টক অব দ্য কান্ট্রি হেফাজতে ইসলাম
ডেটলাইন ৬ই এপ্রিল। হেফাজতে ইসলামের
লংমার্চ। এই লংমার্চ ঘিরে এখন সরগরম রাজনীতির ময়দান। সারা দেশ থেকে ব্যাপক
লোক সমাগমের টার্গেট হেফাজতের। এই লংমার্চের মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান
দিতে চাইছে হেফাজত।
অন্যদিকে অরাজনৈতিক এ শক্তির লংমার্চ
নিয়ে করণীয় নির্ধারণে দ্বিধায় সরকার সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ
কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হবে না। গতকাল ৩ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের
সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী যৌথ সংবাদ
সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ধর্মানুভূতিতে আঘাতকারীদের তথ্য প্রযুক্তি আইনে
শাস্তি দেয়া হবে। লংমার্চ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও গতকাল পর্যন্ত
ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশের স্থান নির্ধারণ হয়নি। সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে,
শর্ত মানলে কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হবে না। হেফাজত যাতে এই লংমার্চ না করে
সেজন্য সব চেষ্টাই করে যাচ্ছে সরকার। সরকারি দলের নেতা, মন্ত্রী ও
প্রশাসনের লোকজন চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদরাসায় হেফাজতের আমীর আল্লামা
আহমদ শফীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে লংমার্চ স্থগিতের আহবান জানিয়েছেন।
কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন লংমার্চ হবেই। লংমার্চ সফল করতে অনড়
সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। ১৩ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে
নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ তারা। ৩ ব্লগারকে গ্রেপ্তার, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের
শাস্তি বাড়ানোর সরকারি ঘোষণা আমলে নিচ্ছে না হেফাজতে ইসলাম। সরকারের এসব
ঘোষণা ও তৎপরতাকে আন্দোলন বানচাল এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসাবে
দেখছে সংঘটনটি। এদিকে দিন যত ঘনিয়ে আসছে লংমার্চ নিয়ে উদ্বেগ উত্তেজনা ততই
বাড়ছে। পাশাপাশি লংমার্চের প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করেছেন আয়োজকরা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ের চায়ের দোকানেও এখন
আলোচিত হচ্ছে লংমার্চ ও হেফাজতে ইসলাম। দেশী-বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম
লংমার্চ। কূটনৈতিক মহলের অনুসন্ধানী দৃষ্টিও এই লংমার্চের দিকে। লংমার্চে
কি হবে কি হতে যাচ্ছে- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মুখে। কর্মসূচি
স্থগিত কিংবা সমঝোতা করতে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপিসহ
উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই
থামছেন না হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা। দফায় দফায় বৈঠক করছেন তারা।
গতকাল বিকালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে সমন্বয় কমিটির দেশব্যাপী সফর নিয়ে
পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়া ৬ই এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যাপারে
দীর্ঘ আলোচনা শেষে চূড়ান্ত কৌশল নির্ধারণ করা হয়। প্রধান বিরোধী দল
বিএনপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন ইতিমধ্যে
লংমার্চের প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে।
এদিকে এই লংমার্চকে কেন্দ্র করে সবার নজর এখন চট্টগ্রাম শহরতলির হাটহাজারী মাদরাসার দিকে। এখানে বহুল আলোচিত হেফাজতে ইসলামের প্রধান কার্যালয়। এখানে বসেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সেখানে যাচ্ছেন প্রতিদিন। কিন্তু ফিরছেন খালি হাতে। আগামী ৬ই এপ্রিল সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ। এই নিয়ে ঘুম নেই হেফাজতের নেতা-কর্মীদের। স্বস্তি নেই সরকারেরও। উৎকণ্ঠা বেড়েছে সবার। কি হবে সেদিন? এতদিন হেফাজতকে গুরুত্ব দেয়নি তারা। গত এক সপ্তাহ ধরে হাটহাজারী মাদরাসার আশপাশে প্রচুর সরকারি গাড়ি দেখা যাচ্ছে। খবর ছড়িয়েছে সমঝোতা বৈঠকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে লোকজন আসছে।
ইতিমধ্যে এসেছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, চট্টগ্রামের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। দুই একদিনের মধ্যে আরও মন্ত্রী, এমপির হাটহাজারী মাদরাসায় যাওয়ার কথা রয়েছে। আল্লামা শফী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, শাহবাগ আন্দোলনে যেসব ব্লগার ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করেছে অবশ্যই তাদের শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় কিছু হলে সরকারকেই দায়ভার নিতে হবে। ৬ই এপ্রিল ঢাকায় লংমার্চে সারা দেশ থেকে লোকজন জড়ো হবে। সেই আন্দোলন থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি আসছে। আর তার আগে বাধা দিলে শুরু হবে লাগাতার অবরোধ। হেফাজতের এমন ঘোষণায় চিন্তায় পড়েছে প্রশাসন। হেফাজতের এসব সিদ্ধান্ত আর কর্মসূচি ঠিক করা হচ্ছে চট্টগ্রামের এই হাটহাজারী মাদরাসা থেকে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ইসলামি আলেমরা আল্লামা শফীর সঙ্গে দেখা করতে মাদরাসায় আসছেন। তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। অন্যদিকে টনক নড়ার পর সর্বশেষ সমঝোতা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন চট্টগ্রামের মন্ত্রী, ডিসি, এসপিরা। গত শনিবার লংমার্চ সফল করতে বৈঠক চলছিল হেফাজত ইসলামের। এমন সময় বিকালে হঠাৎ করেই হাটহাজারী মাদরাসায় হাজির হন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এমএ মান্নান। তার সঙ্গে ছিলেন পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার।
এই সময় তারা আহমদ শফীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন। তবে বৈঠক শেষে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই তারা আল্লামা শফীর কক্ষ থেকে চলে যান। বৈঠকে আহমদ শফী ডিসি মান্নানকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। আমরা ১৩ দফা দাবি দিয়েছি। এতে কোন অস্পষ্টতা নেই। সেখানে স্পষ্টভাবে নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোথাও যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতার কথা নেই। অথচ সরকার শাহবাগ আন্দোলনের সেই নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে দেশের ইসলামের ধর্মভীরু সব লোকজন।’
ডিসির সঙ্গে বৈঠকে লংমার্চের কর্মসূচির বিষয়ে কোন সমঝোতা না হওয়ায় পরদিন আবারও হাটহাজারী মাদরাসায় যান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তার সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। কিন্তু সেই বৈঠকেও কোন ধরনের সিদ্ধান্ত না হওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে যান সরকারের নীতি নির্ধারকরা। বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে আহমদ শফী বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। সরকারেরই একটি অংশ তাদের সুনাম নষ্ট করতে চায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারে হেফাজতের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তাই ইসলামকে নিয়ে সরকারের ছত্রছায়ায় ব্লগাররা যা করছে তা কতটুকু সমীচীন।’
আল্লামা শফীর কথা শুনে বনমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের ইসলামের মান রক্ষায় যথেষ্ট আন্তরিক। একটি পক্ষ সরকারের সঙ্গে আলেমদের দূরত্ব তৈরি করার ষড়যন্ত্র করছে। সরকার সব সময় ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষে। সমপ্রীতির পক্ষে। তাই হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে সরকার অনেক বেশি সহযোগিতা চাইছে। সরকার চায় না হেফাজতের কোন কর্মকাণ্ড জামায়াতের পক্ষে চলে যাক। বৈঠক থেকে বেরিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মানবজমিনকে বলেন, ‘বৈঠক ভাল হয়েছে। আমরা তাদের অনুরোধ করেছিলাম লংমার্চ নিয়ে যাতে কোন ধরনের নতুন করে দূরত্ব তৈরি না হয়। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এখন দেখা যাক। তবে তাদের সঙ্গে আবার আলোচনা হবে।’
হেফাজতে ইসলামের দায়িত্বশীল দু’টি সূত্র জানায়, লংমার্চকে কেন্দ্র করে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছেন। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া হেফাজতের কর্মকাণ্ডের দিকে সরকার থেকে নজর দিতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এনামূল হক দানু, এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসিসহ নেতা-কর্মীদের। তারাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন। জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক বলেন, ‘অনেকেই ফোন করছেন। শফী সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। তিনি এতটাই বিরক্ত যে এখন সরকারের কারও সঙ্গেই কোন কথা বলতে চান না। আমরা সাফ বলে দিয়েছি নাস্তিক ব্লগারদের বিষয়ে কোন আলোচনা নয়। তারপরও আমরা চাই সমাধান। ইসলাম রক্ষায় যদি কোন ভাল সিদ্ধান্ত সরকার দিতে পারে তাহলে আমাদের তা নিতে কোন আপত্তি নেই। আজকালের মধ্যে আরও কয়েকজন এমপি, মন্ত্রী হাটহাজারী মাদরাসায় যাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। ওদিকে ইসলামী দলসমূহের আহ্বায়ক মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ বলেছেন, সরকার ও মহল বিশেষের কোন ষড়যন্ত্রই ৬ই এপ্রিলের লংমার্চসহ ঈমানী আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। সরকার তৌহিদী জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই কথিত সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন ও কয়েকজন চুনোপুঁটিকে গ্রেপ্তার করেছে। মূলত সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় নাস্তিক-মুরতাদ-খোদাদ্রোহীরা নানান ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। তাদেরকে বাঁচানোর জন্যই সরকার নানান ধরনের অপকৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু ইসলাম প্রিয় ও তৌহিদী জনতা সরকারের সে ষড়যন্ত্র কখনওই বাস্তবায়িত হতে দেবে না। তিনি সরকারের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত না হয়ে লংমার্চ কর্মসূচি সফল করতে ওলামা-মাশায়েখ তৌহিদী জনতার প্রতি আহ্বান জানান। গতকাল রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর মাদরাসা-ই-নূরীয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
সমঝোতায় গুরুত্ব দিচ্ছে প্রশাসন: প্রশাসনের পক্ষ থেকে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতাকে এখন পর্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে প্রশাসন। সমঝোতায় রাজি না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে।
গতকাল র্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। সমঝোতায় পৌঁছতে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী চট্টগ্রামের হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বৈঠক শুরু করেছেন। হেফাজতে ইসলামের ঘোষিত ১৩ দফা দাবির প্রতি নমনীয় মনোভাব পোষণ করেছেন ওই মন্ত্রীরা। পর্যায়ক্রমে তাদের বেশির ভাগ দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। সূত্র জানায়, ওই আশ্বাসের ভিত্তি মজবুত করতেই গতকাল ৩ ইসলাম বিরোধী ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি বিতর্কিত বেশ কয়েকটি ব্লগ ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখা হয়েছে। শিগগিরই তা নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে। ইতিমধ্যে আমার ব্লগ নামে একটি ব্লগ বন্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, আইসিটি অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ ও নবীজীকে কটূক্তি করার কারণেই ৩ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী ব্লগগুলো বন্ধ করার আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। সূত্রমতে, গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় ব্লগারদের নিয়ে আপাতত ঘাঁটাঘাঁটি করবে না পুলিশ। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় চিহ্নিত ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে সরকার ঝুঁকি নিতে নারাজ। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বেশ কয়েকজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি থেকে কৌশলে বিরত রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক ছাত্রসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। নজরদারিতে রাখা হয়েছে আরও একাধিক ব্লগারকে। শীর্ষ পর্যায়ের সিগন্যাল পাওয়ার পরপরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সূত্র জানায়, ৬ই মার্চের লংমার্চ ঘিরে নানা কৌশলে এগোচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কৌশলের অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামসহ বিরোধীদলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মসজিদ ও কওমি মাদরাসা। প্রয়োজনে বিজিবি মোতায়েনের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরসহ ১৮দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা একযোগে ঢাকায় গণজমায়েতের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে এ সংক্রান্তে একাধিক প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে। তাতে সারা দেশে থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার আশঙ্কা করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই লংমার্চ থেকেই সরকার পতনের এক দফা দাবির ঘোষণা আসতে পারে তথ্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া ওইসব প্রতিবেদনে একটি রাজনৈতিক দলের বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কাও করা হয়েছে। সরকার বিরোধী ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য গোয়েন্দা রিপোর্টে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সূত্রমতে, প্রতিবেদনের সুপারিশ মোতাবেক ৬ই মার্চ সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তল্লাশির কথা বলা হয়েছে সকল যানবাহনে। প্রয়োজনে যান চলাচল সীমিত করার কথা বলা হয়েছে। বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাট বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও বাস স্ট্যান্ডে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে ঢাকামুখী জনস্রোত প্রতিহত করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ৬ই মার্চের ঢাকামুখী লংমার্চ কর্মসূচি পালনের জন্য এখন পর্যন্ত কোন সংগঠন পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করেনি। কেউ আবেদন করলে নগরবাসীর নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন চলাচলের বিষয়টি আগে গুরুত্ব দিয়ে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশকে সর্বদাই সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারীদের তথ্য-প্রযুক্তি আইনে শাস্তি
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী সবাইকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে। তাই এ সংক্রান্ত প্রচলিত আইন সংস্কার করে এ বিষয়ে সাজা বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। গতকাল পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের মাঝে যেসব ধর্ম প্রচলিত রয়েছে, সেসব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ যদি আঘাত করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে দু’জন আলেমকে রাখা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত বিষয়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ঢাকায় একজন বিচারককে নিয়োগও দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোন যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করতে চায়, তবে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে প্রচলিত আইন এবং তথ্য প্রযুক্তি আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু ও আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম।
আলেম-ওলেমাদের দাবিতে ১৮ দলের নৈতিক সমর্থন: ফখরুল
আলেম-ওলেমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে ১৮ দল। হরতাল শেষে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে পথভ্রষ্ট কিছু ব্লগার ইসলামকে আঘাত করে যাচ্ছে। তারা আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) ও পবিত্র কোরআন নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে। যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত করেছে, সামপ্রদায়িক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। তবে আমরা এ নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। সরকারই তাদের প্রশ্রয় দিয়ে পরিস্থিতিকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের আলেম-ওলেমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি আমরা নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছি। গতকাল তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে মির্জা আলমগীর বলেন, বিষয়টি সামাল দিতে সরকারের আইওয়াশ কিনা সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতি এখন চরম ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করেছে। রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ এক ব্যক্তির হাতে বন্দি হয়ে আছে। ফলে রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য অনিবার্য। ক্ষমতার মসনদে বসে প্রধানমন্ত্রী দাম্ভিক আচরণ করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সীমাহীন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণে দেশবাসী হতাশ। তার বক্তব্যে নিরপেক্ষতা তো নেই-ই উল্টো দাম্ভিকতাপূর্ণ। তিনি সদম্ভে আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ (গতকাল মঙ্গলবার) বলেছেন, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের নামে হুকুমের আসামি করা হবে। মির্জা আলমগীর বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। প্রতিদিন লাশের মিছিলে নতুন নতুন শহীদের নাম যুক্ত হচ্ছে। সরকার পুরো দেশকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
বিকল্পধারার সমর্থন: হেফাজতে ইসলামের ৬ই এপ্রিলের লংমার্চ কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বিকল্পধারা বাংলাদেশ। গতকাল দলের প্রধান সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এক বিবৃতিতে এই সমর্থনের কথা জানান। বি. চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে যে মহারাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তারই পথ ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটের মধ্যে দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা প্রথম থেকেই বলেছি, ইসলাম ও আমাদের প্রিয় রাসুল (স.)-কে অপমান করার যে কোন অপচেষ্টায় আমরা বিরোধিতা করবো। সেজন্য যখন এই প্রশ্ন উঠলো, তখন আমরা সরকারকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছি ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বিরুদ্ধে যে বা যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করুন এবং শাস্তি দিন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য এলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বক্তব্যদাতাকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির বিধান করা হয়। এই হিসেবে কেন ইসলামের প্রিয় রাসুল (স.)-এর বিরুদ্ধে হীন মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে ৬ সপ্তাহ পরেও গ্রেপ্তার ও শাস্তি দেয়া হয়নি- এতে স্বভাবতই দেশের মানুষ অপমানিত বোধ করতে পারে। হেফাজতে ইসলাম এ ব্যাপারে যে কর্মসূচি দিয়েছে তাতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে। বিকল্পধারার প্রধান বলেন, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবং যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সমর্থিত হেফাজতে ইসলামের ৬ই এপ্রিলের লংমার্চ কর্মসূচির প্রতি বিকল্পধারা পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে।
৩ ব্লগার ৭ দিনের রিমান্ডে
ধর্ম নিয়ে কুৎসা রটনাকারী চক্রের সদস্য তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে মশিউর রহমান বিপ্লব (আল্লামা শয়তান) (৪২), রাসেল পারভেজ (অপবাক) (৩৬) ও সুব্রত শুভ (লালু কসাই)। গ্রেপ্তারের পর তাদের আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সার্ভিস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃত তিন ব্লগার দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মপ্রবর্তকদের নিয়ে কুৎসা রটনা করছিল। বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশের নজরে আসার পর তাদের গ্রেপ্তার করে আইসিটি অ্যাক্টের ধারায় মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, এরা সবাই নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী। তাদের ইন্টারনেটে ধর্মবিরোধী উস্কানিমূলক লেখালেখির নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা জানান, সমপ্রতি গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন ব্লগারের ধর্মবিদ্বেষী লেখার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম সরকার বিরোধী কর্মসূচি পালন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকামুখী লংমার্চের ঘোষণা দেয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার দিবাগত রাতে গোয়েন্দা পুলিশের তিনজন এডিসি’র নেতৃত্বে একযোগে অভিযান চালিয়ে শেরেবাংলানগর থানাধীন ইন্দিরা রোড, মনিপুরীপাড়া ও নিউ মার্কেট থানাধীন পলাশী এলাকা থেকে ওই তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের হেফাজত থেকে একটি ল্যাপটপ, একটি ডেস্কটপ, ২টি মডেম ও একটি এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ উদ্ধার করা হয়। সূত্র জানায়, এরা ওলামা মাশায়েখের তালিকাভুক্ত ব্লগার নন। ধর্মবিদ্বেষী প্রকৃত ব্লগারদের ছেড়ে দিয়ে ওই তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন এডিসি বলেন, যাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তিনি আহত। সমপ্রতি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সদস্যরা তাকে ছুরিকাঘাত করেছে। এ কারণে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে এনেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা জানান, মশিউর রহমান বিপ্লব ফেসবুকে ‘আল্লামা শয়তান’, সামহোয়্যারইন ও নাগরিক ব্লগে ‘শয়তান’ এবং আমার ব্লগে ‘নেমেসিস’ ছদ্মনামে ধর্মবিরোধী উস্কানি দিয়েছে। রাসেল পারভেজ আমার ব্লগে ‘রাসেল পারভেজ’, সামহোয়্যারইন, ব্লগে ‘রাসেল’ ও ‘অপবাক’ ছদ্মনামে লেখে। আর সুব্রত শুভ সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘সাদা মুখোশ’, আমার ব্লগে ‘সুব্রত শুভ’, নাগরিক ব্লগে ‘আজাদ’, ইস্টেশন ব্লগে ‘লালু কসাই’ ছদ্মনামে লিখেছে। প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী এ ব্লগাররা ইন্টারনেটে বিভিন্ন ব্লগে তাদের লেখালেখির মাধ্যমে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তকদের বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করে ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করছিল। সূত্রমতে, ডিবি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিট দীর্ঘ দিন ধরে তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করছিল। এরই এক পর্যায়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরা ইন্টারনেটে ধর্ম নিয়ে নানা কটূক্তি করেছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক থেকে এর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা অনুযায়ী ধর্মের বিরুদ্ধে অপব্যাখ্যাকারীদের ১০ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেপ্তার ও শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচির সঙ্গে এ গ্রেপ্তারের কোন সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, জানতে চাইলে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সঙ্গে এর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আইনের পরিপন্থি কাজ করায় ও অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে এই লংমার্চকে কেন্দ্র করে সবার নজর এখন চট্টগ্রাম শহরতলির হাটহাজারী মাদরাসার দিকে। এখানে বহুল আলোচিত হেফাজতে ইসলামের প্রধান কার্যালয়। এখানে বসেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সেখানে যাচ্ছেন প্রতিদিন। কিন্তু ফিরছেন খালি হাতে। আগামী ৬ই এপ্রিল সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ। এই নিয়ে ঘুম নেই হেফাজতের নেতা-কর্মীদের। স্বস্তি নেই সরকারেরও। উৎকণ্ঠা বেড়েছে সবার। কি হবে সেদিন? এতদিন হেফাজতকে গুরুত্ব দেয়নি তারা। গত এক সপ্তাহ ধরে হাটহাজারী মাদরাসার আশপাশে প্রচুর সরকারি গাড়ি দেখা যাচ্ছে। খবর ছড়িয়েছে সমঝোতা বৈঠকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে লোকজন আসছে।
ইতিমধ্যে এসেছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, চট্টগ্রামের জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। দুই একদিনের মধ্যে আরও মন্ত্রী, এমপির হাটহাজারী মাদরাসায় যাওয়ার কথা রয়েছে। আল্লামা শফী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, শাহবাগ আন্দোলনে যেসব ব্লগার ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করেছে অবশ্যই তাদের শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় কিছু হলে সরকারকেই দায়ভার নিতে হবে। ৬ই এপ্রিল ঢাকায় লংমার্চে সারা দেশ থেকে লোকজন জড়ো হবে। সেই আন্দোলন থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি আসছে। আর তার আগে বাধা দিলে শুরু হবে লাগাতার অবরোধ। হেফাজতের এমন ঘোষণায় চিন্তায় পড়েছে প্রশাসন। হেফাজতের এসব সিদ্ধান্ত আর কর্মসূচি ঠিক করা হচ্ছে চট্টগ্রামের এই হাটহাজারী মাদরাসা থেকে। দেশের বিভিন্ন এলাকার ইসলামি আলেমরা আল্লামা শফীর সঙ্গে দেখা করতে মাদরাসায় আসছেন। তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। অন্যদিকে টনক নড়ার পর সর্বশেষ সমঝোতা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন চট্টগ্রামের মন্ত্রী, ডিসি, এসপিরা। গত শনিবার লংমার্চ সফল করতে বৈঠক চলছিল হেফাজত ইসলামের। এমন সময় বিকালে হঠাৎ করেই হাটহাজারী মাদরাসায় হাজির হন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এমএ মান্নান। তার সঙ্গে ছিলেন পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার।
এই সময় তারা আহমদ শফীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন। তবে বৈঠক শেষে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই তারা আল্লামা শফীর কক্ষ থেকে চলে যান। বৈঠকে আহমদ শফী ডিসি মান্নানকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। আমরা ১৩ দফা দাবি দিয়েছি। এতে কোন অস্পষ্টতা নেই। সেখানে স্পষ্টভাবে নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোথাও যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতার কথা নেই। অথচ সরকার শাহবাগ আন্দোলনের সেই নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে দেশের ইসলামের ধর্মভীরু সব লোকজন।’
ডিসির সঙ্গে বৈঠকে লংমার্চের কর্মসূচির বিষয়ে কোন সমঝোতা না হওয়ায় পরদিন আবারও হাটহাজারী মাদরাসায় যান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তার সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। কিন্তু সেই বৈঠকেও কোন ধরনের সিদ্ধান্ত না হওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে যান সরকারের নীতি নির্ধারকরা। বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে আহমদ শফী বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। সরকারেরই একটি অংশ তাদের সুনাম নষ্ট করতে চায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারে হেফাজতের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তাই ইসলামকে নিয়ে সরকারের ছত্রছায়ায় ব্লগাররা যা করছে তা কতটুকু সমীচীন।’
আল্লামা শফীর কথা শুনে বনমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের ইসলামের মান রক্ষায় যথেষ্ট আন্তরিক। একটি পক্ষ সরকারের সঙ্গে আলেমদের দূরত্ব তৈরি করার ষড়যন্ত্র করছে। সরকার সব সময় ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষে। সমপ্রীতির পক্ষে। তাই হেফাজতে ইসলামের কাছ থেকে সরকার অনেক বেশি সহযোগিতা চাইছে। সরকার চায় না হেফাজতের কোন কর্মকাণ্ড জামায়াতের পক্ষে চলে যাক। বৈঠক থেকে বেরিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মানবজমিনকে বলেন, ‘বৈঠক ভাল হয়েছে। আমরা তাদের অনুরোধ করেছিলাম লংমার্চ নিয়ে যাতে কোন ধরনের নতুন করে দূরত্ব তৈরি না হয়। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এখন দেখা যাক। তবে তাদের সঙ্গে আবার আলোচনা হবে।’
হেফাজতে ইসলামের দায়িত্বশীল দু’টি সূত্র জানায়, লংমার্চকে কেন্দ্র করে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছেন। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া হেফাজতের কর্মকাণ্ডের দিকে সরকার থেকে নজর দিতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এনামূল হক দানু, এমপি নুরুল ইসলাম বিএসসিসহ নেতা-কর্মীদের। তারাও বিষয়টি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন। জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক বলেন, ‘অনেকেই ফোন করছেন। শফী সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। তিনি এতটাই বিরক্ত যে এখন সরকারের কারও সঙ্গেই কোন কথা বলতে চান না। আমরা সাফ বলে দিয়েছি নাস্তিক ব্লগারদের বিষয়ে কোন আলোচনা নয়। তারপরও আমরা চাই সমাধান। ইসলাম রক্ষায় যদি কোন ভাল সিদ্ধান্ত সরকার দিতে পারে তাহলে আমাদের তা নিতে কোন আপত্তি নেই। আজকালের মধ্যে আরও কয়েকজন এমপি, মন্ত্রী হাটহাজারী মাদরাসায় যাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি। ওদিকে ইসলামী দলসমূহের আহ্বায়ক মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ বলেছেন, সরকার ও মহল বিশেষের কোন ষড়যন্ত্রই ৬ই এপ্রিলের লংমার্চসহ ঈমানী আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। সরকার তৌহিদী জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই কথিত সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন ও কয়েকজন চুনোপুঁটিকে গ্রেপ্তার করেছে। মূলত সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় নাস্তিক-মুরতাদ-খোদাদ্রোহীরা নানান ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। তাদেরকে বাঁচানোর জন্যই সরকার নানান ধরনের অপকৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু ইসলাম প্রিয় ও তৌহিদী জনতা সরকারের সে ষড়যন্ত্র কখনওই বাস্তবায়িত হতে দেবে না। তিনি সরকারের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত না হয়ে লংমার্চ কর্মসূচি সফল করতে ওলামা-মাশায়েখ তৌহিদী জনতার প্রতি আহ্বান জানান। গতকাল রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর মাদরাসা-ই-নূরীয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
সমঝোতায় গুরুত্ব দিচ্ছে প্রশাসন: প্রশাসনের পক্ষ থেকে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতাকে এখন পর্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে প্রশাসন। সমঝোতায় রাজি না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে।
গতকাল র্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। সমঝোতায় পৌঁছতে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী চট্টগ্রামের হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বৈঠক শুরু করেছেন। হেফাজতে ইসলামের ঘোষিত ১৩ দফা দাবির প্রতি নমনীয় মনোভাব পোষণ করেছেন ওই মন্ত্রীরা। পর্যায়ক্রমে তাদের বেশির ভাগ দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। সূত্র জানায়, ওই আশ্বাসের ভিত্তি মজবুত করতেই গতকাল ৩ ইসলাম বিরোধী ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি বিতর্কিত বেশ কয়েকটি ব্লগ ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখা হয়েছে। শিগগিরই তা নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে। ইতিমধ্যে আমার ব্লগ নামে একটি ব্লগ বন্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, আইসিটি অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ ও নবীজীকে কটূক্তি করার কারণেই ৩ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রয়োজনে ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী ব্লগগুলো বন্ধ করার আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। সূত্রমতে, গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় ব্লগারদের নিয়ে আপাতত ঘাঁটাঘাঁটি করবে না পুলিশ। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় চিহ্নিত ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে সরকার ঝুঁকি নিতে নারাজ। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বেশ কয়েকজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি থেকে কৌশলে বিরত রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক ছাত্রসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। নজরদারিতে রাখা হয়েছে আরও একাধিক ব্লগারকে। শীর্ষ পর্যায়ের সিগন্যাল পাওয়ার পরপরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সূত্র জানায়, ৬ই মার্চের লংমার্চ ঘিরে নানা কৌশলে এগোচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কৌশলের অংশ হিসেবে হেফাজতে ইসলামসহ বিরোধীদলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মসজিদ ও কওমি মাদরাসা। প্রয়োজনে বিজিবি মোতায়েনের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরসহ ১৮দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা একযোগে ঢাকায় গণজমায়েতের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে এ সংক্রান্তে একাধিক প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে। তাতে সারা দেশে থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার আশঙ্কা করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই লংমার্চ থেকেই সরকার পতনের এক দফা দাবির ঘোষণা আসতে পারে তথ্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া ওইসব প্রতিবেদনে একটি রাজনৈতিক দলের বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কাও করা হয়েছে। সরকার বিরোধী ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য গোয়েন্দা রিপোর্টে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সূত্রমতে, প্রতিবেদনের সুপারিশ মোতাবেক ৬ই মার্চ সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তল্লাশির কথা বলা হয়েছে সকল যানবাহনে। প্রয়োজনে যান চলাচল সীমিত করার কথা বলা হয়েছে। বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাট বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও বাস স্ট্যান্ডে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে ঢাকামুখী জনস্রোত প্রতিহত করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ৬ই মার্চের ঢাকামুখী লংমার্চ কর্মসূচি পালনের জন্য এখন পর্যন্ত কোন সংগঠন পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করেনি। কেউ আবেদন করলে নগরবাসীর নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্ন চলাচলের বিষয়টি আগে গুরুত্ব দিয়ে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশকে সর্বদাই সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারীদের তথ্য-প্রযুক্তি আইনে শাস্তি
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী সবাইকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হবে। তাই এ সংক্রান্ত প্রচলিত আইন সংস্কার করে এ বিষয়ে সাজা বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। গতকাল পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের মাঝে যেসব ধর্ম প্রচলিত রয়েছে, সেসব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ যদি আঘাত করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে দু’জন আলেমকে রাখা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত বিষয়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ঢাকায় একজন বিচারককে নিয়োগও দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোন যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করতে চায়, তবে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে প্রচলিত আইন এবং তথ্য প্রযুক্তি আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু ও আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম।
আলেম-ওলেমাদের দাবিতে ১৮ দলের নৈতিক সমর্থন: ফখরুল
আলেম-ওলেমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে ১৮ দল। হরতাল শেষে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে পথভ্রষ্ট কিছু ব্লগার ইসলামকে আঘাত করে যাচ্ছে। তারা আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) ও পবিত্র কোরআন নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে। যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত করেছে, সামপ্রদায়িক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। তবে আমরা এ নিয়ে রাজনীতি করতে চাই না। সরকারই তাদের প্রশ্রয় দিয়ে পরিস্থিতিকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের আলেম-ওলেমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি আমরা নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছি। গতকাল তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে মির্জা আলমগীর বলেন, বিষয়টি সামাল দিতে সরকারের আইওয়াশ কিনা সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতি এখন চরম ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করেছে। রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ এক ব্যক্তির হাতে বন্দি হয়ে আছে। ফলে রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য অনিবার্য। ক্ষমতার মসনদে বসে প্রধানমন্ত্রী দাম্ভিক আচরণ করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সীমাহীন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণে দেশবাসী হতাশ। তার বক্তব্যে নিরপেক্ষতা তো নেই-ই উল্টো দাম্ভিকতাপূর্ণ। তিনি সদম্ভে আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ (গতকাল মঙ্গলবার) বলেছেন, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের নামে হুকুমের আসামি করা হবে। মির্জা আলমগীর বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। প্রতিদিন লাশের মিছিলে নতুন নতুন শহীদের নাম যুক্ত হচ্ছে। সরকার পুরো দেশকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
বিকল্পধারার সমর্থন: হেফাজতে ইসলামের ৬ই এপ্রিলের লংমার্চ কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বিকল্পধারা বাংলাদেশ। গতকাল দলের প্রধান সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এক বিবৃতিতে এই সমর্থনের কথা জানান। বি. চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে যে মহারাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তারই পথ ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটের মধ্যে দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা প্রথম থেকেই বলেছি, ইসলাম ও আমাদের প্রিয় রাসুল (স.)-কে অপমান করার যে কোন অপচেষ্টায় আমরা বিরোধিতা করবো। সেজন্য যখন এই প্রশ্ন উঠলো, তখন আমরা সরকারকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছি ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বিরুদ্ধে যে বা যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করুন এবং শাস্তি দিন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য এলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বক্তব্যদাতাকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির বিধান করা হয়। এই হিসেবে কেন ইসলামের প্রিয় রাসুল (স.)-এর বিরুদ্ধে হীন মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে ৬ সপ্তাহ পরেও গ্রেপ্তার ও শাস্তি দেয়া হয়নি- এতে স্বভাবতই দেশের মানুষ অপমানিত বোধ করতে পারে। হেফাজতে ইসলাম এ ব্যাপারে যে কর্মসূচি দিয়েছে তাতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে। বিকল্পধারার প্রধান বলেন, দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবং যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেজন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সমর্থিত হেফাজতে ইসলামের ৬ই এপ্রিলের লংমার্চ কর্মসূচির প্রতি বিকল্পধারা পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে।
৩ ব্লগার ৭ দিনের রিমান্ডে
ধর্ম নিয়ে কুৎসা রটনাকারী চক্রের সদস্য তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে মশিউর রহমান বিপ্লব (আল্লামা শয়তান) (৪২), রাসেল পারভেজ (অপবাক) (৩৬) ও সুব্রত শুভ (লালু কসাই)। গ্রেপ্তারের পর তাদের আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সার্ভিস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পশ্চিম) মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃত তিন ব্লগার দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মপ্রবর্তকদের নিয়ে কুৎসা রটনা করছিল। বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশের নজরে আসার পর তাদের গ্রেপ্তার করে আইসিটি অ্যাক্টের ধারায় মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, এরা সবাই নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী। তাদের ইন্টারনেটে ধর্মবিরোধী উস্কানিমূলক লেখালেখির নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা জানান, সমপ্রতি গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন ব্লগারের ধর্মবিদ্বেষী লেখার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম সরকার বিরোধী কর্মসূচি পালন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকামুখী লংমার্চের ঘোষণা দেয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার দিবাগত রাতে গোয়েন্দা পুলিশের তিনজন এডিসি’র নেতৃত্বে একযোগে অভিযান চালিয়ে শেরেবাংলানগর থানাধীন ইন্দিরা রোড, মনিপুরীপাড়া ও নিউ মার্কেট থানাধীন পলাশী এলাকা থেকে ওই তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের হেফাজত থেকে একটি ল্যাপটপ, একটি ডেস্কটপ, ২টি মডেম ও একটি এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ উদ্ধার করা হয়। সূত্র জানায়, এরা ওলামা মাশায়েখের তালিকাভুক্ত ব্লগার নন। ধর্মবিদ্বেষী প্রকৃত ব্লগারদের ছেড়ে দিয়ে ওই তিন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন এডিসি বলেন, যাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তিনি আহত। সমপ্রতি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সদস্যরা তাকে ছুরিকাঘাত করেছে। এ কারণে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে এনেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা জানান, মশিউর রহমান বিপ্লব ফেসবুকে ‘আল্লামা শয়তান’, সামহোয়্যারইন ও নাগরিক ব্লগে ‘শয়তান’ এবং আমার ব্লগে ‘নেমেসিস’ ছদ্মনামে ধর্মবিরোধী উস্কানি দিয়েছে। রাসেল পারভেজ আমার ব্লগে ‘রাসেল পারভেজ’, সামহোয়্যারইন, ব্লগে ‘রাসেল’ ও ‘অপবাক’ ছদ্মনামে লেখে। আর সুব্রত শুভ সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘সাদা মুখোশ’, আমার ব্লগে ‘সুব্রত শুভ’, নাগরিক ব্লগে ‘আজাদ’, ইস্টেশন ব্লগে ‘লালু কসাই’ ছদ্মনামে লিখেছে। প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী এ ব্লগাররা ইন্টারনেটে বিভিন্ন ব্লগে তাদের লেখালেখির মাধ্যমে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তকদের বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করে ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করছিল। সূত্রমতে, ডিবি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিট দীর্ঘ দিন ধরে তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করছিল। এরই এক পর্যায়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরা ইন্টারনেটে ধর্ম নিয়ে নানা কটূক্তি করেছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক থেকে এর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা অনুযায়ী ধর্মের বিরুদ্ধে অপব্যাখ্যাকারীদের ১০ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেপ্তার ও শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচির সঙ্গে এ গ্রেপ্তারের কোন সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, জানতে চাইলে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সঙ্গে এর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আইনের পরিপন্থি কাজ করায় ও অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
No comments