জলবায়ু পরিবর্তন -কোপেনহেগেন সম্মেলনে বাংলাদেশের কর্মকৌশল by ফাহমিদা খাতুন
জলবায়ু পরিবর্তন চলমান, এটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তসরকারি প্যানেল বা আইপিসিসি ২০০৭ সালে তাদের চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্টে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিদ্যমান অনেকগুলো বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করে। আইপিসিসি দেখিয়েছে যে গত ১০০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯৬১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত এক দশমিক আট মিলিমিটার থেকে বেড়ে ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সময়ে তিন দশমিক এক মিলিমিটার বেড়েছে; বেশি অঞ্চলজুড়ে এবং বেশি সময় ধরে খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশের পরিস্থিতি অনেকভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এতে করে কৃষি উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষি উত্পাদনে এই ক্ষতির পরিমাণ এশীয় দেশগুলোতে শতকরা ১০ ভাগ এবং সাব-সাহারার আফ্রিকায় শতকরা ১৭ ভাগ হতে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান হারে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গম উত্পাদন শতকরা ১২ ভাগ, ধান উত্পাদন শতকরা ১০ ভাগ এবং ভুট্টা উত্পাদন শতকরা ১৭ ভাগ কমে যেতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ১৬০ কোটি লোকের জন্য পানি এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু ধনী এবং দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য বাড়বে না, দরিদ্র দেশের ভেতরেও বৈষম্য দেখা দেবে। দেশের ভেতরে আর্থসামাজিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কনভেনশন কাঠামো বা ইউএনএফসিসির অধীনে বালি রোডম্যাপ গৃহীত হয়। এতে বিশ্বের দেশগুলো ২০১২ পর্যন্ত এবং তার পরেও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বালি রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে পাঁচটি বিষয়ে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য হওয়ার কথা। এগুলো হলো, (১) দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার জন্য অংশীদারিমূলক দৃষ্টিভঙ্গী, যার মধ্যে বিশ্বের কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা থাকবে, (২) জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বেশি করে কার্যক্রম গ্রহণ করা, (৩) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, (৪) জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং ঝুঁকি মোকাবিলা করতে কার্যক্রম নেয়ার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া বর্ধিত করা, (৫) আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানো।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়কালে গড় তাপমাত্রা মে মাসে এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং নভেম্বর মাসে শূন্য দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। অন্যদিকে বাত্সরিক গড় বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে; ঘন ঘন এবং ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে; ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর কারণে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তাই শুধু বিঘ্নিত হবে না, যারা বেঁচে থাকবে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও হুমকির মুখে পড়বে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। কেননা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া যে কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন করে তা খুবই নগণ্য। তাই বাংলাদেশের জন্য কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা নয়, এই প্রভাবের মাত্রা কমিয়ে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য পরিমণ্ডলে এর ঝুঁকি মোকাবিলার প্রচেষ্টাই মূল লক্ষ্য। যেমন কী করে জলবায়ুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি উত্পাদন চালিয়ে যাওয়া যায়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সেটি কোথায় পাওয়া যাবে? তা ছাড়াও প্রয়োজন প্রযুক্তি।
উন্নত দেশগুলোর কথা এবং কাজের মধ্যে মিল না থাকার কারণে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের সক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম তেমন এগোতে পারছে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কার্বনমুক্ত করতে হলে অর্থ ব্যয় করতে হয়। উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য নিজেদের দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চললেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সাহায্যে তেমনভাবে এগিয়ে আসছে না। চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তাতে প্রায় চার হাজার ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য। এই বিপুল অর্থ মূলত উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতির জন্য ভর্তুকিস্বরূপ। এ ধরনের পদক্ষেপ অসম এবং বৈষম্যমূলক। কেননা, পরিবেশ রক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দে এ রকম উদারতা দেখা যায় না। ইউএনএফসিসি হিসাব করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজন হবে ২৮ থেকে ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা তাদের মোট জাতীয় উত্পাদন বা জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ থেকে শূন্য দশমিক ২১ ভাগ হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতেও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কেননা, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জ্বালানি অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি বলেছে, এই খাতে ২২ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ ২০০৮ সালে বিনিয়োগ হয়েছে ১৪৮ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে বাংলাদেশের জন্যও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রমের অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য সামগ্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে এবং আন্তর্জাতিক কাঠামোর অধীনে পরিবেশ-বান্ধব বিনিয়োগ বহু গুণে বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ জলবাযু পরিবর্তনের জন্য যে কম্প্রিহেনসিভ অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করেছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম পাঁচ বছরের জন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রয়োজন হবে। তবে অর্থায়নের ব্যাপারে আরেকটি বিষয় হলো, জলবায়ু সংক্রান্ত বর্ধিত অর্থ সাহায্য কিভাবে, কোন কাঠামোর অধীনে ব্যয় করা হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে অর্থ জোগাড় করার চেয়ে অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করাটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষতি ও ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই এই বিনিয়োগের একটা বড় অংশ এসেছে উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং দাতা গোষ্ঠীর কাছ থেকে। বাংলাদেশের জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হল, এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিকে সামনে রেখে এই ঝুঁকি হ্রাসে যথাযথ সমন্বিতভাবে কাজ করে যাওয়া। ২০০৮ সালে সরকার বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কৌশলপত্র এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই কৌশলপত্র এবং কর্মপরিকল্পনা ছয়টি ভিত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। (১) খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য, (২) সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, (৩) অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা, (৪) গবেষণা, (৫) জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা এবং (৬) প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনাটি কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে ২০০৯ এ পুনঃসংস্করণ করা হয়েছে। এতেও এই ছয়টি বিষয়েই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোপেনহেগেনে জলবায়ু সংক্রান্ত জাতিসংঘের সম্মেলনে বাংলাদেশের মানুষের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ঝুঁকি মোকাবিলায় কী কী প্রস্তুতি নেয়া জরুরি দরকার, সে সব বিষয়ে আলোচনার মূল নথিপত্র হবে এই কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনাটি।
তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করা সংক্রান্ত আলোচনায় দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। কোন উত্স থেকে অর্থ আসবে, কোন শর্তে আসবে, কিভাবে তা ব্যয় হবে, প্রযুক্তি হস্তান্তর কিভাবে হবে, বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব আইনের ব্যাপারে জটিলতা কিভাবে দূর করা হবে— এই বিষয়গুলো জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশের কৌশলপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। বিশ্ববাসী ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত পেয়েছে, আগামী ৭-১৮ ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন কমানোর ব্যাপারে কোনো ধরনের আইনগত চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। তবে এ ধরনের চুক্তি হোক বা না হোক বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোপেনহেগেন এবং তারপরেও বিশ্বসভায় দেনদরবারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং জুতসই প্রযুক্তি আহরণ করা।
(অক্টোবর ২০০৯-এ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের ওপর সেমিনারে উপস্থাপনার আলোকে রচিত)
ড. ফাহমিদা খাতুন : অর্থনীতিবিদ।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কনভেনশন কাঠামো বা ইউএনএফসিসির অধীনে বালি রোডম্যাপ গৃহীত হয়। এতে বিশ্বের দেশগুলো ২০১২ পর্যন্ত এবং তার পরেও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বালি রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে পাঁচটি বিষয়ে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য হওয়ার কথা। এগুলো হলো, (১) দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার জন্য অংশীদারিমূলক দৃষ্টিভঙ্গী, যার মধ্যে বিশ্বের কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা থাকবে, (২) জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বেশি করে কার্যক্রম গ্রহণ করা, (৩) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, (৪) জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং ঝুঁকি মোকাবিলা করতে কার্যক্রম নেয়ার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া বর্ধিত করা, (৫) আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানো।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়কালে গড় তাপমাত্রা মে মাসে এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং নভেম্বর মাসে শূন্য দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। অন্যদিকে বাত্সরিক গড় বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে; ঘন ঘন এবং ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে; ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর কারণে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তাই শুধু বিঘ্নিত হবে না, যারা বেঁচে থাকবে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও হুমকির মুখে পড়বে। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। কেননা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া যে কার্বনডাই অক্সাইড নির্গমন করে তা খুবই নগণ্য। তাই বাংলাদেশের জন্য কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা নয়, এই প্রভাবের মাত্রা কমিয়ে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য পরিমণ্ডলে এর ঝুঁকি মোকাবিলার প্রচেষ্টাই মূল লক্ষ্য। যেমন কী করে জলবায়ুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি উত্পাদন চালিয়ে যাওয়া যায়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সেটি কোথায় পাওয়া যাবে? তা ছাড়াও প্রয়োজন প্রযুক্তি।
উন্নত দেশগুলোর কথা এবং কাজের মধ্যে মিল না থাকার কারণে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের সক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম তেমন এগোতে পারছে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কার্বনমুক্ত করতে হলে অর্থ ব্যয় করতে হয়। উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য নিজেদের দেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চললেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সাহায্যে তেমনভাবে এগিয়ে আসছে না। চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তাতে প্রায় চার হাজার ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য। এই বিপুল অর্থ মূলত উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতির জন্য ভর্তুকিস্বরূপ। এ ধরনের পদক্ষেপ অসম এবং বৈষম্যমূলক। কেননা, পরিবেশ রক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দে এ রকম উদারতা দেখা যায় না। ইউএনএফসিসি হিসাব করেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজন হবে ২৮ থেকে ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা তাদের মোট জাতীয় উত্পাদন বা জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ থেকে শূন্য দশমিক ২১ ভাগ হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতেও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কেননা, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জ্বালানি অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি বলেছে, এই খাতে ২২ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। অথচ ২০০৮ সালে বিনিয়োগ হয়েছে ১৪৮ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে বাংলাদেশের জন্যও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রমের অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য সামগ্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে এবং আন্তর্জাতিক কাঠামোর অধীনে পরিবেশ-বান্ধব বিনিয়োগ বহু গুণে বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ জলবাযু পরিবর্তনের জন্য যে কম্প্রিহেনসিভ অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করেছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম পাঁচ বছরের জন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার অর্থ প্রয়োজন হবে। তবে অর্থায়নের ব্যাপারে আরেকটি বিষয় হলো, জলবায়ু সংক্রান্ত বর্ধিত অর্থ সাহায্য কিভাবে, কোন কাঠামোর অধীনে ব্যয় করা হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে অর্থ জোগাড় করার চেয়ে অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করাটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ক্ষতি ও ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে, অনেক ক্ষেত্রেই এই বিনিয়োগের একটা বড় অংশ এসেছে উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং দাতা গোষ্ঠীর কাছ থেকে। বাংলাদেশের জন্য সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হল, এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিকে সামনে রেখে এই ঝুঁকি হ্রাসে যথাযথ সমন্বিতভাবে কাজ করে যাওয়া। ২০০৮ সালে সরকার বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কৌশলপত্র এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই কৌশলপত্র এবং কর্মপরিকল্পনা ছয়টি ভিত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। (১) খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য, (২) সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, (৩) অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা, (৪) গবেষণা, (৫) জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা এবং (৬) প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনাটি কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে ২০০৯ এ পুনঃসংস্করণ করা হয়েছে। এতেও এই ছয়টি বিষয়েই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোপেনহেগেনে জলবায়ু সংক্রান্ত জাতিসংঘের সম্মেলনে বাংলাদেশের মানুষের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ঝুঁকি মোকাবিলায় কী কী প্রস্তুতি নেয়া জরুরি দরকার, সে সব বিষয়ে আলোচনার মূল নথিপত্র হবে এই কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনাটি।
তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করা সংক্রান্ত আলোচনায় দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। কোন উত্স থেকে অর্থ আসবে, কোন শর্তে আসবে, কিভাবে তা ব্যয় হবে, প্রযুক্তি হস্তান্তর কিভাবে হবে, বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব আইনের ব্যাপারে জটিলতা কিভাবে দূর করা হবে— এই বিষয়গুলো জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশের কৌশলপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। বিশ্ববাসী ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত পেয়েছে, আগামী ৭-১৮ ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমন কমানোর ব্যাপারে কোনো ধরনের আইনগত চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না। তবে এ ধরনের চুক্তি হোক বা না হোক বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোপেনহেগেন এবং তারপরেও বিশ্বসভায় দেনদরবারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ এবং জুতসই প্রযুক্তি আহরণ করা।
(অক্টোবর ২০০৯-এ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের ওপর সেমিনারে উপস্থাপনার আলোকে রচিত)
ড. ফাহমিদা খাতুন : অর্থনীতিবিদ।
No comments