টিপাইমুখ: একটি বইয়ের খোঁজে -তথ্যভাণ্ডার by শাহদীন মালিক
শুরুতেই
দুটো পুরোনো কথা। কেচ্ছা-ঘটনা। কেচ্ছা এ জন্য যে সঠিক দিন-ক্ষণ-তারিখ-সময়
মনে নেই। আর ঘটনা এ জন্য যে ঘটনাটা আসলেই ঘটেছিল। অবশ্যই কোনোটাই বিরাট
কিছু নয়, কিছুটা ব্যক্তিগত বটে। তাই পাঠক খুব বেশি পুলকিত নাও হতে পারেন।
প্রথম ঘটনা কমবেশি বছর দশেক আগের। গ্যাস নিয়ে সারা দেশে অনেক দিন ধরে মহা হুলস্থুল চলছিল। গ্যাস গেল রে, গ্যাস গেল রে বলে আকাশ-বাতাস ধ্বনিত হচ্ছিল প্রায় সর্বক্ষণ। লং, শর্ট, উল্টো-সিধা অনেক মার্চেই দেশ টইটম্বুর। তখনো টিভি চ্যানেলে টক শোর উত্পাত শুরু হয়নি। বক্তৃতা-বিবৃতি সব পত্রপত্রিকায়।
বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অনেক দরপত্র-ইজারা। কেউ বলেন, দেশের যা গ্যাস, তাতে যুগ যুগ চলবে। অনেকের সন্দেহ, এক যুগও চলবে না। কেউ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্যাস বিক্রির পক্ষে, কেউ ৫০ বছরের রিজার্ভ রাখার ঘোষণায় বিভোর।
গ্যাসের ব্যাপারে আমি তখনো এবং এখনো নিরেট-নিখাদ অজ্ঞ। চতুর্দিকে গ্যাস নিয়ে এত হইচই—কত আর চোখ-কান বন্ধ করে থাকা যায়। তখন আমার বেশির ভাগ সময় কাটে একটা এনজিওতে। দরখাস্ত ঠুকলাম সরকার-বাহাদুর বরাবর। সাদামাটা কথা। দুটি সদ্য পাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী তরুণকে তিন-চার মাসের জন্য নিয়োগ দেব। তাদের কাজ হবে গ্যাসসংক্রান্ত যত বইপত্তর, জার্নাল, প্রবন্ধ, রিপোর্ট পাওয়া যায় সব জোগাড় করা অর্থাত্ কেনা। তারপর ওই প্রকাশিত-জ্ঞানের একটি তালিকা করা। কথা নাই, বার্তা নাই আবেদনে সাড়া মিলল। তিন লাখ টাকা অনুদান পেলাম। আগেই বলেছি, সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে নেই। দুই-চার হাজার টাকা কমও হতে পারে। তবে বড় দাগে তিন লাখ টাকার অনুদান ছিল, সেটা আমি নিশ্চিত।
যেহেতু তিন-চার মাসের চাকরি, তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ববিজ্ঞান বিভাগে খোঁজখবর লাগালাম। কপাল ভালো। সদ্য ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করা দুজনকে পেয়ে গেলাম। ঠিকমতো পাক্কা চাকরি পাওয়ার আগে দুই-চার মাস আমার সঙ্গে কাজ করবে। কাজ বুঝিয়ে দিতে সময় লাগল অল্পই। গ্যাস নিয়ে যা পাও, তা-ই ক্রয় করবে।
হাজার ছয় টাকা খরচ করে বড় গোছের বইয়ের শোকেস কিনলাম। আমার গ্যাস বোঝার দরকার নেই, কিন্তু কেউ যদি গ্যাস বুঝতে চায়, তাহলে ওই এনজিওতে এলেই হবে। গ্যাস-পাঠাগার বা তথ্যকেন্দ্র গড়ার উদ্দেশ্যেই ওই প্রকল্প বা অনুদানের তিন লাখ। ভেবে রেখেছিলাম সব বই-পুস্তক-জার্নাল-রিপোর্ট জোগাড় এবং সেগুলোর সারাংশসহ তালিকা হয়ে গেলে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে সবাইকে জানিয়ে দেব। গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে জানাতে চাইলে সব বই-পত্তর এখানে আছে।
নিয়োগ দিলাম, শেলফ কিনলাম। তারপর আমি সপ্তাহ দুয়েক ঢাকার বাইরে। তিন সপ্তাহ গেল—শেলফটা তখনো একদম খালি। দুই তরুণ ভূতত্ত্ববিজ্ঞানীকে তলব করলাম। বই কোথায়? বোঝা গেল তারা এ-অফিস ও-অফিস দৌড়াদৌড়ি করছে। নিউমার্কেট, নীলক্ষেতসহ সব বই-বাজারে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ‘স্যার, বই নেই।’
হতেই পারে না। ৪০ বছর ধরে দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। সেই ষাটের দশকেই ছাতকের সিমেন্ট আর ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানা হয়েছে গ্যাস সম্বল করে। আশুগঞ্জ বিদ্যুত্। সবই তো গ্যাসে চলছে কয়েক দশক ধরে। গ্যাস ছাড়া রান্না-খাওয়া কিছুই হবে না। তা ছাড়া গ্যাস রপ্তানি নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে এত হুলস্থুল। গ্যাসে আগুন জ্বলে—রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত তো হবেই। আর বলে কিনা বই নেই।
ঠিক মনে পড়ছে না। অনুদানের কিছু টাকা বোধ হয় ফেরত গিয়েছিল। বই পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক বদরুল ইমামের একটি বইয়ে বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে পৃষ্ঠা তিরিশেকের একটা অধ্যায় ছিল। বুয়েটের দুই অধ্যাপকের নাম মনে পড়ছে—দুটো করে প্রবন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। সব মিলিয়ে জ্ঞানের পরিধি সোয়া শ পৃষ্ঠার মতো। তবে বিভিন্ন সাপ্তাহিকে দুই-চার পৃষ্ঠা করে রিপোর্ট-কলাম পাওয়া গিয়েছিল এন্তার। সাংবাদিক-রিপোর্টার ভাইবোনেরা তো আর ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী নয়। তাই সাপ্তাহিক বা পত্রিকায় প্রকাশিত দু-চার পৃষ্ঠার বয়ান তো জ্ঞান হতে পারে না।
আমাদের গ্যাস সম্পদ নিয়ে তথ্য-জ্ঞানকেন্দ্র করার আমার মহাপরিকল্পনা, বলাবাহুল্য ভেস্তে গেল। গ্যাস নিয়ে গত ১০ বছরে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার বিকশিত হয়েছে কি না, তার খোঁজ আর রাখিনি। তবে আমি নিশ্চিত, গ্যাস-তেলসংক্রান্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এ সংক্রান্ত জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের চেয়ে শত গুণে বেশি সমৃদ্ধ। গ্যাস-তেলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে নিশ্চয়ই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আমাদের গ্যাস নিয়ে। অন্যরা জানে, আমি বোধ হয় কিছুই জানি না।
আমার দ্বিতীয় কেচ্ছা-ঘটনা আরও আগের। সম্ভবত তখন ১৯৯৩ সাল। লন্ডনে থাকি। হঠাত্ একদিন মোটামুটি নামীদামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আমার খোঁজ করল। তাদের মোদ্দাকথা—শেখ মুজিবুর রহমানের একটা এক শ-দেড় শ পৃষ্ঠার জীবনী তারা প্রকাশ করতে চায়, ইংরেজি ভাষায়। কারণ, ইংরেজি ভাষায় কোনো জীবনী রচিত হয়নি। তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দশক পেরিয়ে গেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর ইংরেজিতে জীবনী নেই।
বলাবাহুল্য, তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার বিদ্যা-বুদ্ধি তখনো ছিল না, এখনো নেই। তবে অবস্থার বিরাট উন্নতি হয়েছে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অশেষ উন্নতি হয়েছে। সত্যিকার অর্থে জীবনী বলতে যা বোঝায়, সে গোছের ইংরেজি ভাষায় বই এখন আছে একটি। এস এ করিমের লেখা, বছর তিনেক আগে প্রকাশিত।
------২.-----
টিপাইমুখ নিয়ে এখন তাই বই খুঁজছি। দরখাস্ত করিনি, কোনো অনুদানও পাইনি। তাই স্রেফ একে ওকে জিজ্ঞেস করছি। টিপাইমুখ নিয়ে কোনো বইয়ের হদিস এখনো পাইনি।
পাব বলেও বিশেষ ভরসা নেই। গত কয়েক সপ্তাহের হুলস্থুলে বুঝতে পারছি, ভারতের টিপাইমুখ নামক জায়গায় কিছু একটা হচ্ছে। এই কিছু একটা হলে বাংলাদেশের জন্য সমূহ বিপদ। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত দেশের বিরাট অংশ মরুভূমিও নাকি হয়ে যাবে।
‘কিছু একটা’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি এ জন্যই যে নেতাদের টেলিভিশন টক শোর বাণী থেকে বুঝলাম, টিপাইমুখে হয় বাঁধ হচ্ছে, না-হয় সেচ প্রকল্প হচ্ছে অথবা জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র হচ্ছে। যাঁরা লং মার্চ-শর্ট মার্চ করবেন তাঁরাও জানেন না কী হচ্ছে। অবশ্য অকপটে স্বীকারও করছেন যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, আরেক দলের জ্ঞান-গরিমা বোধ হয় এত সাংঘাতিক যে এক চক্কর মারলেই সব মালুম হয়ে যাবে। মরুভূমি হতে ৫০ বছর না ৩৩ বছর, তিন মাস নয় দিন বা আড়াই সপ্তাহ—তা এক চক্করেই বোধগম্য হবে।
গত কয়েক সপ্তাহে আন্তর্জাতিক নদী আইন আর ফারাক্কা চুক্তির একটা ধারা বাজারে বেশ চালু হয়েছে। ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে এক যুগ ধরে হালুম-হুলুম প্রচুর হয়েছে। বই কি লেখা হয়েছে? আন্তর্জাতিক নদী আইন নিয়ে বাজারে কি কোনো বই আছে? পররাষ্ট্র অথবা নদ-নদী মন্ত্রণালয়ে কি কোনো বই আছে।
হাটে হাঁড়ি সম্পূর্ণ ভাঙব না। তাই একটু রাখঢাক করে বলি। ইদানীং যেসব মন্ত্রণালয় নিয়ে মহা হইচই, সে রকম একটি মন্ত্রণালয়ে আমার অতি পরিচিত অনুজ আইনজীবী কাজ করেছিলেন কয়েক মাস। আইনগত দিকগুলোর কিছুটা দেখভাল করার জন্য। ওই মন্ত্রণালয়ের যেটা প্রধান বিবেচ্য বা দায়িত্ব—ধরুন মরুভূমি, সে সংক্রান্ত দেশে বেশ কিছু আইন আছে, সেই পরিচিত তরুণ আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করে আমার কিছুটা হলেও জ্ঞানার্জন হয়েছিল। জ্ঞানটা হলো—পুরো মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিস্ট প্রকল্প অফিসে কোথাও সেই মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কোনো আইনের কোনো কপি নেই।
নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি। আইন তো থাকবে আইন মন্ত্রণালয়ে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন, ফারাক্কা চুক্তির একটা বিশেষ ধারা বা শর্ত, আর এর সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ‘তথ্য-উপাত্ত’, সম্বল-কম্বল তো মনে হচ্ছে এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
--------৩.------
দেশের বয়স তো ৪০ হতে আর বেশি বাকি নেই। কিন্তু দেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের বয়স বোধ হয় বারো কি তেরো।
আমার ধারণা পুনরাবৃত্তি করছি, নিছক ধারণা—মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার-লাইব্রেরি-গবেষণাকেন্দ্র এখনো হয়নি। এমন কোনো লাইব্রেরি এখনো নেই, যেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা যাবে সহজেই।
এ লাইব্রেরি, ও লাইব্রেরি, বইয়ের দোকান, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া যায়। কিন্তু দৌড়াদৌড়িতে সময় ব্যয় হবে বই পড়ার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
টিপাইমুখে বাঁধ না সেচ প্রকল্প, নাকি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র হচ্ছে, সেটা জানা দরকার। কোথা থেকে আসা, কত সের পানি, কোন দিকে দিক পরিবর্তিত হবে অথবা জমিয়ে রাখা হবে সেটা বোধ হয় জানা দরকার। এতকাল এই পানি, কত পানি—কোন দিকে যেত। সুরমা-কুশিয়ারায় এখন কত মণ পানি আসে। এর থেকে কত দিনে কত সের কমলে আমাদের কী অসুবিধা হবে, সেটা কি আমাকে বলার কেউ আছেন?
জানতে পারলে সংগ্রাম-আন্দোলনটা ঠিকভাবে করা যেত। তাই একটা বই খুঁজছি।
>>>>শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট, ডাইরেক্টর স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম ঘটনা কমবেশি বছর দশেক আগের। গ্যাস নিয়ে সারা দেশে অনেক দিন ধরে মহা হুলস্থুল চলছিল। গ্যাস গেল রে, গ্যাস গেল রে বলে আকাশ-বাতাস ধ্বনিত হচ্ছিল প্রায় সর্বক্ষণ। লং, শর্ট, উল্টো-সিধা অনেক মার্চেই দেশ টইটম্বুর। তখনো টিভি চ্যানেলে টক শোর উত্পাত শুরু হয়নি। বক্তৃতা-বিবৃতি সব পত্রপত্রিকায়।
বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অনেক দরপত্র-ইজারা। কেউ বলেন, দেশের যা গ্যাস, তাতে যুগ যুগ চলবে। অনেকের সন্দেহ, এক যুগও চলবে না। কেউ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্যাস বিক্রির পক্ষে, কেউ ৫০ বছরের রিজার্ভ রাখার ঘোষণায় বিভোর।
গ্যাসের ব্যাপারে আমি তখনো এবং এখনো নিরেট-নিখাদ অজ্ঞ। চতুর্দিকে গ্যাস নিয়ে এত হইচই—কত আর চোখ-কান বন্ধ করে থাকা যায়। তখন আমার বেশির ভাগ সময় কাটে একটা এনজিওতে। দরখাস্ত ঠুকলাম সরকার-বাহাদুর বরাবর। সাদামাটা কথা। দুটি সদ্য পাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী তরুণকে তিন-চার মাসের জন্য নিয়োগ দেব। তাদের কাজ হবে গ্যাসসংক্রান্ত যত বইপত্তর, জার্নাল, প্রবন্ধ, রিপোর্ট পাওয়া যায় সব জোগাড় করা অর্থাত্ কেনা। তারপর ওই প্রকাশিত-জ্ঞানের একটি তালিকা করা। কথা নাই, বার্তা নাই আবেদনে সাড়া মিলল। তিন লাখ টাকা অনুদান পেলাম। আগেই বলেছি, সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে নেই। দুই-চার হাজার টাকা কমও হতে পারে। তবে বড় দাগে তিন লাখ টাকার অনুদান ছিল, সেটা আমি নিশ্চিত।
যেহেতু তিন-চার মাসের চাকরি, তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ববিজ্ঞান বিভাগে খোঁজখবর লাগালাম। কপাল ভালো। সদ্য ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করা দুজনকে পেয়ে গেলাম। ঠিকমতো পাক্কা চাকরি পাওয়ার আগে দুই-চার মাস আমার সঙ্গে কাজ করবে। কাজ বুঝিয়ে দিতে সময় লাগল অল্পই। গ্যাস নিয়ে যা পাও, তা-ই ক্রয় করবে।
হাজার ছয় টাকা খরচ করে বড় গোছের বইয়ের শোকেস কিনলাম। আমার গ্যাস বোঝার দরকার নেই, কিন্তু কেউ যদি গ্যাস বুঝতে চায়, তাহলে ওই এনজিওতে এলেই হবে। গ্যাস-পাঠাগার বা তথ্যকেন্দ্র গড়ার উদ্দেশ্যেই ওই প্রকল্প বা অনুদানের তিন লাখ। ভেবে রেখেছিলাম সব বই-পুস্তক-জার্নাল-রিপোর্ট জোগাড় এবং সেগুলোর সারাংশসহ তালিকা হয়ে গেলে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে সবাইকে জানিয়ে দেব। গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে জানাতে চাইলে সব বই-পত্তর এখানে আছে।
নিয়োগ দিলাম, শেলফ কিনলাম। তারপর আমি সপ্তাহ দুয়েক ঢাকার বাইরে। তিন সপ্তাহ গেল—শেলফটা তখনো একদম খালি। দুই তরুণ ভূতত্ত্ববিজ্ঞানীকে তলব করলাম। বই কোথায়? বোঝা গেল তারা এ-অফিস ও-অফিস দৌড়াদৌড়ি করছে। নিউমার্কেট, নীলক্ষেতসহ সব বই-বাজারে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ‘স্যার, বই নেই।’
হতেই পারে না। ৪০ বছর ধরে দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। সেই ষাটের দশকেই ছাতকের সিমেন্ট আর ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানা হয়েছে গ্যাস সম্বল করে। আশুগঞ্জ বিদ্যুত্। সবই তো গ্যাসে চলছে কয়েক দশক ধরে। গ্যাস ছাড়া রান্না-খাওয়া কিছুই হবে না। তা ছাড়া গ্যাস রপ্তানি নিয়ে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে এত হুলস্থুল। গ্যাসে আগুন জ্বলে—রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত তো হবেই। আর বলে কিনা বই নেই।
ঠিক মনে পড়ছে না। অনুদানের কিছু টাকা বোধ হয় ফেরত গিয়েছিল। বই পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক বদরুল ইমামের একটি বইয়ে বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নিয়ে পৃষ্ঠা তিরিশেকের একটা অধ্যায় ছিল। বুয়েটের দুই অধ্যাপকের নাম মনে পড়ছে—দুটো করে প্রবন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। সব মিলিয়ে জ্ঞানের পরিধি সোয়া শ পৃষ্ঠার মতো। তবে বিভিন্ন সাপ্তাহিকে দুই-চার পৃষ্ঠা করে রিপোর্ট-কলাম পাওয়া গিয়েছিল এন্তার। সাংবাদিক-রিপোর্টার ভাইবোনেরা তো আর ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী নয়। তাই সাপ্তাহিক বা পত্রিকায় প্রকাশিত দু-চার পৃষ্ঠার বয়ান তো জ্ঞান হতে পারে না।
আমাদের গ্যাস সম্পদ নিয়ে তথ্য-জ্ঞানকেন্দ্র করার আমার মহাপরিকল্পনা, বলাবাহুল্য ভেস্তে গেল। গ্যাস নিয়ে গত ১০ বছরে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার বিকশিত হয়েছে কি না, তার খোঁজ আর রাখিনি। তবে আমি নিশ্চিত, গ্যাস-তেলসংক্রান্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এ সংক্রান্ত জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের চেয়ে শত গুণে বেশি সমৃদ্ধ। গ্যাস-তেলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে নিশ্চয়ই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আমাদের গ্যাস নিয়ে। অন্যরা জানে, আমি বোধ হয় কিছুই জানি না।
আমার দ্বিতীয় কেচ্ছা-ঘটনা আরও আগের। সম্ভবত তখন ১৯৯৩ সাল। লন্ডনে থাকি। হঠাত্ একদিন মোটামুটি নামীদামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আমার খোঁজ করল। তাদের মোদ্দাকথা—শেখ মুজিবুর রহমানের একটা এক শ-দেড় শ পৃষ্ঠার জীবনী তারা প্রকাশ করতে চায়, ইংরেজি ভাষায়। কারণ, ইংরেজি ভাষায় কোনো জীবনী রচিত হয়নি। তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দশক পেরিয়ে গেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর ইংরেজিতে জীবনী নেই।
বলাবাহুল্য, তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার বিদ্যা-বুদ্ধি তখনো ছিল না, এখনো নেই। তবে অবস্থার বিরাট উন্নতি হয়েছে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অশেষ উন্নতি হয়েছে। সত্যিকার অর্থে জীবনী বলতে যা বোঝায়, সে গোছের ইংরেজি ভাষায় বই এখন আছে একটি। এস এ করিমের লেখা, বছর তিনেক আগে প্রকাশিত।
------২.-----
টিপাইমুখ নিয়ে এখন তাই বই খুঁজছি। দরখাস্ত করিনি, কোনো অনুদানও পাইনি। তাই স্রেফ একে ওকে জিজ্ঞেস করছি। টিপাইমুখ নিয়ে কোনো বইয়ের হদিস এখনো পাইনি।
পাব বলেও বিশেষ ভরসা নেই। গত কয়েক সপ্তাহের হুলস্থুলে বুঝতে পারছি, ভারতের টিপাইমুখ নামক জায়গায় কিছু একটা হচ্ছে। এই কিছু একটা হলে বাংলাদেশের জন্য সমূহ বিপদ। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত দেশের বিরাট অংশ মরুভূমিও নাকি হয়ে যাবে।
‘কিছু একটা’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি এ জন্যই যে নেতাদের টেলিভিশন টক শোর বাণী থেকে বুঝলাম, টিপাইমুখে হয় বাঁধ হচ্ছে, না-হয় সেচ প্রকল্প হচ্ছে অথবা জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র হচ্ছে। যাঁরা লং মার্চ-শর্ট মার্চ করবেন তাঁরাও জানেন না কী হচ্ছে। অবশ্য অকপটে স্বীকারও করছেন যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, আরেক দলের জ্ঞান-গরিমা বোধ হয় এত সাংঘাতিক যে এক চক্কর মারলেই সব মালুম হয়ে যাবে। মরুভূমি হতে ৫০ বছর না ৩৩ বছর, তিন মাস নয় দিন বা আড়াই সপ্তাহ—তা এক চক্করেই বোধগম্য হবে।
গত কয়েক সপ্তাহে আন্তর্জাতিক নদী আইন আর ফারাক্কা চুক্তির একটা ধারা বাজারে বেশ চালু হয়েছে। ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে এক যুগ ধরে হালুম-হুলুম প্রচুর হয়েছে। বই কি লেখা হয়েছে? আন্তর্জাতিক নদী আইন নিয়ে বাজারে কি কোনো বই আছে? পররাষ্ট্র অথবা নদ-নদী মন্ত্রণালয়ে কি কোনো বই আছে।
হাটে হাঁড়ি সম্পূর্ণ ভাঙব না। তাই একটু রাখঢাক করে বলি। ইদানীং যেসব মন্ত্রণালয় নিয়ে মহা হইচই, সে রকম একটি মন্ত্রণালয়ে আমার অতি পরিচিত অনুজ আইনজীবী কাজ করেছিলেন কয়েক মাস। আইনগত দিকগুলোর কিছুটা দেখভাল করার জন্য। ওই মন্ত্রণালয়ের যেটা প্রধান বিবেচ্য বা দায়িত্ব—ধরুন মরুভূমি, সে সংক্রান্ত দেশে বেশ কিছু আইন আছে, সেই পরিচিত তরুণ আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করে আমার কিছুটা হলেও জ্ঞানার্জন হয়েছিল। জ্ঞানটা হলো—পুরো মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিস্ট প্রকল্প অফিসে কোথাও সেই মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কোনো আইনের কোনো কপি নেই।
নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি। আইন তো থাকবে আইন মন্ত্রণালয়ে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন, ফারাক্কা চুক্তির একটা বিশেষ ধারা বা শর্ত, আর এর সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে ‘তথ্য-উপাত্ত’, সম্বল-কম্বল তো মনে হচ্ছে এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
--------৩.------
দেশের বয়স তো ৪০ হতে আর বেশি বাকি নেই। কিন্তু দেশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের বয়স বোধ হয় বারো কি তেরো।
আমার ধারণা পুনরাবৃত্তি করছি, নিছক ধারণা—মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার-লাইব্রেরি-গবেষণাকেন্দ্র এখনো হয়নি। এমন কোনো লাইব্রেরি এখনো নেই, যেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা যাবে সহজেই।
এ লাইব্রেরি, ও লাইব্রেরি, বইয়ের দোকান, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া যায়। কিন্তু দৌড়াদৌড়িতে সময় ব্যয় হবে বই পড়ার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
টিপাইমুখে বাঁধ না সেচ প্রকল্প, নাকি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র হচ্ছে, সেটা জানা দরকার। কোথা থেকে আসা, কত সের পানি, কোন দিকে দিক পরিবর্তিত হবে অথবা জমিয়ে রাখা হবে সেটা বোধ হয় জানা দরকার। এতকাল এই পানি, কত পানি—কোন দিকে যেত। সুরমা-কুশিয়ারায় এখন কত মণ পানি আসে। এর থেকে কত দিনে কত সের কমলে আমাদের কী অসুবিধা হবে, সেটা কি আমাকে বলার কেউ আছেন?
জানতে পারলে সংগ্রাম-আন্দোলনটা ঠিকভাবে করা যেত। তাই একটা বই খুঁজছি।
>>>>শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট, ডাইরেক্টর স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments