চুল নিয়ে চুলাচুলি by জিনিয়া জাহিদ

দেশে এখন চলছে চুল নিয়ে তুঘলকি কারবার। এই তো কয়েকদিন আগে নারীর চুল ঢাকা তথা ঘোমটা নিয়ে সঙ্গীতশিল্পী মিতা হক বিশাল এক ‘ঘোমটা-তত্ত্ব’ দিয়ে পত্রিকায়, ফেসবুকে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন।
এ তত্ত্বের মূলভাবে বলা হল, বাঙালি নারীর চুল ঢাকা থাকলে তাতে আইডেনটিটি ক্রাইসিস হয়!! আর পাশ্চাত্য পোশাক ফ্যাশন বলে বিবেচিত হয়!

মিতা হকের ঘোমটা তত্ত্বকে আরো শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতেই এগিয়ে এলেন নারীকুলের ত্রাতা ‘তসলিমা নাসরিন’!! সম্প্রতি তিনি তার কলামে লিখলেন, বাংলাদেশের মেয়েদের মাঝে ইদানিং নাকি বোরখা পরার হার বেড়ে গেছে।

আর এজন্য পর্দাপ্রথাবিরোধী, ইসলামবিদ্বেষী লেখিকা তসলিমাকে বিশেষ চিন্তিত বলেই মনে হলো।

তসলিমা তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তার একদা সহপাঠী যারা ছিলেন, যারা দেশের নামকরা চিকিত্সক, তারা প্রায় সবাই এখন বোরখা পরছেন। মনে প্রশ্ন জাগে, দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের কেউ কি জোর করে বোরখা পরাচ্ছেন? তাহলে প্রবাসে বসে তসলিমার কেন মনে হলো যে, বাংলাদেশের মেয়েরা যারা বোরখা পরছেন তাদের সবাইকে বোরখা পরতে বাধ্য করা হচ্ছে? কেন মনে হলো যে, দেশে জোর করে বোরখা পরানোর চল এসেছে?
mita-haque
 দেশে যারা বোরখা পরছেন তারা নিজের বোধ-বুদ্ধিতেই পরছেন। আবার এর উল্টোটাও হচ্ছে। দেশে অত্যধিক মাত্রায় পাশ্চাত্যের পোশাক জনপ্রিয় হচ্ছে। যারা পরছেন, তারাও নিজের বোধ-বুদ্ধিতেই পরছেন। এখানে কেউ কাউকে পোশাক চাপিয়ে দিচ্ছে না। ইচ্ছে হলে কেউ মাথার চুল খুলে চলছে, কেউবা মাথার চুল হিজাবে বা লম্বা ওড়নায় কিংবা ঘোমটা দিয়ে ঢেকে চলছে।

কিন্তু এসব চুল ঢাকা আর খোলার থেকেও সম্প্রতি চুল নিয়ে দেশে আরো দু’জনকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। এঁরা দু’জনেই আমাদের অতি আপন, সর্বদা জনসমক্ষে ‘ঘোমটা দেওয়া’, জনগণের মঙ্গল কামনায় সর্বদাই চিন্তিত (?), আমাদের অতি প্রিয় দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।

এই তো গত রোববার ১৮ আগস্ট বিকেলে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের দিন, গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি সংবিধানে বিশ্বাস করি। আগামীতে যা হবে সংবিধান মোতাবেক হবে। তার থেকে একচুলও নড়া হবে না, ব্যস।

সংবিধানের বাইরে ‘এক চুল’ পরিমাণ না নড়ার ঘোষণায় আমাদের রাজনীতিকদের যাদের মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল, মাথায় অল্প বিস্তর চুল কিংবা যাদের আদৌ কোনো চুল অবশিষ্ট নেই সবাই যে বেশ নড়েচড়ে বসেছেন তার প্রমাণ আমরা আম-জনতা পেলাম ঠিক একদিন পর।

চুলের বিপরীতে চুল দিয়েই উত্তর দিলেন সম্প্রতি সৌদি আরবে ওমরাহ করা, মাথার একটি চুলও যাতে না দেখা যায় তেমন হিজাব পরে প্রসংশিত হওয়া, আমাদের মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। ১৯ আগস্ট সোমবার বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে চুল নিয়ে ভয়াবহ এক হুঁশিয়ারি দেন তিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আন্দোলনের বাতাস শুরু হলে চুল তো থাকবেই না, অস্তিত্বেও টান পড়তে পারে। জনগণের আন্দোলনের বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাবে। দিশেহারা হয়ে যাবেন।
toslima-nasrin
‘এক চুল’ ও নড়বেন না- প্রধানমন্ত্রীর এমন হুমকির পর বিরোধীদলীয় নেতার সব ‘চুল থাকবে না’ কিংবা আরেকটু নমনীয় হয়ে ‘চুল এলোমেলো হয়ে যাবে’ শুনে আমরা সাধারণ জনগণও কিন্তু তাঁদের দু’জনের চুল আর সেই সঙ্গে নিজেদের চুল নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত হয়ে পড়েছি। অবশ্য যাদের চুল নেই তাদের কথা আলাদা। এক্ষেত্রে তারা দারুণ সৌভাগ্যবান বলাবাহুল্য। তাদের চুল থাকা কিংবা এলোমেলো হওয়া নিয়ে চিন্তাও নেই।

প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, এক চুলও না নড়ার ঘোষণা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, সরকার দলের চুল নিশ্চয় খুব শক্তপোক্ত, কিংবা হেফাজতি ফর্মুলা অনুযায়ী বোরখা, ঘোমটা এবং টুপি কিংবা হ্যাট দিয়ে মাথার চুল শক্ত করে মাথার সঙ্গে আটকানো, নতুবা এক চুল না নড়ার দাম্ভিক ঘোষণা আসতো না। এক চুলও না নড়ার পরিণতিতে হোক না দেশ সহিংস, তাতে কার বা কি যায় আসে!

অন্যদিকে ধারণা করা যায়, সরকার দলের চুল এলোমেলো করে দেওয়ার প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি দেওয়ার আগে বিরোধীদল নিশ্চয় ‘কুদরতি শ্যাম্পু-তেল’ দিয়ে নিজেদের চুল শক্তপোক্ত করে নিয়েছে কিংবা হেফাজতে চুলের জন্য মাথার চুল ভালো করে ঢেকে নিয়েছে।

চুলের মতই ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয়, দুই দলের সেটা মনে রাখা উচিত। চুল কিংবা ক্ষমতা নিয়ে অহংকার না করে কিংবা হুমকি হুঁশিয়ারি না দিয়ে, যে জনগণের মঙ্গলের জন্য তাদের ক্ষমতার মসনদে চড়ার আকাঙ্ক্ষা, সে জনগণের দিকে তাকিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে চলা দরকার। নইলে কথায় কথায় জনগণকে উদ্ধৃত করে বক্তৃতা দেওয়া, সেই ন্যাড়া মাথার জনগণের হাতেই ভোটের বাজারে তাদের উভয় দলেরই শক্তপোক্ত চুল এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।

zinia-zahidজিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.