রমজানে জেগে থাকে সিলেট by মিজানুর রহমান

পুণ্যভূমি সিলেট। আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ওই শহর নিয়ে রয়েছে নানা মিথ। মুসলিম অধ্যুষিত সিলেটে পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় দেশের অন্য অনেক শহরে দিনের বেলা হোটেল রেস্তরাঁ বন্ধে জোরজবরদস্তির খবর মিলে। কিন্তু সিলেটে এটি হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের খানাপিনার জন্য যেটুকু খোলা থাকে তাতে কেউ কখনো প্রতিবন্ধকতা দূরে থাক ফিরেও তাকায় না। রমজানের রাতে সিলেট শহরটি জেগে থাকে। ব্যবসা-বণিজ্যের জন্য নয় বরং ইবাদত বন্দেগেী, জিকির-আজকারের জন্য। সিলেটের সবক’টি মসজিদে রাতভর ইবাদতে কাটান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজন। তারা ডেভিল তথা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজের নফ্‌স বা আত্মাকে বাঁচাতে আল্লাহ্‌র দরবারে ধরনা দেন। আদালত ছাড়া শহরের অন্যত্র সকালে লোকজনের ভিড় তেমন হয়না বললেই চলে। তবে হ্যাঁ, ইফতার থেকে সেহ্‌রি অবধি অন্যরকম এক সিলেট।

বাইরে থেকে সিলেট অঞ্চলে ঢুকলেই আচমকা শীতল বাতাস মনে প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দেয়। এ নিয়ে অনেক মিথ আছে। বোদ্ধারা নানা ব্যাখ্যা দেন। পাশেই ভারতের ডাউকি। বিস্তীর্ণ পাহাড়। ওখান থেকে ধেয়ে আসা শীতল সিলেটের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। শুধু কী তাই- রমজানের শুরুতেই সিলেট নগরে পা দিয়েই আন্দাজ করা গেল ভিন্নতার। ইবাদতের একটি শহর। গোটা রাতই জেগে থাকে সিলেট নগরী। মসজিদে মসজিদে চলে ইবাদত। যার সমাপ্তি ঘটে ফজরে নামাজের মধ্য দিয়ে। নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজার থেকে হাঁটার রাস্তা নাইওরপুল। রাত তখন একটা। পয়েন্টের পাশে নাইওরপুল জামে মসজিদ। ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। শুধু শব্দ বললে ভুল হবে, রীতিমতো আর্তনাদ। কয়েক শ’ মুসল্লি জামাতবদ্ধ হয়ে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছেন। মধুর সুরে হচ্ছে কোরআন তিলাওয়াত। নামাজে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন মুসল্লিরা। যারাই নাইওর মসজিদের সামন দিয়ে যাচ্ছেন কান্নার শব্দ শুনছেন। মসজিদের ভেতরে ঢুকতেই আবেগী পরিবেশ। আলো-আঁধার ঘেরা মসজিদের ইবাদতরত মুসল্লিরা কেউ কারও দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। নামাজ শেষ করে ইমাম সাহেব বসলেন। শুরু হলো জিকির পর্ব। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে জিকির আজকার চলে। মুসল্লিরা প্রাণখোলা ইবাদতে মশগুল। জিকিরের ফাঁকে ফাঁকে চলে নবী (সা.) শানে দরূদপাঠ, তাওবা-ইস্তেগফার। জীবনের সব ভুলত্রুটি স্মরণ করে ইমাম সাহেবের সঙ্গে সবাই তওবা করেন। এ পর্ব শেষ হতেই শুরু হয় মোনাজাত। প্রায় ২০ মিনিটব্যাপী চলা মোনাজাতে শুধু কান্না আর কান্না। নাইওরপুল জামে মসজিদের এই ইবাদত- বন্দেগীর খবর জানেন গোটা সিলেটবাসী। সময় পেলে অনেকেই ঢুঁ মারেন মসজিদে। রমজানের শুরু থেকে প্রতিরাতে এই রুটিন। দূর-দূরান্ত থেকে পরহেজগার মুসল্লিরা এসে শামিল হন। হাজী ইসমাইল হোসেন। নগরের কুমারপাড়ার বাসিন্দা। সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত। করোনাকাল ছাড়া জীবদ্দশায় প্রতিটি রমজানেই তিনি এ মসজিদে এসে ইবাদত করেন।

মানবজমিনকে জানালেন- এ মসজিদের ইবাদতে তৃপ্তি মেলে। মহান আল্লাহ্‌র কাছে মুসল্লিরা নিজেদের সব উজাড় করে দিয়ে ইবাদতে মশগুল হতে পারেন। এটি অন্যরকম এক আবেগ। বলে বুঝানো যাবে না। তিনি জানান- রমজানে সিলেট শহর সহ আশপাশের এলাকার মানুষ এই মসজিদে ইবাদতে এসে শরিক হন। রাত পৌনে একটা থেকে শুরু হয় দলবদ্ধ ইবাদত পর্ব। ভোররাত পর্যন্ত চলে। এবার অনেকেই এ মসজিদে এতেকাফরত। সিলেট শহরের জিরো পয়েন্টের অদূরে ওলিকুল শিরোমনি হযরত শাহ্‌জালাল (র.) এর দরগাহ্‌। সিলেটের স্থানীয় অনেক মানুষ এটিকে ‘বাদশার বাড়ি’ বলে ডাকেন। আবেগপূর্ণ বন্দেগীর তীর্থ স্থান। রমজানের শুরু থেকে নগর এবং নগরের বাইরের গন্তব্যস্থল থাকে দরগাহ। বিশেষ করে তারাবির নামাজ পড়তে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ। তারাবির নামাজে সবচেয়ে বেশি মুসল্লি হয় দরগাহে। তারাবিহতে বিশেষ আকর্ষণ প্রধান ইমাম হাফেজ মাওলানা আসজাদ আহমদ। তার তিলাওয়াত শুনে শুনে নামাজে শরিক হতে অনেক মুসল্লিই আসেন। মধুর কণ্ঠের তিলাওয়াতে তারাবির সময় গোটা দরগাহ এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। ওল্ডহাম বিএনপি’র সভাপতি ও বৃটেনের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন এবার রমজানের শুরু থেকেই সিলেটে। থাকছেন দরগাহ এলাকায়। প্রতিদিনই তারাবির নামাজে শরিক হন। জানালেন; মক্কা-মদিনার সঙ্গে অন্য কোথাওর তুলনা হয় না। সিলেটের সেই পবিত্র নগরীর ঘ্রাণ পাই, নামাজ পড়ে প্রশান্তি পাই।

এ কারণে রমজানে দেশে থাকলে সিলেটে বিশেষত দরগাহে এসে নামাজ পড়ি। ইফতার ও সেহ্‌রিতে দরগাহে এলাহী কাণ্ড। কয়েকশ’ মানুষের ইফতার ও সেহ্‌রির আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে ইফতারে অনেকেই এসে শরিক হন। গরিব-দুঃখী যেই হোন না কেন কোথাও ইফতার না পেলে দরগাহে মিলবে। ব্যক্তি বা সংস্থার উদ্যোগে ইফতারে শরিক হওয়ার রীতিও রয়েছে। এজন্য অনেকেরই পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন হয়ে থাকে। ৩৬০ আউলিয়ার শহর সিলেট। গোটা শহরজুড়েই মাজার আর মাজার। সড়কের মধ্যখানেও মাজার। রাতভর এসব মাজারে চলে ইবাদত-বন্দেগী। স্থানীয় অনেকেই আসেন মাজার জিয়ারতে। ইতিহাস বেত্তাদের ভাষ্য মতে, প্রায় ৭০০ বছর ধরে এই রেওয়াজ রয়েছে সিলেটে। স্থানীয়দের মতে; সিলেট হচ্ছে- আদবের শহর। এখানে ৩৬০ আউলিয়া শুয়ে রয়েছেন। বেয়াদবি চলবে না। ফলে আদব রেখেই চলতে হয় সিলেটের মানুষকে। মিথ আছে এই শহরে ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর! ৩৬০ আউলিয়া আসার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিলেন গাজী বুরহান উদ্দিন (রহ.)। শহরের পূর্বপাশে তার মাজার। পাশে বিশাল মাদ্রাসা। রাতভর ইবাদত-বন্দেগী চলে মাদ্রাসা ও মসজিদে। মাদ্রাসার মুহতামিম শায়েখ নাসির উদ্দীন দরগাহ ইমামসাব হুজুরের ছাত্র। এখন তিনি নিজেই বয়োবৃদ্ধ। জানালেন- সিলেটের মানুষ ধর্মপ্রাণ। রাতভর ইবাদত- বন্দেগীতেই কাটান। এই রেওয়াজ পূর্ব-পুরুষদের আমল থেকে। দিন দিন মানুষ আরও ধর্মপ্রাণ হচ্ছে। তিনি বলেন- পবিত্র শহর সিলেটের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখানকার আলেম- উলামাদের অবদান অনেক বেশি। তাদের মেহনতের কারণেই সিলেট তার ধর্মীয় গতিপথ ঠিক রেখেছে। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আউলিয়ার শহরের পাশাপাশি সিলেট আলেম-উলামাদের শহর। তাদের সিলসিলাও আলাদা। তবে আক্বিদাগত তেমন পার্থক্য নেই। এ কারণে আলেমদের মধ্যে ঐক্য রয়েছে।

সকাল হলে সিলেটের মাদ্রাসা-মসজিদ থেকে ভেসে আসে কোরআন শিক্ষার সুর। মাদ্রাসার ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে রমজান মাস জুড়ে সহি-শুদ্ধ কোরআন পড়ার তালিম দেয়া হয়। নাইওরপুল মসজিদে রাত ৩ টায় তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন  মুসল্লিরা। গতকাল গভীর রজনীতে কথা হয় এক মুসল্লির সঙ্গে। তিনি জানান- আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ আর মাফি পেতে নীরবে প্রতিদিন আসি।  নামাজ পড়ে  ইমাম ও খতিব নাজিম উদ্দিন কাসেমী সাহেব দোয়ায় অংশ নেই। আমার মনে হয় যেন আল্লাহ্‌ আমার ফরিয়াদ শুনছেন। আশা করি ক্ষমা করবেন। নয়াসড়ক মসজিদে প্রতিবছর আগমন করেন আওলাদে রাসূল (সা:) আরশাদ মদনী (র:)। তিনি তাহাজ্জুদের জামাত পড়ান। সেখানে নামাজ পড়তে আসেন সমগ্র সিলেট বিভাগ থেকে মুসল্লিরা। এই নয়াসড়ক পয়েন্ট এখন মাদানি চত্বর নামে নামকরণ  করা হয়েছে। ইবাদত পিপাসুদের অনেকে এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে ছুটে যান একটু প্রশান্তি আর আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দাদের সহবতের আশায়। তাহাজ্জুদে আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ করার আশায় পরেহজগার সাদাসিধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ লক্ষ্মণীয়। নগরীর বন্দরবাজার জেলরোডস্থ শাহ্‌ আবু তুরাব মসজিদও সারা রাত ইবাদতের একটি কেন্দ্র। সেখানে হযরত আব্দুল্লাহ (র:) হরিপুরীর সাহেবজাদা মাওলানা হেলাল আহমদ ও শায়খুল হাদিস আব্দুল কাদির বাগরখালী নসীহত পেশ করেন। তাহাজ্জুদের নামাজে ইমামতি করেন- মসজিদের পেশ ইমাম মো. আবদুস শহীদ। ওই মসজিদে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাধারণ মুসল্লিরা নামাজ আদায় ও ইবাদত-বন্দেগী করেন।

অনেক মুসল্লি জানান-  আধ্যাত্মিক সিলেটের এই আমলের প্রথা বাপ- দাদার মুখে শুনে এসেছেন। আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভই একমাত্র প্রত্যাশা আগত মুসল্লিদের। ইসলামের দাওয়াত আর ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে প্রাচীন শ্রীহট্টে আগমন ঘটে দরবেশ ও আউলিয়া হযরত শাহ্‌জালাল (র:)-এর। এই দরবেশের সঙ্গে আসেন হযরত শাহ্‌পরাণ (র:)সহ ৩৬০ আউলিয়া। এখানে সূফি-সাধকরা ইসলামের পতাকা উড়ান। গোটা অঞ্চলে হয় ইসলামের প্রচার। সিলেটেই শায়িত আছেন তারা। তার পথ ধরে ইসলামের মহান বাণী প্রচার করছেন শায়খে বরুনা,  ইদ্রিস লক্ষ্মীপুরীর মতো শায়খরা। তাদের নসীহত শুনেন ইবাদত-পিপাসু মুসল্লিরা। তরুণ প্রজন্মও হাঁটছে সেই পথ ধরে। সিলেটের বুজুর্গ ও অলিদের এই ত্যাগ যুগ যুগ থেকে সিলেটবাসী কদর করে আসছে। রমজানের পবিত্র মহিমায় আধ্যাত্মিক সিলেট যেন সত্যিই একখণ্ড পুণ্যভূমি।

No comments

Powered by Blogger.