ঝাড়খণ্ডে মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে বিজেপি by আব্দুল কাইয়ুম
অনলাইন আল জাজিরার এক খবরে বলা হয়েছে, ঝাড়খণ্ডের পাকুর জেলার একটি গ্রাম হচ্ছে বাদা সনকাদ। গোড্ডা, দেওঘর, দুমকা, জামতারা এবং সাহেবগঞ্জ জেলার সঙ্গে মিলিত হয়ে গড়ে উঠেছে সাঁওতাল পরগনা অঞ্চল। ঝাড়খণ্ডের ৮১টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসনই এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া অঞ্চলটির বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী উপজাতি বা আদিবাসী। আবার এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ শতাংশই হচ্ছে মুসলমান। এখানকার মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবে বিজেপি বিরোধী প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে আসছে। কার্যত এ কারণেই এই অঞ্চলে ভোটের রাজনীতিতে একটি কার্যকর ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে মুসলমানদের ভোট। ২০১১ সালের আদমশুমারি তথ্যমতে, ঝাড়খণ্ডের এই অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি ২ লাখ (৩২ মিলিয়ন)। যাদের মধ্যে উপজাতি হচ্ছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে মুসলমান জনগোষ্ঠী হচ্ছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঝাড়খণ্ডের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪১ শতাংশ বাস করে সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আদিবাসী এবং মুসলমানদের মধ্যে ভোটের যে সমীকরণ রয়েছে মূলত সেটি ভাঙতেই মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে বিজেপি। ২০১৯ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলের ১৮টি আসনের মাত্র চারটিতে জয় পেয়েছিল বিজেপি। এ ছাড়া চলতি বছর ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত দু’টি আসনেও পরাজিত হয়েছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী এই দলটি। মোদির দল এবার আদিবাসী তিনটি অঞ্চলের মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে। বিধানসভা এবং সংসদীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার সুবিধা রেখেছে ভারত। রাষ্ট্র-পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রেও আদিবাসীদের এই সুযোগ দেয় দেশটির সরকার।
পাকুর হচ্ছে ঝাড়খণ্ডের উত্তরাঞ্চলীয় একটি এলাকা। যেটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ ছাড়া ওই এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ এবং বাংলা ভাষী পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেও সংযুক্ত রয়েছে। যার ফলে সাঁওতাল পরগনার অধিকাংশ বাসিন্দার মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা, যা পশ্চিমবঙ্গ সহ বাংলাদেশেরও প্রধান ভাষা। যদিও ভারতের এই অঞ্চলে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর’ অভিযোগ নতুন কিছু নয়। তবে ২০১৪ সালে মোদির দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই অভিযোগ বেড়েছে বহুগুণে। যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মত বিশ্লেষকদের। ঝাড়খণ্ডের মতো আসাম রাজ্যেও মুসলমান ভোটাররা নির্বাচনে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, রাজ্যটির এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীই মুসলমান। যার ফলে বিজেপি এবং তার মিত্ররা আসামে গত এক দশক ধরে ‘মুসলিম অনুপ্রবেশকারী’ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে। তাদের অভিযোগ হচ্ছে এসব মুসলমানরা ভারতে ‘অবৈধভাবে’ প্রবেশ করে রাজ্যের জমি দখল করেছে এবং জনসংখ্যায় পরিবর্তন এনেছে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।
২০১৬ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট প্রথম আসামে জয়ী হওয়ার পর থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জেনোফোবিক (বহিরাগত) প্রচারণা জোরদার করেছে। এসব প্রচারণার মধ্যে রয়েছে আসামের মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল, তাদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জেলে পাঠানো বা বাংলাদেশে নির্বাসিত করা। এই প্রচারণার পরে আসামের হাজার হাজার মুসলমানকে ‘সন্দেহজনক’ ভোটার হিসেবে ঘোষণা করেছে বিজেপি সরকার। এ ছাড়া অনেকের ভোটাধিকারও বাতিল করা হয়েছে।
আসামের পর এবার ঝাড়খণ্ডের মুসলমানরাও ভীত হয়ে পড়েছে যে, সেখানেও অনুরূপ রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা বাস্তবায়ন করতে চলেছে বিজেপি। কেননা, ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনী সমন্বয়ক হিসেবে দেয়া হয়েছে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তৃতার জন্য বেশ সমালোচিত ৫৫ বছর বয়সী কট্টরপন্থি এই রাজনীতিবিদ। ইতিমধ্যেই ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনী সমাবেশে ‘অবৈধভাবে’ প্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন শর্মা। তিনি বলেছেন, কথিত ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
অন্যদিকে বিজেপি জয়ী হলে ঝাড়খণ্ডেও আসামের মতো বিতর্কিত ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন (এনআরসি) আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বশর্মা। এনআরসি মূলত ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের জারি করা একটি আদেশ। যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে অভিবাসীদের চিহ্নিত করা এবং যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই তাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু ২০১৯ সালে এই আদেশ প্রয়োগের মাধ্যমে ২০ লাখ ভারতীয়কে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেয় বিজেপি সরকার। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিল হিন্দু। সারা ভারতে এই আদেশ কার্যকরের ঘোষণা থাকলেও প্রাথমিকভাবে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেই এর ব্যবহার দেখা গেছে। বেশির ভাগ বিশ্লেষক এনআরসি’কে ২০১৯ সালে মোদি সরকার কর্তৃক পাস করা একটি বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করছে।
No comments