সরজমিন চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট: ‘টাকা লাগবে না, চাই উন্নত চিকিৎসা-পুনর্বাসন’ by সুদীপ অধিকারী

সোয়েব কবীর। নরসিংদী সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গত ১৮ই জুলাই নরসিংদীর বেলাবোতে গুলিবিদ্ধ হন ২২ বছরের এই যুবক। মাথা, ঘাড়ে, চোখে, মুখে এখনো ৭০টার বেশি শটগানের ছররা গুলির বুলেট নিয়ে ভর্তি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চারতলার পি.বি-১০ নম্বর বেডে। বুলেট বের করতে না পারায় বাম চোখে কিছুই দেখতে পান না সোয়েব। সোয়েব বলেন, পাঁচ বছর আগে বাবা মারা যান। দুই ভাই ও মাকে নিয়ে সংসার আমিই চালাতাম। কিন্তু আন্দোলনে গিয়ে চোখে গুলি লাগার পর থেকে সেই পথও বন্ধ হয়ে গেছে। উপরন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় চিকিৎসা করাতে এসে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল দিয়ে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখনো কোনো সরকারি সহায়তা মেলেনি। এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসা। সোয়েব বলেন, এখানকার ডাক্তাররা আমাকে বলেছে- তারা তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা আমাদের দিয়েছেন। তাদের করার মতো আর কিছু নেই। চিকিৎসকরা বলেছেন- আমি আর কোনোদিনও এক চোখে দেখতে পাবো না। তবে বিদেশে গেলে ভালো হতেও পারি। আমাদের তো সেই সামর্থ্য নেই। এখন পরিবারের কাছে আমরা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। তাই সরকারের কাছে একটাই দাবি আমরা যারা চোখে গুলিবিদ্ধ আছি তাদের যেন বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের যেন পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা করা হয়।

একই ওয়ার্ডের পি.বি-০৯ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন কুষ্টিয়ার রুহান মাহমুদ। ২১ বছরের এই যুবক গত ৪ঠা আগস্ট ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরি পেয়েও যোগদান করতে পারেননি। রুহান বলেন, গুলি লাগার পরে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে তেমন কোনো চিকিৎসাই পাইনি। ৪ঠা আগস্ট রাতেই আমি এই হাসপাতালে ভর্তি হই। কিন্তু ৫ই আগস্ট যখন ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে তখন আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিই। চোখে ব্যান্ডেজ নিয়েই গাবতলী চলে যাই। কেউ ঠেকাতে পারেনি সেদিন। কিন্তু এতকিছু করার পরও আজ তিন মাসের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি। দশ মাস বয়সে বাবা মারা গেছে, ৮ বছর বয়সে মা আরেকজনকে বিয়ে করেছে। নানা বাড়ি মানুষ। দেখার কেউ নেই। এক আন্টি আছে। সেই এর-ওর কাছ থেকে লাখ তিনেক টাকা ধার-দেনা করে আমার পেছনে খরচ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেই এক লাখ টাকা দিয়েছিল তাতে কিছুই হয়নি। তিনি বলেন, আমরাও এই পৃথিবীর আলো দেখতে চাই। সুস্থ হয়ে বাঁচতে চাই। আমাদের এক ছোট ভাই ইন্ডিয়া থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসেছে। তার চোখ ভালো হয়ে গেছে। তাই আমরাও চাই আমাদেরও বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হোক।

এদিকে গত ৪ঠা আগস্ট গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন ১৯ বছরের যুবক মো. আল-আমিন। তিনি বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় হলেও আমি গাজীপুরের এভরি ফুটওয়ারে ডিজাইনারের কাজ করতাম। ৬ ভাই ও এক বোনের সংসার চালানোর জন্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হলে আমিও ওই আন্দোলনে যোগ দিই। পুরো আন্দোলনে তেমন কিছু না হলেও ৪ তারিখে আমার ডান চোখে পুলিশের গুলি লাগে। এরপর স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর গত ৭ই আগস্ট এখানে ভর্তি হই। তখন থেকেই এই পি.বি-১৫ নম্বর বেডে ভর্তি। এখন পর্যন্ত আমার চোখে তিনবার অপারেশন করা হয়েছে। তারপরও ডাক্তার বলেছে আর কোনো দিন চোখে দেখবো না। উল্টো চিকিৎসা করাতে এসে লাখখানেকের বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। তবুও কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। চাকরিটাও চলে গেছে। এখন সারা জীবন কীভাবে কাটাবো তাই ভেবে হতাশ।

আল-আমিনের সঙ্গে আন্দোলনে গিয়ে গাজীপুরে একইদিন ৪ঠা আগস্ট ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন তার সহকর্মী সোহেল রানা। চোখে গুলি লাগার পর তার চাকরি চলে গেছে। নিজের চিকিৎসা করাতে এসে বউ-বাচ্চা নিয়ে তিনিও বিপদে। সোহেল রানা বলেন, মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করতে করতে আর কেউ টাকা দিতে চাই না। কোনো সরকারি সহায়তাও পাইনি। কীভাবে যে আমাদের দিন পার হচ্ছে তা শুধু আমরাই জানি। সরকারের কাছে অনুরোধ- বিদেশে নিয়ে গিয়ে আমাদের উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে চোখের আলো ফিরিয়ে আনুন।

পি.বি-১৬ নম্বর বেডে গত ২১শে জুলাই থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের অটোরিকশাচালক কেশব ঋষি। পেটের দায়ে অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে গত ১৯শে জুলাই নিজ এলাকায় বাম চোখে গুলিবিদ্ধ হন এই যুবক। কেশব বলেন, মাত্র সাত মাস আগে আমার বাবা মারা যান। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে বড় বোন বিয়ের পর অন্যত্র থাকে। এখন আমি, আমার স্ত্রী, পাঁচ বছর বয়সের ছেলে, ছোট ভাই, এক বোন ও মাকে নিয়ে আমার সংসার। অটো চালিয়ে যে টাকা আয় করতাম তাই দিয়েই আমাদের ৬ জনের সংসার চলতো। এখন গুলি লাগার পর পুরো সংসার ভেঙে পড়েছে। বাধ্য হয়ে দশ বছরের ছোট্ট ভাই অন্যের দোকানে কাজ নিয়েছে। উপরন্তু আমার চিকিৎসা ব্যয় যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িছে। দেড় লাখ টাকার ওপরে খরচের পরও কোনো সরকারি সহায়তাও পাইনি।

এদিকে সরকার পরিবর্তনের দিন গত ৫ই আগস্ট কুষ্টিয়া সদরে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হন মো. কুরবান হোসেন হিল্লোল। তিনি বলেন, আমার পরিবারকে আমাকেই চালাতে হয়। আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এতদিন হাসপাতালে পড়ে আছি কেউ খোঁজ নেয়নি। তিনি বলেন, এসি রুমে বসে, দামি দামি গাড়িতে চড়ে, লাখ টাকার ফোন চালিয়ে কেউ আমাদের কষ্ট বুঝবে না। আন্দোলনের এতদিন পরে এসেও আমাদের আজ রাস্তায় দাঁড়ানো লেগেছে। তিনি বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিইনি। আমরা ভিক্ষা নেয়ার জন্য আন্দোলন করিনি। আমরা আমাদের ভাইদের উন্নত চিকিৎসা চাই। একইসঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের পুনর্বাসনের দাবি জানায়। হিল্লোল, রুহান, আল-আমিন, কেশব, সোহানের মতো রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে এখনো চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪৬ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের কেউ এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। কেউ আবার সারা জীবনের মতো নিজের দুই চোখেরই জ্যোতি খুইয়েছেন। এদের বেশির ভাগেরই দেশের চিকিৎসা শেষে জানানো হয়েছে- তারা আর কোনোদিনও চোখে দেখবেন না। সারা জীবনই তাদেরকে চোখের মধ্যে বুলেট বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।

এসব বিষয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে আমাদের রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। বিদেশ থেকে চিকিৎসক এসে পর্যন্ত আমাদের রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন। বেশির ভাগ রোগীরই একাধিকবার চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এখন যারা আসছেন তাদের বেশির ভাগই চেকআপের জন্য আসছেন। আমাদের সাধ্যমতো যা যা করার দরকার তাদের জন্য আমরা করে যাচ্ছি। এর বেশি আমাদের হাতে নেই। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.