুলনামূলক সুবিধাভোগীরা ভর্তি হন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। কেউ কেউ উচ্চতর মাদ্রাসায়ও পড়েন। কিন্তু অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতায় পড়েন, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মা-বাপ আছে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চলছে সেই পুরোনো নিয়মেই। সেখানে অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থী গড়ে দুই বছর সেশনজটে পড়লে জাতীয় ক্ষতির পরিমাণটি ভাবা যায়। ১৩-১৪ লাখ ছাত্রছাত্রীর জীবন থেকে দুটি বছর করে হারিয়ে যাচ্ছে। কমপক্ষে ২৬ লাখ ইউনিট বছর। গত বছর এইচএসসিতে পাস করেছেন পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার। এঁদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে না পড়লেও অধিকাংশ পড়বেন। কিন্তু তাঁদের জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিন, মাস ও বছরগুলোর হিসাব কে দেবেন?
দুই প্রতিদিন পাঠকের কাছ থেকে বহু চিঠি পাই। তরুণদের চিঠির বেশির ভাগই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ও বিসিএস পরীক্ষা-সংক্রান্ত। গতকাল প্রথম আলোয় খবর বের হয়েছে, প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশের সাত মাস পার হলেও ৩৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। ফলে দুশ্চিন্তায় আছেন ৪৬ হাজার ২৫০ জন পরীক্ষার্থী। ভাবা যায়! এই কর্মকমিশন নিয়ে আমরা কী করব? সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আগের বয়সসীমা ছিল ২৮ বছর। এখন করা হয়েছে ৩০ বছর। কিন্তু অনেকেরই অভিযোগ, এই সময়ের মধ্যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে পারেন না। পারলেও চাকরি খোঁজার বয়স থাকে না। সে জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বা ৩৫ করার দাবি তাঁদের। পৃথিবীর আর কোনো দেশে তরুণদের নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার এমন তামাশা করতে পারে না। সব সম্ভবের দেশে সবকিছু করে পার পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ আছে। আছে পথ ও মতের বিস্তর ফারাক। কিন্তু একটি জায়গায় তাদের মধ্যে অদ্ভুত মিল দেখা যায়। সেটি হলো, তরুণ প্রজন্মকে ক্রমাগত উপেক্ষা করা। তাদের তারুণ্য, প্রাণশক্তি ও মেধাকে অগ্রাহ্য করা। আর এই কাজটি শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও অভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অতিশয় বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে পড়েছে। প্রথম শ্রেণীতে পড়ার আগেই ছেলেমেয়েকে দুই থেকে তিন বছর পড়তে হয়, প্লে গ্রুপ, কেজি ওয়ান, কেজি টু। তাই একটি শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হতেই আট থেকে নয় বছর লেগে যায়। চার বছর বয়সেও শিশুটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে এসএসসি পাস করতে লাগে ১৮-১৯ বছর। এরপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ছয়-সাত বছর।
আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খপ্পরে পড়লে তো বাড়তি দুই বছর যোগ করতে হবে। এরশাদের আমলে আশির দশকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছিল। তখন আমাদের এক অনুজ শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করার পর এখানে ভর্তির প্রক্রিয়া বিলম্ব দেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে। সেখানে চার বছরে অনার্স ও এমএ করার পর দেশে এসে দেখেন, তাঁর সতীর্থরা অনার্সই শেষ করতে পারেননি। এই অপচয়ের জবাব কী? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই মস্ত বড় দুর্বলতার দিক নিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা কিংবা শিক্ষাবিদেরা ভাবেন না। ভাবলে প্রতিবছর লাখ লাখ পরীক্ষার্থীকে এভাবে পরীক্ষা, ফল প্রকাশ কিংবা ভর্তি পরীক্ষার তারিখের জন্য হয়রানি ও দুর্ভোগে পড়তে হতো না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা তাঁরা একবারও চিন্তা করেন না। আমাদের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই বড় বড় কথা বলেন। তাঁদের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বলে দাবি করেন, কিন্তু নতুন প্রজন্মের প্রায় প্রত্যেকের জীবন থেকে যে তিন-চারটি বছর হারিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁরা কেউ কিছু বলেন না। এর পেছনে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী শিক্ষার এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতি রাষ্ট্রের ও শিক্ষার অভিভাবকদের চরম উদাসীনতা। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলেজ পর্যায়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। আগে যার দায়িত্ব ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব শিক্ষাক্রম পরিচালনার পাশাপাশি কলেজগুলোর তদারকির কাজ করত; বিশ্ববিদ্যালয় সনদও প্রদান করত তারা। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় শৃঙ্খলা আনার বদলে দুর্গতি এনেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ও কলঙ্কিত হয় বিগত বিএনপি সরকারের আমলে, যখন আফতাব উদ্দিন আহমাদ উপাচার্য ছিলেন। পরবর্তীকালে পদ্মা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। একাধিকবার সরকার ও উপাচার্য বদল হয়েছেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টির দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা কমেছে এমন দাবি করা যাবে না। সেশনজট আগেও ছিল, এখনো আছে।
দলীয়করণ আগেও ছিল, এখনো আছে। আর এসব রোগের উপসর্গ এখন আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমিত নেই, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মচ্ছব চলছে। যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরাই বিশ্বদ্যািলয়গুলোকে দলীয় কর্মীদের কর্মসংস্থান কেন্দ্রে পরিণত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ও শিক্ষক-কর্মচারী অনুপাত কত হওয়া উচিত? উন্নত বিশ্বে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত ১০:১। অর্থাৎ ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। আমাদের দেশে সেটি সম্ভব না হলেও ইউজিসি এই অনুপাত বেঁধে দিয়েছে ১৪:১। কিন্তু যেখানে ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুপাত বেশি হওয়ার কথা, সেখানে অনেক কম। উপাচার্য মহোদয়েরা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম যে কাজটি করেন সেটি হলো, কিছু অপ্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে দল ভারী করা। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই এখন মাথাভারী প্রশাসন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও কর্মচারী অনুপাত ৪: ১। অর্থাৎ চারজন ছাত্র বা ছাত্রীকে দেখাশোনার জন্য একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী রয়েছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ও বেতন বাড়ানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও বেতন থেকে আয় বাড়বে ৫০ লাখ টাকারও কম। অথচ বাড়তি শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ করে তাঁদের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। জনগণের অর্থ নিয়ে এমন স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর সাহস পান কীভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা? একটি দেশের মানবসম্পদ তৈরি করার প্রধান মাধ্যম হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ আমাদের দেশে এর মানই নাজুক। পশ্চিমের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, প্রতিবেশী দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও আমরা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছি না। বিশ্ব, এমনকি এশীয় সূচকেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। আর কত নিচে নামলে মহাত্মনদের চৈতন্যোদয় হবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.