ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: মর্গ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন by মোহাম্মদ ওমর ফারুক
২০১৬
সালের ৪ঠা এপ্রিল। রাজশাহী শহরের নাইস ইন্টারন্যাশনাল হোটেল কক্ষে দুই
তরুণ-তরুণীর লাশ। একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিজানুর রহমান।
অন্যজন পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী সুমাইয়া নাসরীন। ময়নাতদন্ত,
ভিসেরা ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুমাইয়া নাসরীনকে
হত্যা করে মিজানুর রহমান নিজে আত্মহত্যা করেছেন। এই তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার
পর আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেনি। আদালত পুলিশ
ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রাজশাহী’কে তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দেন।
পিবিআই ঘটনা স্থল পরিদর্শনসহ নিবিড়ভাবে সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করেন।
সিসিটিভির ফুটেজ, ভিকটিমের মোবাইল ফোনকল পর্যালোচনা করেন।
ঘটনার দিন হোটেলে কর্মরত বয় বেয়ারাদের জিঙ্গাসাবাদ করেন। সোর্সের তথ্য অনুযায়ী এবং তাদের তদন্তে সন্দেহ হয়েছে এমন একজন আহসান হাবীব (২০)। ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর আহসান হাবীবকে রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় । গ্রেপ্তারের পর জিঙ্গাসাবাদে হত্যাকান্ডের বিবরন দেয় আহসান। জানায়, সে নিজে, রাহাত আর আল-উৎস এই তিনজন মিলে মিজান আর সুমাইয়াকে হত্যা করে। পরে পিবিআই আসামীদের গ্রেপ্তার করেন।
এমন আরো দশটি আত্বহত্যা হয়েছে বলে ময়নাতদন্তে প্রতিবেদন দেয়া মামলাকে পরবর্তীতে পিবিআই তদন্ত করে হত্যা প্রমান করেছেন এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করেছেন। এসব ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ভুল এবং নামেমাত্র ময়না তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কারনে হত্যা মামলাগুলো আত্মহত্যায় রূপ নিয়েছে। এরকম অধিকাংশ ময়নাতদন্তে কোনো রকম নয়ছয় দায়সারা প্রতিবেদন দেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয় প্রশিক্ষনবিহীন ডোম আর ডাক্তররাই তৈরী করছে এসব প্রতিবেদন। ফলে অনেক সময় আসল ঘটনা থাকে আড়ালে। যার কারনে ভোক্তভোগীরা বঞ্চিত হয় ন্যায় বিচার থেকে, মামলা মোড় নেয় ভিন্নখাতে। যথাযথ ডিগ্রি ও প্রশিক্ষনবিহীন জনবল দিয়েই হচ্ছে দেশের অধিকাংশ ময়নাতদন্তের কাজ। আর সেজন্যই অনেক সময় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসছে না। প্রশিক্ষণবিহীন চিকিৎসক ও ডোমদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই কাজ করানোর বিষয়টি নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ আছে, ময়নাতদন্তের কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রশিক্ষিত ডোমরাই করে থাকে। ডোমরাই কাটাছেঁড়া করেন। আর প্রশিক্ষনবিহীন এবং ক্ষেত্রবিশেষ প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখেন। গত চার যুগ ধরে চলছে এমনটাই। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকরা প্রায়সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বিবরন শুনে গোঁজামিল প্রতিবেদন দিয়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের মর্গগুলোতে কোনোরকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই চলছে কার্যক্রম। একটি মৃত্যুর পুনার্ঙ্গ রহস্য উদঘটনের মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই মর্গগুলোতে। পুরনো আমলের ছুরি-কাঁচি, হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে কাটতে হয় লাশ। ভুল প্রতিবেদনের আরো একটি কারন হিসেবে জানা যায়, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের ডোমদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা । এ ছাড়া বিভিন্ন প্রভাবকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দেয়া, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে জ্যৈষ্ঠ চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের কাজে অংশ না নেয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকাও ময়নাতদন্ত ভুল হওয়ার অন্যতম কারণ। মর্গে সাধারণত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে একটি মরদেহ কাটাছেঁড়ায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়াও ইলেকট্রিক্যাল করাত, স্ট্রে ও বিশেষ ধরনের টেবিল, লাশকাটার বিশেষ ধরনের ছোরা ও বিশেষ ধরনের হাতুড়ি, পোর্টেবল এক্স- রে মেশিন, এক্সলাবিন (আলামত রক্ষাকারী বাক্স), অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি ও লাশ সংরক্ষণের কেমিক্যাল থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া অবকাঠামোগতভাবে সার্বক্ষণিক বৈদ্যুতিক সংযোগ, বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), মরদেহ রাখার জন্য হিমঘর বা ফ্রিজ, গরম পানি সরবরাহের লাইন, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের বসার জন্য আলাদা কক্ষ থাকা জরুরি। কিন্তু দেশের কোনো মর্গেই নেই এসব সুবিধা। ঢাকা জেলায় যেসব অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় সেগুলোর কারণ জানতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। রাজধানীর এসব মর্গগুলোর অবস্থাও পুরনো। মর্গগুলোতে লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া।
এছাড়াও জানা যায়, জেলা সদর বা মেট্রোপলিটন এলাকায় ময়নাতদনের্ত জন্য লাশের সংখ্যার আধিক্যের কারণে পর্যাপ্ত সময় না নিয়ে সীমিত সংখ্যক ডাক্তার দিয়ে তাড়াহুড়ো করে তদন্ত দেয়ার কারনেও এমনটা হয়। শুধু তাই নয় তদন্তের কাজে সহয়তাকারী ডোমদের নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যার কারনে বছরের পর বছর সুইপার দিয়েও ডোমের কাজ করানো হচ্ছে মর্গগুলোতে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, লাশ পূনরায় উত্তলনের সময় গলিত, পচাঁ বা প্রাপ্ত লোকবল নিয়োগ, নীতিমালার অভাবে সাধারন দিনমুজুর দিয়ে এই কাজ করা হয় । যার কারনে অনেক অলামত নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা সুরতহাল রির্পোটের উপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। তাছাড়া স্বাক্ষী হওয়ার ভয়ে জৈষ্ঠ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত কাজে অংশ নেন না।
এ নিয়ে পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক গবেষণায় হত্যা আত্মহত্যা হয়ে যাওয়ার মতো চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এসব ঘটনায় কোনো কোনো লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে স্পষ্ট আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। কোথাও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই ছিল খুনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব আমলে নেননি। শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা যায়, লাশের ময়নাতদন্তই ভুল ছিল। আগে যে ঘটনাগুলোকে আত্মহত্যা বলা হয়েছিল, আদতে তা ছিল খুন । গবেষণায় বলা হয়, থানা-পুলিশের তদন্তেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ক্রুটি এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে ৫৩ শতাংশ হত্যা মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। একই গবেষণায় এসেছে, বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে ৩৭ শতাংশ হত্যা মামলায় সাক্ষীরা আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ,সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সবাই যদি সবার পেশাদারিত্বটা ঠিক রাখে তাহলে এমনটা হওয়া কথা না। প্রায় সময় দেখা যায় অপরাধী যদি একটু ক্ষমতাধর হয়, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তার পক্ষে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং সেটা তার পক্ষে যায়ও। এছাড়া প্রায়সময় যে অভিযোগটা ওঠে অদক্ষ ডাক্তার বা ডোমদের দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়, তা কিন্তু পুরোপুরি সত্য। এখন যেটা সরকার করতে পারে ময়নাতদন্ত নিয়ে আলাদা কোনো ইনস্টিটিউট করে ডাক্তারদের প্রশিক্ষন এবং সেখানে ময়নাতদন্তের কাজগুলো করতে পারে।
পিবিআই এর বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল বলেন , দেশে ময়নাতদন্ত করতে পারে এমন ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম। যারা ময়নাদতন্তে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে সেটাও খুব নগণ্য। যার কারনে শহর, গ্রাম বা মফস্বলশহর গুলোতে অপ্রশিক্ষিত ডাক্তাররাই ময়নাতদন্ত করে থাকে যেটা বেশীর ভাগসময় ভুল রিপোর্ট আসার সম্ভবনা থাকে।
দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর মহাসচিব এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, ডাক্তররা কখনো ডোমদের উপর নির্ভরশীল হয় না । ডোম তো অশিক্ষিত তার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কিছু নেই। হয়তো কোনো কোনো চিকিৎসক দায়িত্বে অবহেলা করলে ডোমরা পুরো কাজটা করার সুযোগ পান। তবে বলতে হবে ডাক্তারদের প্রচুর পরিমান প্রশিক্ষনের প্রয়োজন। সরকারিভাবে কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজন নেই। যার ফলে অদক্ষ ডাক্তার দিয়েই কাজটা শেষ করতে হচ্ছে। এর বাইরেও যে ব্যপারটা আছে আধুনিক কোন মর্গ নেই দেশে। আমি ঢামেকের মর্গটাকে আধুনিক বলতে পারছি না। মর্গে সবার আগে দরকার একটি ল্যাব। ল্যাব না থাকার কারনে আমাদের প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
ঘটনার দিন হোটেলে কর্মরত বয় বেয়ারাদের জিঙ্গাসাবাদ করেন। সোর্সের তথ্য অনুযায়ী এবং তাদের তদন্তে সন্দেহ হয়েছে এমন একজন আহসান হাবীব (২০)। ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর আহসান হাবীবকে রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় । গ্রেপ্তারের পর জিঙ্গাসাবাদে হত্যাকান্ডের বিবরন দেয় আহসান। জানায়, সে নিজে, রাহাত আর আল-উৎস এই তিনজন মিলে মিজান আর সুমাইয়াকে হত্যা করে। পরে পিবিআই আসামীদের গ্রেপ্তার করেন।
এমন আরো দশটি আত্বহত্যা হয়েছে বলে ময়নাতদন্তে প্রতিবেদন দেয়া মামলাকে পরবর্তীতে পিবিআই তদন্ত করে হত্যা প্রমান করেছেন এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করেছেন। এসব ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ভুল এবং নামেমাত্র ময়না তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কারনে হত্যা মামলাগুলো আত্মহত্যায় রূপ নিয়েছে। এরকম অধিকাংশ ময়নাতদন্তে কোনো রকম নয়ছয় দায়সারা প্রতিবেদন দেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয় প্রশিক্ষনবিহীন ডোম আর ডাক্তররাই তৈরী করছে এসব প্রতিবেদন। ফলে অনেক সময় আসল ঘটনা থাকে আড়ালে। যার কারনে ভোক্তভোগীরা বঞ্চিত হয় ন্যায় বিচার থেকে, মামলা মোড় নেয় ভিন্নখাতে। যথাযথ ডিগ্রি ও প্রশিক্ষনবিহীন জনবল দিয়েই হচ্ছে দেশের অধিকাংশ ময়নাতদন্তের কাজ। আর সেজন্যই অনেক সময় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসছে না। প্রশিক্ষণবিহীন চিকিৎসক ও ডোমদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই কাজ করানোর বিষয়টি নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ আছে, ময়নাতদন্তের কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রশিক্ষিত ডোমরাই করে থাকে। ডোমরাই কাটাছেঁড়া করেন। আর প্রশিক্ষনবিহীন এবং ক্ষেত্রবিশেষ প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখেন। গত চার যুগ ধরে চলছে এমনটাই। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকরা প্রায়সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বিবরন শুনে গোঁজামিল প্রতিবেদন দিয়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের মর্গগুলোতে কোনোরকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই চলছে কার্যক্রম। একটি মৃত্যুর পুনার্ঙ্গ রহস্য উদঘটনের মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই মর্গগুলোতে। পুরনো আমলের ছুরি-কাঁচি, হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে কাটতে হয় লাশ। ভুল প্রতিবেদনের আরো একটি কারন হিসেবে জানা যায়, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের ডোমদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা । এ ছাড়া বিভিন্ন প্রভাবকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দেয়া, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে জ্যৈষ্ঠ চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের কাজে অংশ না নেয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকাও ময়নাতদন্ত ভুল হওয়ার অন্যতম কারণ। মর্গে সাধারণত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে একটি মরদেহ কাটাছেঁড়ায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়াও ইলেকট্রিক্যাল করাত, স্ট্রে ও বিশেষ ধরনের টেবিল, লাশকাটার বিশেষ ধরনের ছোরা ও বিশেষ ধরনের হাতুড়ি, পোর্টেবল এক্স- রে মেশিন, এক্সলাবিন (আলামত রক্ষাকারী বাক্স), অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি ও লাশ সংরক্ষণের কেমিক্যাল থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া অবকাঠামোগতভাবে সার্বক্ষণিক বৈদ্যুতিক সংযোগ, বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), মরদেহ রাখার জন্য হিমঘর বা ফ্রিজ, গরম পানি সরবরাহের লাইন, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের বসার জন্য আলাদা কক্ষ থাকা জরুরি। কিন্তু দেশের কোনো মর্গেই নেই এসব সুবিধা। ঢাকা জেলায় যেসব অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় সেগুলোর কারণ জানতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। রাজধানীর এসব মর্গগুলোর অবস্থাও পুরনো। মর্গগুলোতে লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া।
এছাড়াও জানা যায়, জেলা সদর বা মেট্রোপলিটন এলাকায় ময়নাতদনের্ত জন্য লাশের সংখ্যার আধিক্যের কারণে পর্যাপ্ত সময় না নিয়ে সীমিত সংখ্যক ডাক্তার দিয়ে তাড়াহুড়ো করে তদন্ত দেয়ার কারনেও এমনটা হয়। শুধু তাই নয় তদন্তের কাজে সহয়তাকারী ডোমদের নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যার কারনে বছরের পর বছর সুইপার দিয়েও ডোমের কাজ করানো হচ্ছে মর্গগুলোতে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, লাশ পূনরায় উত্তলনের সময় গলিত, পচাঁ বা প্রাপ্ত লোকবল নিয়োগ, নীতিমালার অভাবে সাধারন দিনমুজুর দিয়ে এই কাজ করা হয় । যার কারনে অনেক অলামত নষ্ট হয়ে যায়। অনেক সময় ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা সুরতহাল রির্পোটের উপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। তাছাড়া স্বাক্ষী হওয়ার ভয়ে জৈষ্ঠ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত কাজে অংশ নেন না।
এ নিয়ে পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক গবেষণায় হত্যা আত্মহত্যা হয়ে যাওয়ার মতো চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এসব ঘটনায় কোনো কোনো লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে স্পষ্ট আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। কোথাও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেই ছিল খুনের স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা এসব আমলে নেননি। শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। অথচ পরে জানা যায়, লাশের ময়নাতদন্তই ভুল ছিল। আগে যে ঘটনাগুলোকে আত্মহত্যা বলা হয়েছিল, আদতে তা ছিল খুন । গবেষণায় বলা হয়, থানা-পুলিশের তদন্তেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ক্রুটি এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে ৫৩ শতাংশ হত্যা মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। একই গবেষণায় এসেছে, বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে ৩৭ শতাংশ হত্যা মামলায় সাক্ষীরা আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ,সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সবাই যদি সবার পেশাদারিত্বটা ঠিক রাখে তাহলে এমনটা হওয়া কথা না। প্রায় সময় দেখা যায় অপরাধী যদি একটু ক্ষমতাধর হয়, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তার পক্ষে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং সেটা তার পক্ষে যায়ও। এছাড়া প্রায়সময় যে অভিযোগটা ওঠে অদক্ষ ডাক্তার বা ডোমদের দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়, তা কিন্তু পুরোপুরি সত্য। এখন যেটা সরকার করতে পারে ময়নাতদন্ত নিয়ে আলাদা কোনো ইনস্টিটিউট করে ডাক্তারদের প্রশিক্ষন এবং সেখানে ময়নাতদন্তের কাজগুলো করতে পারে।
পিবিআই এর বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল বলেন , দেশে ময়নাতদন্ত করতে পারে এমন ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম। যারা ময়নাদতন্তে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে সেটাও খুব নগণ্য। যার কারনে শহর, গ্রাম বা মফস্বলশহর গুলোতে অপ্রশিক্ষিত ডাক্তাররাই ময়নাতদন্ত করে থাকে যেটা বেশীর ভাগসময় ভুল রিপোর্ট আসার সম্ভবনা থাকে।
দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর মহাসচিব এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, ডাক্তররা কখনো ডোমদের উপর নির্ভরশীল হয় না । ডোম তো অশিক্ষিত তার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কিছু নেই। হয়তো কোনো কোনো চিকিৎসক দায়িত্বে অবহেলা করলে ডোমরা পুরো কাজটা করার সুযোগ পান। তবে বলতে হবে ডাক্তারদের প্রচুর পরিমান প্রশিক্ষনের প্রয়োজন। সরকারিভাবে কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজন নেই। যার ফলে অদক্ষ ডাক্তার দিয়েই কাজটা শেষ করতে হচ্ছে। এর বাইরেও যে ব্যপারটা আছে আধুনিক কোন মর্গ নেই দেশে। আমি ঢামেকের মর্গটাকে আধুনিক বলতে পারছি না। মর্গে সবার আগে দরকার একটি ল্যাব। ল্যাব না থাকার কারনে আমাদের প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
No comments