এসব অশুভ শক্তি প্রশ্রয় পেতে পারে না
এসব অশুভ শক্তি প্রশ্রয় পেতে পারে না ২৯ এপ্রিল যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল ‘বিমানে ভুয়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট- উপস্থিতি প্রমাণে জালিয়াতি’। একটি শব্দ আজকাল নেতিবাচক অর্থে খুব ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হচ্ছে ‘সিন্ডিকেট’। আমাদের সব প্রতিষ্ঠান এখন যেন সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি। সড়কপথের যাত্রীসাধারণ যানবাহনের ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের দাপটে জিম্মি। ড্রাইভার বেপরোয়া বা নিয়ম না মেনে গাড়ি চালাতে গিয়ে মানুষ চাপা দিলেও তাকে কিছু বলা যাবে না। নিয়ম না মেনে অবৈধ ওভারটেকিং করে গাড়ি উল্টে দিয়ে জীবন ও সম্পদহানি ঘটালেও কিছু করা যাবে না। পুলিশ গ্রেফতার করলে সড়ক বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষের অশেষ কষ্টের কারণ ঘটালেও শ্রমিক-মালিক সমিতির সিন্ডিকেট অপরাধীর মাথাতেই ছাতা ধরবে। সংঘশক্তির দাপট দেখিয়ে সরকারকে বাধ্য করবে নতজানু হতে। হার্টের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় রিংয়ের দাম নিয়ে খুব অরাজকতা চলছিল। সিন্ডিকেট করে রোগীর কাছ থেকে অনেক বেশি দাম হাঁকা হতো। সম্প্রতি সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে। এখন তা কার্যকর করাও সহজ হচ্ছে না। লোভীদের অসুবিধা হচ্ছে না ফাঁক খুঁজে পেতে। নির্ধারিত মূল্যে রিং বিক্রি করা হলেও এর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রে আগের বর্ধিত দামই নেয়া হচ্ছে। রমজান মাস আসন্ন। প্রতিবারের মতো এবারও সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, শেষ পর্যন্ত তা আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ঠিক পথ বের করে নেয়। অর্থাৎ বেলা শেষে বলতে হয় সিন্ডিকেটের কাছে সরকার অসহায়। ইতিমধ্যে বাজারের লাগাম সরকারের হাতছাড়া হতে শুরু করেছে যেন। প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে সরকারের ভেতরকার অর্গানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা তখন কঠিন হয়ে যায়। এ দুর্বলতাটি সব পক্ষের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা গোষ্ঠীগুলো চিনে ফেলেছে। তাই এরা বুক ফুলিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যেতে পারছে। যুগান্তরের রিপোর্টে ফিরে আসি। বিমান বরাবরই একটি স্বেচ্ছাচারী জায়গা। ২০-২৫ বছর আগের কথা মনে করতে পারি। আমার এক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আত্মীয়ের কথা জানি। তিনি বিমানের নানারকম যন্ত্রাংশ আমদানি করতেন। জানতাম বিমানের সিবিএ নেতা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই তিনি কাজ পেতেন। এক টাকার জিনিস দশ থেকে বিশ টাকায় কেনা হতো। অতি মুনাফা বণ্টন হতো নানা স্তরে। ক্ষতি হতো রাষ্ট্রের, লোকসান গুনত বিমান। এ অবস্থা থেকে বিমান কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে আমি জানি না। তবে সবাই মানবেন, এসব অবৈধ সুবিধাভোগী নরখাদক বাঘ হয়ে যায়। রক্তের নেশা ছাড়তে পারে না। সব অবৈধ কাজ বুক ফুলিয়ে করে। স্বেচ্ছাচারিতাকেই বৈধ জ্ঞান করে। উল্লিখিত রিপোর্টে দেখা যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট তিন মাস ধরে অফিসে আসছে না। ভুয়া আঙুলের ছাপ দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে অফিসে উপস্থিতি দেখাচ্ছে। তুলে নিচ্ছে বেতন-ভাতা আর ওভারটাইম। কেউ কেউ অর্ধেক সময় ডিউটি করে পুরো বেতন তুলে নিচ্ছে। এসব জালিয়াতি ধরা পড়ায় বিমান শ্রমিক লীগের ১০ প্রভাবশালী নেতাসহ ১২ জনকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতেই ক্ষেপে যায় অভিযুক্তরা। এদের টেলেক্স বার্তা পেয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে থাকা বিমান কর্মচারীদের অনেকে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ বাস-ট্রাক শ্রমিকদের মতো অন্যায় করলেও কিছু বলা যাবে না তাদের। একজন সিবিএ নেতা সাংবাদিককে জানিয়েছেন, টেলেক্স বার্তায় কাজ বন্ধ করতে বলা হয়নি; তারা সবাইকে ম্যানেজমেন্টের অন্যায় ও অবৈধ নির্দেশ না মানতে বলেছেন। এটি পড়ে একটু গোলক ধাঁধায় পড়লাম। তাহলে অফিস না করে প্রতারণার মাধ্যমে বেতন-ভাতা নেয়া সংক্রান্ত রিপোর্টটি কি ভুল? এ ব্যাপারে তো কোনো প্রতিবাদ দেখলাম না। তাহলে চাকরিবিধি মান্য না করে অপরাধ করলে শাস্তির প্রস্তাব রাখাটি অবৈধ আর অন্যায় হবে কেন?
এর একটি ব্যাখ্যা আমরা নিশ্চয়ই এসব নেতার কাছে চাইতে পারি। কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ তাও স্পষ্ট হওয়া দরকার। অবশ্য কেঁচো খুঁড়তে সাপও বেরিয়েছে। কোনো কোনো শীর্ষ কর্মকর্তা অনেক কর্মচারীকে দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করান বলে অন্যসব অন্যায় হজম করে নিতে হয়। রিপোর্টে দেখা যায়, কাজ না করে বেতন-ভাতা নেয়াটা বিমান কর্মচারী ও সিবিএ নেতারা অধিকারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কর্মচারীদের নিয়মের মধ্যে আনতে বিমান প্রশাসন ২০১২ সালে সংস্থার বিভিন্ন দফতরে আঙুলের ছাপ নেয়ার জন্য ৩০টি বায়োমেট্রিক্স অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম লাগিয়েছিল। কিন্তু সে সময় অসাধু কর্মচারীরা মেশিনগুলো ভাংচুর করে। সুপারগ্লু দিয়ে অকার্যকর করে দেয়। পাশাপাশি শুরু করে আন্দোলন। ফলে সে সময় সিস্টেমটি আর কার্যকর হতে পারেনি। কিছুদিন আগে আবার মেশিন বসানো হল। এবার অভিনব পদ্ধতিতে জালিয়াতি শুরু হয়। বিমানের এসব জালিয়াতি নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট রয়েছে যুগান্তরে। আমি আর সেদিকে যেতে চাই না। তবে এ ভয়াবহ আতঙ্কের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। দেশে আওয়ামী লীগ সরকার যখন একটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে, তখন এসব সিবিএ নেতা, সড়কপথে পরিবহন শ্রমিক-মালিক, সরকারের মন্ত্রী কাম শ্রমিক নেতা- সবাই এত ক্ষমতাশালী হয়ে যায় কেমন করে? যেখানে শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের সঙ্গেই আপস করতে হয় সরকারকে? এর উত্তর একটিই- দলীয়করণের বিপরীত প্রতিক্রিয়া। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী বিমানের শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠন হোক অথবা পরিবহন শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠন, সবাই সরকারদলীয়। এ অবস্থায় এসব সংগঠনের কাছ থেকে সুশাসন ও গণতন্ত্রের পথে চলার ক্ষেত্রে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পাওয়ার কথা। সহযোগিতা না পেলে জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসব অপশক্তিকে শক্ত হাতে শাসন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সরকারকে হোঁচট খেতে হয়। এসব সংগঠনের নেতারা নিজ স্বার্থ থেকে একচুলও সরতে রাজি নন। এতে সরকার বেকায়দায় পড়লেও এদের কিছু যায় আসে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে না হাঁটায় দলীয়করণের মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখার ভুল সিদ্ধান্ত জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থায় যে কোনো সরকার মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগটি নেয় দলীয় ব্যানারের সংগঠনগুলো। এরা প্রতারণা করে নিজ দলীয় সরকারের সঙ্গেই। সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নেয় অন্যায় সুবিধা। অন্যথায় অরাজকতা তৈরি করে সরকারকে বিপদে ফেলে। গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে যাওয়া এবং ক্ষমতালিপ্সা সরকারকে নতজানু নীতিতে হাঁটতে পথ দেখায়। অশুভ শক্তি যদি টের পায় সরকার ক্ষমতাকে মূল এজেন্ডা ধরে আপসকামিতার পথে হাঁটছে, তখন এরা ঘাড়ে চেপে বসে সিন্দবাদের বুড়োর মতো। অবস্থা দেখে এখন তেমনটিই মনে হচ্ছে। উদাহরণের তো অভাব নেই। শুধু নির্বাচনী মাঠে শক্তি বৃদ্ধির জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যেভাবে দলীয় আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রতি আগের বকাঝকাকে মাটিচাপা দিয়ে ওদের কোলে চড়াচ্ছে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে মূলধারায় নিয়ে আসার প্রকল্প হাতে নিয়েছে, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের আবহমানকালের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে অপমান করে হেফাজতের দাবি পূরণ করেছে, তাতে বোঝা যায় হেফাজত শক্তির দাপট ঠিকই দেখাতে পেরেছে সরকারকে। নৌমন্ত্রীর আশ্রয়ে সড়ক পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা বোঝাতে পেরেছে, তারা চাইলে এক ঘণ্টার নোটিশে দেশের সড়কপথ অচল করে দিতে পারে। দলীয়করণে গোষ্ঠী বলয়ের বাইরে অনেকটা একা আওয়ামী লীগ সরকারকে আপস করে চলতে হচ্ছে গণপরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাধরদের সঙ্গে। আকাশ পরিবহনেও একই দশা। এ কারণেই বিমানের সিবিএ নেতারা চুরি করেছেন কিনা জানি না, তবে সিনাজুরি তো বেশ দেখাচ্ছেন। পত্রিকায় যেটুকু খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সত্য হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী তাদের শুধু সাসপেন্ড কেন, বিচারের মুখোমুখি হওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত এর কোনো ফলোআপ দেখলাম না। সাধারণ মানুষের ধারণা, এখানেও সরকার নিজের পায়ের নিচে মাটি শক্ত রাখতে ‘সাত খুন মাপ’ করে দেবে হয়তো। সরকারের এমন দুর্বলতা দেখে ছাত্রলীগও হয়তো সুযোগ নেয়ার চিন্তা করতে পারে। বলতে পারে, ‘আমাদের মাস্তানি আর চাঁদাবাজি নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। বললে নির্বাচনে আমাদের পাবেন না। ছাত্রলীগ অনাচার করলে যেমন বলা হয়, এখানে ছাত্রদল আর শিবির ঢুকে পড়েছে, তেমনি তখন ছাত্রদলে ছাত্রলীগ ঢুকে পড়ার অভিযোগ এলে কিছু করার থাকবে না। সুতরাং নেতারা নিজের মতো থাকুন, আমাদের ঘাঁটাবেন না।’
এসব হয়তো অলীক কথা। তবে সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যেভাবে অশুভ শক্তিগুলোকে মাথায় চড়াচ্ছে তাতে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। সরকারের জন্য দুর্ভাগ্য হল, এখন নানা সেক্টরে যেভাবে অরাজকতা শুরু হয়েছে তাতে এক হেফাজত ছাড়া বাকি শক্তিগুলো সরকারি দলের পক্ষপুটেই অবস্থান করছে। আওয়ামী লীগেরই অঙ্গসংগঠন। এদের মূলত সরকারকে সহযোগিতা করার কথা। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ আদায় করার জন্য এসব সংগঠন সরকারকেই বিপাকে ফেলছে বারবার। আমরা তো শুনি আইন আর সরকারের হাত খুব লম্বা। সরকারের চেয়ে রাষ্ট্রের অন্য কোনো সংগঠন যদি শক্তিশালী হয়ে পড়ে, তাহলে ঘোর দুর্দিন। সরকারের আপসকামী নীতি আমাদের তাই শঙ্কিত করে তুলছে। সব ক্ষেত্রে সরকারের দলীয়করণ নীতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়াচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে সরকার হাঁটছে এমন কথা সাধারণ মানুষ মনে করে না। চারদিকের চলমান দুর্নীতি আর গণতন্ত্রের পথে না হাঁটা নির্বাচনের মাঠে সরকারকে বিব্রত করবে। আওয়ামী লীগ পোড়খাওয়া রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন অনেক নেতানেত্রী আছেন এ সংগঠনে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যথেষ্ট সবল নয়। সুতরাং এমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগেরই উচিত ছিল কট্টর দলীয়করণ না করে মানুষের আস্থায় থাকার চেষ্টা করা। অপকর্মকারী নিজ অঙ্গসংগঠনের হলেও আইনের শক্তিতে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল। যদি তা করা হতো তবে বিমানের সিবিএ নেতারা উল্টো সিনাজুরি দেখাতে পারতেন না। আমরা মনে করি, এ ঐতিহ্যবাহী দলের নেতানেত্রীদের বিভিন্ন বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। কোনো অশুভ শক্তিকেই প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
shahnaway7b@gmail.com
No comments